Thursday, January 18, 2018

বাংলার কংসবণিক - মেটাল ক্রাফটসম্যান অব ইন্ডিয়া২ - মীরা মুখোপাধ্যায়

জাতিভাগ
কংসবণিক জাতির মধ্যে জাতিভাগ রয়েছে। বহরমপুরের একজন কংসবণিক কারিগর আমাকে তাদের জাতি ভাগগুলি বললেন, ১) সপ্তগ্রামী, ২) মামুদপুরিয়া, ৩) মাহিতা, ৪) আন্দুরি। খাগড়ার এক কংসবণিক তাদের চারটি ভাগের নাম বললেন, ১) সপ্তগ্রামী, ২)বরানগর, ৩) কালিগঞ্জ, ৪) মাহিতা। নবদ্বীপের কারিগর বলেছিলেন কংসবণিকের উতপত্তি আদি সপ্তগ্রাম থেকে। পরে তারা পর্তুগিজ বোম্বেটের তাড়ায় এদিক ওদিক ছড়িয়ে পড়ে - কেউ বিহার, কেউ ওডিসায় পালিয়ে যায়, কেউ আবার কলকাতায় বাসা বাঁধে।
হুগলির তীরে আদি-সপ্তগ্রাম একটি গুরুত্বপূর্ণ নদী বন্দর ছিল। এখান থেকে সমুদ্রগামী জাহাজে পণ্য ভরা হত। কংসবণিক যেহেতু বণিক, তাদের পক্ষে আদি-সপ্তগ্রামে বাস করাই স্বাভাবিক ছিল। এই বন্দরে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া থেকে বিভিন্ন ধাতুই আসত, হয়ত চিনারাই সেই ধাতু প্রেরণ করত(আজ জানা গিয়েছে এটা আসত মূলত বার্মা থেকে – অনুবাদক)।
নবদ্বীপের এক কারিগির আমায় বলেছেন কংসবণিকেরা বাংলায় এসেছে হাজার বছর আগে।
বাংলায় বণিকেরা ভ্রাতৃসংঘ(confraternity)। কিছু কিছু উৎসব বণিকেরা একসঙ্গে পালন করে পাঁচটি প্রতিমা বেদিতে রেখে। এই বণিকেরা হল স্বর্নবণিক, তাম্রবণিক, গন্ধবণিক, শংখবণিক, এবং মণিবণিক। কিন্তু এদের কয়েকটি জাতির মধ্যে যেমন কংসবণিক আর স্বররণবণিক, আন্তর্জাতি বিবাহ হয় না।
কংসবণিকেরা বাঙালিদের থেকে আলাদা। বিয়েতে তারা ভেলভেটের পাঢাকা পাজামা পরে, গায়ে ভেস্ট থাকে একটি দীর্ঘ আংরাখা(কোট) হাঁটু পর্যন্ত ঝোলে। কংসবণিকদের বিয়েতে একটা অদ্ভুত প্রথা আছে, ইহুদি মেয়েদের চামর দোলানি।
কংসবণিকেরা কালির উপাসক। কিন্তু তারা যেটিকে পুজা করে সেটি হল ঘট, কখোনো সেটিতে নরসিংহ রূপে আকারে বিষ্ণুর মূর্তি আঁকা ছিল।
আগেই বলেছি যদিও তাদের নাম কংসবণিক এবং নামের পরিষ্কার যে তাদের পৈতৃক কাজ ব্যবসা করা, কিন্তু কোথাও কোথাও তারা উৎপাদক হয়ে গিয়েছে। ক্যাওড়াতলার কংসবণিকদের বয়ান কারিগরেরা পূর্ববঙ্গ থেকে কারিগর হিসেবে কলকাতায় এসে বণিক হয়ে গিয়েছে।
খাগড়ার কংসবণিকেরা নিজেদের উত্তরভারতীয় ব্যবসায়ীদের মত সূর্য উপাসক বলে দাবি করে। কিন্তু পূর্ববঙ্গের লোহাজঙ্গের কারিগরেরা নিজেদের নিচু জাতি বলে। এই বৈচিত্রের কারণ বিশ্লেষণ করা কঠিন। কোন কোন এলাকায় কারিগরেরা শুদ্ধ কারিগর জাতিরই নয়, তারা কেউ রজক, ভুইমালি সম্প্রদায় থেকে আসা। এটা কলকাতার মত বড় শহরের বৈশিষ্ট্য।
উত্তরভারতের ধাতু কারিগরদের মত কংসবণিকদের নিজেদের গল্প আর ঐতিহ্য আছে। পরশুরামের গল্প খাগড়ার কংসবণিক জাতিতে শোনা যায়। কিন্তু এখানে গল্পটা শেষ হয় বন্ধুত্বপূর্ণ আবহাওয়ায়। তাদের বক্তব্য হিল পরশুরাম তাদের শেশাহ পর্যন্ত মারে না – পরশুরাম যদি আমাদের হত্যা করত, তাহলে আমরা কোথা থেকে এলাম। কারিগরেরা কালির উপাসনা করে পরশুরামের তীব্র ক্ষাত্র প্রতিমা গড়ে।
---
মীরা মুখোপাধ্যায়ের মেটাল ক্রাফটসম্যান অব ইন্ডিয়া থেকে
(১৯৭৮)
(চলবে)

No comments: