Wednesday, September 6, 2017

আমার বাংলা

বাংলার আগমনী, বাংলার বিজয়া, বাংলার এই মধুর প্রেমযোগ আর তো কোথাও দেখি না।
মুর্শিদাবাদ কিরীটেশ্বরী ও পূর্ববঙ্গের ও উত্তরবঙ্গের কয়েকটি স্থানে দেবীর নামে চমৎকার সব গানের পালা আছে। দেবী থাকেন মন্দিরে। পূজক ঠাকুর প্রতিদিন পূজা করেন। দেবী যেন সুন্দরী মেয়েটি। নিভৃতে সবার দৃষ্টির আড়ালে দীঘির ঘাটে অলক্তাক্ত চরণ দুখানি ডুবিয়ে বসে থাকেন। দেবী একদিন দেখেন শাঁখারী শাঁখা নিয়ে হেঁকে যাচ্ছে, 'শাঁখা পরবি মা?' দেবীর ইচ্ছে হল শাঁখা পরতে। ডাকলেন শাঁখারীকে, শাঁখা পরতে চাইলেন। কী রূপ, কি দুখানি রাঙ্গা চরণ! শাঁখারীর দুচোখ জলে ভরে এল!
ঐ হাতে শাঁখা পরিয়ে দিয়ে সে কৃতার্থ হল। তবু মনের দুঃখে বললে, 'মা, তোর হাতে পরালাম শাঁখা, ধন্য হলাম। কিন্তু বড় গরীব আমি, শাঁখা বেচে খাই, এর মূল্য না পেলে ছেলেপিলে যে না খেয়ে মরবে।' দেবী বললেন, 'ঐ মন্দিরের পূজারী আমার বাপ, তাঁকে বোলো তাঁর মেয়ের শাঁখার দাম তিনি যেন দেন। তিনি যদি বলেন 'টাকা কই?' তবে বোলো দেবীর ঝাঁপিতে যে দুটি টাকা আছে তাই যেন তিনি তোমায় দেন।' শাঁখারী গিয়ে মেয়ের শাঁখার দাম চাইলে পূজারী বিস্মিত হয়ে বললেন, 'মেয়ে তো আমার নেই, বাবা।' তবু একবার ঝাঁপি খুলে দেখেন, ঠিক দুটি টাকাই আছে। এ টাকা তো পূর্বে ছিল না! শাঁখারী বললে, 'বিশ্বেস না হয় ঠাকুর, ওই ঘাটে গিয়ে দেখ, তোমার মেয়ে বসেই আছেন।' গিয়ে দেখেন কন্যা নেই। শাঁখারী ডেকে বললে, 'মাগো, তোমার হাতের শাঁখা তোমার বাবাকে দেখাও না মা একবার, তিনি যে পেত্যয় করেন না।' শুনে সরোবর থেকে শাঁখসুদ্ধ হাতদুখানি দেবী একবার তুলে দেখালেন।
তখন পূজারী মাটিতে লুটিয়ে পড়ে বললেন, 'মাগো, এতকাল পূজা করে তোর দেখা পেলাম না, আর কী পুণ্যফলে দিনহীন শাঁখারী তোকে দেখতে পেল, তোর চরণদুখানি দেখতে পেল, তোর হাতে শাঁখা পরাল! তারি কৃপায় আজ আমি তোর শাঁখা পরা হাত দুখানি মাত্র একটিবার দেখতে পেলাম!
সূত্রঃ 'বাংলার সাধনা' গ্রন্থে 'মালসি গান' প্রবন্ধ,  ক্ষিতিমোহন সেন
----
আমরা এই গল্পের একটা পাদটিকা তৈরি করেছি।
এটা বাংলায় পলাশীর আগের অর্থনৈতিক সম্পর্কর রূপক। শাঁখারি দেবীকে দেখল অর্থে ব্যবসায় উদ্বৃত্ত তৈরি করল, এবং পুজারী কিন্তু ক্ষমতার কাছাকাছি থেকেও ছোটলোক শাঁখারির দয়ায় সেই দেবীর হাত টুকুই দেখতে পেল, গোটা উদ্বৃত্তে তার হাত পড়ল না। পলাশীর পরে ইংরেজের হাত ধরে ক্ষমতা অবলম্বন করে এই উদ্বৃত্তর মাঠা টুকু খেয়ে নিল ব্রাহ্মণ!

No comments: