Tuesday, January 2, 2018

উপনিবেশ বিরোধী চর্চা - দেশিয় জ্ঞানচর্চা, দেশিয় বাস্তবতা - বিদ্যালয় বনাম শ্রুতিনির্ভর দক্ষতা ও জ্ঞানচর্চা

Dipankarদার গত বছরের ফেবুকে দেওয়া একটা লেখা পড়ছিলাম। তিনি লিখছেন, 'এডামস রিপোর্ট' মন দিয়ে পড়লে দেখা যাবে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের কল্যানে ও বিদেশী শাসকদের বদান্যতায় কি ভাবে গত ২০০ বছরে 'কাবাব' রা বাংলার এক বৃহৎ জনগোষ্ঠীকে 'অশিক্ষিত','প্রান্তিক' মানুষে পরিণত করেছে'।
দীপঙ্করদার কারিগরী-হকার অর্থনীতির সমস্ত তথ্য তত্ত্ব জোরালোভাবে সমর্থন করেও, বিদ্যাসাগর মশায়ের মেকলিয় দর্শন ভিত্তিক পড়াশোনা শুরু করার তথ্যের পাশে দাঁড়িয়েও অদৃষ্টবাদিতার বিপক্ষে মত প্রকাশ করা গেল।কারণ আজও বাংলার শিক্ষা ব্যবস্থায় শ্রেণীকক্ষ ভিত্তিক শিক্ষা প্রধান হয়ে ওঠে নি।তারা মধ্যবিত্তের মত হয় ত ক্ষমতার কাছে কোনদিন ছিল না, কিন্তু আজও তারা বিপুল পরিমান গ্রামীন উৎপাদন ব্যবস্থার নির্ণায়ক।
একথা দুর্নিবার ঠিক যে দ্বারকানাথ, রামমোহন, বিদ্যাসাগর ইত্যাদির হাত ধরে দেশজ বিদ্যালয়গুলির শ্মশানযাত্রা ঘটিয়ে দিয়েছিলেন নব্য ইংরেজি শিক্ষিত কর্পোরেট নবজাগরিত বাঙ্গালিরা(চেহারায় বাঙালি, মননে ইওরোপিয়, দর্শনে মেকলিয়) মেকলের তত্ব অনুসারে। পরম পত্রিকায় ব্রিটিশপূর্ব শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে সংখ্যায় বিদ্যালয় ধ্বংস নিয়ে হাহুতাশ বা এডামের শিক্ষা সমীক্ষা নিয়ে আলোচনায় বার বার বিদ্যালয় পাঠক্রিয়া পদ্ধতি ধ্বংসের ধুয়ো তুলি - আদতে সেই কাজটা মন দিয়ে করি পশ্চিমি কেন্দ্রিভূত শিক্ষা ব্যবস্থার প্রতিভূ হিসেবে তার দার্শনিক প্রভাব এড়াতে না পেরে।
এর কিছুটা যে সত্য তা নিয়ে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই - কেননা গ্রামীন পাঠশালাগুলির পাঠ্যক্রম তৈরি হয়েছিল আজকে যাকে প্রান্তিক সমাজ(কেন প্রান্তিক?) বলা যায় তাদের জন্য, তাদের দর্শন নিয়ে, তাদের ব্যয়ে, তাদের বাড়ির কাছের পরিবেশ সেবার জন্য, সাগরপারের লুঠেরা সওদাগরি অর্থনীতি সেবার জন্য নয়।
কিন্তু সেই তথ্যটাই সম্পূর্ণচিত্র নয় বলে আমরা মনে করি - এটাও মনে করি দীপঙ্করদা যাকে কারিগর অর্থনীতি বলছেন, সেট শুধুই লিখিত জ্ঞান-শিক্ষাচর্চার ওপরে নির্ভর করে ছিল না, আজও নেই।
কারিগর অর্থনীতির বিপুল অংশ নির্ভর করেন পরম্পরার শ্রুতি, হাতে হাতে দক্ষতা প্রবাহিত জ্ঞান, প্রজ্ঞা আর দর্শন প্রবাহের বাস্তবতায়। বিদ্যালয় এই ব্যবস্থার একটা অংশ ছিল ঠিকই, কিন্তু সবটাই নয় - বাঙলার কারিগরী ব্যবস্থায় থাকা মোট জনগণের সংখ্যার মধ্যে কত অংশ বিদ্যালয়ে যেত এই অনুপাতটা দেখলেই ব্যাপারটা পরিষ্কার হয়ে যায়।
আজও গ্রাম অর্থনীতি ২৫০ বছরের কর্পোরেট অর্থনীতির থেকেও বড় - আজও জ্ঞান-বিদ্যাচর্চা প্রাতিষ্ঠানিক মেকলিয় বিদ্যাচর্চা থেকে যে বড় - তাঁর শ্রেয় যায় এই জ্ঞান-দক্ষতা প্রবাহনের পরিকল্পনা, ব্যবস্থা সুচারুরূপে অন্তত বিপুল শক্তিমান কর্পোরেটদের ধ্বংসক্রিয়ার সমান্তরালভাবে নিজের দর্শনে বয়ে নিয়ে যেতে পারা মানুষের দক্ষতায়। সেটা বিদ্যালয় ব্যবস্থার বাইরে দাঁড়িয়েই এই মানুষেরা করে চলেছেন। ১০+ কোটি মানুষের বাংলায় মাধ্যমিক দেয় ১২-১৩র কাছাকাছি লক্ষ পড়ুয়া মোট জনসংখ্যার ১ শতাংশ হয়ত - যত ওপরের দিকে ওঠা যাবে তত পড়ুয়ার সংখ্যা কমবে। গ্রাম ভিত্তিক পাঠশালার জোর কমে গেলেও পরম্পরার মৌখিক জ্ঞানচর্চা কমে নি।
সেই বয়ে চলা দক্ষতাটাই চোখে পড়ে না, যতটা পড়ে বিপরীত শিবিরের ধ্বংস ক্রিয়া।
কর্পোরেট এককেন্দ্রিক জ্ঞানচর্চার ধ্বংসক্রিয়ার তুলনায় আজও এই ভেঙে পড়া সময়কে ধরে, গ্রামীন কৌম অর্থনীতি, দর্শন, সমাজ, তাঁর বিপরীতে যে নির্মান করে চলেন, তার চরিত্র অনেক জটিল, বর্ণিল, প্রভাবী এবং চোখে না দেখতে পাওয়ার।
সেটাই তার জোরের জায়গা।

No comments: