Saturday, January 27, 2018

উপনিবেশ বিরোধী চর্চা - চাহিদা১ - ইভান ইলিচ

যেখানেই যান মনে হয় চিনি চিনি। বিশ্বজুড়ে কুলিং টাওয়ার, পার্কিং লট, কৃষি ব্যবসা আর মেগাসিটির রমরমা। এতদ সত্ত্বেও যেন মনে হচ্ছে উন্নয়নের ধারা শেষ পর্যায়ে এসে পৌঁছেছে – যেন মনে হচ্ছে এই বিপুল বিশাল অট্টালিকার ঝাঁক বিশ্বের জন্য বেমানান মনে হচ্ছে। বিশ্বজোড়া এই ধরণের উন্নয়ন প্রকল্পগুলো একে একে খণ্ডহর, অব্যবহার্যে পরিণত হচ্ছে। আতঙ্কের হল আগামী দিনে এই আবর্জনার মধ্যেই আমাদের বেঁচে থাকা অভ্যেস করতে হবে। কুড়ি বছর আগে (এই বইটি সম্পাদিত হচ্ছে ২০০৯ সালে, লেখাটা তৈরি হয়েছে ১৯৯০ নাগাদ) উন্নয়নের পুজায় প্রণিপাত যে প্রত্যাঘাত (counterintuitive) করবে সেটা মোটামুটি বোঝা যাচ্ছিল। আজ টাইম ম্যাগাজিন বিশ্বজোড়া এই আবর্জনাকে খবর করে প্রচ্ছদের বিশ্বধ্বংসের ছবি ব্যবহার করে। আমরা কেউই জানি না - জলবায়ুর পরিবর্তন, জিন শূন্যতা (depletion), দূষণ, বিভিন্ন সুরক্ষা কবচের ধ্বংসপ্রাপ্তি, সমুদ্র স্তরের উল্লম্ফন এবং কোটি কোটি মানুষের গৃহহীন হওয়া – এই চারটি ধ্বংসের ঘোড়সওয়ারকে কিভাবে সামলানো যাবে। এই বিষয়গুলি আলোচনায় দুটি প্রতিক্রিয়া উঠে আসে – হয় আতঙ্ক নয় আসূয়া। এই বিশ্বপরিবর্তনের সঙ্গে বেঁচে থাকার থেকে আরও ভীতিপ্রদ হল, বিগত চার দশকের উন্নয়নের সংজ্ঞায় অসীম চাহিদাকে সঙ্গে নিয়ে বেঁচে থাকা। উন্নয়নের বর্ষা নৃত্য মন্থনের যে অসীম চাহিদার উদ্ভব ঘটল তা শুধু বিশ্বকে লুঠে দূষণের হলাহলে ঢেকে ফেলার থেকেও গভীরতর প্রভাব ফেলেছে। মানুষের চরিত্রেই মৌল পরিবর্তন(transmogrified) এনেছে। তারা Homo sapiensকে Homo miserabilisএ পরিণত করেছে। আজ মনে হয় মৌল চাহিদা যেন উন্নয়ণের কুটিল উত্তরাধিকার(insidious legacy), যাকে সে পিছনে ফেলে এসেছে।
এই পরিবর্তনটা ঘটেছে কয়েক শতাব্দ জুড়ে। এই সময়ে শেকড়ে পরিবর্তন এসেছে, একে কখোনো বলা হয়েছে প্রগতি, কখনো উন্নয়ন, কখোনো বৃদ্ধি। এই যুগব্যাপী প্রক্রিয়ায় মানুষ কৃষ্টি আর প্রকৃতিতে সম্পদ আবিষ্কার করে ফেলার দাবি করেছে – সেগুলো যেন জনগণের সম্পত্তি – তারা সেগুলির সঙ্গে অর্থনৈতিক মূল্যমান জুড়ে দিয়েছে। অভাব বা ঘাটতির ঐতিহাসিকেরা এই গল্পসূত্র জুড়তে পারেন। সর ফেটালে যেমন ঘন হয়ে মাখনে পরিণত হয়, হঠাতই যেন এক রাতের মধ্যে অভাবের নায়ক Homo economicus, থেকে অভিযোজনের মাধ্যমে পরিণত হল Homo miserabilisএ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী প্রজন্ম এই পরিবর্তন চোখের সামনে দেখল, সাধারণ মানুষ কিভাবে চাহিদাবন্ত মানুষে পরিণত হয়। বিশ্বে  জন্মানো অর্ধেক Homoই কিন্তু এই নতুন মানুষে পরিণত হল।
প্রত্নতত্ত্বিক সাক্ষ্য থেকে একটা বিষয় পরিষ্কার Homo sapiens নামক পূর্ণ বয়স্ক মানুষের অতীত ৫ লক্ষ কোটি বছরের বেশি নয়। তারা প্রথম পাথর যুগের Lascaux গুহার শিকারের ছবি থেকে পিকাসোর বিশ্ব কাঁপানো গুয়ের্নিকায় সময়ে বেঁচেছে - দশ হাজার প্রজন্ম তৈরি করেছে, হাজার হাজার ভাষায় হাজার হাজার রকমের জীবনযাত্রা নির্বাহ করেছে, তারা কেউ বরফে বাস করেছে, কেউ গরু পালন করেছে, কেউ রোমান কেউবা মোঘল, কেউ নাবিক কেউ যাযাবর। নিড়ানি, টাকু, কাঠ, কাঁসা, লোহার হাতিয়ার নির্ভর প্রত্যেকটি জীবনযাত্রার একটাই শর্ত প্রত্যেকটি প্রত্যেকটির থেকে সম্পূর্ণভাবে আলাদা। কিন্তু প্রত্যেকটি নিশ্ছিদ্র শর্ত ছিল নির্দিষ্ট সময়ে নির্দিষ্ট স্থানে গোষ্ঠীর প্রথার প্রতি পূর্ণ আনুগত্য প্রদর্শন। প্রত্যেক কৃষ্টি এই প্রয়োজনীয়তার শাসনকে ভিন্ন ভিন্ন লব্জে গ্রথিত করেছে। প্রত্যেকটি চাহিদার দৃষ্টিভঙ্গী প্রকাশিত হত ভিন্ন ভিন্ন ভঙ্গীতে মৃতকে কবর দেওয়া থেকে শুরু করে জাদুর ভয়(exorcize fears) পাওয়া পর্যন্ত। চাহিদার নমনীয়তার বিপুল বৈচিত্র্যময় কৃষ্টির প্রাবল্য প্রত্যেক সমাজে, ব্যক্তিতে আলাদা আলাদা ছিল। নতুন কিছু করতে টনগানেরা(Tongans) হাজার হাজার মাইল সমুদ্র পেরিয়ে এসেছে। Toltecsরা মেক্সিকো থেকে উইসকন্সিনে এনে মন্দির তৈরি করেছে। মঙ্গোলিয়ার মুসলমানেরা কাবায় আসে, স্কটেরা পুণ্য ভূমিতে পদার্পণ করে। এই সব যন্ত্রণা ভয় বিষ্ময় সন্ত্রাসের সব রকম রূপ সত্ত্বেও মানব সভ্যতার অর্ধেক পরিমানে উত্তরপুরুষ বর্তমানে যে চাহিদার সংজ্ঞায় জীবনধারণ করেছে, কোনদিন মানুষ তার ধারে পাশেও পৌঁছতে পারে নি।
(ক্রমশঃ)

উলফগাং শ্যাকস সম্পাদিত দ্য ডেভেলাপমেন্ট ডিক্সনারি, আ গাইড টু নলেজ এজ পাওয়ার থেকে

No comments: