Thursday, September 21, 2017

বাংলা সকলের মহাজন - লুঠ, খুন অত্যাচারী শাসনের সম্পদ১০

ধংস-লুঠের বয়ান
সৈদাবাদে জগৈই ও ছিদাম নামে দুই সহোদর ছিল. ...ইহারা নিতান্তই গরীব ছিল...ছিদাম খেতের আলুপটল ইত্যাদি তরকারি বাজারে বিক্রয় করিত...কিছুকালপরে সে ইংরাজদিগের রেশমের কুঠিতে দালালি আরম্ভ করিল। ইংরাজদিগের কাশিমবাজারের রেশমের কুঠির এ্যাসিস্টান্ট ওয়ারেন হেস্টিংস ছিদামকে বিশেষ কার্যদক্ষ মনে করিয়া তাহাকে রেশমের কুঠির প্যাদার কার্যে নিযুক্ত করিল....ছিদাম রেশমের কুঠির প্যাদার কার্যে নিযুক্ত হইয়া অত্যল্পকাল মধ্যেই হেস্টিংস সাহেবের প্রিয়পাত্র হইয়া উঠিল। এই সময়ের রেশমের কুঠির প্যাদাদিগেরও বিলক্ষণ দশ টাকা আয় হইত। ....ছিদামের বিবাহের সাতআট বত্সর পরে মেস্তর উইলিয়ম বোল্টস সাহেব কাশিমবাজারের ফ্যাক্টরের(কুঠির প্রধান অধ্যক্ষের) কার্যে নিযুক্ত হইয়া আসিলেন। ইনি বাঙালিদিগের রক্ত শোষণ করিয়া কয়েক বত্সরে প্রায় বিরানব্বই লক্ষ টাকা উপার্জন করিয়া ছিলেন। পরে আবার কলিকাতাস্থ মেয়রের কোর্টের জজের পদেও নিযুক্ত হইয়াছিলেন। ছিদামের কর্ম তত্পরতা দেখিয়া উইলিয়ম বোল্টস সাহেব বড় সম্তুষ্ট হইলেন। তিনি মনে মনে স্থির করিলেন যে, ছিদামকে রেশমের কুঠির দেওয়ানের পদে নিযুক্ত করিবেন। কিন্তু শেষে আবার কী মনেকরিয়া ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বাণিজ্যের দেওয়ানের পদে নিযুক্ত করিয়া নিজের যে বাণিজ্য ছিল, সেই বাণিজ্যের দেওয়ানের পদে ছিদামকে নিযুক্ত করিলেন

....রেশমের কুঠির গোমস্তাদিগের মধ্যে ছিদামের ন্যায় কার্যদক্ষ লোক অতি অল্পই ছিল। ছিদাম কোনপ্রকার কুকার্য কোনপ্রকার নৃশংস আচরণ করিতেই কুণ্ঠিত হইত না। সুতরাং ছিদাম বোল্টস সাহেবের নিজের বাণিজ্যের গোমস্তাগিরি কার্যে নিযুক্ত হইলেও ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানির বাণিজ্যেরও অনেক কাজকর্ম তাহাকে দেখিতে হইত। অনেক বিষয়েই তাহার উপদেশ ও পরামর্শের আবশ্যক হইত। বোল্টস সাহেব বলিতেন ছিদাম আমার দক্ষিণ হস্ত। ছিদাম একপ্রকার বোল্টস সাহেবের প্রাইভেট সেক্রেটারী বলিলেও অত্যুক্তি হয় না। যত অর্থ লোলুপ স্বার্থপরায়ণ ইংরাজ তখন এদেশে বাণিজ্য করিতেন তাঁহারা ছিদামের প্রশংসা করিতেন। ছিদাম গোমস্তাগিরি পদে নিযুক্ত হইলে পর চৌদ্দ মাসের মধ্যে প্রায় এক লক্ষ পঞ্চাশ হাজার টাকা উপার্জন করিল। ছিদামের সহায়তাপ্রাপ্তি নিবন্ধন বোল্টস সাহেব শুদ্ধ কেবল তাহার নিজের বাণিজ্য দ্বারা অত্যল্প কাল মধ্যে নয় লক্ষ টাকা উপার্জন করিলেন। ইষ্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানির বাণিজ্যেও বিলক্ষণ লাভ হইতে লাগিল। বোল্টস সাহেবের সময়েই মুর্শিদাবাদ হইতে অনেক তন্তুবায় স্বীয়-স্বীয় ঘর বাড়ি পরিত্যাগপূর্বক স্থানান্তরে পলায়ন করিয়াছিল।(চণ্ডীচরণ সেন, মহারাজা নন্দকুমার - শতবত্সর পূর্বের বঙ্গের সামাজিক অবস্থা)

বাঙলা-বিহারের দেড় লাখ গ্রামে এক লাখ টোল-চতু্ষ্পাঠি, কয়েক হাজার ন্যায় অথবা স্মৃতি শাস্ত্রের উচ্চশিক্ষা কেন্দ্র, বৈদ্য শিক্ষাসহ নানান প্রযুক্তির পাঠশাল, ধর্ম-জাত নির্বিশেষে, কয়েকশ বছর ধরে দেশিয় ভাষায়(যে অঞ্চলে যে ভাষা – বাংলায় বাংলা, বিহারে বিহারী, মৈথিলি বা ত্রিহুতিয়া) তিল তিল করে অকেন্দ্রিতভাবে, স্থানীয় উদ্যম, স্থানীয় সম্পদে প্রতিপালিত হচ্ছিল। বাঙলার এই সর্বজনের স্বাধীণ বিদ্যাশিক্ষার পরিকাঠামো, বিশ্ববিদ্যালয়সম শিক্ষা ব্যবস্থাগুলি(১৮১৮র ওয়ার্ডের এবং ১৮৩৫-৩৮ তিন দফার আডাম সমীক্ষা) ধংস করে নব্য-বাঙালিরা ব্রিটিশ সমাজ-শিক্ষা ব্যবস্থাকে আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থা বলে আত্মীকরণ করছেন কোটি কোটি গ্রামীণদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে; ভারতের জ্ঞানচর্চার ঐতিহ্য(সেটি সংস্কৃত শিক্ষা নাও হতে পারে) সবলে উপড়ে ফেলে, পাশ্চাত্য জ্ঞানচর্চাকে পুতে দেওয়া হবে ভারতের মাটিতে, যে কর্মের মূল্যায়ণ আজও হয় নি। এই বিষয়টি বিশদে আলোচনা করেছেন তাঁর দ্য বিউটিফুল ট্রি পুস্তকে, ভারতের তিনটি প্রান্ত- বাংলা, মাদ্রাজ এবং পাঞ্জাবের তিনটি শিক্ষা সমীক্ষা আলোচনায়।

নব্য ভাগ্যবান বাঙালিরা কোথাও আবার ব্রিটিশ রাজের সঙ্গে মিলে স্বাধীণতা সংগ্রামী গ্রামসমাজকে দমন করছেন, সাম্রাজ্যের হয়ে লুঠকর্মও সমাধা করেছেন। বদলে পেয়েছেন লুঠের বখরার খুদকুঁড়ো। প্রত্যেকদিন, প্রত্যেকটি ঘন্টায়, প্রত্যেক মুহূর্তে নিজেদের দেশ, নিজেদের সমাজ, নিজেদের ঐতিহ্যের, নিজেরদের পূর্বজদের কৃতকর্মের অবমাননার পালা চলছে নাম-সংকীর্তণ আর শহুরে ভদ্রলোকী-খেউড় সহকারে, ব্রিটিশ কোম্পানি রাজের সরাসরি প্রযোজনায়। যে আলালি-খোকামির ঘটা করে নাম দেওয়া হবে বাঙলার নবজাগরণ। মনেপ্রাণে ব্রিটিশ সংস্কৃতিরপ্রতি নতজানু বুদ্ধিবিভাষাময় মানুষজন নবজাগরণকে সংস্কারমুক্তি আন্দোলন নাম দিয়ে নিজেদের পৃষ্ঠকণ্ডুয়ণ করবেন। বিনয় ঘোষ ব্রিটিশদের পক্ষে দাঁড়িয়ে তাদের সমাজভাঙা কর্মকে সমর্থন করতে, কোনও ঘোমটা না টেনে সরাসরি বলছেন, নতুন যুগের নতুন মহানগরে যুগমানসের অভিব্যক্তির সূত্রপাত হয়েছে। বিজ্ঞান, ব্যক্তিস্বাধীণতা, সংস্কারমুক্তি, গণতন্ত্র ও শিক্ষার নতুন ভাবাদর্শের আমদানি হচ্ছে পণ্যদ্রব্য ও কাঁচামালের সঙ্গে কলকাতার বন্দরে। অর্থনৈতিক সংঘাতের সঙ্গে আদর্শ-সংঘাতও দেখা দিচ্ছে মহানগরে। অনিবার্য ঐতিহাসিক নিয়মে নবযুগের বাঙলার নবজাগৃতিকেন্দ্র হচ্ছে কলকাতা। ব্রিটিশ সমাজ-সংস্কৃতি-জীবনযাপন পদ্ধতির অনুকরণে হুগলির তীরে গড়ে উঠছে নতজানু ব্রিটিশবাদী শহুরে ভারত। গ্রামীণ ভারতের কোটি কোটি সাধারণ মানুষের তৈরি পরিকাঠমো ধ্বংসকর্মের সঙ্গে সরাসরি সঙ্ঘাত লাগছে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের সঙ্গে বেড়েওঠা চাকুরিজীবি, ধণিকপুরুষ, ব্যাসায়ী, দালাল আর দাদনি বণিকদের।

No comments: