Thursday, September 21, 2017

বাংলা সকলের মহাজন - লুঠ, খুন অত্যাচারী শাসনের সম্পদ৪

বাঙলায় ইংরেজরা ব্যাবসা করার প্রথম সময় থেকেই বাঙালি দাদনি ব্যাবসায়ি এবং জমিদারদের বড় একটা অংশ কিন্তু তাদের সঙ্গে ছিলেন। ১৭৫৭র ছলে-বলে-কৌশলে ক্ষমতা দখলের পর থেকেই তাঁরা নব্য ইংরেজ সাম্রাজ্যের লুঠের ছোট অংশিদার হয়ে বসেন। কেমন?

একটা ছোট উদাহরণ পেশ করা যাক। কলিকাতা সেকালের একালের পুস্তকে হরিসাধন মুখোপাধ্যায় বলছেন, কলিকাতা আক্রমণের সময় অনেক বাঙ্গালীর ঘরবাড়ী নষ্ট হইয়া গিয়াছিল। ... নবাবসৈন্য কলিকাতা লুঠ করায়, অনেকের বহুমূল্য জিনিষ পত্রাদিও নষ্ট হয়। নবাব মীরজাফর সেরাজ কর্ত্তৃক কলিকাতা লুণ্ঠনের ক্ষতিপূরণ স্বরূপ, ইংরেজ কোম্পানীর প্রজাবর্গের জন্য ও কোম্পানীর যে সমস্ত ইংরেজ কর্ম্মচারী এই আক্রমণে গতসর্বস্ব হইয়াছিলেন, তাঁহাদের ক্ষতিপূরণ জন্য এক কোটী সত্তর লক্ষ টাকা কোম্পানীকে দেয়াছিলেন। এদেশীয়দের মধ্যে অনেকে কলিকাতা আক্রমণের সময় প্রাণভয়ে পলায়ন করিয়াছিল- কলিকাতা রক্ষার জন্য ইংরাজের কোনও সহায়তা করে নাই – এই জন্য প্রথম সংকল্প স্থির হয়, যে এদেশীয় লোকেরা কোনওরূপ ক্ষতিপূরণ পাইবে না।
...কলিকাতার বাঙ্গালী অধিবাসীদের মধ্যে গোবিন্দরাম মিত্র, শোভারাম বসাক প্রমুখ কয়েকজন বাঙ্গালী সেই সময় কলিকাতা ত্যাগ করে নাই। ইহাঁদের প্রার্থনামতে, কোম্পানী-বাহাদুর পরে বাঙ্গালী নবাব কর্তৃক কলিকাতা আক্রমণের সময় সহর ত্যাগ করে নাই বা কোম্পানীর কোনওরূপ বিরুদ্ধাচরণ করে নাই, তাহারা ক্ষতিপূরণ স্বরূপ, নবাব মীরজাফর প্রদত্ত টাকার অংশ পাইবে। দেশীয়দের মধ্যে এই টাকা বিতরণের ভার – গোবিন্দরাম মিত্র ও শোভারাম বসাকের হাতে পড়ে। কিন্তু দুঃখের বিষয় – তাঁহারা এই খেসারত পূরণের টাকার খুব বেশী অংশই নিজেরা গ্রহণ করেন। ...এই টাকা বিতরণের জন্য এদেশীয় তেরজন কমিশনার নিযুক্ত হন। আমরা তাঁহাদের নামের তালিকা, ক্ষতিপূরণের দাবীর টাকার একটী তালিকা, এস্থলে উদ্ধৃত করিয়া দিলাম। এই তালিকা হইতে পলাশী-আমলে কলিকাতার জনকয়েক অবস্থাপন্ন অধিবাসীর কথা জানিতে পারা যায় (খুচরো বাদদিয়ে)

কমিশনারদের নাম তাঁহাদের নষ্ট সম্পত্তির জন্য দাবীর পরিমান কোম্পানী বাহাদুরের মঞ্জুরী টাকা
১) গোবিন্দরাম বসাক ৪১২৬৮০ ৩৭৬৮০
২) শোভাবাম বসাক ৪৪১২৭৮ ৬৬২৭৮
৩) আলিজান ভাই ৩৪৪৫৭ ১৭৪৫৭
৪) রতু সরকার বা রতন সরকার ১৮০৩২২ ৪০৩২২
৫) শুকদেব মল্লিক ৫০৯৪২ ১০৯৪২
৬) নয়নচাঁদ মল্লিক ৪৩৯২২ ৫৯২২
৭) দয়ারাম বসু ৫১৫৩ ১১৫৩
৮) নীলমণি মিত্র ২৮১১৩ ১০১১৩
৯) হরেকৃষ্ণ ঠাকুর ১৩৭৮৮ ৩৭৮৮
১০) দুর্গারাম দত্ত ৬৪৭ ১০০
১১) রামসন্তোষ ৬৪১০ ৯১০
১২) মহম্মদ সাদেক ২৭১৬ ১
১৩) আইনুদ্দিন ০ ০
এই তালিকা থেকে দেখা যাচ্ছে তিনজন মুসলমান বাঙালিই সঠিক অর্থ পাননি। হরিসাধনএর যুক্তি, লোভে পড়িয়া আশার অতিরিক্ত দাবী করিয়া বসিয়াছিল। ইংরেজদের পক্ষ নিয়ে লেখক হরিসাধন লিখলেন, ...এই তালিকা হইতে প্রমাণ হয় – কোম্পানি বাহাদুর সকলেরই দাবী যথেষ্ট কমাইয়া দিয়াছিলেন। এই তালিকা হইতে দেখা যাইতেছে, শোভারাম বসাক সর্বাপেক্ষা বেশী টাকা পান, আর গোবিন্দরাম মিত্র তাঁহার নিম্নে। এই তেরজন বাঙালী কমিশনারের অনুগৃহীত, কলিকাতার অন্যান্য বাঙালী অধিবাসিগণ, ক্ষতিপূরণ স্বরূপ কত টাকা পাইয়াছিলেন, পাঠকবর্গের কৌতুহল নিবৃত্তির জন্য, আমরা তাহার আর একটী তালিকা ...সংগ্রহ করিয়া দিলাম।

নাম(দেশীয় কমিশনারগণের সহিত ক্ষতিপূরণ-প্রার্থীদের সম্বন্ধ) (প্রথম অঙ্কটা) ক্ষতিপূরণের দাবী (দ্বিতীয় অঙ্কটা)যাহা মঞ্জুর হয়
চৈতন দাস (রতু সরকারের আশ্রিত ব্যক্তি) ১৭০২ ৩০২
দুর্লভ লক্ষ্মী, কানতনরী, চরণ বসাক(শোভারাম বসাকের আশ্রিত ব্যক্তি) ৮২৩৩ ১২৩৩
কুড়রাম বিশ্বাস(গোবিন্দরাম বসাকের অধীনস্থ কুলী সর্দ্দার) ৫৯৮৩ ১৯৮৩
গণেশ বোস(কমিটির জনৈক কেরাণী) ১৫১৭ ৩১৭
রামদেব মিত্র(গোবিন্দরামের সম্পর্কীয় ব্যক্তি(কিন্তু ১৭৪৭এ ইহার মৃত্যু হয়) ৭৩১৩ ১৩১৩
রতন ৩১৫২০ ৬৫২
ললিতা ২৮১৯ ৮১৯
মতিবেওয়া(গোবিন্দরাম মিত্রের আশ্রিত গণিকাগণ)) ৩৬৭৭ ৫৭৭
দুর্গারাম, বিন্দু, গঙ্গা(গোবিন্দরাম মিত্রের আশ্রিত ব্যক্তি) ৩০৯১ ৫১৯
দুর্গারাম শর্ম্মা (গোবিন্দরাম মিত্রের আশ্রিত ব্যক্তি) ৩০৯ ৫৩২ ১৩২
নীলমণি চন্দ্র((গোবিন্দরাম মিত্রের আশ্রিত ব্যক্তি) ৩০৯) ৭১০ ১৬০
হরিরাম ঘোষ((গোবিন্দরাম মিত্রের আশ্রিত ব্যক্তি) ৩৯০ ৯০
রামচরণ সরকার(কমিটির কেরাণী) ৬৪৬ ৯৬
লক্ষ্ণীকান্ত ঘোষ(গোবিন্দরামের অনুগৃহীত) ৩১৮ ৯৬
নয়ানদাস ধোপা(রতু সরকারের অনুগৃহীত) ১৬৬৭ ৪৬৭
গঙ্গাদত্ত পাত্র(শোভারাম বসাকের আশ্রিত) ২৫১৩ ৫১৩
বৃন্দাবন ও ফুলচাঁদ(রতু সরকারের আশ্রিত) ১২৩৯৫০ ২৮৯৫
গোপীচরণ বসাক(শোভারাম বসাকের আশ্রিত) ৪০৫৬ ১০৫৬
রামকিশোর চক্রবর্তী(গোবিন্দরাম মিত্রের আশ্রিত) ১৪২১ ৪২১
রাধাকান্ত রায়(নীলমণি মিত্রের লোক ) ৮৭৬ ১৭৬
রামশঙ্কর সরকার(রামসন্তোষের আশ্রিত) ১১৪০ ২৪০
ব্রজকিশোর শিরোমণি(নীলমণি মিত্রের ব্যক্তি) ২১৯৮ ৬৯৮

গোবিন্দরাম মিত্র কুমারটুলীর অধিবাসী। নবাব(সিরাজ - লেখক) যখন কলিকাতা আক্রমণ করেন, কথন তিনি কলিকাতার আবাসবাটী ত্যাগ করেন নাই। নিজের সিপাহিদ্বারা আত্মরক্ষার চেষ্টা করিয়াছিলেন। শোভারাম বসাক সম্ভবতঃ কলুটোলা অঞ্চলে থাকিতেন। আজো তাঁহার নামে একটি রাস্তা ঐ অঞ্চলে আছে। রতু সরকার, নীলমণি মিত্র, শোভারাম বসাক, ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর সহিত ব্যবসা-সম্বন্ধে লিপ্ত ছিলেন। রতু সরকার শোভারামের প্রতিবেশী। ...যে সকল ব্যক্তি নবাব কর্তৃক সম্পত্তিনাশের ক্ষতিপূরণ দাবী করিয়াছিলেন – তাঁহাদের অধিকাংশই উক্ত মিত্রজা সরকার ও বসাক মহাশয়দের অনুগৃহীত। ...প্রথম তালিকায় গোবিন্দরাম প্রমুখ ব্যক্তিগণ তাঁহাদের নিজের জন্য বার লক্ষ, কুড়ি হাজার চারিশত উনত্রিশ টাকা দাবী করেন। দ্বিতীয় তালিকাতেও দাবির পরিমান তেয়াত্তর হাজার চারিশত তিপান্ন টাকা। কোম্পানী-বাহাদুর গোবিন্দরামের দাবিটা কিছুটা অসঙ্গত বলিয়া মনে করেন। কারন কোম্পানীর সিপাহীরাই গোবিন্দরামের ধনসম্পত্তি রক্ষা করিয়াছিল।



...মীরজাফরের সহিত ইংরাদজেরসন্ধির সত্বানুসারে, সিরাজ কর্ত্তৃক কলিকাতা আক্তমণের সময়, ইংরাজ ও দেশীয়গণের যে সম্পত্তি লুঠ হইয়াছিল বা অগ্নিদাহে যাহা কিছু ক্ষতি হইয়াছিল, তাহার সম্পূরর্ণার্থে নবাব এক ক্রোর টাকা ক্ষতিপূরণ স্বরূপ প্রদান করেন। কটন সাহেবের মতে – কলিকাতার ইংরাজ-অধিবাসীরা পঞ্চশলক্ষ, হিন্দু ও মুসলমানেরা কুড়িলক্ষ ও আর্ম্মিনিয়ানগণ সাতলক্ষ টাকা ক্ষতিপূরণ স্বরূপ পান। ...নবাব কর্তৃক কলিকাতা লুণ্ঠনের এক বত্সরের পরে অর্থাৎ ১৭৫৭ খৃঃ অব্দের ৬ জুলাই তারিখে – এক দফায় ৭৬ লক্ষ টাকা মুরশীদাবাদ হইতে কলিকাতায় আসে। এই টাকা ৭০০টী কাঠের সিন্ধুকে আবদ্ধ ছিল ও একশতখানি নৌকা মুর্শিদাবাদ হইতে কলিকাতায় টাকা আসিয়াছিল। ইহার দুই সপ্তাহ পরে কোম্পানীর ক্ষতিপূরণের জন্য আরও চল্লিশ লক্ষ টাকা কলিকাতায় পৌঁছয়।

No comments: