Saturday, September 16, 2017

বাংলা যখন বিশ্ব সেরা - পলাশীপূর্ব বাংলার শিক্ষা ও শিক্ষা ব্যবস্থা১২

(তাত্ত্বিক অবস্থান)

যদুনাথ সরকার থেকে নরেন্দ্র কৃষ্ণ সিংহর মত বহু ঐতিহাসিকই হাহুতাশ করেছেন কেন মোঘল সাম্রাজ্য এবং আমাদের আলোচ্য নবাবী সাম্রাজ্য নানান জনকল্যাণমূলক কাজে হাত লাগায় নি। সোজা কথা সোজাভাবেই বলা যাক, জাতিরাষ্ট্রবাদী রাষ্ট্র ব্যবস্থা ইওরোপের দান। এর আগে কোন সরকারই গায়ে পড়ে গ্রাম সমাজের উপকার করতে যায় নি। ইওরোপ সর্বপ্রথম তার গ্রামকে উপনিবেশে পরিণত করে তাকে তিলে তিলে লুঠ, খুন, অত্যাচার এবং সব শেষে হত্যা করে। কৃষক, পশুচারক, বনবাসী এরা ইওরোপিয় কর্পোরেট লুঠের সম্পদ আহরণের প্রথম শিকার ছিল। এই দেশিয় লুঠকে ঢাকতে তাকে একটা জনকল্যাণের ভাল করার মুখোশ পরতে হয়েছিল – যার নাম জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্র ব্যবস্থা।

সেই মুখোশ পরার কোন দায় ছিল না মুঘল রাষ্ট্রের। রাষ্ট্রবাদী যদুনাথ সরকারের মুঘল এডমিনিস্ট্রেশনে পাচ্ছি, মুঘলদের রাষ্ট্রীয় নীতি ছিল কারিগর আর কৃষকদের ওপর যে কোন অত্যাচার রোধ করা। তাই নবাবি আমলে কৃষক, কারিগরদের ওপর অত্যাচারে জমিদার শাস্তি পেয়েছে, বিশেষ করে মুর্শিদকুলি আর আলিওবর্দি আর সিরাজের সময় এটা তাথ্যিক নথিকরণ রয়েছে। ফলে তাকে জুতো মেরেও গরু দান করতে হয় নি। বহুকাল ধরে ভারত জুড়ে রাষ্ট্রীয় ভাবে সমাজগুলো নিয়ন্ত্রণ/দখলদারি না করার যে নীতি গড়ে উঠেছিল, সুলতানি, মুঘল এবং নবাবি আমলে তার কোন ব্যত্যয় হয় নি। গ্রাম সমাজ তার মত করে স্বতন্ত্রভাবে গড়ে উঠেছিল। রাজা, সম্রাট, সুলতান, নবাব জনগণের থেকে বার্ষিক রাজস্ব নিয়েই তার দায় শেষ বলে মনে করত। এই জন্য কারিগর, তাঁতি, অভিকর শিল্পী সক্কলে তাদের নিজেদের মত করে বিকাশ ঘটাতে পেরেছিল। আমরা এডামের সমীক্ষায় দেখেছি এক্কেবারে রাষ্ট্রীয় উদ্যম ছাড়াই তাঁরা গোটা বাংলা সুবা ত্রিহুত থেকে নাটোর পর্যন্ত দেড়লক্ষ গ্রামে ১ লক্ষ বিদ্যালয় চালাত, স্থানীয় প্রয়োজনের দিকে লক্ষ রেখেই।

ঠিক এর আগে অবশ্যই রাষ্ট্রীয় প্রণোদনায় গড়ে উঠেছিল বিশালকায় বৌদ্ধ শিক্ষা ব্যবস্থা। বিশাল বিশাল বৌদ্ধ মঠে আয়োজিত হত বিস্তৃত পাঠ কেন্দ্র। ভারত, জাপান, চিন, তিব্বত জুড়ে গড়ে উঠল এক লক্ষ দেড় লক্ষ বৌদ্ধ সমাবেশের প্রকাণ্ড প্রকাণ্ড মঠ, বিদ্যালয় গড়ে উঠেছিল। কিন্তু এক শতকের মধ্যেই বাইরের চাপে পড়ে সেই বিপুল ব্যবস্থা ভেঙ্গে গেল। জনমানসে তার অস্তিত্বটুকুও রইল না, সেগুলিকে আজ খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে প্রত্নতাত্ত্বিক খননে।

বিপরীতে দেখুন আমাদের ধারণা, এডাম যে শিক্ষা ব্যবস্থার বর্ণনা দিয়েছেন, যে শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে শিক্ষিতরা হাত দেন নি –কেননা তা হলে ঔপনিবেশের সরবরাহ করা উদ্দেশ্যপূর্ণ নানান তথ্য, তত্ত্ব, উপাত্ত, সামাজিক বিশ্লেষণ তাসের প্রাসাদের মত হুড়মুড়িয়ে ভেঙ্গে পড়বে - সেই সুপ্রাচীন শিক্ষা ব্যবস্থাটি কিন্তু জনগণেশের দানে, সক্রিয় ব্যবস্থাপনায় বহুকাল টিকে ছিল, যতক্ষণনা, ইওরোপিয় কর্পোরেট শক্তি তার পোষিত জাতিরাষ্ট্র ব্যবস্থাকে ব্যবহার করে তার লুঠ, খুন, অত্যাচারের দখলদারির তত্ত্ব – এটা মানে প্রগতি আর এটা মানে পিছিয়ে পড়া - সমাজের ওপর বলপ্রয়োগ করে চাপিয়ে দেয় নি।

এখানে আরেকটা জরুরি কথা বলে নেওয়া দরকার, বাংলা জুড়ে প্রথাগত শিক্ষা ব্যবস্থার একটা কাঠামো তৈরি করা হয়েছিল তো বটেই সমাজের প্রয়োজনে, তার মানে এই নয়, এর বাইরে জ্ঞানচর্চার বিন্দুমাত্র উদ্যমের অস্তিত্ব ছিল না। বিপুল, বিশাল, কারিগর, অভিকর শিল্পীরা তাদের জ্ঞানচর্চা, প্রযুক্তি চর্চা, শিল্প চর্চা করতে সামাজিক/পারিবারিক জ্ঞানের সর্ব্যব্যাপী অস্তিত্বের পরিবেশের মধ্যে। তাই পরম্পরার বিদ্যালয়গুলি উঠে গেলেও গ্রামে জ্ঞানের, প্রজ্ঞার, শিক্ষার এবং এগুলি ব্যবহার করে দক্ষতা অর্জনের পরিবেশের ঘাটতি আজও নেই। ঠিক এই কাঠামোর ওপর নির্ভর করে দাঁড়িয়ে আছে বাংলার কারিগর কৃষ্টি-আর্থব্যবস্থ্যা।

No comments: