Tuesday, September 19, 2017

বাংলা যখন বিশ্ব সেরা - পলাশী পূর্ব কিছু ইওরোপিয় মিথ-মিথ্যে১

কয়েকদিন ধরে যে তথ্যগুলি আলোচনা করলাম সেগুলির অধিকাংশই ব্রিটিশ, ফরাসি, ডাচেদের দিনপঞ্জী, স্মৃতিকথা, জারনাল, সমীক্ষা ইত্যাদি থেকে নেওয়া হয়েছে। ডাওকে বাদ দিলে হলওয়েল, স্কট ইত্যাদি প্রমান করতে চেষ্টা করেছেন পলাশীর চক্রান্ত(যদিও অনেকে একে যুদ্ধ বলতে উৎসাহী) দেশের অধিকাংশ মানুষের জীবনে আশীর্বাদ স্বরূপ। ইসলাম লুঠেরা এবং ইসলামের নামে যারা রাজত্ব করছিল তারা অত্যাচারী। হিন্দুরা মুসলমান শাসনে বিরক্ত হয়ে মুক্তির পথ খুঁজছিল। মুসলমান শাসনে তাদের বিন্দুমাত্র আস্থা ছিল না। এমন কি যদুনাথ সরকারও হিস্ট্রি অব বেঙ্গলএর দ্বিতীয় অংশে প্রমান করেছেন পলাশীর চক্রান্ত মধ্যযুগের অন্ত আর নতুন যুগের সূচনা বিন্দু। শুধু হিন্দুরাই নয়, মুসলমানেরাও পলাশি চাইছিলেন।

এর আগেও বলার চেষ্টা করেছি, জমিদারি বা নবাবী আমলের নানান তথ্য নিয়ে যে সব ঐতিহাসিক কাজ করেছেন এবং তাঁদের তত্ত্ব প্রমান করতে চেষ্টা করেছেন, সেই তথ্যগুলো তারা আহরণ করেছিলেন ওরমে, হলওয়েল, ওয়াটস, স্ক্রাফটন ইত্যাদি সাম্রাজ্যবাদী লেখকদের রচনা থেকে। এরা উদ্দেশ্যমূলকভাবে মিথ তৈরি করার চেষ্টা করেছেন এমনভাবে যাতে ব্রিটিশলুঠের নানান তথ্য ঢাকা পড়ে যেতে পারে।

এই মিথগুলি হল-
১) নবাবী আমলে মুর্শিদকুলি থেকে সিরাজ পর্যন্ত বাংলায় আইনের শাসন ছিল না। নবাবেরা অত্যাচার করতেন।
২) নবাবেরা জোর জবরদস্তি করে অর্থ আদায় করতেন।
আর
৩) হিন্দুদের ওপর নির্যাতন হত।

প্রথম মিথটি ধরা যাক, বাংলায় আইনের শাসন ছিল না। বাংলায় যা চলছিল তার নাম একচ্ছত্র আধিপত্যের নৃসংশতা। সমসাময়িক ঐতিহাসিক সালিমুল্লা, গোলাম হুসেন, করম আলি, সালিন য়ুসুফ আলি সকলের সাক্ষ্য থেকে প্রমান মুর্শিদকুলির সময়ে দেশে শান্তি ফিরিয়ে নিয়ে এসেছিলেন। উপদ্রুত এলাকায় থানা বসিয়ে তাঁর বিশ্বস্ত কর্মচারী মহম্মদ জানকে চোর দাকাতদের শায়েস্তা করার নির্দেশ দিয়েছিলেন। বাংলার জমিদারেরা রাস্তাঘাট ও নদীপথে যাতায়াত ও নিরাপদে পণ্য পাঠাতে পারতেন। মার্সাল এক ইংরেজের সাক্ষ্য উল্লেখ করে বলছেন, এই সময়ে(১৭৫৩/১১৬০) বাংলার বণিকেরা পিওনের হাতে দেশের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে সোনা রূপো পাঠাতেন। সুজার কাজ সম্পর্কে ছিয়াত্তরের পরের শাসক জন শোর পঞ্চমুখ, তাঁর প্রশাসন জনগণের সুবিধের জন্য কাজ করে যেত। গোলাম হোসেন বলছেন দরিদ্রতম বিচারপ্রার্থী তাঁকে নজেকে নবাবপুত্রের মত ভাবত। কাজপাখী তাড়িত ভীত চড়ুই তাঁর বুকের আশ্রয়ে ছুটে যেত। যদিও মুর্শিদিকুলির বজ্র ফাঁস থেকে সুজার সময়ে জমিদারেরা কিছুটা রেহাই পেয়েছিলেন, কোন প্রজার অত্যাচারের কাহিনীতে মুর্শিদকুলি জমিদারদের ওপর শাস্তির খাঁরা নামিয়ে এনেছেন এমন উদাহরণ আগেই দিয়েছি। মারাঠা বর্গীরদের আক্রমনে বাংলায় অরাজকতা দেখা দিয়েছিল। কিন্তু আলিবর্দী তাঁর মত করে চেষ্টা করে গিয়েছেন রাজ্যে শান্তি ফেরাবার।

দ্বিতীয় মিথ হল নবাবেরা অত্যাচারী, ব্যক্তিগত স্বার্থে জোর জবরদস্তি করে টাকা আদায় করতেন। এর আগে আমরা যে আর্থব্যবস্থার আলোচনা করেছি তাতে এই অভিযোগ অসত্য বলে সহজেই উড়িয়ে দেওয়া যায়। মুর্শিদকুলি রাজস্ব আদায়ে খুব কঠোর ছিলেন এবং প্রজাদের ওপর অত্যাচারের অভিযোগ বিষয়েও খুব কঠোর ছিলেন। আওরঙ্গজেবের আর্থিক দুরবস্থা লাঘবে এবং রাজত্বে আর্থিক শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে তাকে কঠোর সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে। সলিমুল্লার অতিরঞ্জিত বর্ণনা থেকে ইংরেজরা ঘটনা তুলে এই তথ্য প্রমানের চেষ্টা করছেন, কিন্তু তার সারা জীবনের সঞ্চয় তার পূর্বের সুবাদারদের থেকে কম। সবরকম বেআইনি কর রদ করেছিলেন। রাজত্বের কোষাগার উদ্বৃত্ত হওয়া তার সময় থেকেই শুরু হয়েছে।

ইংরেজদের গায়ের জ্বালা হচ্ছে তাদের থেকে মুর্শিদকুলি টাকা তুলতেন। আদতে মনে রাখতে হবে ইংরেজরা দিল্লিশ্বরকে মাত্র তিন হাজার টাকা দিয়ে বাংলাড় বিনা শুল্কে বাণিজ্য করার ছাড়পত্র আদায় করেছিলেন। বড় আমলারা বুক্তিগত বাণিজ্য করার জন্য রাষ্ট্রকে একটা পয়সা কর দিত না। এছাড়াও তারা বিভিন্ন বাণিকদের কাছে দস্তক বিক্রি করে নবাবের রাজস্ব ফাঁকি দিত। ওলান্দাজ আর ফরাসীরা আড়াই শতাংশ হারে বাণিজ্য শুল্ক দিত। কিন্তুয় ইংরেজেরা প্রায় কিছু না দিয়েই বাণিজ্য করত। হিসেবে দেখা গিয়েছে মুর্শিদিকুলি ইংরেজদের কাছ থেকে যে টাকা উশুল করেছিলেন, সেটা তাদের মোট বাণিজ্যের দুই শতাংশের কাছাকাছি। অবশ্যি সুজা আর আলিবর্দি বাংলার রাজস্বে অতিরিক্ত আবওয়াব বসিয়েছিলেন। ১৭২২/১১২৯এর রাজস্ব বন্দোবস্তের পর আর বাংলার রাজস্ব বাড়ে নি। কিন্তু লোকবল আর চাষবাস আর বাণিজ্য বাড়ছিল। ফলে রাজস্ব কিছু যা বেড়েছিল তা সমাজের আত্তীকরণ করার পক্ষে যথেষ্ট ছিল। ভেরলেস্ট লিখছেন এ সময়ে কৃষক স্বচ্ছন্দ, কারিগর উৎসাহিত, বণিক ধনশালী আর শাসক সন্তুষ্ট।

No comments: