Friday, September 15, 2017

বাংলা যখন বিশ্ব সেরা - পলাশীপূর্ব বাংলার শিক্ষা ও শিক্ষা ব্যবস্থা৬

শিক্ষা পরিকাঠামো
গ্রামে পাঠশালার জন্য আলাদা ঘর ছিল না। যে স্থানে পড়ুয়েরা পাঠ নিত সেই স্থানটি নানান সময়ে নানান কাজে ব্যবহৃত হত। কেউ চন্ডিমন্ডপেই পাঠদিতেন। পাঠগ্রহণ ছাড়াও সেখানে সারা বছর নানান ধরনের পুজো, পার্বন ও অনুষ্ঠান হত। কোথাও কোথাও গ্রামের আড্ডার জন্য নির্দিষ্ট বৈঠকখানায়ও এই পাঠশালা আয়োজিত হত। কোনো কোনো পৃষ্ঠপোষক আবার নিজের বাসস্থানের এক অংশ ছেড়ে দিতেন পাঠশালের জন্য। ৩০-৪০পড়ুয়ের জন্য যে সব পাঠশাল, সেগুলো বছরের শুকনো সময়ে খোলা যায়গায় আর বর্যার সময় তিন চারটি অস্থায়ী পাতায় ছাওয়া কুঁড়ে ঘরে হত। বর্যায় পড়ুয়েদের পাততাড়ি্ গুটেতে হত।

গুরুমশাই তাঁর স্মৃতি থেকে আবৃত্তি করে পাঠদান করতেন। পাঠশাল শেষ হত স্বরস্বতী বন্দনা দিয়ে। একজন নেতা পোড়ো বন্দনা আবৃত্তি করত। পড়ুয়েদের ভুঁইএ মাথা ঠেকিয়ে বন্দনার একটার পর একটা স্তবক আবৃত্তি করতে হত যাতে এই বন্দনাটি তাদের স্মরণে থাকে। ছড়ায় শুভঙ্করী(এডামের ভাষায় ককার অব বেঙ্গল)ও শেখানো হত। ছাপার হরফে পুস্তকের চল গ্রামাঞ্চলে ছিল না। কিছু কিছু ছাপাই পঞ্জিকা(এলম্যনাক) অবস্থাপন্ন পরিবারের গৃহস্থরা কলকাতা থেকে কিনে নিয়ে যেতেন। কোনও গুরুমশাই ছাপার বই দেখেননি। এডাম এদের স্কুল বুক সোসাইটির প্রকাশনায় পুস্তক দেখান। গুরুমশাইরা এগুলো খুবেশি গুরুত্ব দেননি। তিনি লিখেছেন সোসাইটি বইগুলি বিক্রির জন্য বাউলিয়ায় একজন দালাল ঠিক করেছে।

বাঙলা মাধ্যমে শিক্ষাদানের চারটি স্তর ছিল। প্রথম পর্বে মাটিতে বাঁশের বাঁখারি বা লাঠি দিয়ে আঁক কেটে অক্ষর শেখানো হত। জেলায় সাধারণতঃ অর্থ সাশ্রয়ের জন্য বালির বেদি ব্যবহার হত। এই পর্ব দশ দিনের বেশি চলত না। দ্বিতীয় পর্বে তালপাতার ওপর লেখা আর অক্ষরের উচ্চারণ শেখানো হত। এসময় অক্ষরগুলোর মাপ শেখানো হত না। এই পর্ব চলত দুবছর থেকে চার বছর পর্যন্ত। এ সময় যুক্তাক্ষর, স্বরভক্তি(syllables formed by the junction of vowels with consonants), সাধারণ স্থান নাম, ব্যক্তির নামও শেখানো হত। অন্য গ্রামগুলিতে জাতি, নদী, পর্বত ইত্যাদের নামও শেখানো হত। কড়ি আর শতকিয়াও শেখানো হত। কাঠা(জমির মাপ) তালিকা, সের তালিকা(ওজনের মাপ)ও শেখানো হত। তৃতীয় স্তরও দুই থেকে তিন সপ্তাহ। এ সময় প্ল্যানটোন পাতা(কলাগাছের পাতা!) দিয়ে শব্দ দিয়ে সরল বাক্য শেখানো হত। শব্দের কথ্য আর লেখন পার্থক্যও মুখে শেখানো হত(abbreviated in speech by the omission of a vowel or a consonant, or by the running of two syllables into one)। এই শেখাকে লিখতেও শেখানো হত। correct orthography of words of Sanscrit origin which abound in the language of the people। এই সময়ে পড়ুয়েদের শেখানো হত সরল অঙ্ক, যোগ-বিয়োগ। কিন্ত গুণ আর ভাগ আলাদা আলাদা করে শেখানো হত না। গুনের নামতা ২০ অবদি মুখস্থ করতে হত। রোজ পাঠশালা শুরু হওয়ার পরই এই নামতা পড়ানো হত।

সাধারণ অঙ্ক শেখার পর কৃষি আর সাধারণ বাণিজ্যের অঙ্কও শেখানো হত। কৃষিতে বা বাণিজ্যে জমা-খরচের খাতা কীভাবে রাখতে হয়, তাও শেখানো হত। দৈনিক মজুরির হার থেকে মাসিক অথবা বার্ষিক মজুরির হার বার করতে হত। কাঠা আর বিঘার মধ্যেকার সম্পর্কও অঙ্ক কষে বার করতে হত। দৈর্ঘ, প্রস্থ দেওয়া থাকলে একটি জমির সাধারণ ক্ষেত্রফল কী হবে তাও জানতে হত। একটি নির্দিষ্ট পরিমান জমি থেকে কত খাজনা দেয় হয় তাও জানতে হত পড়ুয়েদের। খাতা রাখার সাধারণ হিসেবও শিখতে হত পড়ুয়েদের। শেখানো হত সের মনএর মধ্যেকার আর তোলা আর ছটাক সম্পর্কও। কষতে হত প্রত্যেক টাকায় আনা আর কড়ির সংখ্যাও। এক টাকার ওপরে সুদও কষা শেখাতেন গুরুমশাইরা। একটাকার কমের মুদ্রামানের বিনিময় মূল্য – বাটাও শেখানোর ব্যবস্থা ছিল। চতুর্থ বা শেষস্তর দুই বা তিন বছরের মধ্যে শেষ হত। এই পর্বে ব্যবসার পদ্ধতি, ব্যবসার চিঠি, দান, লিজ, একসেপটেন্স, হাতচিটা ইত্যাদি শেখানো হত। এক বছরের মধ্যে যে পড়ুয়ে নিজে নিজেই এ সমস্ত লিখতে পারত তাকেই কৃতকার্য রূপে ধরে নেওয়া হত। এছাড়াও রামায়ণ এবং মনসামঙ্গলের নানান ছত্রও আবৃত্তি করত পড়ুয়েরা।

এডামের সমীক্ষা অনুসারে বাংলায় তিন ধরণের উচ্চশিক্ষার পাঠশালা ছিল। কোথাও ব্যকরণ, অলঙ্কার, আর কোথাও কোথাও পৌরাণিক কাব্যও পড়ানো হত। দ্বিতীয়গুলিতে স্মৃতি আর কিছুটা পৌরাণিক কাব্য পড়ানো হত। তৃতীয় উচ্চ পাঠশালাগুলি লজিককে কেন্দ্র করে গড়ে উঠত। এই তিনধরণের বিদ্যালয়ে নির্দিষ্ট কিছু পাঠ্য পড়ানো হত। গুরুমশাই কিন্তু এই সব পাঠদান কেন্দ্রে দীর্ঘ বক্তৃতা দিতেন না। পাঠশালাগুলিতে ছাত্ররা নানান প্রশ্ন করত আর গুরুমশাই তার উত্তর দিতেন। প্রত্যেক শ্রেণীকক্ষে নির্দষ্ট মানের ছাত্র পাঠগ্রহণের ক্ষমতা অনুযায়ী আলাদা আলাদা বসত। সামনে পুঁথি খুলে সবথেকে ভাল পড়তে পারা ছাত্রটি সশব্দে পাঠগুলি উচ্চারণ করত, গুরুমশাই তার উত্তর দিতেন। এই ভাবে পড়াশোনা এগোত। সাধারণ ব্যকরণ শিখতে দুই থেকে ছয় বছর পর্যন্ত সময় লাগত। পাণিনী শিখতে নিদেন পক্ষে লাগত দশ বছর কখোনো আবার বারো বছরও। ব্যকরণ শেখার পর কাব্য, মীমাংসা আর দর্শণও পাঠ নিতে পারত। যে সব ছাত্র ন্যায় অথবা মিমাংসা পড়ত তাদের সময় লাগত ছবছর পর্যন্ত। এমনকী তাকে অন্য বিদ্যালয়েও যেতে হত। এডাম বলছেন একলাখ ব্রাহ্মণের মধ্যে এক হাজারমাত্র সংস্কৃত ব্যকরণ শিখতেন, এদের মধ্যে চারশ থেকে পাঁচশ কাব্য পড়তেন, পঞ্চাশ জন হয়ত অলঙ্কার শাস্ত্রে পন্ডিত ছিলেন। এই হাজারের মধ্যে শচারেক স্মৃতির পাঠোদ্ধার করতে পারতেন। এদের মধ্যে মাত্র জনা দশেক তন্ত্র সম্বন্ধে বিশারদ ছিলেন। ন্যায় বিশারদ ছিলেন শতিনেক, পাঁচ থেকে ছজন শুধু মিমাংসা, বেদান্ত, পতঞ্জলি, বৈশেষিক অথবা বেদ পড়াতে পারতেন। দশজন জ্যোতির্বিদ্যায় পারদর্শী ছিলেন। পঞ্চাশ জনের কাছাকাছি শ্রীভাগবত বা পুরাণ মুখস্থ করতেন।

No comments: