Saturday, September 9, 2017

পলাশীপূর্ব বাংলার কৃষি ও শিল্প৩

বাংলা বনজ সম্পদেও খুব কম ছিল না। গোলাম হোসেন রিয়াজ...এ জানিয়েছেন বাজুহা সরকারে(রাজাশাহী, পাবনা, বগুড়া ও ময়মনসিংহ) বিশাল অরণ্য ছিল। প্রচুর পরিমান কাঠ পাওয়া যেত। বেশিরভাগ বাড়ি আর নৌকো তৈরিতে ব্যবহার করা হত। বীরভূম আর বাঁকুরা ছিল জঙ্গল মহল – কাঠ, মধু, লাক্ষা আর মোম পাওয়া যেত। শ্রীহট্টের বন থেকে আসত ফল, কমলালেবু ও ওষুধের ব্যবহার করার মত নানা রকম মূল। এ অরণ্যে প্রচুর পরিমান অলি কাঠ মিলত। রেনেল বলছেন জলপাইগুড়িতেও প্রচুর কাঠ পাওয়া যেত। সুন্দরবনের প্রধান উতপাদন কাঠ আর আম। আমের ফলন বাংলার সর্বত্র ছিল। খুলাসাতের রচয়িতা জানিয়েছেন বরবকাবাদে(মালদা, রাজশাহী, বগুড়া) ও শ্রীহট্টে প্রচুর কমলালেবু উৎপন্ন হত। এই অঞ্চলে সাংতাড়া নামে ফলের কথা বলেছেন, মনে হয় সেটা বাতাপিলেবু।
জমিদারদের সঙ্গে রায়তদের সম্পর্কের কোন হেরফের হয় নি। রায়ত-জমিদার সম্পর্ক প্রত্যক্ষ ও ঘনিষ্ঠ। সরকারের সঙ্গে শুধু রাজস্ব দেওয়ায় সীমাবদ্ধ। ১৭১১/১১১৭এ দুর্ভিক্ষ হয়েছিল এমন উল্লেখ কোম্পানির কাগজে দেখা যায়। কয়েক হাজার মানুষ মারা গিয়েছিলেন। মুর্শিদিকুলি খাঁ খাদ্যশস্যের রপ্তানি বন্ধ করে দিয়ে চরম প্রশাসনিক দক্ষতা প্রয়োগ করে এই দুর্ভিক্ষ রোধ করেছিলেন। ১৭৩০/১১৩৭এর বাংলাদেশের ঝড়ের পরে এবং পঞ্চাশের বন্যায় খুব খাদ্যের ঘাটতি পড়ে, কিন্তু এ সব সাময়িক, খুব গুরুতর রূপ নিয় নি।
কৃষিজাত পণ্য খুব বেশি ইওরোপে যেত না, - কারণ সেটি আকারে বিশাল জায়গা দখল করে বেশি, ফলে জাহাজ পরিবহন ভাড়াও বেশি। সহজে নষ্ট হয়। ফলে যে যাত্রা এক বছরের কাছাকাছি বা বেশি তাতে অবিকৃত অবস্থায় কাঁচা খাবার দ্রব্য নিয়ে যাওয়া কঠিন। ইওরোপের শিল্পে চাল তেলের ব্যবহার তখনও শুরু হয় নি। তবে চাল, তেল, চিনি, ডাল, আফিম, নীল, লঙ্কা ইত্যাদি ভারত এবং অন্যান্য ইওরোপিয় দেশে সেট।
১৭৬৯/১১৭৬এ কোম্পানির গভর্নর হ্যারি ভেরলেস্ট ডিরেক্টর বোর্ডকে লিখছেন, বাংলার পণ্য, বৈচিত্রে, প্রাচুর্যে আর গুণগত মানে খুব উঁচু। আর শস্তাও। আবদুল মজিদ খাঁ দ্য ট্রানজিশন ইন বেঙ্গল বইতে দেওয়ান রেজা খাঁ আর উইলিয়াম বোল্টসের সাক্ষ্য তুলে বলছেন বাংলার শিল্পী কারিগর তাঁদের খুশীমত পণ্য উৎপাদন করত এবং নিজের পছন্দ মত উৎপন্ন পণ্য বিক্রি করতে পারত। বাংলা সরকার তাদের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করতে পারত না(একই উদাহরণ দিয়েছেন ওমপ্রকাশ পলাশীপূর্ব বাংলার তাঁতিদের অধিকারের কথা বলতে গিয়ে)। অর্থাৎ আভ্যন্তরীণ শিল্প উৎপাদনের ক্ষেত্রে ও বাজারে যথেষ্ট স্বাধীনতা ছিল। শিল্পী ও কারিগর প্রাক পলাশী সময়ে স্বাধীনভাবে উৎপাদন করত আর বিক্রি করতে পারত। সিরাজ পর্যন্ত নবাবেরা আভ্যন্তরীণ বাজারে এই স্বাধীনতার অধিকার বজায় রাখতে পেরেছিলেন।
বাংলায় কারিগর উৎপাদন ব্যবস্থায় তিন ধরণের ব্যবস্থা চালু ছিল। গ্রামীন উৎপাদক নিজেই যখন স্বাধীনভাবে পণ্য উৎপাদন করত এবং নিজের পছন্দমত দামে বাজারে বিক্রি করত। দ্বিতীয় ব্যবস্থায় কারিগর মহাজন বা বণিকদের থেকে মূলধন আগাম নিত, নির্দিষ্ট দামে ও সময়ে পণ্য নির্দিষ্ট যায়গায় যোগান দিত। এটাকে দাদনি ব্যবস্থা নামে পরিচিত। শেষটি হল মহাজন বা বণিকদের কুঠি/বাড়িতে দল্বেঁধে পণ্য উৎপাদন করত। এ ব্যবস্থায় উতপাদকেদের স্বাধীনতা ক্ষুন্ন হত ও কারিগর পারিশ্রমিক কম পেত।
(ক্রমশঃ)

No comments: