Tuesday, January 30, 2018

মুঘল দরবারের মুন্সি১২- চন্দ্র ভান ব্রাহ্মণ - উপনিবেশপূর্ব ইতিহাসকে কেন নতুন ভাষ্যে লিখতে হবে

মুঘল দরবারের মুন্সি১২
চন্দ্র ভান ব্রাহ্মণ
উপনিবেশপূর্ব ইতিহাসকে কেন নতুন ভাষ্যে লিখতে হবে

এক ব্রাহ্মণ আর এক 'ধর্মান্ধ'২

ঔরঙ্গজেব যখন ক্ষমতায়, চন্দ্র ভানও সে সময় মুঘল দরবারে তার কাজের শেষ পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছেন। অনেকের ধারণা ঔরংজেব ক্ষমতায় আসার জন্য চন্দ্র ভান কাজ ছাড়তে বাধ্য হন এবছেড়ে দিল্লি আগ্রা বেনারসে বাস করতে শুরু করেন। অথচ আমরা চন্দ্র ভানের নিজের লেখা থেকে পাই যে ঔরঙ্গজেব ক্ষমতায় আসার বেশ কিছু বছর পর তিনি অবসর নেন। বাস্তব হল ঔরঙ্গজেবক্ষমতায় এলে চন্দ্র ভান তাঁকে শুভেচ্ছা জানিয়ে চিঠি লেখেন -
To the Emperor:
Greetings to the kind, merciful, just, and loving emperor:
We have grown old with [worldly] sins, but now we desire
To leave these transgressions to the unadulterated youths
অথবা
শুদিম পীর বা ইস্যানওচশম আন দারিম
কি জুর্মই মা বা জাওয়ানন পারসা বখশন্দ।

এর থেকে প্রমান হয় তার অবসরের বয়স এলেও চন্দ্র ভান অবসরের কথা ভাবছিলেন না এবং ঔরঙ্গজেবের অধীনে দরবারে কাজ করার ক্ষেত্রে কোন নৈতিক বাধাও তিনি মনে আনেন নি। বরং তিনি আরও স্নেহ আর শ্রদ্ধায় চিঠি দিয়ে সরকারিভাবে কাজ চালিয়ে যাওয়ার অঙ্গীকার করেন।

কোন শহরে তিনি অবসর জীবন যাপন করতেন এটা নিয়ে বিতর্ক আছে। তিনি নিজে কিছুটা ধোঁয়াশা রেখে বলেছেন প্রদীপ্ত কবরের(রাউজায়ি মুনাব্বরা) শহরে। প্রদীপ্ত কবর এই উপমহাদেশে একটাই আছে সেটা আগ্রার তাজ মহল। রাজীব মনে করেন তিনি জন্ম শহর লাহোরে আর ফিরে যান নি। আগ্রায় থেকে যান।

রাজীব তাঁর তত্ত্বের সমর্থনে আরও একটি উদাহরণ তুলে দিচ্ছেন। আওরঙ্গজেবের সময়ের দরবারের তথ্যপত্র, নিয়মিত খবরের কাগজ, আখবারাতই দরবাতি মুয়ালার ১৬৬৬এর অক্টোবরের একটি চিটের নথি সূত্রে জানা যাচ্ছে, ফিরদৌস আশিয়ানি(শাহ জাহান)র, যিনি তার আগের বছরে মারা যান এবং তাঁকে তার প্রিয়তমা স্ত্রীা মুমতাজের(ঔরঙ্গজেবের মা) পাশের কবরের(তাজ মহল) সমাধিস্থ করা হয়, সেই সমাধি স্থল রক্ষণাবেক্ষণের আধিকারিককে অন্যান্যদের সঙ্গে আংরাখা দিয়ে সম্মান জানানো হয়। সেই ব্যক্তির নাম চন্দ্র ভান ব্রাহ্মণ। তাকে উল্লেখ করা হয়েছে সমাধির প্রধান আমলা(দিওয়ানই মুকবরা)। তাঁর সঙ্গে তাঁর পুত্র, সমাধির হিসাব রক্ষক তেজ ভানকেও একইভাবে সম্মান জানানো হয়(তেজ ভান পিসরই চন্দর ভান মুস্তৌফিয়ি মুকবরা)। অর্থাৎ আওরঙ্গজেবের ক্ষমতায় আসার এক দশক পরেও তিনি আগ্রায় থাকছেন সরকারি আমলা হিসেবে।

মুঘল দরবারের মুন্সি১১ - চন্দ্র ভান ব্রাহ্মণ - উপনিবেশপূর্ব ইতিহাসকে কেন নতুন ভাষ্যে লিখতে হবে

এক ব্রাহ্মণ আর এক 'ধর্মান্ধ'
ঐতিহাসিক মহম্মদ সালিহ কাম্বু, শাহজাহানের সময় চন্দ্র ভানকে ছাড়া মাত্র অন্য তিন জনকে গদ্য আর পদ্য উভয়ে আঙ্গিকেই মাহির বলেছেন। সালিহর সঙ্গে চন্দ্র ভানের চিঠি আদান প্রদান হত তার প্রমান সালিহ'র চিঠি সংকলন বাহারইসুখানে চন্দ্র ভানকে জুবায়ি নুক্তা তারাজানই দৌরাণ মুনসিয়ি অল জামানি চন্দর ভান(the cream of discerning intellects of the times, the secretary of the age)রূপে উক্তি করেন। তিনি চন্দ্র ভানের সম্বন্ধে অসম্ভব উচ্চ ধারণা পোষণ করতেন। চন্দ্র ভানের লেখার অঙ্গিকের সঙ্গে প্রখ্যাত আবুল ফজলের লেখার তুলনা করছেন, যা অসাধারণ তুলনা বললে কম বলা হয়।
সালিহ চন্দ্র ভানকে শাহ জাহান এবং ঔরঙ্গজেবের সময়ের প্রখ্যাততম প্রাশানিকদের সমপর্যায় বলে মনে করতেন। কিন্তু প্রশাসনিক মুন্সি পদে অমুসলমান চন্দ্র ভান একা ছিলেন না। কিছু নাম চন্দ্র ভানের লেখায় পেয়েছি, কিছু নাম অন্য সূত্র থেকে। তেমনি একজন দয়ানত রায়। ১৬৩৯ সালে আফজল খাঁয়ের মৃত্যুর পর একটা নির্দিষ্ট সময় ধরে তিনি গোটা রাষ্ট্রের আর্থ দপ্তর, দেওয়ানি, সামলেছেন।
অধিকাংশ ইতিহাস বই থেকে প্রায় অদৃশ্য হয়ে যাওয়া আরেক অমুসলমান উচ্চপদ প্রশাসক রাজা রঘুনাথ রায় কায়স্থ(মৃ ১৬৬৪) ১৬৫৬ সালে প্রখ্যাত উজির সাদ আল্লা খানের মৃত্যুর পর প্রায় এক বছর দেওয়ানি সামলেছেন। রঘুনাথ সাদ আল্লা খানের ঘনিষ্ঠ পৃষ্ঠপোষকতা পেয়েছেন। চন্দ্র ভান লিখছেন তার আগে যেমন দয়ানত রায়, তেমনি তার সময়ে রাজা রঘুনাথ। তিনি বলছেন, মীর জুমলা উজির পদাধিকারী হলেও, বাস্তবে কার্যকরী উজির হিসেবে কাজ করেছেন রঘুনাথ। চন্দ্র ভান এবং অন্যান্য আমলা রঘুনাথকে দৈনন্দিনের কাজে সাহায্য করতেন।১৬৫৮ সালে ঔরঙ্গজেব ক্ষমতায় আসার পর, উজির হলেন বিশ্বস্ত মীর জুমলা। তার পরে উজির হিসেবে এলেন জাফর খাঁ, চন্দ্র ভানের চিঠিবন্ধু। জাফর খাঁ মালওয়ার সুবাদার হিসেবে গেলে আবার উজিরাতের কাজ দেখাশোনার কাজ সামলাতে হল রঘুনাথকে।
এবং স্বাভাবিকভাবেই অনেকেরই মনে হতে পারে ঔরঙ্গজেবের মত ধর্মান্ধ সম্রাট ক্ষমতায় আসার পর মুঘল ফরবারি রাজনীতিতে রঘুনাথের মত অমুসলমান ক্ষমতাচ্যুত হন। ঘটল উল্টোটাই। ঔরঙ্গজেব রঘুনাথকে রাজা উপাধি দিলেন এবং জাফর খানের বদলে তাঁকেই উজিরের পদ দেন। রঘুনাথ ঔরঙ্গজেবের সিঙ্ঘাসনের লড়াইতে যেমন সমর্থন করেছেন তেমনি দারার বিরুদ্ধে যুদ্ধও করেছেন। ঔরঙ্গজেবের সিংহাসনে আরোহনের পর রঘুনাথই উজির ছিলেন দীর্ঘ পাঁচ বছর। ঔরঙ্গজেবের সাম্রাজ্যের ষষ্ঠ বছরে মৃত্যু পর্যন্ত। তার মৃত্যুর বহু পরেও ঔরঙ্গজেব নানান চিঠিতে বহুবার রঘুনাথকে অন্যতম প্রধান, গুরুত্বপূর্ণ, দিগদর্শক প্রশাসক আখ্যা দিয়েছেন।

Monday, January 29, 2018

মুঘল দরবারের মুন্সি১০ - চন্দ্র ভান ব্রাহ্মণ - উপনিবেশপূর্ব ইতিহাসকে কেন নতুন ভাষ্যে লিখতে হবে

জ্ঞানচর্চার প্রবাহের একটা গুরুত্বপূর্ন উদাহরণ পাচ্ছি চন্দ্র ভানের লেখায় শাহ জাহান এবং আওরঙ্গজেবের সময়ে গুরুত্বপূর্ন পদাধিকারী নুর আল দিন মহম্মদ আবদ আল্লা সিরাজির আলোচনায়। তিনি শুধু দুই সম্রাটের সময়ের উচ্চ পদাধিকারিই ছিলেন না, ছিলেন আকবরের সভাসদ আবুল ফজল এবং আবুল ফৈজ ফৈজির বংশোদ্ভুত। তিনি চিকিৎসা শাস্ত্রের ইতিহাসে বিপুল অবদান পেশ করেছেন। সুস্থ থাকার শিল্প নিয়ে তিনি বহু শাস্ত্র রচনা করেছেন, যার মধ্যে উল্লেখ্য হল ইলাজত দারা শুকোহি(ওরফে টিব্বি দারা শুকোহি, ১৬৪৬ সনে)। এই বইতে তিনি য়ুনানি এবং ভারতীয় চিকিৎসা শাস্ত্রের যতটুকু জ্ঞান ছিল, সেগুলি সঙ্কলিত করেছেন জাহানারার দুর্ঘটনার দু বছর পর এবং বইটি তিনি সাম্রাজ্ঞীর ভাই দারা শুকোকে উতসর্গ করেন।
নুর আল দিনএর অন্য পৃষ্ঠপোষকও ছিল। তার লেখা আরবি আর পারসি চিকিৎসাশাস্ত্রীয় লব্জগুলি নিয়ে অভিধান কিতাস অলাটিব্বা (চিকিৎসকের মাণদণ্ড, সংকলিত ১৬৩০-৩১)কে উতসর্গ করেন মুঘল আমলা আমন আল্লা খানকে(মৃ ১৬৩৭)। আমল আল্লা খান নিজে চিকিৎসাশাস্ত্রবিদ ছিলেন এবং ঔষধবিজ্ঞান বিষয়ে অন্তত একটি পুস্তক রচক এবং চৌদ্দশতকের একটি সংস্কৃত চিকিৎসা শাস্ত্র মদনাবিনোদের ফার্সি অনুবাদক। এছাড়াও তিনি রোগনির্ণয় এবং নিদানবিদ্যা বিষয়ে আনিস অল মুয়ালিজিম (চিকিৎসক সাথী) সঙ্কলকও এবং স্বাস্থ্য বিধির প্রয়োজনীয়তা নিয়েও শাবাবই সিত্তা রশিদি(ছয়টি গুরুত্বপূর্ণ স্বাস্থ্যবিধি) রচনা করেন। তবে ভারতীয় বিজ্ঞানের ইতিহাসকার Fabrizio Spezialeর মতে তিনি প্রখ্যাত হয়ে থাকবেন আলফাজ আল আদ্বিয়া(চিকিৎসাবিদ্যার লব্জগুলি, ১৬২৮-২৯)। বইটিতে ১৪৪১টি ভারতীয় ওষুধএর উল্লেখ আছে এবং এটি শাহ জাহানের প্রতি উৎসর্গীকৃত। Speziale জানাচ্ছেন ১৭৯৩ সালে এই বইটি ফোর্ট উইলিয়ামের হাসপাতাল কমিটির জন্য ফ্রান্সিস গ্ল্যাডউইন অনুবাদ করেন। উনবিংশ শতকে এর সাতটি সংস্করণ প্রকাশিত হয়।
আলোচনায় পরিষ্কার মুঘল আমলকে ধর্মান্ধ ইত্যাদি বিশেষণে দাগিয়ে দিতে দেশি বিদেশি গবেষকেরা যে উতসাহে পরিশ্রম করেছেন এবং প্রচার পেয়েছেন দেশিয় এবং পশ্চিমি প্রচারমাধ্যমে, তার তুলনায় খুব কম পরিশ্রম এবং বুদ্ধিবৃত্তি ব্যয় হয়েছে এই সময়ের বৌদ্ধিক শাস্ত্র বিষয়ে গবেষণার আলোচনায়। মুঘল সম্রাট এবং অভিজাতরা কিন্তু এই বৌদ্ধিক পরিবেশ জিইয়ে রেখেছিলেন তাঁদের সময়ে এবং সেই জন্য মহম্মদ দাউদ বিখ্যাত হন। মনে রাখতে হবে চন্দ্রভান কিন্তু তাঁকে, তাঁর সময়ের গ্যালেন হিসেবে চিহ্নিত করছেন না, তিনি পুরনো মানসিকতার মানুষ বলে নয় বরং বলছেন, এমন কিছু নবতম পদ্ধতি আবিষ্কার করেছিলেন, যা তার সময়ে সুলতানতের চক্ষুকে ভাল করে তুলেছিল(access to novel remedies and wondrous therapies that finally cured that light in the eye of the sultanate and empire)।
আরিফ চ্যালা নামে এক অজ্ঞাতকুলশীল চাপরাশি যিনি পরে মহম্মদ দাউদ নামে বিখ্যাত হবেন, রাজ্ঞীর ঘা সারাবার জন্য নতুন ধরণের পট্টি(bandages) আবিষ্কার করেন। এই কাজের জন্য তাঁকে উপহারে ভরিয়ে দেওয়া হয়। সম্রাটের হাতিশাল থেকে হাতি, মনসব পদ দেওয়া হয়। এছাড়াও সারা রাজ্য জুড়ে দানের বন্যা বইয়ে দেওয়া হয়, রান্নাশাল ক্ষুধার্থদের জন্য খুলে দেওয়া হয়। বন্দী মুক্তি ঘটে। প্রচুর খেরাজ সম্পত্তি উপহার দেওয়া হয় কিন্তু চন্দ্র ভান ব্যঙ্গ করে বলছেন এই কাজ আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় বেশ দেরিও হয়।

মুঘল দরবারের মুন্সি৯ - চন্দ্র ভান ব্রাহ্মণ - উপনিবেশপূর্ব ইতিহাসকে কেন নতুন ভাষ্যে লিখতে হবে

সম্রাট রাজ্ঞীর ক্ষত দেখাশোনা করে সারিয়ে তোলার জন্য মুঘল সাম্রাজ্যের ভিষগদের দরবারে আসার জন্যে ডাক দিলেন। রাজদরবারে আসা ভিষগদের নিয়ে তিনি একটি দলও তৈরি করলেন। এঁদের মধ্যে বিশেষ করে তিনি হাকিম মনিমার নাম উল্লেখ করে বলছেন তিনি চিকিৎসাবিদ্যার উদ্ভাবনকুশলতায়(হিকমত ওয়া হাজাকত medical ingenuity) অনন্য ছিলেন। এছাড়াও ছিলেন হাকিম ফাত আল্লা, হাকিম সালেহ এবং হাকিম আবদ অল রহিম। এছাড়াও দুজন চিকিতসককে আলাদা করে ডাকা হয় হাকিম মাসি অল জামান এবং মুকারব খান। মুকরব খান আইন আল শিফা(সুস্থতার নিধি) নামক চিকিৎসা শাস্ত্র লেখেন, যার ভিত্তি ছিল সিকন্দর শাকে উতসর্গীকৃত মিঞা ভুয়ার(মৃত্যু ১৫১৯) শাস্ত্র মাদান আল শিফায়ি সিকন্দর শাহি(সিকন্দর শাহের চিকিৎসার খনি)। চন্দ্র ভান লিখছেন, সারা দেশ থেকে আগত ভিষগ, বৈদ্য, বৈজ্ঞানিকদের সম্মিলন ঘটল এই উপলক্ষ্যে।
এর থেকে একটা বিষয় স্পষ্ট হয় যে মুঘল সাম্রাজ্যে অতীত থেকেই ভিষগ পেশাদারদের একটা শৃঙ্খল জ্ঞানচর্চাকারী দল তৈরিই ছিল, যাদের মধ্যে অনেকেই নিজের নামে বিখ্যাতও ছিলেন। প্রত্যেকে পেশাদার হিসেবে আলাদা আলাদা ক্ষেত্রে মাহির ছিলেন, যদিও প্রত্যেককে হাকিম নাম দেওয়া হচ্ছে।
অধিকাংশ বিশেষজ্ঞ গ্রিকো-হেলেনিয় জ্ঞানচর্চায় যা ভারত-পারস্যিক জ্ঞানচর্চায় য়ুনানি চিকিতসাবিদ্যায় পারদর্শী ছিলেন, যাদের শেকড় আমরা হয়ত খুঁজে পাই এরিস্টটল বা গ্যালেনের সময় থেকেই।তবুও তার পরে শতাব্দের পর শতাব্দ জুড়ে আবু বকর মহম্মদ ইবন জাকারিয়া অল রিজভি (৮৪৫-৯২৫), আবু অল-কাসিম অল হুসেইন ইবন সিনা(ওরফে আবিসিন্না মৃ ১০৩৭) প্রভৃতি প্রখ্যাত চিকিৎসক জ্ঞানী আরবি ফার্সি চিকিতসা শাস্ত্রকে বার বার নবনির্মান করেছেন।
গ্যালেনিয় চিকিৎসা শাস্ত্র ভারতে এসে নতুন ধরণের জীবন লাভ করে ভারত-পারসিক বৈজ্ঞানিকদের হাত ধরে। বিশেষ করে ত্রয়োদশ শতে দিল্লির সুলতানেরা এই জ্ঞানচর্চার সঙ্গে আয়ুর্বেদিয় জ্ঞানচর্চাকে মেশানোর উদ্যম গ্রহণ করার পর থেকে। চন্দ্রভান যখন আমাদের জানাচ্ছেন জাহানারাকে সুস্থ করে তোলার শ্রেয় দেওয়া হছে ইরাণ থেকে মুঘল দরবারে আগত অভিবাসী চিকিৎসক হাকিম মহম্মদ দাউদকে, এটা মনে রাখা দরকার, তিনি তাঁর সময় গ্যালেন(জালিনুস অল জামান) হিসেবে নন্দিত ছিলেন।
এই সময়ের যে বর্ণনা চন্দ্র ভান চাহার চমনে লিখেছেন, সেটা ভারতীয় জ্ঞানচর্চার ইতিহাসে খুব গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করেছিল, বিশেষ করে চিকিৎসা শাস্ত্রে।আধুনিকপূর্ব ইন্দো-পারসিক চিকিৎসকেদের আজও ধ্রুপদী গ্রিক বা প্রাচীন ভারতীয় বৈজ্ঞানিক পরম্পরার অনুসারী হিসেবেই দ্যাখা হয়। কিন্তু তার অর্থ এই নয় যে তাঁরা শুধু ধ্রুপদী শেকড়েই আঁকড়ে বসে ছিলেন, বরং সেই প্রাচীন জ্ঞানকে কালোপযোগী করে তোলার চেষ্টার যে অভাব ছিল না তার বড় প্রমান চন্দ্র ভানের চাহার চমন।

মুঘল দরবারের মুন্সি৯- চন্দ্র ভান ব্রাহ্মণ - উপনিবেশপূর্ব ইতিহাসকে কেন নতুন ভাষ্যে লিখতে হবে

চন্দ্র ভানের লেখায় মুঘল দরবারের নানান বৌদ্ধিক পরিবেশের বিশদ বর্ণনা পাই। চাহার চমনএর প্রথম দিকে এই ধরণের একটা উদাহরণ আছে।
শাহজাহানের রাজত্বের ত্রিশ বছরের মাঝামাঝি সময়ে ১৬৪৪ সালের মার্চ মাসে জাহানারা বেগম ওরফে বেগম সাহেবার পরিধেয় প্রদীপের আলোয় জ্বলে ওঠে এবং বেগম পুড়ে যান। জাহানারা খুব সাধারণ রাজ্ঞী ছিলেন না, তিনি দরবারের গুরুত্বপূর্ণ অংশ ছিলেন, বিদ্বানদের পৃষ্ঠপোষণা করতেন, নিজেও বিদুষী ছিলেন। কাদিরী এবং চিস্তি সুফিদের অন্যতম পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। ১৬৩১ সালে তাঁর মা মুমুতাজ মহল মারা যাওয়ার পরে তিনিই তাঁর মায়ের স্থান নেন এবং অনন্য ব্যক্তিত্বে পরিণত হন রাজকীয় নানান দায়িত্ব কাঁধে নিয়ে। ফলে জাহানারার দুর্ঘটনা দরবারের প্রায় প্রত্যেকটি সদস্যের কাছে নিদারুণ দুঃসংবাদ বয়ে নিয়ে আসে। যেভাবে তিনি পুড়ে গিয়েছিলেন, তাতে দরবারিদের সঙ্গে সম্রাটেরও মনে হয়েছিল সাম্রাজ্ঞীর জীবন সংশয় অবশ্যম্ভাবী।
সাম্রাজ্ঞীর জীবন সংশয়য়ের ঘটনাটা চন্দ্র ভান লিখছেন তাঁর অননুকরণীয় সাহত্যিক শৈলীতে। এতে শুধু যে সাম্রাজ্ঞীর প্রতি তার নিজস্ব প্রশস্তি ফুটে উঠেছে তাই নয়, তিনি দার্শনিকভাবে দেখছেন ভাগ্য পরিবর্তনে মরণশীল মানবের ন্যুনতা। In those days when the victorious flags and triumphal standards and conquering imperial banners as high as the sky were majestically encamped in the seat of the
caliphate Akbarabad [i.e., Agra], by the force of fate and destiny—the mysteries of which are concealed and veiled even from the eyes of men of vision—on one of the nights in the month of Farwardin a stray spark from a lamp ignited the hallowed skirt of that nawāb of blessed title, the empress of the age, a Rabi‘a in character and a Maryam in manner, the Zubaida of contemporary women, the grand dame of the times renowned throughout the world, [Princess Jahan Ara] Begum Sahib, whose dress was so like an ornament in paradise that it pulled a veil over the face of heavenly nymphs [hūrān-i bihishtī], and whose veil of honor and curtain of dignity [muhajjaba-i ‘izzat wa haudaj-i rif‘at] cast a shadow even over the world-illumining sun.
এখান থেকে চন্দ্র ভান বিস্তৃতভাবে বলেছেন কি করে দীর্ঘকাল ধরে ক্ষতের সঙ্গে লড়াই করলেন সাম্রাজ্ঞী, তাঁর মনের জোর(তিনি লিখছেন an agony so severe that merely describing it makes my pen tremble like a willow tree) ইত্যাদি। এছাড়াও বলছেন, সম্রাট নিজে সাম্রাজ্ঞীর সেরে ওঠার নজরদারি করছেন। চন্দ্র ভানের লেখায় স্পর্শকাতর সম্রাটের যে অন্তরঙ্গতার কোমল ভাবটি ফুটে উঠেছে, সেটি অন্য কোন বর্ণনায় পাওয়া যায় না - His Majesty’s mind was so distracted by care and concern for that blessed one’s condition that these folios don’t have space [to describe it]। তিনি লিখছেন “from the time of the accident’s occurrence right up to the day her infirmity receded, throughout the day and night he would give only one general audience in order to assuage the concerns of his subjects before again returning to attend to the treatment of that light in the eye of the sultanate।

মুঘল দরবারের মুন্সি৮ - চন্দ্র ভান ব্রাহ্মণ - উপনিবেশপূর্ব ইতিহাসকে কেন নতুন ভাষ্যে লিখতে হবে

স্থপতি করিমের অধীনে কিছু দিন কাজ করেই চন্দ্র ভান আফজল খাঁ শিরাজীর প্রশাসনে কাজ করতে শুরু করেন এবং ১৬২৯ সালে শাহ জাহানের রাজত্বের শুরুর এক বছরের মধ্যেই প্রধানমন্ত্রী(উজির) হওয়ার সময়েও তাঁর সঙ্গে ছিলেন। এর পরের তিন দশক ধরে আমাদের আলোচ্য মুন্সি কখোনো সরাসরি সম্রাট শাহ জাহান, কখোনো শাহ জাহানের অধীনস্থ উজিরের সঙ্গে কাজ করেছেন।
এই সময় চন্দ্র ভান সম্রাটের ব্যক্তিগত সচিব এবং তাঁর ব্যক্তিগত দিনলিপিকার(ওয়াকিয়ানবিশ) হিসেবে সম্রাটের ব্যক্তিগত কাজকর্ম(খিদমতই তাসতিরই খাসা)র কাগজপত্র খসড়া লিখতেন এবং সাম্রাজ্যের প্রখ্যাত অভিজাত আমলাদের সঙ্গে ঘুরে বেড়িয়ে সাম্রাজ্যের পঞ্জিকায়(ডায়রি) বিভিন্ন এলাকার গাছ গাছালি এবং স্থানীয়দের সম্বন্ধে তথ্য লিপিবদ্ধ করেন।
তার কাজের একটা বড় সময় অর্থ দপ্তরে(দেওয়ানি)র মুন্সি হিসেবে আফজল খাঁ(মৃ ১৬৩৯) এবং পরে ইসলাম খাঁ মাশাদি(মৃ ১৬৪৭), সাদ আল্লা খান(মৃ ১৬৫৬), মীর মহম্মদ সঈদ আরদাস্তানি মুয়াজ্জম খাঁ(মীর জুমলা নামে খ্যাত ১৫৯১-১৬৬৩) এবং জাফর খাঁ(মৃ ১৬৬৭০) মত নানান উজিরেরে অধীনে কাজ করেছেন। তবে প্রশাসনিক দর্শন বুঝতে তাঁকে সব থেকে বেশি প্রভাবিত করেছেন আফজল খাঁ এবং সাদ আল্লা খান।
এত সব বর্ণনা করছি এই কারণে, মুঘল সময়ের বিশেষজ্ঞরা সে সময় বর্ণনা করতে গিয়ে ধর্মান্ধ ইসলাম চর্চার কারণে যে সামাজিক বিভাজন তৈরি হয়েছিল এমন একটা বর্ণনা দেন social division and cultural insularity created by the revival of a strident and uncompromising Islam। এই বর্ণনার ছিটে ফোঁটা উদাহরণ অন্তত চন্দ্র ভান বা তার সময় বর্ননায় আমরা পাচ্ছি না।
রাজীব লিখছেন, যে সব অভিজাতর অধীনে চন্দ্র ভান কাজ করেছেন, তাঁরা তাঁকে ধর্ম পরিবর্তনের জন্য চাপ দেন নি। বরং তাঁর লেখা থেকে স্পষ্ট শাহ জাহান থেকে ঔরঙ্গজেবের সময়ে অন্তত দরবার বা প্রশাসনে সাধারণ সৌজন্যের সভ্য প্রভাবশালী পেশাদারি মিথষ্ক্রিয়ার পরিবেশ বজায় ছিল।

মুঘল দরবারের মুন্সি৭ - চন্দ্র ভান ব্রাহ্মণ - উপনিবেশপূর্ব ইতিহাসকে কেন নতুন ভাষ্যে লিখতে হবে

সাম্রাজ্যে আসফ খাঁএর পদমর্যাদা এত বেশি ছিল যে তাঁর উচ্চপদস্থ মুন্সি সাধারণ কর্মচারী হিসেবে কাজ করত না। তাঁর সময়ে তিনি বৈজ্ঞানিক, বুদ্ধিজীবীদের পৃষ্ঠপোষকতা করেছেন। মারা যাওয়ার সময় তাঁর সম্পত্তির পরিমান ছিল আড়াই কোটি টাকা। এই বিপুল সম্পত্তি তিনি শুধু চাকরি করে করেন নি, বরং নিজের ব্যবসা এবং ইওরোপিয়দের সঙ্গে যৌথভাবে ব্যবসা করে অর্জন করেছেন। পদমর্যাদা কাজে লাগিয়ে তিনি পূর্বতন আদিলিশাহী জ্যোতির্বিদ ফারিদ অল দিন মাসুদ ইবন ইব্রাহিম দিহলাভি(মৃ ১৬২৯)কে বরাত দেন শাহ জাহানের সময়ের শুরু থেকে একটি পঞ্জিকা তৈরি করতে।

পঞ্জিকাটি তৈমুরী শাসক-বিজ্ঞানী উলুঘ বেগের(মৃ ১৪৪৯) গণনা নির্ভর করে তৈরি হয়, নাম হয় জিজইশাহজাহানি। কিন্তু আসফ খাঁএর উদ্দেশ্য ছিল উলুঘি আধুনিক পঞ্জিকা(জিজইজাদিদ)র সমসাময়িকীকরণ। সম্রাট সিংহাসনে আরোহন করলে নতুন পঞ্জিকাটি উপহার দেন । নিজ ব্যয়ে দিল্লির সংস্কৃতজ্ঞ ব্রাহ্মণ পণ্ডিত নিত্যানন্দকে দিয়ে অনুবাদ করান। এটির নাম হয় সিদ্ধান্তসিন্ধু এবং সারা দেশের মুসলমান, অমুসলমান সব ধরণের রাজা এবং অভিজাতর সঙ্গী হয়।

প্রায় একশ বছর পরে রাজপুত শাসক-জ্যোতির্বিদ সোয়াই জয় সিং (১৬৮৮-১৭৪৩) মুঘল সম্রাট মহম্মদ শাহের(১৭১৯-৪৮) সম্মানে এই পঞ্জিকা বা জিজ পুণর্নবীকরণ করে বলেন এটি প্রত্যেকটি পঞ্জিকার(এমন কি ইওরোপিয়) তুলনায় সব থেকে সাম্প্রতিক।

আসফ খাঁ শুধু দেশিয় বিজ্ঞানের পৃষ্ঠপোষকতা করেন তাই নয়, তিনি সংস্কৃত সাহিত্যেরও সমঝদার ছিলেন। তাঁর এই অনুরাগের প্রতিদান হিসেবে ষষ্ঠদশ শতকের প্রখ্যাত সংস্কৃতিজ্ঞ জগন্নাথ পণ্ডিতরাজা তাঁর নামে আসফবিলাস (আসফ প্রশস্তি) নামে একটি প্রশস্তি লেখেন। জগন্নাথ জাহাঙ্গিরের সময় তেলেঙ্গা প্রদেশ থেকে দিল্লি আসেন। পদ্য প্রকরণ হিসেবে তাঁর লেখা রসগঙ্গাধর বিপুল সম্মান লাভ করে। শাহ জাহান তাঁকে পণ্ডিতরাজা উপাধি দেন এবং আসফবিলাসে তাঁর সম্বন্ধেও সর্বভূম(যা শাহ জাহানত নামের সংস্কৃত অনুবাদ) জগন্নাথ প্রশস্তি লিখেছেন।

আমরা জানি না সে সময় চন্দ্র ভান জগন্নাথ বা অন্যান্য সংস্কৃতজ্ঞ বা হিন্দি পণ্ডিতের সঙ্গ করেছিলেন কি না। তবে বিভিন্ন দরবারি উৎসব অনুষ্ঠানে অংশ নেওয়া হিন্দি গায়ক ও নর্তকদের সঙ্গে দরবার বা আসফ খাঁএর মত নানান অভিজাত, যারা এঁদের পৃষ্ঠপোষণা করতেন, বিশদ সম্বন্ধ বর্ননা করেছেন। সম্প্রতি Allison Busch এবং Katherine Butler Schofield চন্দ্র ভান এবং এবং অন্যান্য সূত্র ধরে দেখিয়েছেন এই লেখাগুলি সপ্তদশ শতকের মুঘল দরবারের সম্পূর্ণ চিত্র উপস্থাপন করে না।

মুঘল দরবারের মুন্সি৬ - চন্দ্র ভান ব্রাহ্মণ - উপনিবেশপূর্ব ইতিহাসকে কেন নতুন ভাষ্যে লিখতে হবে

আমরা আগে দেখেছি চন্দ্র ভানের সঙ্গে আবদ অল করিম মামুরির সম্পর্ক ছিল। আর ছিল ইনায়ত খাঁ ইনায়ত আল্লা, লাহোরের সুবাদারের সঙ্গে। চন্দ্র ভান লিখছেন, ইনায়ত খাঁর সঙ্গে পরিচিত হণ তাঁর বন্ধু মৌলানা আবদ অল করম মার্ফত। ইনায়ত খাঁকে তিনি গজল উতসর্গ করলেও তাঁর সঙ্গে সম্পর্ক বেশি দিন থাকে নি। হয়ত ১৬১৮ সালে অত্যধিক মদ্য আর অন্যান্য নেশ দ্রব্য সেবনের জন্য ইনায়ত খাঁয়ের মৃত্যু হয়। আমাদের মনে হয় এই সময়ের আশেপাশের চন্দ্র ভান মুঘল দরবারে প্রবেশ করেন।
খুব কম সময়ের সম্পর্ক হলেও মৃত্যুর আগে ইনায়ত খাঁ চন্দ্র ভানকে বৃহত্তর রাজ পরিবারের এক গুরুত্বপূর্ণ সদস্য, পাদসাহের ডান হাত(য়ামিন অল দৌলা) আবু অল হাসান আসফ খাঁয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করিয়ে দিয়ে যান। হয়ত ইনায়েত খাঁএর(যার প্রশস্তিতে চন্দ্র ভান লিখেছেন, দর রাস্তি ওয়া দুরুস্তি আদিল ওয়া নজর নাদাস্ত) কোন সময়ে মনে হয়ে থাকবে চন্দ্র ভানএর প্রশাসনিক প্রতিভার বিকাশে আরও বৃহত্তর মঞ্চ প্রয়োজন। চন্দ্র ভানের আক্ষেপ সেটি দেখার জন্য তিনি আর রইলেন না - আজ ইত্তিফকত-ই রোজগার ইন মানি দস্ত বা-হম নাদাদ। তিনি লিখছেন আসফ খাঁ মার্ফত তিনি যেহেতু দরবারে প্রবেশ করেছেন, তাই তিনি নিজেকে আসফ খানেরও কর্মচারী মনে করেন।
আসফ খাঁ যেহেতু সাম্রাজ্ঞী নুর জাহানের দাদা, জাহাঙ্গীরের শালা, আর্যমন্দ বানু বেগম ওরফে তাজ মহল খ্যাত মুমতাজ মহলের বাবা এবং শাহ জাহানের শ্বশুর, চন্দ্র ভান রাজ দরবারে নানান ধরণের কৃষ্টি মানুষের সঙ্গে মেলামেশার মধ্যে দিয়ে গিয়েছেন এবং তিনজন সম্রাটের সময় নিজের চোখে দেখেছেন। ১৬২৮ সালে শাহ জাহান ক্ষমতায় এলে বিশ্বস্ত সঙ্গী হয়ে ওঠেন আসফ খাঁ, সম্রাট আর সাম্রাজ্ঞীর মধ্যে ক্ষমতার টানা পোড়েনের মধ্যস্থ এবং অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ পদ উকিল(পরামর্শ দাতা) হিসেবে কাজ করতে থাকেন। তাঁর সময়ে আরেক অভিজাত ইরাদত খাঁ উজির(প্রধানমন্ত্রী) ছিলেন।
মনে রাখতে হবে আসফ খাঁয়ের আরও একজন অমুসলমান কায়স্থ কর্মচারী রায় মুকুন্দ দাস ছিলেন। যিনি বরাবরই আসফ খানের পক্ষে ছিলেন(ওয়া রায় মুকুন্দ দাস কায়স্থ হমদস্ত ওয়া হাম জামান(জবান?)ই আসফ খাঁ বুদ)। শেখ ফরিদ ভক্করির জাখিরাত অল খাওয়ানিন সূত্র জানা যাচ্ছে মুকুন্দ দাস আসফ খানের কর্মী হিসেবে বিপুল ঐশ্বর্য আর সম্মানের মালিক হন এবং ১৬৪১এ আসফ খাঁয়ের মৃত্যুর পরও শাহ জাহানের প্রশাসনে কাজ করতে থাকেন - প্রথমে কারখানার গুদাম(দিওয়ানইবুয়ুতাত)এর প্রধান, তার পরে কর্মচারীদের বেতনের(সাহিবইতন) হিসাব রক্ষক রূপে।

চিরস্থায়ী বন্দোবস্তে বাংলাদেশের কৃষক - বদরুদ্দিন উমর

চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের সমর্থকেদের এই তথ্যগুলি পড়তে অনুরোধ করা হচ্ছে -
*** সেনসাস কমিশনার টমাস মুনরোর মতে ১৮৪২ পর্যন্ত ভারতে কোন ভূমিহীন কৃষক ছিল না।
*** ১৮৭২এ ভূমিহীন কৃষকের সংখ্যা দাঁড়ায় ৭৫ লক্ষ।
*** ১৯৩১এর সেন্সাসে ভূমিহীন কৃষক মোট জনসংখ্যার এক তৃতীয়াংশ। বঙ্গীয় প্রাদেশিক কৃষক সভা ফ্লাউড কমিশনে বলছেন কৃষকদের নানান ভাগ করে এই সংখ্যা কম দেখানো হয়েছে। এটা ৩৩%এর অনেক বেশি।
*** ১৯২১এ জমিদার ও খাজনা ভোগীর সংখ্যা ছিল ৩৯০৫৬২, ১৯৩১এ হল ৬৩৩৮৩৪ অর্থাত ৬২% বাড়ল।
*** কৃষি কর্মরত ভূমি মালিক এবং প্রজা ১৯২১এ ছিল ৯২৭৪৯২৪; ১৯৩১এ কমে হল ৬০৭৯৭১৭
***কৃষি শ্রমিক ১৯২১এ ছিল ১৮০৫৫০২ থেকে ১৯৩২এ বেড়ে হল ২৭১৮৯৩৯।
*** ১৮৮৪ সালে ৪৩০০ দলিল হস্তান্তর হয়, ১৯১৩ সালে দাঁড়ায় ১৫ লক্ষে। বিপুল সংখ্যক কৃষক জমি হারিয়ে কৃষি শ্রমিকে পরিণত হল।

Sunday, January 28, 2018

মুঘল দরবারের মুন্সি৫ - চন্দ্র ভান ব্রাহ্মণ - উপনিবেশপূর্ব ইতিহাসকে কেন নতুন ভাষ্যে লিখতে হবে

মুঘল সাম্রাজ্যের শুলইকুল(সবার জন্য শান্তি) নীতি
চন্দ্র ভান নিয়ে আরও কয়েকটি লেখা হবে। আদতে চন্দ্র ভান(বা চন্দর ভান)এর সময়টা এবং তাঁর কাজ নিয়ে যতই ভেতরে ঢুকছি দেখছি গুরুত্বপূর্ণ কতগুলি বিষয় পাক খেতে খেতে বেরিয়ে আসছে। এই লেখায় চন্দ্র ভানের মতই সে সময়ের আরেক অমুসলিম মুন্সি হরকরণ দাস কম্বুর কথা আলোচনা করব।
আমরা দেখব চন্দ্র ভানের পেশাদারি মুন্সিত্বের জীবনে আফজল খাঁ শিরাজির প্রভাব ছিল। মুঘল দরবার পর্যন্ত তার যাত্রার সঙ্গে জুড়ে ছিলেন আরও কিছু মানুষ। চন্দ্র ভানের লেখা পত্তরে জানা যায় লাহোরের প্রধান স্থপতি (মীরইইমারত) আবদ অল করিম মামুরি(স্থপতিr) তাঁর প্রথম কর্মদাতা। তিনি প্রখ্যাত হন তাজ মহলের তৈরির সঙ্গে জড়িয়ে গিয়ে। তিনি ছিলেন প্রধান খাজাঞ্চি এবং আমলা। চন্দ্র ভান লিখেছেন তিনি মুল্লা আবদ অল করিমের অধীনে কাজ করে প্রচুর কাজ শিখেছেন এবং তিনি ছিলেন নৈতিকতা সম্পন্ন মানুষ(মখদুমই কায়দাদানই আলম) এবং asceticism, renunciation, equanimity (আবির বারয়ি ফকর ওয়া ঘিনা ওয়া কুয়াম ওয়া মুস্তাকিম) হিসেবে অমূল্য; তাঁর অধীনে কাজ শেখা যেন মুক্তোর মত দুর্মূল্য (শাগির্দয়ি আন মখদুম দুরই মুসমানই মুজাররব অসত)।
১৬১৫ সালে আবদ অল করমকে জাহাঙ্গীর মাণ্ডুর গ্রীষ্মাবাস তৈরিতে এবং সেখানকার শাসকদের স্থাপত্য সারানোর কাজে পাঠান। দুবছর পর মাণ্ডুর কাজ শেষ হলে ১৬১৭ সালের মার্চের ১৮ তারিখে আবদ অল করিমের পদবৃদ্ধি করে ৮০০ মনসবদার হিসেবে মানুর খান উপাধি দান করেন। এক মাস পরে তাকে লাহোরের প্রাসাদ তৈরি দায়িত্ব দিয়ে পাঠানো হয়। হয়ত ১৬১৭-১৮র সময়ে লাহোর দুর্গের রক্ষণাবেক্ষণের কাজ শেষ করার পরে চন্দ্র ভান তাঁর অধীনে কাজ শুরু করবেন। ১৭১৯এ সম্রাট লাহোরের প্রাসাদগুলি দেখতে এলে আবদ অল করিম সম্রাটের সঙ্গে থাকেন তার জন্য মনসবদারি আরও ১০০ বাড়ে।
চন্দ্র ভান দরবার পর্যন্ত পৌঁছতে পেরেছিলেন তার একটা বড় কারণ যে আকল খান এবং মীর আদব অল করিম দুজনের উচ্চকোটির যোগাযোগের মানুষ ছিলেন। এবং উল্লেখ্য চন্দ্র ভানের কোন পারিবারিক আভিজাত্য না থাকা সত্ত্বেও কিন্তু চন্দ্র ভান উচতম আমলা পদগুলির একটিতে বৃত হন।
চন্দ্র ভানের মত যোগাযোগ হীন, মধ্যবিত্ত পরিবারের একজন সন্তান এক্কেবারে করণিক অবস্থা থেকে শুধু প্রশাসনিক উচপদে আরোহন করছেন না, তার এক সম্রাটের আমল থেকে অন্য সম্রাটের আমল পর্যন্ত বয়ে যেতে বিন্দুমাত্র কষ্ট হয় নি। রাইটিং সেলফ, রাইটিং এম্পায়ারে রাজীব কিনরা বলছেন, মুঘল সাম্রাজ্য আকবরের সময়ে গৃহীত শুলইকুল(সবার জন্য শান্তি) তত্ত্ব যা আদতে বৃহত্তরভাবে সাধারণকে পৃষ্ঠপোষণা করার নীতি, সার্বিকভাবে সব সম্রাটের আমলই পালন ও বাস্তবায়িত হয়ে এসেছে। এই নীতির জন্য চন্দ্র ভানের মত সাধারণ একজন নিম্নশ্রেণীর সাধারণ অমুসলমান করণিককে পৃষ্ঠপোষণা করতে দুজন মুসলমান উচ্চপদস্থ অভিজাতর কোন সমস্যা হয় নি।
শুধু চন্দ্র ভানএর পরিবারই বিচ্ছিন্ন উদাহরণ ছিল না সেই সময়। সে সময়ের অন্যতম নামি অমুসলমান প্রশাসাক মুলতানের হরকরণ দাস কম্বু, ইতিবর খান (ওরফে মুমতাজ খান)এর মুন্সি ছিলেন। ইতিবর খান ছিলেন শাহ জাহানের দরবারের গুরুত্বপূর্ণ অভিজাত এবং সঙ্গী। শাহ জাহানের বিদ্রোহেরে সময় তিনি আগরার সুবাদার হিসেবে তার পাশে দাঁড়ান। চন্দ্র ভানের মতই হরকরণের পরিবারেও অনেকেই ফারসি জানতেন, এবং রাজ প্রশাসনে কাজ করেছেন। বাবা মথুরা দাসের কবি খ্যাতি ছিল। যতদূর সম্ভব দক্ষিণ এশিয়ার প্রথম চিঠি লেখার মূলসূত্রটি রচনা করেন হরকরণ। ১৬২২ সালে এটির প্রাথমিক নাম ছিল ইরশাদ অল তালিবিন(ছাত্রের প্রাথমিক পাঠ), যা পরের দিকে এটি এতই বিখ্যাত হয় যে, বইটি ইনশায়ি হরকরণ (হরকরণের গদ্য লেখার মূল সূত্র ) নামে নামাঙ্কিত হয়। এই বইটি আরও দেড়শ বছরের বেশি সময় ধরে জীবিত ছিল। ১৭৮১ সালে কোম্পানির ডাক্তার ফ্রান্সিস বেলফোর গভর্নর-জেনারেল হেস্টিংসের নামে উতসর্গ করেন। ঔপনিবেশিক আমলাদের কিভাবে ফার্সিতে চিঠি লিখতে হয় সে সম্বন্ধে নির্দেশিকা হিসেবে এটি কাজ করে। এটি ভারতে মুদ্রিত প্রথম দিককার ছাপা বই।
উল্লেখ্য হরকরণের খ্যাতি কিন্তু জাহাঙ্গিরের দরবারে কাজ করার সূত্রে হয় নি, আর তিনি তার সভাসদও ছিলেন না। তিনি আজকের একজন অনামি অভিজাত ইতিবর খানের মুন্সি ছিলেন। তবুও চন্দ্র ভানের মতই হরকরণের সাহিত্য কৃতি বহুকাল বেঁচে ছিল।

দাস ব্যবস্থা দেখিনি - দক্ষিণ এশিয়ায় এল বলে

কয়েক দিন আগে দেখিয়েছিলাম দিল্লির ফাঁকা মেট্রোয় বাড়ির কাজের মহিলাটিকে মেঝেয় বসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে এক বাড়িউলি। আজ ঠিক সেই রকম একটি খবর। 
এবার গঙ্গাপার ঢাকা থেকে। বাড়ির কাজের মেয়েকে কয়েক লক্ষ টাকা দামের গাড়ির বুটে বসিয়ে, বুট বন্ধ করে নিয়ে যাছেন এক অর্থবান ভদ্রবিত্ত।
ছবির মধ্যে প্রথমটি ঢাকার দ্বিতীয়টি দিল্লির। এশিয় ভদ্রবিত্ত ইওরোপিয় দাস ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনতে বদ্ধ পরিকর।
ঢাকার ছবিসূত্র Pinakiদা।
দিল্লিরটি একটি ইন্টারনেট পত্রিকা - কয়েক দিন আগে সূত্র উদ্ধৃত করেছি।

মুঘল দরবারের মুন্সি৪ - চন্দ্র ভান ব্রাহ্মণ - উপনিবেশপূর্ব ইতিহাসকে কেন নতুন ভাষ্যে লিখতে হবে

চন্দ্র ভানের মত প্রায় কোন আমলার জীবনই চারজন সম্রাটের সময়ের প্রশাসন, সমাজ পরিবর্তন, যুদ্ধবিগ্রহ বা অর্থনীতির বদল দেখার অভিজ্ঞতা হয় নি। চন্দ্র ভানের জীবন ও কর্ম আলোচনা মুঘল আমলের এক বিশাল সময় জুড়ে বৌদ্ধিক পরিবেশ বোঝার সুযোগ। আকবরের শেষ সময় এবং জাহাঙ্গীরের(১৬০৫-১৬২৭) সিংহাসনে আরোহণের সময় চন্দ্র ভানের পরিবার লাহোরে ছিল। তা সত্ত্বেও আমরা জানতে পারি না তাঁর পিতার পৃষ্ঠপোষক কে ছিলেন, কিন্তু তাঁর ভায়ের(দাদা?) সঙ্গে যুক্ত মানুষদের কথা তিনি বিপুল সম্মান দিয়ে আলোচনা করেছেন।

আকিল খাঁ তাঁর দাদার কর্মদাতা ছিলেন। তিনি কর্মউপলক্ষ্যে আফগানিস্তানে গিয়ে হঠাতই মারা যান ১৬৪৯ খ্রি। চন্দ্র ভান লিখছেন, When that Khan, still in the prime of youth and success, hastened from this impermanent world and transient way station to the eternal province [i.e., died], within days [my brother] Uday Bhan lifted a goblet of love from the tavern of truth and turned to the bliss of eternal intoxication. At present he is a complete stranger to the ways of worldly people।

জাহাঙ্গীরের রাজত্বের একটা বড় সময় মুঘল প্রশাসনে কাজ করা আকিল খাঁয়ের সঙ্গেও চন্দ্র ভানের পত্র বন্ধুত্ব ছিল। বেভারিজের অনুবাদে ১৫০০ থেকে ১৭৮০ পর্যন্ত মুঘল সাম্রাজ্যের আমলাদের জীবনী মাসিরঅলউমারা সূত্রে জানতে পারছি আকিল খাঁ পদ্য আর হিসেব শাস্ত্রে দক্ষ ছিলেন(আজ নজম ওয়া সিয়াক বাহরা-ওয়ার বুদ)। কিছু সময়ের জন্য তিনি আরজমুকরর (editor of royal petitions), পদে থাকলেও চন্দ্র ভানের মত মুন্সি হিসেবেই তাঁর প্রসিদ্ধি।

আকিল খাঁ দরবারের বিখ্যাত অভিজাতদের সঙ্গে তুলনীয় হতেন না। তিনি পারস্যের একটি অভিজাত পরিবারে জন্ম গ্রহণ করেন এবং গোটা পরিবার মুঘল দরবারে অভিবাসিত হয়। তিনি ১৬৪৭ সালে সাম্রাজ্ঞী জাহান আরার হারেমের মুহরদার (পাঞ্জাধারক) শিক্ষিকা, জাহাঙ্গীরের এক সময়ের কবি তালিব আমুলদির বোন বিদুষী সতী অলনিসা খানুমের কন্যাকে বিবাহ করেন। তাঁর পিতা আবদ অল হক শিরাজী(পরে আমানত খাঁ উপাধিতে ভূষিত হবেন) ভারতে এসে মুঘল রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। কিন্তু তাঁর প্রখ্যাতি শিল্পরূপেরলিপিবিদ(calligrapher) হিসেবে। তার প্রথমদিককার কাজ ছিল ১৬১৩ সালে শেষ হওয়া সেকেন্দ্রায়(আগরা) আকবরের সমাধিতে লিপি খোদাই(হয়ত কিছু কবিতা তাঁরই লেখা) এবং আগরার মাদ্রাসা শাহীর (সম্রাটীয় মহাবিদ্যালয়) মসজিদের গায়ের লিপির কাজগুলি করা।তাঁর খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে তাজমহলের এবং তার আশেপাশের বিভিন্ন স্থাপত্যে কোরাণ এবং সাহিত্যিক লিপির পরিকল্পনার জন্যে। বলা দরকার আকিল খাঁয়ের পিতা, দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণতম ঐতিহাসিক স্থাপত্যের দেওয়ালে আক্ষরিকভাবে তার আঁচড় কেটে গিয়েছেন।

তবে পরিবারের প্রখ্যাততম সদস্য কিন্তু আমানত খাঁ নন, ভাই(আকিল খাঁএর কাকা) মির্জা শুকুর আলি শিরাজি, মুঘল সাম্রাজ্যে যিনি আফজল খাঁ (আকবরের আমলে প্রযুক্তিবিদ ফাতাউল্লা শিরাজির শিষ্য - ফাতাউল্লার কৃতি নিয়ে কয়েক দিন আগেই ফেবুতে লিখেছি, শিষ্য হিসেবে আফজল খাঁএর নামোল্লেখ আছে) উপাধিতে বিখ্যাত হন। ১৬০৮ সালে ভারতে এসে আফজল খাঁ, বুরহানপুরের মুঘল ব্যক্তিত্ব আবদ অলরহিম খানই খানানের কাছে কাজ করেন। সে সময়ের দাক্ষিণাত্যে নবাব কাজ করা শাহ জাহানের পার্শ্বচর হিসেবে যোগ দেন।

আফজল খাঁ সম্বন্ধে আল্লামি উপাধিধারী মন্ত্রী আবুল ফজল সুখ্যাতি করেছেন। জ্ঞানে, নিজের সময়ে তিনি প্লেটো বা এরিস্টটলের সঙ্গে তুলনীয় ছিলেন। ক্রমশ তিনি নিজেকে গুরুত্বপূর্ণ প্রশাসক এবং রাজনৈতিক দৌত্যে যোগ্য করে তোলেনে। ১৬২০ সাল নাগাদ শাহ জাহানের ঘনিষ্ঠতম পরামর্শদাতাদের মধ্যে অন্যতম হয়ে ওঠেন।

যদিও তাঁর খ্যাতি প্রশাসক রূপে কিন্তু আবদ অল বাকি নহাওয়ান্দি, মসিরইরাহিমিতে আফজল খাঁকে উলেমা এবং ফুজালা হিসেবে বর্ণনা করছেন। সেই সময়ের আরেক লেখক মহম্মদ সাদিক হামাদানি, তবাকতই শাহজাহানিতেও আফজল খাঁকে উলামা ওয়া হুকুমা ওয়া ফুজালা হিসেবে বর্ণনা করেছেন।

উপনিবেশপূর্ব চর্চা - ব্রিটিশ-পূর্ব সময় বোঝার ৬টি প্রচেষ্টা ও গবেষণা - পার্থ পঞ্চাধ্যায়ী, বিশ্বেন্দু নন্দ, এবং কলাবতী মুদ্রার নথিকরণ দল

বহুদিনের চেষ্টায় কয়েকটি বই অনুবাদ করাগেল
মুঘল আমল এবং সার্বিকভাবে ব্রিটিশপূর্ব সময় বোঝার ক্ষেত্রে কয়েকটি বই-

*** মুঘল এডমিনিস্ট্রেশন
*** এনেকডোটস অফ আওরঙ্গজেব - আহকমইআলমগিরি
*** লাইফ অব মীর জুমলা
*** উনবিংশ এবং বিংশ শতে রাষ্ট্র এবং দেশজ চিকিৎসা ব্যবস্থা ১৮০০-১৯৪৭
*** ইন্ডিয়ান টিচার্স অব বুদ্ধিস্ট ইউনিভার্সিটি
*** পলাশী পূর্ব পঞ্চাশ বছরের বাংলার সমাজ, অর্থনীতি, কৃষ্টি - একটি সামগ্রিক দৃষ্টিভঙ্গী
*** গরীব কাহারে কয়, উন্নয়নের বিশ্ব রাজনীতি তত্ত্ব - আর্তুরো এসকোবার
*** দ্বিতীয় ইতিহাসঃ লুঠেরা ইংরেজ, সাথী মধ্যবিত্ত, সাংস্কৃতিক গণহত্যা, গ্রামীন স্বাধীনতা সংগ্রাম

পরিচিতি
১) যদুনাথ সরকার রচিত মুঘল এডমিনিস্ট্রেশন - আচার্য মুঘল প্রশাসনিক ব্যবস্থা স্পষ্ট বিবৃত করেছেন - মুঘলদের সম্বন্ধে নানান ধরণের ভুল ধারণা এই বইটি দূর করতে সাহায্য করবে। এ ছাড়াও মুঘল আমলে সব থেকে বেশি লালন পালন পেত দুটি পেশা কৃষক আর কারিগর - কারণ তারা জানতেন এরা মুঘল সাম্রাজ্যকে খাওয়ায় পরায় - এই ধারনাটিও পরিষ্কার হবে। ব্রিটিশরাই এদেশের উধারকর্তা এই ধারণার মূলে কুঠারাঘাত করবে এই বইএর গভীর অধ্যয়ণ, যদিও আচার্যের উদ্দেশ্য তা ছিল না বলেই মনে হয়।

২) যদুনাথ সরকার অনুদিত আহকমইআলমগিরির ইংরেজি অনুবাদ এনেকডোটস অফ আওরঙ্গজেবএর বাংলা অনুবাদ আওরঙ্গজেবের উপাখ্যান। মূল রচনা হামিদুদ্দিন খাঁ বাহাদুর। বাদশা আলমগিরের পারিবারিক, বৈদেশিক যোগাযোগ, তার কঠোরতা-কোমলতা, তার অনন্যতা, তিন ভায়ের মধ্যে তার বীরত্ব কাহিনী এবং মুঘল রাজত্বের নানান সুস্বাদু অজানা কাহিনী মানুষটাকে নতুন করে, নতুন ভাবে চিনতে সাহায্য করবে।

৩) জগদীশ নারায়ণ সরকারের লাইফ অব মীর জুমলা। আওরঙ্গজেবের সেনাপতি মীর জুমলার দাক্ষিনাত্যের প্রশাসন, তার বিপুল হীরের খনি, ইওরোপিয়দের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক, সুজার বিরুদ্ধে আক্রমনে বাংলায় নৌকোর রণনীতি সজ্জা - যে খান থেকে ব্রিটিশদের পন্টুন ব্রিজের ধারণা চুরি এবং সব শেষে অসম আক্রমণ ও মৃত্যু এই বইটির উপজীব্য। ঔরঙ্গজেবের সময় দাক্ষিনাত্য এবং বাংলা-অসমের উদ্বৃত্ত অর্থনীতির ঝলক পাওয়া যায় এই বইটিতে।

৪) পুনম বালার উনবিংশ এবং বিংশ শতে রাষ্ট্র এবং দেশজ চিকিৎসা ব্যবস্থা ১৮০০-১৯৪৭ - পুণম বালা - তিনি গবেষণার কাজটা করেছিলেন নবাবি আমল শেষে ব্রিটিশ আমলের শুরু থেকে ভারত ভাগ পর্যন্ত ব্রিটিশ বাংলার চিকিৎসা ব্যবস্থায় বিভিন্ন চিকিৎসা ব্যবস্থার তুলনামূলক বর্ণনা।এই সময়টা জানা প্রয়োজন কারণ সে সময় আয়ুর্বেদ আর হেকিমি চিকিৎসা ব্যবস্থার কি হালত ছিল জানতে।বিশেষ করে কখন রাষ্ট্রীয় কাঠামোয় পশ্চিমি চিকিৎসা ব্যবস্থা থানা গেড়ে বসল, তা জানাটাও জরুরি ছিল যেহেতু আমরা দেশজ চিকিতসা ব্যবস্থা প্রসারে উৎসাহী। এখানে তিনি আয়ুর্বেদ এবং ইউনানির ইতিহাসও সংক্ষেপে বর্ণনা করেছেন।

৫) ইন্ডিয়ান টিচার্স অব বুদ্ধিস্ট ইউনিভার্সিটি - ফণীন্দ্র নাথ বোস
সুলতানি আমলের আগে ভারতে আর তিব্বতে বাংলা তথা ভারতীয় শিক্ষাবিদ আর বিশ্ববিদ্যালয়। দীর্ঘকাল ধরে বাংলা জুড়ে একটা ধারণা ছড়িয়েছিল বাংলার টোল ব্যবস্থা ছিল উচ্চবর্ণ চভিত্তিক।অথচ ১৮৩৬ সালের উইলিয়াম এডাম শিক্ষা সমীক্ষায় আমরা দেখতে পাচ্ছি গ্রামে অনুচ্চবর্ণই প্রধাণত এই শিক্ষা ব্যবস্থার ধারক-বাহক ছিলেন। ফলে তার আগের প্রাতিষ্ঠনিক বৌদ্ধ শিক্ষা ব্যবস্থাটা কেমন ছিল সেটা জানাও জরুরি। এডাম সমীক্ষায় জনগণের সমীক্ষা ছিল বিকেন্দ্রিভূত - অথচ রাষ্ট্র দ্বারা পোষিত বৈদ্ধ শিক্ষা ব্যবস্থা যে চরম কেন্দ্রিভূত ও রাজানুগ্রাহি ছিল সেটাও এই বইএর রচনায় ভেসে ওঠে।

৬) পলাশীর পূর্বে ৫০ বছরে বাংলা সুবা - এই ধারাবাহিক লেখাটা আমাদের মত আবাল-ছাবালদের জন্য - আমরা যারা ইতিহাসে পাতিহাঁস, ভূগোলেতে গোল তাদের খোরাকের জন্য এটা তৈরি করা হয়েছে। বিশেষ করে আওরঙ্গজেবের মৃত্যুর কিছুটা আগের সময় থেকে বাংলার উপনিবেশের শুরুর সময় পর্যন্ত একটা ধারাবাহিক ইতিহাস আমাদের মত গোলা মানুষদের জানা দরকার। আমাদের কাজ যেহেতু বাংলার লুঠ এবং পলাশীর আগের বৈশ্য-শূদ্র-মুসলমান এবং অন্যান্য পরম্পরার পরম্পরার সমাজ যে উদ্বৃত্ত বাংলা তৈরি করেছিল, তাকে জানা, সেহেতু আওরঙ্গজেবের মৃত্যুর পরের ৫০ বছরের সময় জানা এবং জানানো প্রয়োজন ছিল। অব্যবহিত ব্রিটিশপূর্ব সময় জানা বোঝা না গেলে এই কর্পোরেট ব্যবস্থার বদলে কোন উৎপাদন ব্যবস্থা কেন চাইছি, কেন আমরা বারবার বলছি ১১৬৫/১৭৫৭র আগে আমরা ফিরে যেতে চাইছি সে তত্ত্বটা বোঝানো সম্ভব নয়।

৭) গরীব কাহারে কয়, উন্নয়নের বিশ্ব রাজনীতি তত্ত্ব - আর্তুরো এসকোবার
এনকাউন্টারিং ডেভেলাপমেন্টঃ দ্য মেকিং এন্ড আন্মেকিং অব দ্য থার্ড ওয়ার্লড বই থেকে অনুবাদের কাজ চলছে। এসকোবার দেখাবার চেষ্টা করেছেন কিভাবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর সময়ে সারা বিশ্বে বড় পুঁজি উন্নয়ন নামক নব্য উপনিবেশবাদ কায়েম করেছে জাতিরাষ্ট্র আর পশ্চিমি বিজ্ঞানের দোহাই দিয়ে।

---
এছাড়াও
৮) দ্বিতীয় ইতিহাসঃ লুঠেরা ইংরেজ, সাথী মধ্যবিত্ত, সাংস্কৃতিক গণহত্যা আর গ্রামীন স্বাধীণতা সংগ্রাম
এখানে বাংলার লুঠ, পলাশীর পর স্বাধীনতার লড়াই, নবজাগরণকে নতুন করে দেখা, সাংস্কৃতিক দাসত্ব ইত্যাদির চেষ্টা করা হয়েছে। বিশেষ করে ১৮০০ সালের পরে রামমোহন-দ্বারকানাথ জুটির রাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক, সাংস্কৃতিক দাসত্ব, গ্রামীন স্বাধীনতা সংগ্রামের পাশাপাশি আলালেরা কিভাবে ব্রিটিশদের সঙ্গে মিলে দেশিয় কাঠামো ধ্বংসের কাজ করছিল, ইত্যাদির ব্যাখ্যান।
---
লেখা, অনুবাদের সময় ফেসবুকে যারা এই নালায়ককে প্রতিনিয়ত সঙ্গ দিয়েছেন, যারা এই পল্লবগ্রাহীকে টেনে শেকড়ে গুঁজে রাখতে পেরেছেন তাদের অসম অধ্যাবসায়ে, তাদের সক্কলকে শ্রদ্ধাভরা প্রণাম, ভালবাসা। যারা এগুলি পড়ে মন্তব্য করেছেন, যারা পড়েন নি, যারা অযাচিতভাবে আমার ভুল শুধরে দিয়েছেন, তাদের সক্কলকেই আমার প্রণাম সালাম।

সক্কলে সুস্থ থাকুন।
আর আমাদের মাথায় হাত রাখুন।



উপনিবেশ বিরোধী চর্চা- হেরিটেজপ্রিয় ইংরেজ, কিন্তু কেনো - রফিক আখন্দ

(আমাদের ব্রিটিশ হেরিটেজ-প্রিয়তা বিষয়ক লেখার উত্তরে শেকড়ের বন্ধু Rafiq Akhand লিখছেন হৃদয় খোঁড়া বেদনার ভাষ্য। প্রস্তাব দিয়েছেন বাংলার ঐতিহ্যন আলোচনাটি মুঘল আমল থেকে পিছিয়ে সুলতানি আমলে নিয়ে যাওয়া হোক। অবশ্যই সাধু প্রস্তাব। যে সময় বাংলা বাঙ্গালা নাম পেল, সেই আমলের কৃতি এবং কৃতি ধ্বংস নিয়ে আমাদের সক্কলে ঔৎসুক্য আছে। আপনার কলম চিরজীবি হোক। মঙ্গলময় আপনার হৃদয়ে সত্যের কাছাকাছি পৌঁছবার আকণ্ঠ আকুতি ভরে দিন।
নীচে দাদার লেখাটি পড়ুন।)


উপরের পোস্টে নিয়ে এলেন আবারো অভিনব আরেক অন্ধকারের বস্ত্র হরণ| উচ্চ মাধ্যমিক শ্রেণিতে অধ্যয়নকালীন সেই বালকবয়সে যে জিজ্ঞাসা, বেদনা কিছুটা তাড়িত করতো, এই মাঝ বয়সে ফের উস্কে দিলেন বহু মাত্রায় | হ্যাঁ, এই নবাগ্নিতে শূচি হতে চাই অজ্ঞানতার পাপ থেকে | মিথ্যাবাদী, কপট, ভণ্ড, লুটেরা, তস্কর বেনিয়া বৃটিশ ও তাদের সহযোগীদের কর্তৃক উপমহাদেশের ঐতিহ্য, প্রত্ন লুণ্ঠনের বিষয়টি নিয়ে এসেছেন |

কৃতজ্ঞতা জানিয়েও বিনীত আবেদন রাখছিঃ এ বিষয়ে দীর্ঘ বিস্তৃত স্থান ও সময়কেন্দ্রিক কথা হোক | তবে প্রথমেই দিল্লীতে মোগল ঐতিহ্যে দৃষ্টি দিলে সময়ের বিচার আর বাংলাভারতে বৃটিশ-ইউরোপীয় লুণ্ঠন, ধ্বংসকরণের কুকর্মের খতিয়ান সংক্ষিপ্ত হয়ে যাবে |

তাই অনুরোধ করিঃ সময়কালটা বাংলার সুলতানী শাসন ঐতিহ্য থেকে শুরু করা হোক | কেমন করে গৌড়ের সুলতানী বহু স্থাপত্য ঐতিহ্যকে মাটির সাথে মিশিয়ে দেওয়া হলো ? কেমন করে সেখানকার সুলতানদের বাসবভন, দুর্গ, নগর রক্ষা প্রাচীর, সুফিদরবেশদের কবর, পাকা সেতু ধ্বংস করা হলো ? সেসব ধ্বংস করে সেগুলোর কোন কোনটা থেকে প্রাপ্ত সোনা,দানা,গহনা, মুদ্রা, পুঁথিপুস্তকাদি লুটে নেওয়া হলো ? লুটে নেওয়া সেই বিপুল পরিমাণ সম্পদ ও ঐতিহ্য দিয়ে পূর্ণ করা হলো বৃটিশ লাইব্রেরি, মিউজিয়াম | বাংলার স্বর্ণালী সমৃদ্ধির যুগ, সুলতানী রাজধানী গৌড়ের ইট, কাঠ, পাথর শত শত নৌকা ভর্তি করে কলকাতা, হুগলী, চুচূঁড়ার ইংরেজ দুর্গ তৈরি করা হলো | এমন কি সুলতানী বাংলার সবচেয়ে উজ্জ্বল শাসক আলাউদ্দিন হোসাইন শাহর সমাধিসৌধটিতে হীরেজহরত থাকতে পারে, কেবলমাত্র এই লোভী সন্দেহে গৌড়ের বাংলাকোট থেকে চিরতরে ভেঙে গুড়িয়ে দেওয়া হলো | আদিনা মসজিদের গ্রানাইট পাথরের কারুকার্যময় থাম (যা এই বাংলার গ্রামীণ নিপুণ কারিগররাই তৈরি করেছিলেন), শত শত দৃষ্টিনন্দন ফুলেল নকশা, গৌড়ের কিয়দংশ, বর্তমান বাংলাদেশের সোনা মসজিদের প্রস্তর মিহরাব, ফ্লোরাল মটিফ মসজিদগাত্র থেকে উপড়ে নিয়ে ইংল্যান্ডে চালান করা হয়েছে | কার্জনামলে প্রত্নজরিপের নামেও এসব অপকর্ম চলেছে বলে জনশ্রুতি রয়েছে | বলুন, এসব কথাও বলুন |

মাত্র বছর চার আগে, এশিয়াটিক সোসাইটি অব বাংলাদেশের একটি সেমিনারে যোগদানের সৌভাগ্য হয়েছিলো | বাংলার হেরিটেজের উপর প্রবন্ধ পাঠ করছিলেন, বাংলাদেশের অন্যতম প্রাজ্ঞজন, জাতীয় অধ্যাপক সুফিয়া আহমেদ | প্রবন্ধ উপস্থাপনকালে তাঁর কণ্ঠে ঝরে পড়ছিল প্রচ্ছন্ন ক্ষোভ, কষ্ট | কারণটা ছিলোঃ তৎকর্তৃক ফ্রান্সের ল্যুভ, গিমে জাদুঘর দর্শনের বেদনাদায়ক অভিজ্ঞতা | তিনি সেগুলোতে প্রত্যক্ষ করেন বাংলা থেকে লুণ্ঠিত অজস্র সুবর্ণ ও রজত মুদ্রা, শিলালেখ, নানা ঐতিহ্যিক নিদর্শন | সুফিয়া আপার কণ্ঠ খানিকটা ভারি হয়ে আসছিলো অক্ষমতার কষ্টে |

তাঁর কণ্ঠে দীর্ঘশ্বাসঃ আমার গৌরবের সম্পদ আজ অন্যের গোলায় !