Friday, September 22, 2017

চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত - ব্রিটিশ লুঠে আজও বামপন্থী তরফদারি

Souvikএর লেখার উত্তরে এই লেখাটি--
শুধু রঞ্জিত গুহই নন, বিনয় ঘোষও বলে গিয়েছেন ফিলিপ ফ্রান্সিস চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের মূল পরিকল্পক। এবং আমরাও তাই বলি। কিন্তু সমস্যা দাঁড়ায়, বামপন্থীরা সখন লুঠেরা ঔপনিবেশিকতায় জর্জরিত এই পরিকল্পনাকে ভারতের/বাংলার উন্নয়নের ভাবনা হিসেবে ধরে নেন। জন শোরের পরবর্তী গভর্নরদের হয়ে ফিলিপ ফ্রান্সিস বাংলা উদ্ধারে এসেছিলেন - যেন বাংলা পড়েছিল 'বিন মা-বাপকে বাচ্চে' হয়ে। সমস্যা দাঁড়ায় বামপন্থীদের বাংলা উদ্ধারের তত্ত্বে।
বিনয়বাবু সোচ্চার হয়েছিলেন ইংরেজ রাজপুরুষের নামওয়ালা রাস্তাগুলোর নাম পরিবর্তনের ঝোঁকে - মনে করতেন বাংলায় তাদের অইবদান সুপ্রচুর। পুঁজিবাদী পথে বিকাশে তাঁর আস্থা ছিল, বাংলার বিকাশ কেন যে ইওরোপয় কাঙ্ক্ষিত পথে হল না তা নিয়ে তার হাহুতাশ নবজাগরণেরর তত্ত্ব আস্থা টলে যাওয়ার পরেও যায় নি - যেটা আদতে কোন দিনই বাংলার কৃষি আর শিল্প বিকাশের পথ ছিল না। চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত যে ফলদায়ক তা প্রথম বলেন লুটের প্রথম তাত্ত্বিক রামবাগানের রমেশ দত্তমশাই এবং নৌরোজী যাঁরা শেষ জীবন 'সুসভ্য' ব্রিটিশদের মাঝে কাটান এবং লন্ডন থেকে জগদীশচন্দ্রকে বাংলায় ফিরে আসার বিষয়ে প্রধান বাধাদাতা ছিলেন রমেশ দত্ত।
গোটা উপমহাদেশে ব্রিটিশদের পরিকল্পনায় সুরক্ষিত, এই ধারনাটি তৈরি করেছেন বামপন্থীরা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে, পলাশীতে যে আসলে যুদ্ধ হয়েছিল এবং সেই যুদ্ধে এঙ্গেলস কথিত উচ্চ প্রযুক্তির গোলাবারুদ ব্যবহার করে ব্রিটিশেরা জিতেছিল সেটা প্রমানের দায়ও আজকাল তাদের ওপরেই বর্তেছে - যেন ভারতে পলাশীর আগে ব্রিটিশ-নবাব-মোগল যুদ্ধে যতবার বৃষ্টি হয়েছিল তবারই ব্রিটিশ জিতেছিল, যদিও ইতিহাস অন্য কথা বলে - পলাশীর আগের বছরে সিরাজের প্রতাপে ব্রিটিশ বাপবাপ করে বাংলা ছাড়ার উপক্রম হয়েছিল - আজও হলওয়েলের সে নাকি কাঁদুনি শেষ হয় নি - এর ৪০ বছর পরেও টিপুর সংগে হারতে হারতে জিতেছিল ব্রিটিশ।
ফলে বিতর্ক যা হয়েছে তা লুঠ কোন পদ্ধতিতে সংগঠিত হবে তা ঠিক করা - এর বেশি কিছুই নয়। ব্রিটিশ যদি লুঠ নাই করে বাংলার উন্নয়ন নিয়ে ভাববে তাহলে মীরকাশিমের হস্তবুদের পর থেকে যে ক্রমশঃ রাজস্ব বেড়েছিল আর নুন তামাক সুপুরির মত নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যে আকাশ ছোঁয়া উতপাদন শুল্ক বসে ছিল, যে অঙ্কের ভিত্তিতেই চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের রাজস্ব পরিকল্পিত হয়েছিল, তা যথেষ্ট কমিয়ে দেওয়া যেত। তা করে নি ব্রিটিশ, এটা মাথায় যেন রাখি।
বামপন্থীরা কোন দৃষ্টিতে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তকে দেখেছেন তার একটা ছোট্ট উদাহরণ দিই - বাংলাদেশের গবেষক সিরাজুল ইসলাম মনে করেন, ব্রিটিশেরা ভেবেছিল এই ব্যবস্থায় বাংলার জমির বাজার তৈরি হবে যা বাংলাদেশের পুঁজিবাদী বিকাশে সহায়ক হবে Economically it was expected that the permanent settlement would encourage the investment of capital in land and, therefore, the growth of a middle class; that it would lead to more lenient and considerate treatment of the tenants by the landlords, and would thus promote general prosperity (The Permanent Settlement in Bengal-A Study of its Operations 1790-1819, Bangla Academy, Dhaka, 1979, p.xi.)।
তিনি বলছেন “মহান” কর্নওয়ালিস বুঝেছিলেন বাংলার “বেচারা” রায়তদের বেশি বেশি করে জমিদারকে নানান ধরণের “তোলা” দিতে হত, এবং কোম্পানিও জমিদারদের থেকে প্রচুর রাজস্ব উসুল করত। তাদের উভয়ের দুরবস্থায় ভীষণই মনকষ্টে ছিলেন বাংলা প্রধান, তিনি জমিদারদের রাজস্ব আদায়কে রাহাজানি নাম দেন Cornwallis was particularly disturbed to see that the landlords and raiyats were coerced to pay higher and higher taxes every year and all their surpluses were ruthlessly extracted from them by the Company’s government. He called this practice banditry of the state, which was primarily responsible, according to him, for the collapse of the Bengal economy and the economy of the Company itself.
পলাশীর পরের লুঠের কথা ছেড়েই দিচ্ছি, কর্নোয়ালিস বা সাম্রাজ্যের জমি-তাত্ত্বিকেরা যদি বাংলার রায়ত বা জমিদারদের প্রতি এতই সহানুভূতিসীল হবেন তাহলে কেন
১) পলাশীর পরে যে বিপুল হারে রাজস্ব বেড়েছিল, এবং সেই ক্রমশ গুণত্তোর প্রগতিতে বাড়া রাজস্ব হারকে ভিত্তি করে এই বন্দোবস্তে জমিদারদের দেয় ঠিক হল, তাকে নতুন করে কী ধার্য করা যেত না।
২) কর্নওয়ালিসের বাংলার প্রতি এতই যদি দরদ, এই চরমতম বর্ধিত হার যে জমিদার দিতে পারবে না, তাদের জমিদারি নিলামে তোলার জন্য কেন সূর্যাস্ত আইন প্রযুক্ত হল?
সমস্যা হল লুঠেরা চালুনির কোটি কোটি ছিদ্র ওয়ালা ব্রিটিশ আবার ছুঁচ নবাব্দের লুঠের বিচার করে। সামগ্রিকভাবে সরকারি বা বিপ্লবী সব ধরণের বামপন্থী তাত্ত্বিকতার আড়ালে আজও ব্রিটিশ লুঠের তরফদারি করেন, সেটাই দুঃখের, সেটাই তাদের মুখোশ খুলে দেয়।
বাস্তব হল রঞ্জিত গুহ থেকে সিরাজুল ইসলাম সকলেই ব্রিটিশদের গুণমুগ্ধ, ব্রিটিশ পরিকল্পনার অনুগামী, আদতে ব্রিটিশ/ইওরোপিয় গণতন্ত্র আর উন্নয়ন ভাবনা বাংলা/ভারতের পক্ষে একমাত্র দাওয়াই, সেই ধারণা থেকে তাঁরা বেরোতে পারেন নি আজও।
সমস্যা।
ঠিক এই জন্যই আজ বাংলা তথা ভারতের নেই নেই দশা।
সবার আগে এই মানুষদের তাত্ত্বিকতা থেকে নেতোতে হবে।
তারপর অন্য কথা।
লাইকআরও প্রতিক্রিয়া প্রদর্শন করুন
মন্তব্য করুন
মন্তব্যগুলি
Dipankar Shibu আমাদের মনে রাখতে হবে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের মূল উদ্দেশ্য ছিল বাংলায় গজিয়ে ওঠা নতুন শিল্পপতিদের মুনাফা যাতে চা ও পাট শিল্পে বিনিয়োগ না হয়ে জমিদারি কেনা বেচায় ও বেলেল্লে পনায় নিয়োজিত হয় তা বাস্তবায়িত করা। মনে রাখতে হবে ১৭৭৬ সালে মার্কিন দেশ স্বাধীন হলে বাংলার শিল্পপতিরা, যেমন রামদুলাল দে, সরাসরি সেদেশের সাথে ব্যবসা করতেন। তাঁর ৪টে জাহাজ কলকাতা থেকে নিয়মিত মার্কিন বন্দরে যাতায়াত করতো। চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত ও নবজাগরণের ধাক্কায় বাংলার সেই সব শিল্পপতিরা হারিয়ে গেলেন। প্রচুর সম্ভাবনাময় ঠাকুর পরিবার ও মেতে উঠলো নীল চাষে। দ্বারকানাথ হলেন প্রিন্স!
লাইকআরও প্রতিক্রিয়া প্রদর্শন করুন
প্রত্যুত্তর
1
8 ঘণ্টাসম্পাদনা করা হয়েছে
পরিচালনা করুন
Biswendu Nanda হ্যাঁ আমি তো দীপঙ্করদার বিষয়টা ধরিই নি।
ব্যবসায়ীদের কথা ছেড়েই দিচ্ছি, পলাশীর পরে ব্রিটিশ লুঠের ছোট তরফ হয়ে যে অর্থ লুঠেছিল বাঙ্গালি দাদনি আর বণিকেরা সে অর্থ চিরিস্থায়ী বন্দোবস্ত করে এক্কেবারে শুষে নিল ব্রিটিশেরা। এটাঈ বলা হয় না।
লাইকআরও প্রতিক্রিয়া প্রদর্শন করুন
প্রত্যুত্তর7 ঘণ্টাসম্পাদনা করা হয়েছে
পরিচালনা করুন
Biswendu Nanda আর যেটা বলা হয় নি
আমরা এর আগে বহুবার আলোচনা করেছি বাংলা ছিল সারাভারতের এশিয়ার শুধু নয় বিশ্বের কারখানা। বাংলার বিকেন্দ্রিত উৎপাদন ব্যবস্থায় কৃষক ছাড়াও বিপুল পরিমানে কামার, কুমোর, স্বর্ণকার, সূত্রধর, কৈবর্ত, যুগি, বণিক, ব্যাপারী, চিকিৎসক এরকম, হাজারো উৎপ
াদক সেবাদায়িদের হাতধরাধরি করা বিপুল কর্মকাণ্ড ছিল। 
চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত আর বাংলার বিশিল্পায়নের সরাসরি প্রভাব পড়ল বাংলার শুধু কৃষিতে নয় গোটা অর্থনীতিতে। বিপুল সংখ্যক কারিগর, তাঁতি এবং চাষী কাজ আর জমি হারিয়ে দিন-মজুরে পরিণত হল। সিরাজুল ইসলাম তাঁর লেখায় Willem van Schendel, “Economy of the Working Class প্রবন্ধ থেকে তথ্য তুলে বলছেন, তৎকালীন সরকারের হিসেবেই দেখা যায় ১৮৮০ থেকে ১৯৪০র মধ্যে ৭০ লক্ষ কারিগর কৃষিশ্রমিকে পরিণত হয়েছিল। জমিহারা শ্রমিক যারা অন্যের জমিতে চাষ করতেন তারা বর্গাদার বা আধিয়ার হিসেবে চিহ্নিত হলেন। কৃষি বাজার নিয়ন্ত্রণ করতে লাগল হাতে গোণা বৃহৎ ভূস্বামীরা। গ্রাম বাংলায় অসীম দারিদ্রের একটা বড় কারণ হল ভূস্বামীদের না চাষ করেও অধিকাংশ ফসলের দখলদারি ইত্যাদি। 
শিরিন আখতার The Role of Zamindars 1707-1772, Asiatic Society of Bangladesh,Dhakaয় লিখছেন যদিও ব্রিটিশ পূর্ব জমিদারদের চরিত্রও ছিল কিছুটা উৎপীড়ক ছিল, কিন্তু গ্রামীন অর্থনীতির অংশ হিসেবে ঐতিহাসিকভাবে তার দায়িত্ব পালন করত জমিদারেরা। বংশপরম্পরায় জমিদার আর প্রজা/রায়তদের সঙ্গে একটা যৌথ ফলপ্রদ দীর্ঘকালীন সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল, স্থানীয় এলাকায় স্থানীয়দের সঙ্গে মিলেমিশে তারা পাঠশালা চালাত, রাস্তা তৈরি করত, পতিত জমি উদ্ধার করত, সরাই তৈরি করত, নিরাপত্তার ব্যবস্থা করত এবং চুরি ডাকাতি হলে রায়তদের বাধ্যতামূলক ক্ষতিপূরণ দেওয়ার দায়িত্ব তাঁদের ওপরে ন্যস্ত ছিল। তারা বহু বছর ধরে এক আর্থ-ভৌগোলিক অঞ্চলে থাকত। আর আমাদের বক্তব্য হল শূদ্র-বৈশ্য-মুসলমান এবং অন্যান্য পরম্পরার সমাজের কারিগরদের যৌথ উদ্যোগে যে বিকাশশীল উদ্বৃত্ত অর্থনীতি গড়ে উঠেছিল তার একটা ক্ষুদ্র হুলেও শ্রেয় যায় জমিদারদের কর্মকাণ্ডে – স্থানীয় কারিগরদের সরাসরি পৃষ্ঠপোষণা করতেন জমিদার, ভূস্বামী আর সম্রাটেরা। কিন্তু এই দীর্ঘকালীন নির্ভরশীল আর্থ-সামাজিক-কৃষ্টিক ব্যবস্থা ভেঙ্গে দিল চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত।
লাইকআরও প্রতিক্রিয়া প্রদর্শন করুন
প্রত্যুত্তর
1
8 ঘণ্টা

No comments: