Friday, September 15, 2017

বাংলা যখন বিশ্ব সেরা - পলাশীপূর্ব বাংলায় শিক্ষা ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান১

আমরা এই পর্ব শুরু করব উইলিয়াম এডামের ১৮৩৬/১২৪৩এর শিক্ষা সমীক্ষা দিয়ে। জানি ভুরু কুঁচকোচ্ছেন। হ্যাঁ তখন পলাশীর পর লুঠেরা সত্তর বছর কেটে গেছে। কিন্তু যে শিক্ষা ব্যবস্থাটার অবশেষ নাটোর থেকে ত্রিহুত পর্যন্ত বাংলা সুবার গ্রামে টিকে ছিল তখনও, সেটা পুরনো বাংলার শিক্ষা ব্যবস্থার প্রতিনিধি। তাই পলাশী পূর্ব নবাবী আমলের শিক্ষা ব্যবস্থার একাংশ জানার জন্য উইলিয়াম এডামের শিক্ষা সমীক্ষা জানা দরকার।
বাংলার, ভারতের তাবড় তাবড় শিক্ষাবিদ, ঐতিহাসিক, শিক্ষা সমীক্ষা করা শিক্ষাবিদ, আমলা কেউই এই শিক্ষা সমীক্ষা ছোঁন নি। কেন? আমাদের এই ধারাবাহিকটি পড়ুন। তাহলেই সমঝে যাবেন। শেষে যে উপাত্ত দেব, সেটি যে কোন ঐতিহাসিক, সমাজতাত্ত্বিক শিক্ষাবিদের পায়ের তলার মাটি কেড়ে নিতে পারে তা বলাই বাহুল্য। কেননা উপনিবেশ সযত্নে যে তত্ত্ব তৈরি করে গিয়েছে বাংলা তথা ভারত সম্বন্ধে তা সশব্দে খান খান হয়ে ভেঙ্গে পড়তে বাধ্য।
একমাত্র এই সমীক্ষায় হাত দিয়েছিলেন করমচাঁদ গান্ধী। এই ব্যবস্থাকে বলেছিলেন নন্দিত বৃক্ষ, দ্য বিউটিফুল ট্রি। ব্রিটিশ পূর্ব শিক্ষা ব্যবস্থার জোরের জায়গা নিয়ে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস-চ্যান্সেলার, লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অব ওরেয়েন্টাল স্টাডিজের প্রতিষ্ঠাতা ফিলিপ হার্টগের সঙ্গে বাদানুবাদে, চিঠি আদানপ্রদানে জড়িয়ে পড়েন ১৯৩২/১৩৩৯ সালে লন্ডনে এক বক্তৃতার পর। এই শব্দবন্ধটি নিয়ে এডাম এবং অন্যান্য শিক্ষা সমীক্ষার ওপর অসাধারণ বই লেখেন গান্ধী শিষ্য ধরমপালজী। ভারতের শিক্ষা ব্যবস্থার ইতিহাসে এই বই দিগদর্শনকারী। পলাশীপূর্ব বাংলার শিক্ষা ব্যবস্থা আলোচনায় অবশ্যই এডাম সমীক্ষা পড়া জরুরি। আসুন এডাম সমীক্ষা প্রবেশ করি।
---
“Since we have lost practically all contact with our tradition, and all comprehension of our chitta and kala, there are no standards and norms on the basis of which to answer questions that arise in ordinary social living. Ordinary Indians perhaps still retain an innate understanding of right action and right thought, but our elite society seems to have lost all touch with any stable norms of behavior and thinking. The present attempt at imitating the world and following every passing fad can hardly lead us anywhere. We shall have no options until we evolve a conceptual framework of our own, based on chitta and kala, to discriminate between right and wrong, what is useful for us and what is futile. - ধরমপালজী” (http://www.cpsindia.org/annam_hindu.html)
উত্তমর্ণ -উদ্বৃত্ত বাঙলা
ভারতপথিক ধরমপালজীর সাথীরা, আলমোড়ার লোক বিজ্ঞান কেন্দ্র, কেরলের কয়েকটি শেকড়ে ফেরার আন্দোলন, গান্ধিজীর আদর্শে অনুপ্রাণিত বহু সংগঠণ গ্রামভারতের সনাতন সমাজ, দর্শণ, ঐতিহ্য, প্রযুক্তি নথিকরণের প্রচার করছে। বাঙলায় গ্রামদর্শণ আলোচনার মুখপাত করেছিলেন রাজেন্দ্রলাল মিত্র, অক্ষয় কুমার দত্ত, হরপ্রসাদ শাস্ত্রী, বসন্তরঞ্জন রায়, হরিদাস পালিত, হরেকৃষ্ণ মুখোপাধ্যায়, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, বিনয় সরকার, দীনেশচন্দ্র সেন, নির্মল চন্দ্র বসুরমত মানুষেরা। সেই উত্তরাধিকার বয়ে চলেছেন বিনয় ঘোষ, সুধীর কুমার করণ, রঘুনাথ গোস্বামী, শক্তিনাথ ঝা, জয়া মিত্র, কলাবতী মুদ্রা, তারাপদ সাঁতরা, গুরুসদয় দত্তেরমত লেখক, গবেষক সমাজভক্ত ব্যক্তি সংগঠণ।
ভারতীয় গ্রামীণদের সাম্প্রদায়িকতা, মূঢ়তা, অজ্ঞাণতা, জাতপাতের দ্বন্দ্ব, প্রাচীণতম প্রযুক্তি, ব্যাপকতম অশিক্ষা, পশ্চাদপদতারমত(নিউ ইয়র্ক ডেলি ট্রিবিউনের লেখায় কার্ল মার্ক্স বললেন, A country not only divided between Mahommedan and Hindoo, but between tribe and tribe, between caste and caste; a society whose framework was based on a sort of equilibrium, resulting from a general repulsion and constitutional exclusiveness between all its members. Such a country and such a society, were they not the predestined prey of conquest? সূত্রঃ http://www.marxists.org/archive/marx/works/1853/07/22.htm) ন্যুনতার মিথ-মিথ্যাকে প্রশ্ন করার কাজ আজও অপেক্ষা করছে। প্রচার ব্রিটিশ শিক্ষাব্যবস্থা অসাম্প্রদায়িক। ভারতীয় পাঠশালার পাঠ্যবস্তুতে ভগবানের আরাধণা। আর সেই ধর্মীয় পাঠের একচ্ছত্র অধিকার ছিল ধনবান উচ্চবর্ণের। কৃষি বিপ্লবের প্রচারের বাহুল্যে ভুলে যাই ব্রিটিশপূর্ব সময়ের চেঙ্গলপট্টু পুঁথিতে উল্লিখিত এক হেক্টারে ১২ টন ধান চাষের বাস্তবতা (www.cpsindia.org/)। মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী শেষ বয়সে ব্রিটিশ সমান ইওরোপ সমান প্রগতিশীলতা এই সমীকরণ ভাঙতে চাইছিলেন(হরপ্রসাদ শাস্ত্রী রচনাবলী, ভূমিকা, প্রথম খন্ড)। সেটুকুও করতে পারেননি তাঁর বহু অনুগামী। এই মিথগুলিকে প্রশ্ন করার কর্তব্য পালন করতে হবে বর্তমান প্রজন্মকে। ইওরোপিয় জ্ঞাণচর্চার ধারা থেকে বেরিয়ে দেশিয় জ্ঞাণচর্চার পরম্পরা সম্বল করলেই এই কাজের ধারাবাহিকতা বইবে। অন্যতম হাতিয়ার হয়ে উঠতে পারে উইলিয়ম এডামের শিক্ষা সমীক্ষা।
বাঙলা কতটা সম্পদশালী ছিল সে তথ্যটা বাঙলায় একলাখ পাঠশালা খুঁজে বার করা এডামের সমীক্ষায় নেই। কিন্তু এডামের সমীক্ষা আলোচনার মুখপাতে এ বিষয়টি বোঝা জরুরি। কেননা এটি ভিত্তি করেই গড়ে উঠেছিল বাঙলার গ্রামকৌমের এক লাখ পাঠশালা ধারণের আর্থিক সামর্থ। বেঙ্গল টাইগার এন্ড ব্রিটিশ লায়ন, এন একাউন্ট অব দ্য বেঙ্গল ফেমিন ১৯৪৩, ৫৮ পাতায় রিচার্ড স্টিভেনসন ১৮৭০-৭১এর ২৪ পরগণা জেলার প্রশাসনিক আয় ব্যায়ের এক আপাত নির্দোষ হিসেব উপস্থিত করছেন।
আয়(পাউন্ডে)
খাজনা ১,৬৩,৭৩৬, অন্যান্য ৩,৬০২, আবগারি ১৫,৪৪০, কর আদায়(এসেস ট্যাক্সেস) ১০,৪০৮, স্টাম্প ৫৭,১৪১, ইন্টারেস্ট অন ল চার্জেস ২,৪৪৮, টোল, ফেরি থেকে আদায় ৪১,৮৯০, জেলের উতপাদন থেকে রোজগার ১৪,০৯৮, বিদ্যালয় বেতন ১১,৭১০ মোট আয় ৩,২১,৪৮৩
খরচ(পাউন্ডে)
কালেক্টর ৩,১৪১, আপতকালীন খরচ ২,০৮৩, গভর্মেন্ট এস্টেটস ২,৯৯৭, আবগারি ৭৩৪,
এসেসড ট্যক্সেস ১,৪৫৩, স্টাম্পস ১,৫২৪, কোর্ট ১০,৭৮৬, কমিশন ৫,৪২২, টোল আদায় ৫,৩০০ জেল লকআপ ১৩,১৩২, শিক্ষা ১৮,৩৪৩, পুলিশ ১৭,৪৭৯ মোট ব্যয় ৮৩,৫৭৩
সে বছরে ৪০০ শতাংশের কাছাকাছি উদ্বৃত্ত আয় ব্রিটিশ লব্জেই পশ্চাদপদ জেলায়(সে সময় ব্রিটিশ-উচ্চমধ্যবিত্ত-বাঙালি চক্রান্তে শিল্প-শিক্ষায়, ভারতবর্ষেরই ২৪ পরগণার দশা)। এই জেলায় শিল্প নেই। যেখানে কর বসিয়ে উদ্বৃত্ত অর্থ রোজগার হয়। অথচ এই জেলা থেকে ব্রিটিশ রাষ্ট্রের চতুর্গুণ রোজগার। কর গুনে ১১৩ বছর আগে পলাশি। সে সময় থেকে বাঙলার গ্রামসমাজ ক্লাইভ, হেস্টিংস, কর্নওয়ালিসের উত্তরাধিকারীদের লুঠেরা সময় দেখেছে। একে একে শিল্প পরিকাঠোমো ধংস দেখেছে। একলক্ষ পাঠশালার মৃত্যু দেখেছে। ছিয়াত্তরের মন্বন্তরে শিরদাঁড়া ভেঙে দেওয়া তিন কোটি মানুষের মৃত্যু উপত্যকা দেখেছে।

No comments: