Sunday, January 21, 2018

বাংলার উপনিবেশিকতাবাদ বিরোধী চর্চা২ - কয়েকটি কথা

কয়েকটি নজর দেওয়ার মত মূল বিষয়
দিক নির্ণয় - উপনিবেশবাদ বিরোধিতা এবং তা উতপাটনে, ভারতকে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার নানান উপনিবেশবাদ বিরোধী বৌদ্ধমতালম্বী, ইসলামি(যেমন মহাথির মহম্মদের মত উপনিবেশবাদ বিরোধী নেতা) দেশের সঙ্গে হাত মিলিয়ে তার নিজের ভুলিয়ে দেওয়া কৃষি, শিল্প, জ্ঞান-বিজ্ঞান বিষয়ে নতুন পথ নিতে হবে। তথাকথিত উন্নয়নে ইওরোপ আমেরিকার লেজুড় বৃত্তি ভারতকে কোথাও পৌছে দেয় নি তা ঐতিহাসিকভাবে প্রমানিত - অন্তত স্বাধীনতার সত্তর বছর পর ইন্ডিয়ার - ভারতের নয় - অর্থনীতি কাণাগলিতে ঘুরপাক খাচ্ছে। এ কাজে সরাসরি বিরোধিতা আসবে ক্ষমতার কাছাকাছি থাকা শাসক আর ইংরেজি শিক্ষিত মধ্যবিত্তের থেকে।লড়তে হবে পরম্পরার জ্ঞানের মানুষদের, যারা আদতে এই ব্যবস্থার অছি, আজও।
কতগুলি কথা যা আমরা ভুলতে বসেছি, যেগুলি আমাদের কর্পোরেটদের জন্য তৈরি পাঠ্যক্রমে পড়ানো হয় না -
১। ভারত বিষয় ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ বা ইওরোপিয় জ্ঞানচর্চা – যার নাম ভারততত্ত্ববিদ্যা - দৃষ্টি খণ্ডিত। তাঁরা আমাদের শিল্পকলা, কারুশিল্প, প্রযুক্তি, নন্দনতত্ত্ব বিষয়ে যা বলে গিয়েছেন, তার অধিকাংশের ভিত্তিভূমি হল ইওরোপ, ইওরোপিয় জ্ঞানচর্চার দৃষ্টিভঙ্গী, ক্ষমতার কাছাকাছি থাকা মানুষের বিকশিত তত্ত্বের বিকাশ – বহু ভারততত্ত্ববিদ ভারতে এসে সংস্কৃত, কিছুটা আরবি পারসি শিখেছেন – এবং সংস্কৃত, আরবি, পারসি সাহিত্যের ওপর ভিত্তি করে এদেশের ব্রিটিশ লুঠের ফলে উৎসারিত দারিদ্র্যের নিদান দেওয়া চলছে আজও, কিভাবে ভারতের উন্নতি হয়(আমাদের বক্তব্য যে সম্পদ লুঠ হয়েছে সেই সম্পদ ভারতে ফিরিয়ে আনার দাবি তোলা হোক – যে দাবির বিরোধিতা করবে ইংরেজি শিক্ষিত মধ্যবিত্ত, যারা সেই সম্পদ লুঠ করতে সাম্রাজ্যকে সহায়তা করেছে, আজও করে চলেছে) – এবং এই সাহিত্যগুলির বাইরে থাকা বিস্তৃত ভারতের বিভিন্ন ভাষার জ্ঞানচর্চা বা সমাজের অক্ষহৃদয় জানার চেষ্টা করা হয় না - হয়ে থাকলে খুব কম – এই মানুষদের অধিকাংশ এই রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার বাইরে বসবাস করেন আজও – ব্রিটিশ শাসনে গ্রাম ভারত লুঠের বিষয়ে দৃষ্টি ঘোরাতে এই মানুষদের বিষয়ে উদ্দেশ্যপূর্ণ মিথ্যে বলা হচ্ছে।
২। কৃষক, কারু শিল্পী, বস্ত্রশিল্পীরা যারা উৎপাদন করে আন্তর্জাতিক বাজারে একচেটিয়া ব্যবসা করতেন, তাঁদের অধিকাংশ শূদ্র ছিলেন। এমন কি জ্যোতির্বিদ, অঙ্কবিদ(যেমন আর্যভট, আর্যভট্ট নয়), বৈদ্যরা এদের বড় অংশ ছিলেন শূদ্র - যেমন নাথ যোগীরা। বাংলা, পূর্বভারত ছিল তান্ত্রিকসভ্যতার দেশ। তান্ত্রিকদের বড় অংশ শূদ্র, এবং মহিলাদের দ্বারা শাসিত।
৩। ব্রিটিশরা এদেশে এসেছিল ১) কয়েক হাজার বছরের ঘাটতিতে চলা এশিয় ইওরোপিয় ব্যবসার গতিমুখ বদল করতে, ২) এদেশ লুঠে সেই সম্পদ ইওরোপে নিয়ে গিয়ে তাদের অবস্থা ফেরাতে, ৩) যৌথ সমাজের(উতপাদক, ভৌগোলিক) ধারণা বদলে ব্যক্তি সম্পদের ধারণা রোপণ করতে, ৪) উচ্চতম কর, দাস ব্যবস্থা চাপিয়ে, শ্রমের মজুরির হার কমিয়ে দিয়ে পুঁজির কেন্দ্রিভবন করতে, ৫) সম্পত্তির অধিকার এবং আইন বিষয়ে নতুনতম ধারণা রোপন করতে।
৪। তাঁরা নতুন ধরণের জমিদারি(চিরস্থায়ী বা রায়তারি) ব্যবস্থা চালু করে অতিরিক্ততম কর আদায় নিশ্চিত করে, কৃষকদের দারিদ্র্যে নিমজ্জন করে।
জাতি
১। যখন ব্রিটিশ/ইয়োরোপীয়রা ভারতে আসে, তখনও দেশের অধিকাংশ রাজা, কবি, লেখক, উতপাদক জ্ঞানচর্চক শূদ্র
২। তার পরেও বলা হল দেশের শাসকেরা উচ্চবর্ণ – বরং ব্রিটিশ শাসনের সময় থেকে উচ্চবর্ণের রমরমা বেড়েছে। বলা দরকার ভদ্রবিত্তদের হাত ধরে ইওরোপকেন্দ্রিকতাবাদ বেড়ে চলেছে এদেশে।
৩। ভারতের সমাজ ভাঙতে ইওরোপিয় শূদ্র বিভাজন(ওবিসি, এসসি, এসটি ইত্যাদ) সহায়ক হয়েছে।
৪। আজকে শূদ্র বর্ণের যে দারিদ্র্য বা পিছিয়ে পড়া অবস্থা দেখা যায়, তার বড় কারণ ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের সঙ্গে পলাশী আর চিরস্থায়ী বন্দোবস্তেরপর উচ্চবর্ণের হাত মেলানো। যা ভারত সভ্যতার কয়েক হাজার বছরে হয় নি। ভারতীয় ইতিহাস বিকৃত হয়েছে ঔপনিবেশিক সময়ে। ১৮০০ সালের আগে পর্যন্ত সর্বভারতীয় স্তরে শূদ্ররা ছিল জাগতিক যে কোনো বিষয়ে দক্ষ, জ্ঞানী।
৫। ব্রিটিশ শাসনের প্রথমদিকে করা সারা ভারতের বিভিন্ন শিক্ষা সমীক্ষায়, জনগণনায় প্রকাশ শূদ্ররা ছিল সব থেকে শিক্ষিত সম্প্রদায় – এটি সত্য বাংলায়, পাঞ্জাবে এবং তামিলনাড়ুতে। এবিষয়ে ব্রিটিশ শাসনের ১৮৩৬ সালের এডামের, লিটম্যানের শিক্ষা সমীক্ষা দ্রষ্টব্য। আর সর্বভারতের শিক্ষার বাহন কিন্তু পাণীনিয় সংস্কৃত ছিল না, ছিল স্থানীয় ভাষা। পূর্ব ভারতে কিছুটা সংস্কৃততে পড়ানো, সাহিত্য জ্ঞানচর্চা হত, কিন্তু তার ব্যকরণ ছিল বাংলা ব্যকরণ ঘেঁসা। ব্রিটিশ শাসনের তিনচারশ বছর আগের জ্ঞানচর্চার অবস্থা দেখেন – কবি, লেখক, শিক্ষকদের জাতি দেখেন – তথাকথিত উচ্চবর্ণ তখন কোথায়?
৬। বিহার বাঙলায় যাদের আসভ্য, বনবাসী, আদিবাসী, উপজাতি বলে উল্লিখিত করা হয়েছে, তাঁদের অধিকাংশই যোদ্ধা, জ্ঞানী ছিলেন(যেমন ডোম –আগডুম বাগডুম ঘোড়াডুম ছড়াটির অর্থ হল – আগে ডোম, বাগে(পিছনে) ডোম, ঘোড়ায় ডোম, চর্যাপদে ডোমনী, হাড়িপা ইত্যাদি লক্ষ্যনীয় – বাঙলায় রূপা বাগদী রাজা ছিলেন(হরপ্রদাস শাস্ত্রীর বেনের মেয়ে উপন্যাস) – বাগদী, কৈবর্ত, ঘোষ, বিশ্বাস, দে, দত্ত, লাহা ইত্যাদিরা ছিলেন সমাজ কেন্দ্রে। মঙ্গলকাব্যে ডোম মেয়েরা ঘোড়ায় চড়ে যুদ্ধ করেছেন – আসম, কদলী রাজ্যে নাথ গুরুকে ভেড়া করে রেখেছিলেন মেয়েরা, তার উদ্ধার করতে শিষ্যকে পাঠানো হয়) এবং ব্রিটিশ শাসনের প্রথম সময় – বাঙলার ফকির-সন্ন্যাসী যুদ্ধের সময় থেকেই শূদ্ররা উপনিবেশের বিরুদ্ধে লড়াই করেছেন। এদের একটা বড় অংশ লোহা ইস্পাতের, জং ছাড়া লোহা তৈরির মত বিভিন্ন উৎপাদনের সঙ্গে জড়িত ছিলেন।
কৃষি
১। ১৮০৪এর এডিনবরা রিভিউর সমীক্ষা ছিল, ভারতের কৃষিজীবিরা সে সময়ের ইংলন্ডের কৃষকদের তুলনায় বেশি রোজগার করতেন।
২। ক্যাপ্টেন হ্যালকট দক্ষিণভারতে ড্রিলপ্লাউ দেখেছিলেন – এ নিয়ে তার বর্ণনাও রয়েছে। তাঁর ধারণা ছিল এটি আধুনিক ইওরোপের উদ্ভাবনা। এছাড়াও অরঘট্ট বা চাকা ঘুরিয়ে জলতোলার ঐতিহ্য বেশ প্রাচীন ভারতীয় প্রযুক্তি – একেও ব্রিটিশরা পারসিয় চাকা (পারসিয়ান হুইল) নাম দিয়েছিল।
৩। বীজ বৈচিত্র্যে দেশের কৃষি উৎপাদনের হার খুব উচ্চ মানের ছিল। কৃষকেরা খুব সাধারণ কিন্তু কার্যকরী হাতিয়ার ব্যবহার করতেন।
শিল্প
১। ১৮০০ সাল পর্যন্ত ভারতে ১৫-২০ লাখ তাঁতি ছিল। খনন কাজ ছিল শ্রমিকদের অন্যতম প্রধান জীবিকা। ব্রিটিশ নীতিতে ১৮২০ সাল নাগাদ ভারতীয় উৎপাদন ব্যবস্থা হাঁটুগেড়ে বসে। ভারতের মেয়েরা সুতো কেটে ধণার্জন করতেন। তাঁত ব্যবস্থা ধ্বংস করে মিল ব্যবস্থা নিয়ে আসায় বড় অবনমন ঘটল ভারতের স্বনির্ভর গ্রামের স্বাবলম্বী মেয়েদের অর্থনৈতিক অবস্থার। তবুও আজকে বাংলা/ভারতীয় গ্রামীন উৎপাদন ব্যবস্থায় মূল শ্রমের/বুদ্ধির কাজ করেন মেয়েরাই।
২। ভারতের ইস্পাত বিশ্বের সেরা ছিল – এর নাম ছিল উজ ইস্পাত। বিশ্বে এর কোনো তুলনা ছিল না। এটি ধ্বংস করা হয়েছে।
৩ । প্রসন্নন পার্থসারথী বলছেন সে সময় দক্ষিণের তাঁতিদের তুলনায় ব্রিটিশ তাঁতিদের রোজগার বেশ কম ছিল।
৪। তাঁতির, উৎপাদকের কাঁচামাল পণ্য তাঁর নিজের, দাদন দেওয়া মানেই সেটা বরাতদারদের পণ্য হয়ে গেল এটা বলা যাবে না।
৫। তাঁতি দাদন নিয়েও দাদন ফেরত দিতে পারত।
৬। ভারতে প্লাস্টিক সার্জারি, নাকের, চোখের অপারেশন, বসন্তের টিকা দেওয়ার কাজ খুব সাধারণ ছিল। আজও ব্রিটিশ মণীষার প্রচার এটি ভারতীয়রা নকল করেছে। কিন্তু বিষয়টা বেশ উলটো। টিপু সুলতানের সঙ্গে যুদ্ধে ভারতীয় ভিষগের, ব্রিটিশ সেনানীর কাটা নাক লাগানোর রাইনোপ্লাস্টির একটি নথিকরণের উদাহরণ পাওয়া যাচ্ছে
৭। ভারতীয় উৎপাদন ব্যবস্থা ধ্বংস করে ব্রিটিশ শিল্পের খাতক করে তোলা হল ভারতকে। বেশ কিছু উচ্চবর্ণকে ব্রিটিশ নীতির উপযোগী করে গড়ে তোলা হল, যারা ভারতে ব্রিটিশ প্রযুক্তি, শিল্পস্বার্থ আর পুঁজির লুঠ, অত্যাচার কার্য দেখার এবং তা বজায় রাখার জন্য নিয়োজিত হল। তারা লুঠের বখরা পেল নানান ভাবে।
৮। আজও ভারতের অধিকাংশ পরম্পরাগত উতপদক, তথাকথিত ইওরোপিয় কেন্দ্রিভূত উৎপাদন ব্যবস্থার বাইরেই কাজ করেন, মূলত সামাজিক সামুহিক উৎপাদন ব্যবস্থার অংশ। আধুনিক সমাজবিজ্ঞান আর জাতিরাষ্ট্রবাদী গণতান্ত্রিক বড় পুঁজি ব্যবস্থার ভাষায় এঁরা সক্কলে হয় আদিবাসী, নয় পিছিয়ে পড়া, না হয় ওবিসি। কেননা এরা একে অপরের ব্যবসা কিনে নিতে পারে না, একের লাভ অন্যে নিজের পকেটে ভরতে পারে না, একজন উতপাদককে বঞ্চিত করে নিজে ধনী হওয়ার স্বপ্ন দেখে না।
৯। ১৭৫০ পর্যন্ত ভারত-চিন দুই দেশ মিলে বিশ্বের ৭৩ শতাংশ শিল্প উৎপাদন করত - পারস্যকে জুড়লে তা ৯০ শতাংশের কাছাকাছি গিয়ে দাঁড়ায়। বাংলার অংশ ছিল ৬য়ের বেশি। ১৮১০ পর্যন্ত শুধু দক্ষিণভারতে ১০,০০০ থেকে ২০,০০০ তাঁত ছিল, ১০,০০০ পরিযায়ী লোহা গলানো চুল্লি ছিল। ভারতের ইস্পাত নিয়েই বিংশ শতক পর্যন্ত ইওরোপে চিকিৎসার হাতিয়ার তৈরি হত। ভারতে যা তাঁত ছিল তার উৎপাদনের জন্য সেসময়ের ভারতের প্রত্যেক বাড়ির মহিলাকে অন্তত আট ঘণ্টার সুতো কাটতে হত। ১৮০৮ সালে শুধু পাটনায় তিন লক্ষ মহিলা সুতো কেটে রোজগার করতেন। ইওরোপের সঙ্গে ভারতের বাণিজ্য গবেষণা নিয়ে বহু শ্রম অর্থ ব্যয় হয়েছে - কিন্তু সেটা মাত্র ভারতের মোট উৎপাদনের ১০%। ভারতের অভ্যন্তরীণ বাজার আর এশিয় আফ্রিকার বাজার ছিল মোট ৯০ শতাংশ, তা নিয়ে আলোচনা হয় না।
১০। ১৭৬৩ সালে ব্রিটিশ সেনাপতি গুটিবসন্তের বীজ ছড়ায় স্থানীয় মানুষকে খুন করতে – ভারতে রেলপথ বিস্তারে বহু মানুষ, সমাজ উচ্ছন্নে গিয়েছে, ইওরোপ থেকে আনা নানান রোগের কবলে পড়ে।
এ নিয়ে আর বহু তথ্য আগামী দিনে দেওয়া যাবে। আজকের মত অলমিতি।

No comments: