সেদিনের বোম্বাই বা আজকের মুম্বই গড়ে উঠেছিল মালব অঞ্চলের উত্পাদিত আফিম, মুম্বই বন্দর হয়ে চিনে পাঠাবার উদ্বৃত্তের গুড়ে। বম্বে থেকে যে ৫০ জন পার্সি ব্যবসায়ী মালওয়া আফিম চিনে পাঠাতেন তার মধ্যে ছিলেন টাটা, ওয়াদিয়ারা(পারিবারিকভাবে জাহাজ তৈরির ব্যবসায় ছিলেন)ও আছেন। জামশেদজী টাটাই ব্রিটিশ আমলে চিনের সঙ্গে আফিম ব্যবসার একচ্ছত্র অধিপতি ছিলেন এমন নয়, বম্বের কম করে পঞ্চাশটি পার্সি পরিবার এই চোরাচালানের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে ছিল। এরা প্রায় সকলেই ম্যানিয়ার এন্ড কোংএর আফিমব্যবসার সঙ্গী ছিলেন। হাতে গোণা কয়েকজন যুক্ত ছিলেন রাসেল এন্ড কোম্পানির সঙ্গে। ১৯৩০এ প্রকাশিত D.E. Owenএর British Opium Policy in China and India সমীক্ষার ওপর নির্ভর করে স্মগলিং এজ সারভারসান, কলোনিয়ালিজম, ইন্ডিয়ান মার্চেন্টস এন্ড পলিটিক্স অব ওপিয়াম পুস্তকে(প্রকাশক লেক্সিংটন বুকস) দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের অমর ফারুকি লিখছেন ১৮২০ নাগাদ কলকাতার দ্বারকানাথেরমত বাঙালি ভদ্রলোকেদের আফিম ব্যবসার পথ ধরে, ভারতের মধ্য-পশ্চিমাঞ্চলের পার্সি, গুজরাটি বানিয়া, কোঙ্কনি মুসলমানেদের এক বিশাল গোষ্ঠী মালব আফিম ব্যবসার পরতে পরতে জুড়ে ছিলেন। ১৮৩০, এই দশকটিতে ৪২টি বিদেশি কোম্পানি এই ব্যবসাটি চালাত, তার মধ্যে ২০টির সরাসরি নিয়ন্ত্রণ ছিল পার্সিদের হাতে। তত্কালীন ভারতের সমুদ্র পরিবহন আর আফিম ব্যবসা ছিল একই মুদ্রার এপিঠ ওপিঠমাত্র। সব থেকে বড় জাল ছড়ানো ছিল জামসেদজী জিজিবয়ের(১৭৮৩-১৮৫৯)। জিজিবয় ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের সব থেকে বড় এজেন্সি হাউস, জার্ডিন ম্যাথিসনের অন্যতম অংশিদার। তিনি নাইট(১৮৪২), ব্যারণ(১৮৫৭) উপাধি পাওয়া প্রথম ভারতীয়। আফিম পরিবহনের জন্য তাঁর অনেকগুলি জাহাজও ছিল। তিনি ব্যাঙ্ক অব বোম্বের ছজন নির্দেশকের মধ্যে অন্যতম।
আজকের বম্বে শহরটি গড়ে উঠেছে বাঙালি-বিহারি, সিন্ধ্রি রক্ত জলকরা আফিম চাষী, পার্সি, হং আফিম ব্যবসায়ী আর চৈনিক আফিমখোরদের নেশার অর্থ ব্যবহার করে তৈরিকরা অর্থিক লাভের বনিয়াদের ওপর বসে। দশকের পর দশক জুড়ে অবৈধ আফিম ব্যবসার লাভ থেকেই আজকের দক্ষিণ বম্বের বিশাল বিশাল প্রাসাদোপম হর্ম্যগুলি গড়ে ওঠে। আজকের ধণতান্ত্রিক ভারতের অর্থনীতির প্রাণকেন্দ্র বম্বে শহরটির ভ্রুণটি তৈরি হচ্ছিল ১৭৯০ থেকে ১৮৪০এর মধ্যে অবৈধ আফিম ব্যবসার অপরিমিত লাভের পাহাড়ের ওপর বসে। মনে রাখতে হবে ১৮২০ থেকে ১৮৪০ সালের মধ্যে, বম্বেতে অবৈধ আফিম ব্যবসা থেকে যে রূপো আসত তার পরিমান দ্বারকানাথেরমত কলকাতার ইংরেজ-বাঙালি ব্যবসায়ীদের লাভ্যাংশের থেকে অনেক অনেক বেশি। কলকাতা থেকে যে সরকারি আফিম চিনে অবৈধভাবে সরাসরি রপ্তানি হত, তার লাভের হকদার ছিল সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশ কোম্পানি সরকার, ছিটেফোঁটা লাভের গুড়ের অংশিদার হতেন সেই ব্যবসাকে সাজনোগোজানের প্রক্তিয়াতে জুড়ে থাকা দালালেরা। এদের একাংশ বাঙালি।
কিন্তু বম্বের বিষয়টা ঠিক উল্টো। সরাকারকে নির্দিষ্ট একটা অংশ কর দিয়ে এই লাভের গুড়ের পুরো অংশটাই যেত এই ব্যবসার সঙ্গে জড়িত পার্সি অংশিদারদের সিন্দুকে। চিনেদের আফিমের মৌতাতে রেখে পার্সিদের সেই লাভের অর্থে গড়ে উঠেছে মালাবার হিল, কাম্বালা হিল, ব্রিচ ক্যান্ডি, আঙ্ক্লেশ্বরেরমত জনপদসমূহ। পরে সেই অঞ্চলের বিলাসবহুল পার্সি বাংলোগুলো লিজে দেওয়া হয়েছে ইওরোপিয়দের। ১৮৩০-১৮৪০এর মধ্যে এই পার্সিরাই গড়ে তুলেছিলেন বম্বের শহরতলী অঞ্চলগুলো। যেমন কার্সেটজী মানকজীর অধিকার ছিল অনিকের, ঢাকজী দাদাজীর ভারাসাভি(আজকের ভারসোভা), ফারমজী কাওয়াসজীর পোয়াই লেন, জামসেদজী বোমানজীর ভিলে পার্লে, জুহু, কারসেটজী কাওয়াসজীর জর্জগাঁও, রতনজী এদুলজীর ঘাটকোপর, কৃষণরাও রঘুনাথের বোরবিদে এবং লক্ষ্ণণ হরিচাঁজদীর চিনচোলি।
আফিম বাম রাজনীতি আর টাটারা
ঐতিহাসিকেরা সাধারণতঃ নতুন বম্বের সঙ্গে আফিমের সম্পর্ক দেখাতে গিয়ে প্রায় প্রত্যেক পার্সি পরিবারের নামোল্লেখ করলেও টাটা পরিবারের নাম উল্লেখ করতে ভুলে যান। উদ্দেশ্যপূর্ণ কীনা বলা মুশকিল।
তবে সাধরণে প্রচলিত বিশ্বাস টাটারা অনেক রক্ত-ঘাম ঝরিয়ে তবে আজকের ভারতের প্রধাণতম শিল্পপরিবার হয়ে উঠেছেন। রক্ত-ঘাম তাঁরা ঝরিয়েছিলেন, তবে তা চিনের সাধারণকে আফিম সেবন করাতে। গুজরাটের অধিবাসী জামশেদজী টাটার বাবা যোরাথ্রুষ্টবাদী পার্সি পুরোহিত নাসিরনজী টাটা এই পরিবারের স্রষ্টা। নাসিরনজী তার পুত্র জামশেদজী এবং অন্যান্য ভাইদেরকে হংকং, সাংহাই এবং ইংলন্ডে আফিম ব্যবসার দপ্তর খুলে দেন।
ভারতীয় বামপন্থীরাও এই পথের পথিক। অনেক বামপন্থীই টাটা পরিবারকে আদতে ভারতের পুঁজিপতিদের মধ্যে প্রহ্লাদরূপে দেখতে চান। বাংলার তদানীন্তন বামপন্থী সরকারের ন্যানো মোটর গাড়ির কারখানা করার উদ্যমেই তা স্পষ্ট। টাটা পরিবারের সঙ্গে ব্রিটিশ বামপন্থার যোগাযোগ অনেক দিনেরই, বলছেন মেরি এল কিয়েনহোলজ তাঁর ওপিয়াম ট্রেডার্স এন্ড দেয়ার ওয়ার্ল্ডস – ভলিউম টু- আ রিভিসনিস্ট এক্সপোজার অব দ্য ওয়ার্ল্ডস গ্রেটেস্ট ওপিয়াম ট্রেডার পুস্তকে। পুঁজিপতি জামশেদজী টাটার ছোট পুত্র স্যর রতন টাটা গোপাল কৃষ্ণ গোখলের সঙ্গে মিলে সোসালিস্ট সার্ভেন্টস অব ইন্ডিয়া সোসাইটি গঠন করেন। জামশেদজীর পুত্র বামপন্থীদের দুর্গ, লন্ডন স্কুল অব ইকনমিক্সএর একটি চেয়ারেরও স্রষ্টা। আরো একটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য হল রতন এবং দোরাবজী টাটার কাজিন শাপুরজি সাকলতওয়ালা (১৮৭৪-১৯৩৬), যিনি টিসকোর অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা, ব্রিটিশ পার্লামেন্টের প্রথম কমিউনিস্ট সদস্য। তিনি একাদিক্রমে ১৯১৪ থেকে ১৯২৯ পর্যন্ত ব্যাটারসি(লন্ডনের একটি বরো) থেকে পার্লামেন্টে নির্বাচিত হন।
No comments:
Post a Comment