Monday, September 11, 2017

বাংলা যখন বিশ্ব সেরা - পলাশীপূর্ব বাংলার কৃষি ও শিল্প৬

এ সময়ের বাংলার অন্যতম প্রধান শিল্প হল চিনি। বাংলা চিনি রপ্তানি করে প্রচুর অর্থ উপার্জন করত। পলাশীর আগের বছরের মোট উৎপাদিত চিনির পরিমান ছিল পাঁচ লক্ষ মণ। পলাশীর আগের দুদশকে চিনি রপ্তানি করে বাংলা মোট ষাট লক্ষ টাকা রোজগার করেছিল। স্ট্যাভোরিনাসের বাইতে বিশদে চিনি তৈরির বর্ননা আছে। কাঠের ঘানিতে পিষে আখের রস তৈরি হত। তারপর জ্বালিয়ে পরিস্রবন করে নানান পদ্ধতির মধ্যে দিয়ে গিয়ে চিনি তৈরি হত। তিনি সোরা, আফিম আর লাক্ষা তৈরির পদ্ধতিও দিয়েছেন। শীতের সময় গরমজল মাটির তলায় রেখে সহজে বরফ তৈরি করা হত(এই বর্ননা আকবরের সময়েও পাওয়া যায়। গরমতম এলাকা এলাহাবাদেও বরফ তৈরি করা হত, আকবর সোরা দিয়ে ঠাণ্ডা করা বরফযুক্ত শরবৎ খেতেন)।
বাংলার বিশাল উপকূল এলাকায় নুন তৈরি হত। বাংলার লবণ তৈরির এলাকাগুলি হল কাঁথি, হিজলি, তমলুক, সুন্দরবন, সন্দ্বীপ। লবণ উৎপাদনের জমির নাম জলপাই। এগুলিতে সমুদ্রের জল ওঠে। খালাড়ি বা খন্ডে ভাগ করে লবণ উৎপাদক মালঙ্গীদের বন্দোবস্ত দেওয়া হত। লবন থেকে শুধু রাজস্ব আসত পঁয়তাল্লিশ হাজার টাকা। মেদিনীপুর জেলায় চার হাজার খালাড়ি ছিল। লোনাজল জঙ্গলের কাঠ জ্বালিয়ে প্রচুর নুন উৎপাদন হত। দেশের চাহিদা মিতিয়ে ভূটান, অসম, কাশ্মীর, তিব্বত আর নেপালে রপ্তানি হত(গ্রান্টের এনালিসিস...)। বাংলার প্রথম একচেটিয়া ব্যবসার দখলদারি করা হল লবনের। সুপুরি তামাক আর আফিম খুব বড়ভাবে উৎপাদন হত বাংলায়। গুজরাটের যে বন্দর দিয়ে বাংলার সুপুরি রপ্তানি হত আরবে, সেই বন্দরটার নামই হয়ে গেল সোপারা।
রেনেলের জারনাল থেকে বাংলার খনিগুলির বর্ননা পাওয়া যাচ্ছে। বীরভূমে বেশ কিছু খনি ছিল। এগুলো থেকে লোহা তুলে পাশের কারখানাতে পাঠাতে হত। বীরভূমের ডেউচ্যা, মহম্মদবাজার, দামড়া এবং মল্লারপুরে লোহার কারখানাগুলি গড়ে উঠেছিল। কৃষ্ণনগরেও নাকি লোহার খনি ছিল। বীরভূমির মল্লরাজারা স্থানীয় কারিগরদের দিয়ে এই লোহাচুর ব্যবহার করে জং ছাড়া অস্ত্রশস্ত্র বানাতেন। বিষ্ণুপুরের দলমাদল বা মদনমোহন বা গোপাল সিংহের বাবা রঘুনাথ সিংহের তরবারি সেই সাক্ষ্য দিচ্ছে আজও। আজও পশ্চিম জং ছাড়া লোহা বানাতে পারে না। মীর কাশেম মুঙ্গেরে অস্ত্র কারখানা বানিয়েছিলেন। আজকের মতই বহু শত বছর ধরে মুঙ্গের ভাগলপুর দেশি অস্ত্রশস্ত্রের কারখানা ছিল। কোম্পানির কাগজপত্রে দেখি কলকাতা আর কাশিমবাজারে ভারি কামান টানার গাড়ি তৈরি হত।
যদিও যদুনাথ সরকার ব্রিটিশ বা সোভিয়েত ঐতিহাসিকদের অনুসরণে মোগল সাম্রাজ্যকে সামরিক সাম্রাজ্য বলে দাগিয়ে দিয়েছেন, কিন্তু নতুন সময়ের ঐতিহাসিক ফরমেশন অব কলোনিয়াল স্টেট ইন ইন্ডিয়া বইতে হাইডেন বেলেনয় বলছেন অন্যকথা মুঘল সাম্রাজ্য ছিল আসলে কেন্দ্রিভূত প্রশাসনিক অর্থে কাগজ নির্ভর সাম্রাজ্য। এটা সত্য ছিল মুঘল আমলের আগে সুলতানি আমল থেকেই যখন বাংলা বাণিজ্যে সারা বিশ্বে একচ্ছত্র বাণিজ্য করছে। তো, বাংলার কাগজ বাংলাতেই তৈরি করা হত নবাবী আমলেও। যারা কাগজ তৈরি করতেন তাদের নাম কাগজী ছিল। তাদের অবস্থা বেশ স্বচ্ছল ছিল অন্যান্য কারিগরের মতই। অন্যান্য গ্রামীন উৎপাদনের মতই কাগজ বানাতে খুব বেশি পুঁজিপাটা লাগত না। আমাদের নিজস্ব পাটের আঁশ, চুন আর জলই সেগুলি কাগজীদের দক্ষতায় কাগজে রূপান্তরিত হত। মন্টগোমারি মার্টিন ইস্টার্ন ইন্ডিয়া গ্রন্থে বলছেন, চুনের জনে ভেজানো পাটের মণ্ড ঢেঁকিতে কুটে, বাঁশের ছাঁদে ফেলে, রোদে শুকিয়ে কাগজ বানানো হত। বাংলার কাগজ ভারতের প্রভূত জায়গায় রপ্তানি হত। ব্রিটিশ আমলেও বাংলার কাজগ বিভিন্ন প্রেসিডেন্সিতে যেত। ব্রিটিশ কাগজ এদেশে চালাতে এই বিপুল লাভজনক শিল্পটাকেই গায়ের জোরে মেরে ফেলা হল।
বাংলার বিপুল অকৃষি উৎপাদন শিল্পের কথা প্রচুর বিদেশি বণিক এবং বিভিন্ন কোম্পানির সমীক্ষায় পাওয়া যায়। সেই সময়ের সাহিত্যেও তা ভুরি ভুরি মেলে। মূলত সোনা রূপো, হাতির দাঁত, শাঁখার কাজ, পিতল ও ভরণের কাজ, লোহা ও কাঠ ইত্যাদির কাজের জন্য বাংলা মাহির ছিল। কারিগরেরা বংশ পরম্পরায় উৎপাদন বিতরণের কাজে যুক্ত থাকতেন। মুর্শিদাবাদ, বাঁকুড়া, বীরভূম, নদিয়া পিতল কাঁসার জন্য বিখ্যাত ছিল। রসিকলাল সেনের মহারাজ রাজবল্লভ বইতে পাচ্ছি নওয়াজেস মহম্মদের দেওয়ান রাজবল্লভ ঢাকার রাজনগরে বহু কারিগর বসিয়েছিলেন। রাজনগরের পিতল কাঁসার বাসন, লোহার দ্রব্যাদি, মাটির দ্রব্য আর অবশ্যই সুতি বস্ত্রের জন্য ঢাকা একসময় প্রখ্যাত ছিল। মুর্শিদাবাদের হাতির দাঁতের কাজের বিবরণ পাত গুরুসদয় দত্ত বা অন্যান্যদের লেখা থেকে। হাতির দাঁতের পাটি দেখেছি ব্রহ্মপুত্রের বদ্বীপ মাজুলির এক সত্রতে। হাতর দাঁতের শুধু শৌখিন দ্রব্য তৈরি হত না, যুদ্ধাস্ত্রের বাঁটও হত। বিষ্ণুপুর আর ঢাকা ছিল শাঁখ কারিগরদের ঘাঁটি। সারা ভারতে এই দুই শহর শাঁখের কারিগর সরবরাহ করত।
বাংলা ছিল নবাবী নৌবহরের ঘাঁটি। চট্টগ্রাম, হুগলির বলাগড় সারা বিশ্বের নৌবহর তৈরি করত। করম আলি ‘মুজফর নামা’য় বাংলার নৌকোর উল্লেখ আছে বা ১৭৯১ সালে সলভিনসের আঁকায় চল্লিশটার কাছাকাছি নৌকো আর বজরার ছবি পাচ্ছি। বজরা, ময়ূরপঙ্খী, খোসখান, পালবারা, সেরিঙ্গা, স্লুপ ইত্যাদি নামের নৌকোর নাম পাওয়া যায় সমসাময়িক সাহিত্যে। সামরিক প্রয়োজনে দ্রুততম নৌকো প্রস্তুত করতে পারতেন। পাটনা সরবরাহ করত সোরা। সে সময়ের সারা বিশ্বে সোরার মূল সরবরাহকারী ছিল পাটনাম সরকার সারণ। সেটা বাংলার সোরা নামেই সারা বিশ্বে যেত।
প্রাচীনকাল থেকেই বাংলার আরেকটা বড় রপ্তানি দ্রব্য ছিল হাতি – বাংলার হাতি যুদ্ধের জন্য বিশেষভাবে প্রশিক্ষিত। যদুনাথ সরকারের আহকমিআলমগিরিতে এরকম দুটি হাতির বর্ণনা পাচ্ছি। আগেই লিখেছি শ্রীহট্টের সুসঙ্গের জমিদারেরা মুঘল আর নবাবদের হাতি সরবরাহ করতেন, সে বাবদে তারা ৪৫ হাজার টাকা রাজস্ব ছাড় পেতেন। হাত পোষ মানানো খুব পুরোনো বিদ্যা ছিল বাঙালির। হরপ্রসাদ শাস্ত্রী লিখছেন প্রাচীন কালে পালকাপ্য নামে একজন ঋষি হাতি পোষ মানাবার শাস্ত্র তৈরি করেন।
লাইকআরও প্রতিক্রিয়া প্রদর্শন করুন
মন্তব্য করুন
9টি মন্তব্য
মন্তব্যগুলি
Rafiqul Haq Akhand বৃহত্তর ময়মনসিংহ জেলার একটি থানার একটি গ্রামনাম কাগজী | এর আশেপাশে তৈরি হত পণির, যা ঈস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি 'ঢাকা চীজ' নামে বিভিন্ন দেশে রপ্তানি করত | আর শুধু মোগল আমল নয়, ইংরেজ আমলেও সিলেট থেকে প...আরও দেখুন
লাইকআরও প্রতিক্রিয়া প্রদর্শন করুন
প্রত্যুত্তর
6
গতকাল 08:23 AM-এসম্পাদনা করা হয়েছে
পরিচালনা করুন
Biswendu Nanda অনেক কিছু তাড়াহুড়োতে লিখতে ভুলে গিয়েছি - ঢাকা চিজের মত হুগলিতে ছিল ব্যান্ডেল চিজ, যা আজও পাওয়া যায়।
লাইকআরও প্রতিক্রিয়া প্রদর্শন করুন
প্রত্যুত্তর
5
গতকাল 08:20 AM-এ
পরিচালনা করুন
H.M. Iftekhar Alam Rajib এটা বলা কি অত্যুক্তি হবে যে ব্রিট্রিশ অর্থনীতি তৈরি হয়েছে বাংলার টাকায়। আর ফলে ব্রাইটনদের তৈরি সকল কলোনীর উত্থানের মূলেও এই বাংলাই টাকা।
লাইকআরও প্রতিক্রিয়া প্রদর্শন করুন
প্রত্যুত্তর
1
গতকাল 08:48 AM-এ
পরিচালনা করুন
Hasan Santu British first populated colony was bangla
1762 te deuani laver por just 10 bochore steam engine abishkar
Bengle army die all India dokhol nea possible hoichilo
অনুবাদ দেখুন
লাইকআরও প্রতিক্রিয়া প্রদর্শন করুন
প্রত্যুত্তর
1
10 ঘণ্টাসম্পাদনা করা হয়েছে
পরিচালনা করুন
Amirun Nahin Biswendu Nanda দাদা এ নিয়ে বই লিখুন।
লাইকআরও প্রতিক্রিয়া প্রদর্শন করুন
প্রত্যুত্তর
1
21 ঘণ্টা
পরিচালনা করুন
Soumen Ray খুব ভালো পোস্ট।
লাইকআরও প্রতিক্রিয়া প্রদর্শন করুন
প্রত্যুত্তর14 ঘণ্টা
পরিচালনা করুন
Subhadip Bagchi একটা প্রশ্ন বীরভূমের এই লৌহ আকরিক এখন উত্পাদন সম্ভব কি ?এই বিষয়ে গত global bengal summit এ মমতা একটা চুক্তি সাক্ষর করেছেন ।এছাড়া পাল যুগে বাংলাতে সোনার খনির ও উল্লেখ পাওয়া যায় আজ যা বিস্মৃত ।biswendu বাবু একটু আলোকপাত করলে ভালো হয় ।
লাইকআরও প্রতিক্রিয়া প্রদর্শন করুন
প্রত্যুত্তর
1
11 ঘণ্টাসম্পাদনা করা হয়েছে
পরিচালনা করুন
Biswendu Nanda আপনি যে প্রশ্ন করেছেন, সে বিষয়ে আমাদের বলার যোগ্যতা নেই। ভূতত্ত্ববিদেরা বলতে পারবেন। 
কিন্তু কাজ করতে গিয়ে যতিটুকু বুঝেছি কর্পোরেট লোহা-ইস্পাত উৎপাদন ব্যবস্থা, তার প্রযুক্তি, এগুলি এতই পুঁজি নিবিড় যে যারা পুঁজি বিনিয়োগ করেন, তারা যদি মনে করেন এই বিনিয়ো
...আরও দেখুন
লাইকআরও প্রতিক্রিয়া প্রদর্শন করুন
প্রত্যুত্তর
1
10 ঘণ্টা
পরিচালনা করুন
Arindam Roy বাহ্ । আপনার থেকে প্রচুর জানতে পারি। ধন্যবাদ আপনাকে।
লাইকআরও প্রতিক্রিয়া প্রদর্শন করুন
প্রত্যুত্তর
1
10 ঘণ্টা
পরিচালনা করুন
Avik Satpati north bengal e potato chips er factory kara jay..............as like pran patato cracker in punjab

No comments: