Souvik Ghoshalএর সঙ্গে 'কেন আমি বামপন্থী নই' নিয়ে আলোচনা -
'কেন আমি বামপন্থী নই'এর আমাদের ভাষ্য-
আমার জীবনের শুরু বামপন্থার রাজনীতিতে। আজও বহুকিছু আমার চরিত্র রেণুতে বয়ে নিয়ে চলেছি যা অনপনেয় বঙ্গীয় বামপন্থী সমাজের উদ্ভব। আমার পারিবারিক, আমার কাছের সমাজের বহু বাম মানুষ আছেন যাদের চরিত্র আজও অনুকরণযোগ্য।
কিন্তু সচেতনভাবে বঙ্গীয় বামপন্রহীদের গত ৪০ বছর ধরে যে তাত্ত্বিক অবস্থান আমি দেখেছি, তার থেকে আমার অন্তরাত্মা আমায় সরে আসতে নির্দেশ দিয়েছে। বিশেষ করে বাংলার অতীত, বাংলার অর্থনীতি, বাংলার সমাজ বিশ্লেষণে বামপন্থীদের ঔপনিবেশিকতা আমায় অন্তত দূরে ঠেলেছে। নবজাগরণের প্রতি অপরিসীম শ্রদ্ধা(সরোজ দত্ত বা শেষ জীবনের সীমিতভাবে বিনয় ঘোষের প্রশ্ন তোলা সত্ত্বেও), গত কয়েকদিনের যাদবপুর/মেডিক্যাল কাণ্ডে মেধার ওপর অনাবশ্যক জোর, শিক্ষার গর্ব, দল গোষ্ঠীগুলিতে প্রায় বংশ কুলীনতার হাতছানি, ইওরোপমন্যতা, বড় পুঁজি আর তার লুঠেরা প্রযুক্তির ভবিষ্যতকেই বিশ্বের ভবিষ্যৎ হিসেবে নির্ধারণ করা, শিক্ষা জ্ঞানের মধ্যে পার্থক্য না করা, ইংরেজি ভাষার ওপর অতীব নির্ভরতা, বাংলার গাঁইয়াদের মৌলিকভাবে এবং সচেতনভাবে দলের নেতৃত্ব বাইরে রেখে দেওয়া এই ধরণের হাজারো বিষয় বিশ্লেষণ করার পর থেকেই নিজেকে বামপন্থী বলা থেকে বিরত করেছি। বিশেষ করে প্রতিষ্ঠিত পশ্চিমী অর্থনীতির তাত্ত্বিকতা এবং মার্ক্সীয় অর্থনীতির তাত্ত্বিকতার বাইরে থাকা গ্রামীন কর্পোরেট বিরোধী উৎপাদন ব্যবস্থাকে চিনতে না পারা বা চাওয়া আমায় ভীষণ আহত করেছে। আমি ব্যক্তিগতভাবে কার্ল মার্ক্সের অতীব অনুরাগী, কিন্তু অনুগামী নই। অর্থনীতির বাইরে তাঁর নানান ধারনা মানুষের অসাধারণ বিশ্লেষনী মনকে উদ্দীপ্ত করে। কিন্তু বঙ্গীয় বামেরা তাঁর কর্পোরেটিয় অর্থনৈতিক বিশ্লেষণের বাইরে বেরোলেনই না। আক্ষেপ, বাংলার যে অক্ষ হৃদয় - সেই কারিগরি অর্থনীতির মৌলদর্শনকে তারা আজও ছুঁতে পারেন নি - তাকে সেই ইওরোপিয় কর্পোরেটিয় অর্থনীতির ভিত চারচলক দিয়ে বিশ্লেষণের পরম্পরা বজায় রেখে চলেছেন। ফলে ইওরোপিয় লুঠেরা খুনি নবজাগরণীয় পাগান অর্থনীতিকেও তারা বুঝলেন না।
আপনি ছিলেন এই দলের মধ্যে ব্যতিক্রম, আপনার সঙ্গে আলোচনার ধারাবাহিকতা আমি আর Dipankarদা চালিয়ে আসছিলাম, সেটাও রুদ্ধ হয়ে গেল, আমরা মনে করলাম আপনি বামপন্থী গোঁড়ামি থেকে বেরোতে পারেন নি, আপনি মনে করলেন আমাদের সঙ্গে আলোচনা বৃথা।
আমরা গোটা নবজাগরনীয় উদ্যম নিয়ে প্রশ্ন তুলছি সরাসরি। সেই লুঠেরা ব্যবস্থা জাত যে জীবনধারা আর দর্শন, তার বিরুদ্ধে প্রশ্ন তোলা না গেলে প্রায় সব ধরণের তাত্বিক উদ্যম ব্যর্থ হয়ে পড়বে এবং আমাদের বাংলার কারিগরদের বোঝা অর্থহীন হয়ে পড়বে।
Souvik Ghoshal আমাদের লেখার উত্তরে লিখলেন -
আপনাদের সাথে বিনিময় বন্ধ হওয়ার কারণ এটা নয় যে আমি আপনাদের সমালোচনাগুলো ও ভাবনাগুলো গ্রহণ করি নি।
বরং আমি নিজে সেগুলো বোঝার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি এবং আমার কমরেডদের সাথেও এই নিয়ে বিনিময় হচ্ছে মতামতের।
একভাবে বলতে পারা যায় যে ভাবনাটা আপনারা উশকে দিয়েছেন সেটা আমাদের ইতিহাসের মধ্যে দাঁড়িয়ে এবং মার্কসবাদ লেনিনবাদ মাও সে তুং চিন্তাধারার প্রবাহের মধ্যে দাঁড়িয়ে আমি বোঝার চেষ্টা করে যাচ্ছি।
আমার মনে হয়েছে সমস্যাটা মার্কসীয় দর্শনের মধ্যে নেই। আমাদের প্রাকসিসের মধ্যেই কিছুটা আছে, হয়ত বা হাত ফেরতা মডেল অনুকরণের মধ্যে আছে।
মার্কসবাদের রুশীকরণ যদি লেনিন করে থাকেন এবং মার্কসবাদের চিনাকরণ যদি মাও করে থাকেন, তাহলে সেই মাপের মার্কসবাদের ভারতীয়করণ হয় নি।
আমরা দলিত আন্দোলনের দিক থেকে ভারতীয় বামপন্থা সম্পর্কে যে প্রশ্নগুলি তোলা হয়েছে, সেগুলিকেও বিশ্লেষণ করে আমাদের সীমাবদ্ধতাগুলি দেখছি।
ভারতের বামপন্থার সঙ্কটকে আমরা সংসদীয় রাজনীতির সিট বা ভোটের একমাত্রিক দাঁড়িপাল্লায় মাপতে চাই না। সেগুলি বড়জোর কয়েকটি আংশিক সূচক হতে পারে। মূল সঙ্কট অন্যত্র আছে। বিশেষ করে সোভিয়েত মডেলের ভাঙনের পর এবং চিনের ধারা পাল্টানোর পর যখন ভারতের নিজস্ব মডেলটির গুরুত্ব সমধিক হয়ে উঠল, তখন তার যোগ্য প্রত্যুত্তর দিতে আমরা ব্যর্থ হলাম। আমরা বলতে বিভিন্ন ধারার সমন্বয়ে যা লেফট আম্ব্রেলা, আমি তার কথাই বলতে চাইছি।
কিন্তু আমি মনে করি এই ধারার মধ্যেই রয়েছে লড়াই আত্মত্যাগ অনুসন্ধান পরীক্ষা নিরীক্ষার সাহস এবং মানুষের প্রতি ভালোবাসার সর্বোৎকৃষ্ট ঐতিহ্য ও অনুশীলন। এর বাইরে গিয়ে গণমুক্তির কোনও সার্বিক ন্যারেটিভ খোঁজা দুষ্কর।
এরই সঙ্গে এটাও বলার যেহেতু আমি বিশুদ্ধ চিন্তাবিদ নেই মূলত একজন পলিটিক্যাল অ্যাক্টিভিস্ট যার একটি সোচ্চার দলীয় পরিচিতি আছে, তার পক্ষে চলমান রাজনীতির পার্টিগত দ্বন্দ্ব এড়ানো সম্ভব নয়।
যেহেতু আপনারাও দল নিরপেক্ষ বুদ্ধিজীবী মাত্র নন, তাই কিছু জটিলতা অবশ্যম্ভাবী। কিন্তু সেটুকুই শেষ কথা নয়। শেষ পর্যন্ত যেহেতু মানুষের জন্য রাজনীতির জটিলতাগুলির উত্তর খোঁজাই আমার চরম লক্ষ্য, তাই বিনিময়ের সমস্ত সম্ভাবনাই আমার দিক থেকে উন্মুক্ত রাখতে আমি বাধ্য।