Saturday, September 30, 2017

জমির বিলিবন্টন ও রাজস্ব আদায়ের পদ্ধতি৭

আকবরের তৈরি প্রশাসনিক কাঠামোটা জানা খুব জরুরি। কেননা তার এই রাজস্ব এবং প্রশাসনিক কাঠামোর ওপর নির্ভর করে তারপরের দেড়শ বছরের গোটা মুঘল সাম্রাজ্য, বাংলায় ৫০ বছরের নবাবী প্রশাসন এবং তার পরের ব্রিটিশ প্রশাসনিক এবং রাজস্ব আদায়ের ব্যবস্থা গড়ে উঠেছিল, যদিও ব্রিটিশদের লুঠ উদ্যমের সঙ্গে আকবরের উৎকর্ষময় পরিকল্পনার কোন তুলনাই চলতে পারে না।

প্রত্যেক সুবা বিভক্ত ছিল অনেকগুলো সরকারে। সরকার আবার অনেকগুলি পরগণায়। পরগনাগুলি আবার মহলে। মহল তৈরি হত কতগুলি মৌজা বা গ্রাম নিয়ে।

সুবা
সুবাদার - তাঁর সময়ের সুবার শাসনতান্ত্রিক কাঠামোর মাথায় ছিলেন ছিল সুবাদার বা সিপাহসালার। আওরঙ্গজেব বাংলায় মুর্শিদকুলি খাঁকে দেওয়ান হিসেবে পাঠালে তাঁর নিজস্ব যোগ্যতায় তিনি প্রধান শাসনকর্তা হয়ে ওঠেন। তাঁর আগে সুবাদারেরা শাসনপ্রধান ছিলেন।

দেওয়ান – ইনি রাজস্ব সংগ্রহ করতেন। প্রাদেশিক কর্মচারীদের বেতন দিতেন, দেওয়ানি বিচার করতেন এবং রাজস্ব বিভাগ দেখাশোনা করতেন। যদিও দেওয়ান আর সুবাদারের পদ একই শ্রেণীর ছিল কিন্তু সুবাদার সেনা প্রধান হওয়ায় একটু বেশিই ক্ষমতা ভোগ করতেন

যাইহোক এই দুজনকে রাজকীয়ভাবে একই শ্রেণীর পদ দেওয়ায় এটা পরিষ্কার যে পাদশাহেরা আন্দাজ করেছিলেন দুজনের মধ্যে ঈর্ষার যে লড়াই চলবে তাতে কেন্দ্রিয় শাসন আরও জরদার হবে এবং ভিতরের গুপ্ত তথ্য আরও বিশদে পাওয়া যাবে।

সুবার কাজকর্ম বিষয়ে সুবাদার এবং দেওয়ান পৃথক পৃথকভাবে তাদের মন্তব্য নিয়মিত পাঠাতেন পাদসাহের কাছে।

সদর – মানুষকে বৃত্তি বা নিষ্কর জমি দেওয়ার জন্য সুপারিশদার
কাজি – বিচার বিভাগের প্রধান। সরকার আর পরগণার কাজিদের বিচার ইত্যাদি পরিদর্শন করতেন।
বকশী – সৈন্যদলে লোক নিয়োগকর্তা, হিসাবও রাখতেন, মাইনে দিতেন(বলছেন আচার্য যদুনাথ), প্রাদেশিক সৈন্যরা যাতে কর্মক্ষম থাকে তারজন্য উনি দেখাশোনা করতেন।
ওয়াকিয়ানবিশ – সংবাদলেখক। রোজ পাদশাহকে প্রদেশের সংবাদ পাঠতেন। গুপ্তচর নিয়োগ করতেন।
কোতয়াল – রাজধানীর আইনকানুন, শৃঙ্খলা, পরিচ্ছন্নতা, স্বাস্থ্য ইত্যাদি দেখতেন
মীরবহর – নৌকোর, ফেরি, আমদানি শুল্ক ইত্যাদি আদায়ের ব্যবস্থা করতেন।

সরকার বা জেলার শাসনকাঠামো
ফৌজদার – সৈন্যদলের সাহায্যে সরকারের শৃঙ্খলা বজায় রাখতেন।
আমলগুজার – রাজস্ব কর্মচারী। বন্দোবস্ত নেওয়া প্রজাদের জমির বন্দোবস্ত নিতেন, খাজনা ধার্য, খাজনা আদায়, কৃষকদের নিরাপত্তা/সুরক্ষার ব্যবস্থা করতেন। কৃষকদের চাষ পতিত জমি উদ্ধারের জন্য অগ্রিম অর্থ দাদন দিতেন।
কাজি – সরকারের মামলা মোকদ্দমার বিচার করতেন।
কোতয়াল – নগররক্ষল্ক
বিতিকিচি – রাজস্ব কর্মচারী, কানুনগোদের বড় আধিকারিক। পরগনার কানুনগোরা যে সমীক্ষা পাঠাতেন সেগুলো পরীক্ষা করে খাজনা ধার্য করতেন।
খাজনাদার – জেলা বা সরকারের কোষাধ্যক্ষ্য। গ্রাম বা পরগণার আদায়ীকৃত সমস্ত খাজনা এরই মাধ্যমে রাজস্ব বিভাগে জমা পড়ত।

পরগনার শাসন কাঠামো
শিকদার – পরগনা প্রধান। তার অন্ত্যতম প্রধান কাজ ছিল কৃষক বা প্রজাদের থেকে খাজনা আদায় করে রাজস্ব দপ্তরে জমা দেওয়া।
আমিল – চাষীর সঙ্গে প্রত্যক্ষ যোগ থাকত। খাজনা ধার্য আর আদায় করতেন।
ফোতেদার – পরগনার রাজস্ব আধিকারিক
কারকুন – পরগনার হিসাবলেখক। যে খাজনা আদায় হত তার হিসেব লিখতেন।
কানুনগো - পরগনার কানুনগোরা ছিলেন জমিজমার আইন বিশারদ। এরা গ্রামের পাটোয়ারিদের প্রধান ছিলেন। কানুনগোরা ভূমি আইন, বিভিন্ন প্রকার বন্দোবস্তের স্বরূপ ও খুঁটিনাটি, খাজনা ধার্যের হিসেব আর খাজনা আদায় বিষয়ে নিয়মিত নজরদারি করতেন। এরা আদায়ের ওপর ১টাকা আদায় পেতেন। পরে তাদের কিছু জমির ব্যবস্থা করে দেওয়া হয় এবং মাসিক ২০-২৫ টাকা বেতন দিতেন।
চৌধুরী – পরগনার জমিদার, আর খাজনা আদায়ে সাহায্য করতেন।

মৌজা বা গ্রামস্তরের শাসনব্যবস্থা
মুকদ্দোম – গ্রাম প্রধান। তার কাজ ছিল আইনশৃঙ্খলা দেখা, মামলা মোকদ্দমার বিচার করা আর খাজনা আদায়ে সাহায্য করতেন।
পাটোয়ারি – প্রজাদের বন্দোবস্ত নেওয়া জমির খাজনা ধার্য করতেন এবং আদায়ে সাহায্য করতেন।
এছাড়াও ছিলেম আমিন সহ আরও বহু কর্মচারী যাদের পরিশ্রমে সঠিক সময়ে সঠিক রাজস্ব আদায় হত।

জমির বিলিবন্টন ও রাজস্ব আদায়ের পদ্ধতি৬

আকবরের প্রশাসনিক ও রাজস্ব পরিকল্পনা

জাবতি নিয়মে খাজনা ধার্য দুটি জিনিসের ওপর নির্ভর করত
ক) দস্তুর(দস্তুর কি এর আগে বিশদে বলা হয়েছে – উত্তম, মধ্যম এবং সাধারণ জমির বিঘা প্রতি গড় ফলন হার বার করা হত। তার গড় ফলনের একতৃতীয়াংশ সরকারি প্রাপ্য খাজনা। প্রথম দিকে এই হার দিল্লি থেকে তৈরি হত, ফলে তাতে রাজস্ব আদায়ে বিলম্ব হত। বিলম্ব রুখতে আকবর ১৫৭১-১৫৮০ এই দশ বছরে বিভিন্ন ফসলের গড় মূল্য নিয়ে দস্তুর তৈরির আদেশ দিলেন, ফলে দস্তুর তালিকা আর প্রতিবছর করতে হল না। বিভিন্ন অঞ্চল বা সুবায় বিভিন্ন শ্রেণীর শস্যের জন্য বিশদ দস্তুর থাকত।

প্রতিবছর চাষের মরশুমে রাজস্ব কর্মচারীরা আগের বছরের উৎপাদন অঙ্ক মিলয়ে কোন কোন নতুন জমি চাষ করা হল মেপে পরিমান নির্নয় করতেন। কোন গ্রামের সম্পূর্ণ জমি মাপা(কিস্তোয়ার) হলে মুকদ্দম(গ্রাম প্রধান) তা মুনতাখাব তালিকায় লিখতেন, এবং দুটি নকল করে আলমগুজারের কাছে প্রতিসপ্তাহে পাঠিয়ে দিতেন। তাতে লেখা থাকত গ্রামের নাম, মুকদ্দমের নাম, কৃষকের নাম, শস্যের নাম, জমির পরিমান ইত্যাদি। তাতে চাষীর মোট জমির থেকে পতিত জমির(নাবুদ) পরিমান বাদ দিয়ে কর্ষিত জমি(বুদ) পরিমান নির্নয় করা হত। তারপর বিতিকিচি তালিকা দেখে দস্তুর মিলিয়ে রাজস্ব নির্নয় করতেন। ফসল কাটার আগে প্রত্যেক চাষীকে তার দেয় রাজস্বের অঙ্ক জানিয়ে দেওয়া হত।)

খ) দ্বিতীয়টি হল, গ্রামের বিভিন্ন জমির পরিমানের একটি খসড়া তালিকা তৈরি করা হত। এটা করা হত জরিপ পদ্ধতিতে। জাবতি জরিপ পদ্ধতিতে মাপজোক করা হত একটা বাঁশ দিয়ে, বাঁশের দুদিকে হাতল থাকত। যে সব জরিপ কর্মী কাজ করতেন তাদের পারিশ্রিমিক ছিল বিঘা প্রতি ১ দাম। নিরাপত্তা সরকার থেকে করা হত। আহারের খরচও পেতেন। আকবরের মাপার একক ছিল এলাহি গজ। ৩৬০০ বর্গগজে এক বিঘা। জাবতি পোলজ জমির ক্ষেত্রে সারা বছর প্রযোজ্য হত। পারৌতিতে যখন চাষ হত তখন পুরো খাজন ধার্য হত। চাঁচর বা বানজর জমিতে নামমাত্র রাজস্ব নেওয়া হত। জাবতি প্রথায় যদি দেখা যেত খাজনা ধার্যের পরে প্রাকৃতিক কারণে শস্য হানি ঘটেছে, তাহলে খ্যাজনা রেহাই দেওয়া বা কমানো হত।

৩) নসক – এই নিয়মে সরাসরি চুক্তির মাধ্যমে কৃষকদের থেকে খাজনা নেওয়া হত। অনেকটা জমিদারি পদ্ধতিতে এই আদায় হত। ফসল কত হত দেখা হত না। বাংলা, বেরার, কাশ্মীর এবং গুজরাটের কোন অংশে নসক প্রথায় খাজনা আদায় করা হত।নসকে জমি মাপার দরকার হত না, দস্তুর তৈরি হত না বা মুকদ্দমের প্রয়োজন ছিল না। প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে চাষ নষ্ট হলে খাজনা মকুবের ব্যবস্থা ছিল। পতিত জমির জন্য কোন খাজনা নেওয়া হত না।


আকবরের সময় জমির মাপ
এক বিঘে হত ৩৬০০ বর্গগজে। এক গজ ছিল ৪১ আঙ্গুল(১ আঙ্গুল = ৩/৪ ইঞ্চি), আজকের আড়াই ফুটের একটু বেশি। এই গজকে বলা হত এলাহি গজ। ১ বিঘার ২০ ভাগের ১ ভাগকে বলা হত বিশওঁয়া(কাঠা) বা ১৮০ বর্গগজ। ১ বিশওঁয়ার ২০ ভাগের ১ ভাগকে বলা হত ১ বিশওঁয়াশা অর্থাৎ ৯ বর্গগজ।

তাঁর সময়ে ৯ বিশঁওয়া বা ৮১ বর্গগজের জমি খরাজ মুক্ত ছিল, কোন রাজস্ব দিতে হত না। কিন্তু কেউ যদি ১০ বিশওঁয়া জমি বন্দোবস্ত নিতেন তার ১ বিশওঁয়ার জন্য রাজস্ব দিতে হত।


এর আগে জানিয়েছি আকবরের সময়ে জমি মাপা হত লম্বা বাঁশের সাহায্যে। তার আগে দড়ি মাপে বেড়ে যেত বলে এই ব্যবস্থা। এটা এক জরিপ।

জমির বিলিবন্টন ও রাজস্ব আদায়ের পদ্ধতি৫

আকবরের প্রশাসনিক ও রাজস্ব পরিকল্পনা

আকবর রাজত্ব পেয়ে তাঁর রাজত্বকে ১২টি সুবায় ভাগ করেন ১) কাবুল, ২) লাহোর, ৩) মুলতান, ৪) দিল্লি, ৫) আগ্রা, ৬) অযোধ্যা, ৭) এলাহাবাদ, ৮) বিহার, ৯) বাংলা, ১০) আজমীর, ১১) মালব, ১২) আহম্মদাবাদ। তাঁর শেষ জীবনে দাক্ষিণাত্য বিজয়ে আরও তিনটি সুবা তাঁর সাম্রাজ্যের অন্তর্ভূক্ত হয়েছিল, ১) আহমদনগর, ২) খান্দেশ, ৩) বেরার।

এবারে আকবরের দেওয়ানি বা প্রশাসনিক ব্যবস্থা নিয়ে আলোচনা করা যাক।
তাঁর প্রথম দেওয়ান ছিলেন মুজাফর তুরমতি খান। তাঁর সহকারী হিসেবে প্রথম জীবনে কাজ করেছেন টোডরমল্ল। টোডরমল্ল প্রথমে গুজরাটের ভূমিজরিপ করে ভূমির উতপাদকতা অনুসারে রাজস্ব নির্ধারণ করেন। কিন্তু এই নীতি আকবর গ্রহণ নিলেন না।

আকবর গোটা সাম্রাজ্যকে ১৮২ পরগণায় ভাগ করেন(বাংলা-বিহার বাদ দিয়ে)। প্রত্যেক পরগনায় একজন করে রাজস্ব কর্মচারী থাকতেন। এদের পদ ছিল ক্রোরী। এদের দায় ছিল প্রত্যেক পরগনা থেকে এককোটি মুদ্রা রাজস্ব আদায় দিতে হবে। পরে বোঝা গেল এতে কৃষজকদের ওপর অত্যাচার বাড়বে। এই পরিকল্পনা বাদ দেওয়া হয়।

১৮৫২য় দেওয়ান হলেন টোডরমল্ল। টোডরমল্ল জরিপ করে উর্বরতা অনুসারে জমিকে চারটি শ্রেণীতে ভাগ করেন।
১) পোলজ – সারা বছর ধরে চাষের উপযোগী
২) পারৌতি – যে জমির উর্বরতা বৃদ্ধির জন্য কিছু সময় ফেলে রাখতে হয়।
৩) চাচর – যে জমিকে সারা বছর ৩।৪ বছর ফেলে রাখতে হয়।
৪) বানজর - খুব অনুর্বর, ৫।৬ বছর অনাবাদী ফেলে রেখে একবার চাষ করতে হত।

তিনি রাজস্ব আদায়ের তিনটে পদ্ধতি চালু করেছিলেন
১) গল্লাবক্স – সাবেক ভারতীয় রাজস্ব আদায়, জমির উৎপাদনের একতৃতীয়াংশ রাজস্ব। এই নিয়ম চালু ছিল কাবুল, কাশ্মীর, খাট্টায়। জমিতে ফসলের পরিমান মেপে দেখা হত না। অনুমানে শস্যের পরিমান স্থির করা হত। তারপরে নগদ অর্থে ঐ পরিমান মূল্য বিবেচিত হত। ঐ মূল্যের একতৃতীয়াংশ সরকার খাজনা হসেবে নিত।

২) জাবতি – বাংলা, বেরার, কুমায়ুন এবং খান্দেশ ছাড়া প্রায় কোন সুবাতেই জাবতি প্রথার চল ছিল না। জাবতি আসলে জরিপ ব্যবস্থা। এই নয়ম হল রায়তারি। যা চাষী বা রায়তের সঙ্গে সরকারের প্রত্যক্ষ খাজনা আদায়ের সম্পর্ক। জাবতি নিয়মে গ্রামের যে সকল জমিতে ফসল চাষ করা হয়েছে তার প্রত্যেকটিতে খাজনা ধার্য করা হত নগদ টাকায়। প্রত্যেক চাষের মরশুমে রাজস্ব কর্মচারীরা প্রতিটি জমির খসড়া তালিকা তৈরি করত। তাতে দখলকারের নাম, ফসলের নাম, জমির পরিমান ইত্যাদি লেখা থাকত। জমির পরিমানের সঙ্গে সরকারি দস্তুরে প্রকাশিত বিভিন্ন শস্যের নগদ অর্থে নিঘা প্রতি প্রদেয় রাজস্বের হার গুণ করে কৃষকের রাজস্বের পরিমান নির্ধারণ করে, তাকে ফসল কাটার আগেই তার প্রদেয় রাজস্বের পরিমান জানিয়ে দেওয়া হত।

ধরা যাক পাঞ্জাবের এক আখ চাষী তিন বিঘায় চাষ করেছে। দস্তুর মিলিয়ে দেখা গেল এক বিঘা আখ চাষের জন্য ঐ অঞ্চলের রাজস্ব হল ২২ দাম(দাম হল তামার মুদ্রা, ৪০ দামে ১ টাকা)। তাহলে চাষীটি তিন বিঘার জন্য সরকারকে খাজনা দেবে ৬৬ দাম মানে ১টাকা ২৬ দাম।

জমির বিলিবন্টন আর রাজস্ব আদায়ের পদ্ধতি৪

যদিও এটা এই প্রবন্ধের বিষয় এটা নয়, তবুও তাঁর প্রশাসনিক বিভাগের কথা বলা যাক,
কেননা এই প্রশাসনিক বিভাগ, যার ওপর ভিত্তি করে রাজস্ব আদায়ের কাঠামোটা দাঁড়িয়ে থাকে, সেটা জানা জরুরি। এবং এই কাঠামোটা আগামী দিনে মুঘল পাদসাহীর পাদসাহরা বিশেষ করে আকবর অনুসরণ করবেন।
শের শাহ সাম্রাজ্যকে প্রশাসনিকভাবে তিনভাগে ভাগ করেছিলেন।
১। কিল্লা বা সামরিক সাসনকর্তা শাসিত অঞ্চল – যেমন লাহোর, পাঞ্জাব, আজমীর, মালব, প্রভৃতি। এখানকার শাসনকর্তার নাম ছিল কিল্লাদার।
২। ইকতা বা প্রদেশ – এই অঞ্চলকে মুঘল যুগে সুবা বলা হত। আজকের প্রদেশের মত। শাসনকর্তাদের বলা হত ইকতাদার।
৩। বাংলা প্রদেশের জন্য বিশেষ এক শাসনব্যবস্থা।
১৫৪৬ সালের খ্রিষ্টাব্দের পর শেরসাহ বাংলায় আর কোন ইকতদার নিয়োগ করে নি। বাংলাকে ৪৭টি সরকারে ভাগ করে প্রত্যেকভাগে একজন করে শিকদার নিয়োগ করেছিলেন। সরকার অনেকটা স্বাধীন রাজ্যের মত ছিল, কিন্তু কেন্দ্রের অধীন। সরকারে শাসক শিকদারের উর্দ্ধতন রাজ কর্মচারীর নাম ছিল কাজী ফজিলত। তাঁর কাছেই শিকদারেরা খাজনা জমা দিতেন। কাজী ফজিলত সমস্ত খাজনা জড়ো করে একত্রে দিল্লীতে পাঠাতেন।
ইকতার রাজস্ব আদায়ের কৌশল আলোচনা করতে সে সময়ের ইকতার কাঠামো এবং সরকারী কর্মচারীদের পরিচয় বর্ণনা করা হল-
ইকতা/প্রদেশ – শাসনকর্তা বা ইকতাদার
সরকার/জেলা – ভারপ্রাপ্ত কর্মচারী বা শিকদারিশিকদারান(শাসনকর্তা)।
মুনসেফিমুনসিফান(বিচার কর্তা)
পরগণা – (থানা) ভারপ্রাপ্ত কর্মচারী - শাসনে শিকদার আর বিচারে মুনসেফ
আমিন – জমি পরিমাপ বিশেষজ্ঞ এবং জমি-সংক্রান্ত বিচারক
ফোতেদার – রাজস্ব জমা আধিকারিক(ট্রেজারি অফিসার)
কানুনগো – জমিজমার আইনকানুন বিশেষজ্ঞ
কারকুন – জমিজমা ও ফসল ইত্যাদির বা রাজস্ব আদায়ের হিসেবরক্ষক। দুজন কারকুন
থাকতেন, একজন স্থানীয় ভাষায় অন্যজন ফারসি ভাষায় লিখতেন।
মৌজা/দেহাত/গ্রাম – শাসনের বা রাজস্ব আদায়ের সব থেকে ছোট একক। ভারপ্রাপ্ত কর্মচারী
পাটোয়ারি, এরা গ্রামের জমিজমা, ফলন ইত্যাদির হিসেব রাখতেন।  
মুকদ্দম – গ্রামের মোড়ল, এরাই খাজনা আদায় করতেন চাষীদের থেকে।
চৌকিদার – পাহারাদার
গ্রামপঞ্চায়েত – বিচারব্যবস্থা ইত্যাদি পরিচালনা করত
শের শাহের আগে গোটা গ্রামে রাজস্ব ধার্য হত। শের শাহ গ্রামের দেয় মোট খাজনা,
চাষীদের মাথা পিছু করে ভাগ করে দিলেন। মুকদ্দমের কাজ ছিল সেই খাজনা সরকারের পক্ষ থেকে আদায় করা। তিনি চেষ্টা করতেন সব থেকে বেশিই কি করে আদায় করা যায়। শের শা ঠিক রলেন গ্রাম নয় খাজনা ধার্য হবে ব্যক্তি চাষীর মাথাপিছু।
অবশ্যই এটা আদায় করবেন মুকদ্দম। তাকে একটা মুচলেকা দিতে হত। কিছু নগদও অর্থ জামিন হিসেবে রাখতে হত। রায়তদের অধিকার ছিল মুকদ্দমের কাছে বা রাজস্ব দপ্তরে গিয়ে রাজস্ব জমা দেওয়ার।
গ্রামে পাটোয়ারির নেতৃত্বে কারকুন সেই হসেব রাখত। সেই রাজস্ব জমা হত পরগনায়। সমস্ত পরগনার রাজস্ব জমা জড়ো হয়ে ইকতারে চলে যায়। ইকতাদারেরা সেই জমা রাজস্ব দিল্লীতে পাঠাতেন।
রাজস্ব শস্যে বা নগদেও নেওয়া হত। রাজস্ব কর্মচারীরা যখন গ্রামে নানান কারণে – জমিজমার বিবাদ, জমি পরিদর্শন ইত্যাদির জন্য আসতেন, তাদের আহার থাকার ব্যবস্থা করতে হত প্রজাদেরকেই।
মোটামুটি শের শাহ পাঁচ বছর ক্ষমতায় ছিলেন, তার পরিকল্পনার মাথা ছিল খুব পরিষ্কার। আমরা পরমে দেখিয়েছি, তার মুদ্রা ব্যবস্থা আকবর গ্রহণ করেছিলেন, এখানেও দেখব তার ভূমিরাজস্ব ব্যবস্থা ভারতের ইতিহাসে অন্যতম প্রধান পরিকল্পক আকবর গ্রহণ আর বিস্তৃত করেন। সেটাও খুব গুরুত্বপূর্ণ ইতিহাস।

জমির বিলিবন্টন ও রাজস্ব আদায়ের পদ্ধতি৪

শের শাহর আমলে জমি জরিপ ও খরাজ ব্যবস্থা
শের শাহর আমলে কিসমতিগল্লা(ব্রিটিশরা লিখবে কিসমত-ই-গল্লা। অন্তত বাংলায় বড় আরবি বা ফারসি শব্দ ব্রিটিশদের অনুসরণে ভেঙ্গে লেখার প্রথা বন্ধ হোক। এটা ঔপনিবেশিক পদ্ধতি। ইওরোপিয়রা বড় সমাসবদ্ধ শব্দ বুঝতে পারত না বলে ভেঙ্গে লেখার চল করেছে। একগজি(মুজতাবা আলি উবাচ) সংস্কৃত বা জার্মান সমাসবদ্ধ পদ যখন আমরা ভেঙ্গে লিখি না, তাহলে বন্ধু আরবি ফারসি বড় সমাসবদ্ধ পদ অর্বাচীন অবুঝ ইওরোপিয়দের মত ভেঙ্গে লেখার কোন যুক্তি দেখি না। এই যুক্তি দেখিয়েছিলেন মরহুম মুসতাফা সিরাজ মশাই) অর্থাৎ উৎপন্ন ফসলের একতৃতীয়াংশ খাজনা হিসেবে আদায়ের যে নিয়ম চালু ছিল তার সঙ্গে তিনি চালু করলেন জরিপ প্রথায় আদায়। জমি বন্দোবস্তের সময় চাষীদের খাজনা দেওয়ার প্রথা বেছে নেওয়ার সুযোগ দেওয়া হত। অর্থাৎ পুরোনো কিসমতিগল্লা না জমি জরিপ করে ফসলের উৎপন্ন পরিমান ঠিক করা হত, তারপরে তার ১/৩ অংশ নেওয়া হত। চাষীরা তাদের সুবিধে মত ইচ্ছে প্রকাশ করত। তখন জমির পরিমান, কি কি ফসল কৃষক চাষ করবে ইত্যাদি ঠিক হত।
এবারে তিনি তার কর্মচারীদের জানালেন তিনি জানেন যে রাজস্ব কর্মচারীরা চাষীদের থেকে একটু বেশি অর্থ নিয়েই থাকে। তিনি দুটি ব্যবস্থাতেই তাদের প্রাপ্য আদায় ঠিক করে দিলেন কারণ এই প্রাপ্য চাষীদেরই দিতে হত।
পাট্টা ও কাবুলিয়তের মাধ্যমে তিনি বিলিবন্দোবস্ত সরকার আর প্রজাদের মধ্যে ঠিক করলেন। জমির দলিল করে(পাট্টা) চাষীদের বিস্তারিত জানালেন, রাষ্ট্র কোন জমি, কত পরিমান, কত খাজনায় তার সঙ্গে বন্দোবস্ত করল। এই পাট্টায় লেখা থাকত কোন ধরণের প্রথায় সে রাজস্ব দিতে চাইছে, কোন ধরণের ফসল সে চাষ করবে ইত্যাদি।
উল্টোভাবে প্রজাও সরকারকে তার জমি বন্দোবস্ত নেওয়ার কথা স্বীকার করে দলিল করে দিত। এর নাম হল কবুলিয়ত বা কবুলতি।
অর্থাৎ রাষ্ট্র লিখিতভাবে পাওনা খাজনা বা রাজস্বের দাবি প্রজাকে জানাত, এবং খাজনা পাওয়ার পর রাষ্ট্র লিখিতভাবে কত পরিমান সে পেয়েছে তা প্রজার কাছে স্বীকার করে নিত।
মাপজোকের জন্য তাঁর একক ছিল সিকন্দরি গজ(এর আগে আলোচনা করেছি)। আজ যেমন সেটেলমেন্ট দপ্তরের গান্টার চেন থাকে জরিপের জন্য, এ গান্টার চেন সমান ২২ গজ। শের শাহের সময় ৬০ গজকে বলা হত ১ জরিপ। এবং ৩৬০০ বর্গগজ ছিল ১ বিঘা।
জমির উর্বরতা বুঝতে জমিগুলিকে তিনভাগে ভাগ করলেন, উত্তম, মধ্যম এবং সাধারণ। প্রত্যেক মরশুমি ফলনের হার তিন প্রকার জমিতে সরজমিনের ফসল-ফলন থেকে নির্ণয় করা হত। তারপর এই গড় অঙ্কই হত ফসলটির বিঘা প্রতি ফলনের পরিমান।
সরকারের প্রাপ্য হল এই ফসলের পরিমানের একতৃতীয়াংশ। বিভিন্ন শস্যের এই বিঘাপ্রতি ফলনের ওপর নগদ অর্থে রাজস্ব দাবির যে তালিকা প্রস্তুত হত তার নাম দস্তুর।
ধরাযাক বাংলা সুবার গৌড়ের কোন জমিতে আখের ফলন উত্তম জমিতে ২০ মণ, মধ্যম জমিতে ১৫ মণ আর সাধারণ জমিতে ১০  মণ। মোট ফলন দাঁড়াল ৪৫ মণ। বিঘাপ্রতি গড় দাঁড়াল ৪৫/৩ = ১৫ মণ। সুতরাং জরিপ নিয়মে গৌড়ের আখের ফলন বিঘা প্রতি ১৫ মন ধরা হবে। কোন চাষীর যদি ৬ বিঘা থাকে, তাহলে তার জমিতে উৎপন্ন আখের পরিমান হবে ৯০ মণের এক তৃতীয়াংশ ৩০ মণ।
এরকম করে জরিপ নিয়মে প্রত্যেক ফসলের খাজনা নির্দিষ্ট করা হল। চাষী সরকারি কর্মচারীর কাছে বা রাজস্ব নেওয়ার দপ্তরে তার নির্ধারিত খাজনা নেওয়া হত।

এর সঙ্গে ছিল জায়গীরদারদের বন্দোবস্তের জমি। এরা শের শাহর বড় সেনাপতি ছিলেন - খাওয়াজ খাঁ, হাজি খাঁ, সুজাত খাঁ ইত্যাদি। এখানে জরিপ নয়, কিসমতিগল্লা প্রথা চালুছিল। অর্থাৎ তাঁর খাস জমিতে শুধু দুটি চরিত্রে রাজস্ব নিতেন আর জায়গিরদের কিসমতিগল্লায়।

জমির বিলিবন্টন আর রাজস্ব আদায়ের পদ্ধতি৩

তবে আঞ্চলিক নানান রীতি চালুছিল
১) উৎপন্ন ফসলের অংশ
এটা আগে আলোচিত হয়েছে - অনেকটা আধিয়ার বা ভাগচাষীদের মত। এই ভাগাভাগিতে চাষীদের সুবিধে ছিল প্রকৃত ফলনের ওপর চাষী তার খাজনা শোধ করলে, ভবিষ্যতে আর ধার বকেয়া কিছুই থাকত না।
২) জরীপ পদ্ধতিতে অর্থাৎ জমি মাপ করে, জমির পরিমান নির্ধারণ করে খাজনা ধার্য করা - এই উপায়ে বিঘা প্রতি প্রতিটি ফসলের ফলনের হার সরকার আগে থাকতেই তৈরি করত। পরে চাষীর বন্দোবস্ত নেওয়া জমির পরিমান স্থির করে তার জমির উৎপন্ন ফসলের হিসেব বার করা হত। এর একতৃতীয়াংশ সরকার খাজনা নিত। ধরা যাক কোন পরগনার আমন ধানের বিঘা প্রতি ফলনের সরকারি হার হল ২০ মণ। কারোর যদি দশ বিঘা জমি থাকে, ঐ পরিমান জমিতে সের যদি আমন ধান ফলিয়ে থাকে, তবে ধরে নেওয়া হবে সেই জমিতে ২০০ মণ ধান হবে। এক্ষেত্রে ঐ চাষী সরকারকে মোট উৎপন্নের ২/৩ অংশ খাজনা হিসেবে ধান দেবে।
৩) চুক্তিমত খাজনা আদায় – এছাড়া ছিল চুক্তি খাজনা। কোন কোন পরগণায় সরকার কৃষকের সঙ্গে বন্দোবস্ত দেওয়া জমির জন্য চুক্তিমত বাৎসরিক খাজনা ঠিক করত। যেমন ধরা যাক কোন রায়ত তার কুড়ি বিঘে জমির ওপর বাৎসরিক খাজনা দেবে ঠিক হল বিঘে প্রতি ৫ টাকা। মোট ১০০টাকা। জমিতে যতই ফসল ফলুক সেটা পাটোয়ারি বা মুকদ্দম দেখতে যাবে না। সরকার ঐ জমি থেকে ১০০টাকা পেয়েই খুশি।
৪) লাঙ্গল হিসেবেও খাজনা আদায় কোন কোন স্থানে চালু ছিল। এটা ভারতীয় পুরোনো পদ্ধতি। এক একটা লাঙ্গল আর উৎপাদন সরঞ্জামকে উৎপাদনের ক্ষমতা হিসেবে ধরা হত। কোন এলাকায় কোন রায়তের ১০ খানা লাঙ্গল আছে এবং তার জমি ৩০০ বিঘে। সরকার লাঙ্গল পিছু কর ধার্য করে বার্ষিক ১৭ টাকা। তিনি যাই চাষ করুণ না কেন সরকারকে ১৭০ টাকা খাজনা দিলের চাষীর দায় শেষ হয়ে যাবে। সরকারি কর্মচারী তার উৎপন্ন ফসলের পরিমান দেখতে যাবেন না।
জমিতে চাষীদের দখলি সত্ত্ব
এই আমলে চাষীরা ঠিকমত খাজনা না দিতে পারলে শাস্তি হত দৈহিক, কয়েদ বা স্ত্রীপুত্র কন্যাদের বেচে দিয়ে টাকা উসুল করা হত। কিন্তু চাষীকে কোনভাবেই উচ্ছেদ করা হত না – সেটা রাজস্ব বিভাগের আদেশ থেকেই বোঝা যেত। তখন জমি বেশি ছিল আর চাষী কম ছিল। কৃষকেরা জমি চাষ করলেই তো রাজস্ব আদায় এবং রাষ্ট্র আর কর্মচারীদের আয়। চাষী যত বেশি জমি চাষ করবেন রাজস্ব তত বৃদ্ধি পেত। যে রায়ত ঠিকমত চাষ করছে, নিয়মিত খাজনা দিচ্ছে তাকে উচ্ছেদ করে নতুন চাষী বসানোর প্রশ্নই উঠত না। যদি চাষী জমি চাষ না করত, তাহলেও বিকল্প চাষী না পাওয়া পর্যন্ত তাকে তার জমিতেই বসিয়ে রাখা হত। সরকারি নীতি ছিল নেই মামার থেকে কানা মামা ভাল। শতাব্দীর পর শতাব্দী চাষীকে নিজের জমিতে বসিয়ে রাখার চেষ্টা শেষে নিয়মের মত হয়ে দাঁড়াল, কালক্রমে এটা চাষীর প্রায় দখলিসত্ত্বে পরিণত হল। অর্থাৎ বছরে বছরে নর্দিষ্ট সময়ে খাজনা দিলে চাষীর জমি চাষীর দখলে থাকবে।
রাষ্ট্রর রায়ত বিষয়ে কয়েকটা নীতি ছিল
১) রায়ত চাষীকে জমিতে আটকে রাখার চেষ্টা
২) নতুন নতুন পতিত জমিকে উদ্ধার করে চাষীকে দিয়ে তাকে চাষ করানোর উৎসাহ দেওয়া।
৩) জমিতে যাতে উন্নত মানের ও উন্নত জাতের ফসলের চাষ হয় তা দেখা অর্থাৎ সে ধানের যায়গায় যদি আখের চাষ করে তাতে তাকে উৎসাহ দেওয়া। তাহলে রাজস্ব বেশি আদায় হবে।
এই খরাজ বা ভূমিব্যবস্থা হুমায়ুনের আমল পর্যন্ত চলেছিল।

জমির বিলিবন্টন আর রাজস্ব আদায়ের পদ্ধতি২

রাজস্ব আদায়ের পদ্ধতি
জমির বিলিবন্টন আর রাজস্ব আদায়ের পদ্ধতি
গ্রামে, মহালে এবং পরগণায় খাজনা আদায়ের কাঠমো আলোচনা করা গেল-
গ্রাম পাটোয়ারি – জোতজমি, জমা ফসলের হিসেব রাখতেন।
মুকদ্দম – গ্রামের মোড়ল। এর মাধ্যমেই গ্রামের কৃষি জমি বিলি-বন্দোবস্ত হত এবং গ্রামের ওপর ধার্য করা খাজনা আদায় করে সরকারকে দিতে বাধ্য থাকতেন।
পরগনা – একজন পাটোয়ারি গ্রামে যে জমিজমার হিসেব রাখতেন, পরগণার কানুনগো তাঁর অধীন গ্রাম সমূহের জমিজমা, তার ফসল, দখলদার ইত্যাদির হিসেবও রাখতেন। সেযুগে একজন পরগনার কানুনগো আদায়ের ওপর শতকরা এক টাকা আদায় পেতেন। কানুনগো ছিলেন জমিজমা এবং প্রজাসত্ত্বের আইনিকানুন বিষয়ে অভিজ্ঞ ব্যক্তি। তার সমীক্ষাতেই সরকার থেকে গ্রামের খাজনা আদায় হত। আবুলফজলের মতে কানুনগোরাই হল চাষীদের ভরসাস্থল।
চৌধুরী বা পরগনার প্রধান
গ্রামগুলোর খাজনা চৌধুরীদের কাছে জমা হত। এরাও আদায়ের ওপর একটাকা করে পেতেন।
আমিন
জমিজমা মাপজোক করে চাষীদের মধ্যে জমি বিলি করার অধিকারী। জমি বিবাদের যথোপযূক্ত মিমাংসা করার দায় ছিল তাঁর ওপরে।
পরগনার দায়িত্বে থাকা চৌধুরীরা আদায়ী খাজন জমা দিতেন জেলা বা সরকারি রাজস্ব বিভাগে। সেখান থেকে রাজস্ব, প্রদেশ বা ইকতার সরকারি কোষাগারে জমা হত।
খাজনা সাধারণত গ্রহণ করা হত ফসলে। নগদে দিলে রাজস্ব কর্মচারীরা খুশিই হতেন। ফসলের মূল্য চলতি বাজার দরে ধরা হত।
খাননা আদায়ের হার
সুলতানি যুগের আগে ফসলের এক ষষ্ঠাংশ খাজনা দিতে হত। ব্যতিক্রমও ছিল। সুলতানি আমলে ছিল একতৃতীয়াংশ। কোন জমিতে যদি উৎপন্ন ধানের পরিমান হত তিন মণ, তাহলে সরকারি খাজনা হবে ১ মণ ধান, চাষীর থাকবে ২ মণ।

জমির বিলিবন্টন আর রাজস্ব আদায়ের পদ্ধতি১

১) জায়গীরদারদের মাধ্যমে
সাম্রাজ্যের এক একটা বড় অঞ্চল জায়গীরদের মধ্যে বিলি করা হত, এরা প্রায় সকলেই বড় বড় সেনাপতি হতেন। এই জায়গীর অঞ্চলগুলি ছিল একটা রাজ্যের মধ্যে, আরেকটা রাজ্যের মত। এই জায়গিরদারেরা সম্রাটকে যুদ্ধবিগ্রহে সাহায্য করতেন। এদের বেতন নগদ টাকায় দেওয়া হত না। নির্দিষ্ট করে দেওয়া ভূসম্পত্তি থেকেই আদায় করা খাজনায় তাদের সামগ্রিক খরচ নির্বাহ হত। যদুনাথ সরকার বলছেন মুঘল সাম্রাজ্যটা দাঁড়িয়েছিল এই জায়গিরদারদের ক্ষমতার ওপরে।
এই জায়গীরদারেদের আভ্যন্তরীণ কৃষি রাজস্ব বা খরাজ আদায়ে সম্রাট খুব একটা হস্তক্ষেপ করতেন না।
২) আঞ্চলিক জমিদারদের/ভূস্বামীদের মাধ্যমে
সুলতানি থেকে মুঘল হয়ে নবাবী আমলের পাঁচশ বছরের রাজস্ব আদায়ের চক্র ছিল, সে সময়ে বিভিন্ন এলাকার অমুসলমান এলাকা প্রধানদের এক প্রকার স্বাধীনতা স্বীকার করে নিয়েছিলেন রাষ্ট্রপ্রধানেরা – যেমন বিষ্ণুপুর বা দিনাজপুরের রাজারা। এর বিনিময়ে জমিদারেরা সম্রাটকে একটা বাৎসরিক কর দিতেন।
আবার অনেক সময় করদ রাজ্যগুলো সম্রাটকে যুদ্ধের সময় সৈন্য এবং রসদ দিয়ে সাহায্য করতেন – যেমন রাজপুতানার রাজারা।
এই রাজ্যগুলোর অভ্যন্তরীণ কৃষিজমির বিলিবন্দোবস্ত আর খাজনা আদায় রাজা বা জমিদারেরা অতীতের সাবেকি রীতিতেই করতেন। তাদের আভ্যন্তরীণ রাজস্ব প্রশাসন নিয়ে সম্রাটেরা এক্কেবারেই মাথা ঘামাতেন না, তবে রাজস্ব দেওয়া বন্ধ হলে সম্রাটেরা জমিদারদের উৎখাত করে নতুন জমিদার বসাতেন।
৩) খালসা জমির বন্দোবস্ত
এর বাইরে যে জমি পড়ে থাকে তা হল সরকারের খাস জমি। এর নাম খালসা জমি। এই সমস্ত জমির বিলি বন্দোবস্ত, খাজনা আদায় হত রাজস্বমন্ত্রী(দেওয়ান) ও কর্মচারীদের মাধ্যমে। অনেক সময় ইজারাদারদের মাধ্যমে রাজস্ব নেওয়া হত, তাকে একটা নির্দিষ্ট জমি বন্দোবস্ত দেওয়ার মাধ্যমে। ইজারাদার আদতে ব্যবসায়ী। তিনি মোটা টাকা লগ্নী করে চাষীদের থেকে রাজস্ব আদায় করে মোটা মুনাফা করার আশা রাখতেন। ব্রিটিশ আমল পর্যন্ত এই ইজারাদারদের মেয়াদ ছিল এক বছর। ব্রিটিশ আমলে এই ইজারা অনির্দিষ্ট কালের জন্য করে দেওয়া হত। এটা এই সময় উত্তরাধিকার সূত্রে পরের প্রজন্মেও অর্পিত হত ইজারা।
৪) গ্রামের প্রধান ব্যক্তির মাধ্যমে
খালসা জমির আদায় বহু সময় গ্রামের মণ্ডলদের মাধ্যমেও নেওয়া হত। তুর্ক-আফগান সময়ে ব্যক্তি রায়তের ওপর রাজস্ব ধার্য হত না, খাজনা ধার্য হত গ্রামের মোট কৃষিজমির ওপর এবং মুকদ্দমের ওপর ভার থাকত নির্দিষ্ট পরিমান খাজনা আদায় করে সরকারকে নির্দিষ্ট সময়ে জমা দেওয়া। সরকারি খাজনা আদায় না হলে দায়ি থাকত মুকদ্দম। মুকদ্দম গোটা আদায়ীকৃত খাজনার পরিমান গোটা গ্রামের প্রজাদের ওপর বেঁটে দিত।
সূত্রঃ প্রাচীন জরিপের ইতিহাস
অরুণ কুমার মজুমদার

তুর্ক আফগান যুগে জরিপ ব্যবস্থা

মোটামুটি গুপ্ত যুগের তৈরি ভূমি রাজস্ব ব্যবস্থার কাঠামো প্রায় মুঘল আমলের আগে অবদি চলেছে। গুপ্ত যুগে মানুষের ঘরবাড়ি, চাষবাস, জমি ইত্যাদির খতিয়ান তৈরি করতেন গ্রামে কর্মরত একজন সরকারি কর্মচারী নাম পুস্তপালস। তার কর্মচরিত্র পাটোয়ারির কাজকর্মের সঙ্গে তুলনীয়। আমিনদের মত যারা জমির বিলিব্যবস্থা করতেন তার পদের নাম ছিল প্রমাতা। ন্যায়করনিক জমির সীমানা প্রদর্শন করতেন এবং জমি সংক্রান্ত বিবাদ-বিসংবাদ ফয়সালা করতেন।
সেন বংশ উচ্ছেদ করে ১২০৪/৬১১ সালে সুলতানি আমল শুরু হল। বখতিয়ার খলজি এবং তার উত্তরাধিকারীরা দেখলেন ভূমিরাজস্ব আদায় ব্যবস্থা ভেঙ্গে লাভ নেই। কর্মচারীদেরও পরিবর্তন করলেন না, শুধু পদের এবং বিষয়ের নামগুলো পরিবর্তন করে দিলেন। গ্রাম হল মৌজা। মণ্ডল হল পরগণা, বিষয়(জেলা) হল সরকার আর ভূক্তি হল সুবা। রাজস্ব কর্মচারীদের নাম হল পাটোয়ারি, মুকদ্দম, কানুনগো, কারকুন ইত্যাদি। রাজস্ব আদায়ের হারটি এক ষষ্ঠাংশ থেকে বাড়িয়ে দ্বিগুণ এক তৃতীয়াংশ করে নিলেন।
পুরোনো কর্মচারীরাই পুরোনো পদ্ধতিতে নতুন নামে রাজস্ব তুলতে লাগল। ব্রিটিশ আমলের আগে পর্যন্ত তারা দেশে রাজত্বের উত্থান পতন দেখেছেন প্রচুর, রাজশক্তিও গ্রামের পরিচালন ব্যবস্থায় কর নেওয়া ছাড়া হাতও দেয় নি। গাঁইয়ারা বলতেন রাজাগেল রাজা এল মোদের তাতে কি/ নতুন রাজা আসুন বসুন খাজনা নেবেন কি?
আলাউদ্দিন খলজি ঠিক করলেন কোন সরকারি কর্মচারীরা ধনশালী হতে পারবেন না। ফলে তিনি এমন কিছু নীতি নিলেন যাতে কর্মচারীরা দুঃস্থ হয়ে যায়। তাঁর নীতি প্রয়োগ করলেন অর্থউপমন্ত্রী সরাফ কুইয়ানি। বহু কর্মচারীকে কারারুদ্ধ করা হল, রায়তদের সামনে তাদের হেনস্থা করা হল, যে সব গ্রামে রাজস্ব আদায় হয় নি, সে সব গ্রামে কৃষকদের ওপর অত্যাচার করা হল, জমি কেড়ে নেওয়া হল, কারারুদ্ধ করা হল রায়তদের, গ্রামগুলিতে হাহাকার উঠল। কিন্তু শীঘ্র তার মৃত্যু ঘটায় ক্ষমতায় এল তুঘলকরা।
তুঘলকেরা ক্ষমতায় এসে কর্মচারীদের সম্মান ফিরিয়ে দিলেন। বাজেয়াপ্ত জমি, সম্পদ ফিরিয়ে দিলেন, এবং কৃষকদের, কর্মচারীদের মুক্ত করে আবার নতুন করে চাষে কোমর বাঁধতে বললেন। তারা বুঝেছিলেন কৃষকরাই ফসল উৎপাদন করে, রাজত্বের সম্পদের উৎস তারাই। আর কর্মচারীরাই রাষ্ট্রের কর আদায়ের মূল শৃঙ্খল। তাদের ঠিকমত দেখাশোনা না করলে রাজস্ব ঠিকমত উঠবে না। দেশের অভ্যন্তরে ফসল যাতায়াতের নিরাপত্তা দেওয়ার জন্য কেল্লা গড়ে উঠল। কৃষি লাভজনক করতে খাল কাটা হল, সেচের ব্যবস্থা করা হল। ভূমিরাজস্বের হার উৎপন্ন ফসলের দশ শতাংশ করা হল।
রাষ্ট্র সেন-পাল-শশাঙ্ক আমলের কৃষক প্রতিপালন নীতি নতুন করে ফিরিয়ে আনল তুঘলকরা। এই নীতি অপ্রতিহতভাবে চলেছে লুঠেরা ব্রিটিশ আমলের আগে নবাবি আমল পর্যন্ত। রাষ্ট্র রাজস্ব কর্মচারী এবং রাজস্ব সংগ্রাহকদের উদ্দেশ্যে কৃষির উন্নতির জন্য লিখিত ফরমান জারি করল –
১) মাঠের উৎপন্ন ফসল দেখেই যেন খাজনা ধার্য করা হয়।
২) কোন উড়ো খবরে মোটা খাজনা ধার্য করে যেন কোন চাষীকে কষ্ট দেওয়া না হয়।
৩) খাজনা ধার্য করার সময় পাটোয়ারিরা যেন মাথায় রাখে ধার্য খাজনা যেন চাষীরা সহজে পরিশোধ করতে পারে।
৪) খুত, পাটোয়ারি, মুক্কোদ্দম, চৌধুরী, কানুনগো প্রভৃতি পদাধিকারীদের জানিয়ে দেওয়া হল, যে জমি আছে সেটার ওপর খুব বেশি রাজস্ব ধার্য না করতে, তাতে চাষীর ওপর চাপ পড়ে। ফলে তাকে পতিত জমি উদ্ধার করিয়ে চাষের জমি এবং তার ফলে রাজস্ব বাড়াবার সুযোগ করে দেওয়া দরকার।
তুঘলকদের মানবিক ফরমানে ফলে চারিদিকে প্রায় ধ্বংস হয়ে যাওয়া কৃষি ব্যবস্থা চাঙ্গা হয়ে উঠল দেশে রোজগার বৃদ্ধি ঘটল। আদায় কমানোর ফলে যে পরিমান রাজস্ব ক্ষতি হচ্ছিল চাষীর রোজগার বৃদ্ধির ফলে সে ঘাটতিটুকু পুষিয়ে গেল।
মহম্মদ বিন তুঘলকের দোয়াবের চাষী আর রায়তদের খুব খারাপ পরীক্ষানিরীক্ষার পর(কৃষকদের রাজস্ব বাড়িয়ে দিয়েছিলেন ২০-৩০ গুণ) কৃষকেরা বিদ্রোহ করে খাজনা দেওয়া বন্ধ করে দেয়, কৃষকদের ওপর চরম অত্যাচার নেমে আসে, তারা ঘর বাড়ি ছেড়ে পালাতে শুরু করে, তাতেও তাদের রেহাই মেলে না, তাদের জঙ্গল থেকে সেনা দিয়ে বার করে এনে হত্যা/অত্যাচার করা হত।
এরপরে ফিরোজ তুঘলকে ক্ষমতায় এসে আবার রাজত্বে নতুন করে রাজস্ব ব্যবস্থায় স্থিতাবস্থা আনেন। তিনি বুঝেছিলেন রাজস্বের বড় অংশটাই আসত খরাজ থেকে। ফলে চাষীর জমির খাজনা ধার্য হত ফসলের একটা অংশের ওপর। ফলে সে যতবেশি চাষ করবে ততবেশি রাষ্ট্রের রাজস্ব, চাষীরও দিতে হবে কম। তিনি কতগুলো নীতি তৈরি করেন-
১) কৃষকদের যে কোন রকম অত্যাচার থেকে বাঁচাতে হবে। দেখতে হবে কোনও রকম যেন উৎপীড়ন না হয়।
২) চাষের জমিতে সেচের প্রয়োজন আছে। সেটা রাষ্ট্রের দায়।
৩) চাষীরা হাতে যথেষ্ট উদ্বৃত্ত না থাকলে পরের বছর সে বিনিয়োগ করতে পারবে না।
৪) তার সময়ের আগে যত অতিরিক্ত কর(সেস) বসেছিল সব তুলে নেওয়ার ফরমান জারি করলেন তিনি।
৫) কৃষককে বেশি জমি চাষ করতে দিলে সে বেশি উৎপাদন করবে এবং তাতে রাষ্ট্রের রোজগার বাড়বে।
তিনি সমগ্র রাজ্যের জন্য ভূমিরাজস্ব কর্মচারী নিয়োগ করলেন। সেই কর্মচারী ছ বছর ধরে সারা সাম্রাজ্য ঘুরে জরিপ করে জমির পূর্ণাঙ্গ বিবরণ তৈরি করলেন। সুলতান সেই বিবরণ দেখে রাজস্বে হার কমিয়ে দিলেন। সুলতানি আমলের আগের করগুলিও বাতল হল। রাজস্ব কমে গেল ঠিকই কিন্তু রাজত্বে সুখ শান্তি ফিরে এল।
রাজ্যে পতিত জমি উদ্ধার হল, বেশি চাষও হল কেননা চাষীরা দেখল বেশি ফসল হলে সুলতান খাজনা নেন সামান্য। ফলে বেশি উৎপাদন করলে আদতে তাকে সামান্য পরিমান রাষ্ট্রকে দিতে হয়। সারা দেশে কূপ, খাল এবং সেচ ব্যবস্থা করা হল। যমুনা থেকে ১৫০ মাইল খাল কেটে খরা এলাকায় জল পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা করলেন। হিসার শহরের পত্তন এই রাজত্বে হয়। তিনি দেখিয়ে দিয়েছিলেন কম হারে রাজস্ব আদায় করেও বেশি রাজস্ব রাষ্ট্র রোজগার করতে পারে।
এরপর তৈমুরের আক্রমনে আবার অচলাবস্থা নেমে আসে। সিকান্দর লোদিই ফার্সি ভাষায় আয় ব্যয়ের হিসেব লেখানো শুরু করলেন, তার জন্য তিনি কারকুন পদ সৃষ্টি করেন। তিনি জমির পরিমানের জন্য সিকান্দর গজ মাপের স্রষ্টা। তার আমলে গজ দড়ির পরিমান ছিল ৩২ ডিজিট(কত? জানি না)। এটা জমি মাপের একক। এই এককটা শের শাহ নিয়েছিলেন।
তুর্কি-আফগান যুগে ভারতকে কতগুলী ইকতা-য় ভাঙ্গা হয়, এটা অনেকটা মুঘলদের সুবার অনুরূপ। প্রত্যেকটি ইকতা কতগুলো সরকারে(জেলা) ভাগ করা হল। সরকারকে কতগুলো পরগণায় ভাগ করা হয়। একটি পরগণার রাজস্ব একক ছিল গ্রাম বা দেহাত।
সূত্রঃ প্রাচীন জরিপের ইতিহাস
অরুণ কুমার মজুমদার

Friday, September 29, 2017

রামমোহন আর বিদ্যাসাগরের পাশ্চাত্য জ্ঞানচর্চার ওকালতি - বিদ্যাসাগরের বাল্যকালে দক্ষিণভারতে অঙ্কচর্চা

বিষ শুধু বিষ দাও অমৃত চাইনা!
Debabrataদা, বিদ্যাসাগরের জাতিবাদিতা বিযয়ে প্রশ্ন তুলতে যে গরল উঠছে, তাতে বহু প্রগতিশীলের বিদ্যার বহর উন্মুক্ত হয়ে যাচ্ছে। জনৈক 'প্রগতিশীল বিদ্বানের' 'রামমোহন রায় অত্যন্ত যুক্তিপূর্ণ ভাবেই পাশ্চাত্যের বিজ্ঞান শিক্ষা চালু করার সপক্ষে আমহার্স্টকে চিঠি লিখেছিলেন। উনি না জন্মালে আপনি আজ এক হিন্দু রাষ্ট্রের বাসিন্দা হতেন' এরকম একটা উক্তি দেখলাম।
ইওরোপবাসী এই উক্তির প্রেক্ষিতে আমাদের ছোটলোকেদের বক্তব্য।
---
সে সময়ের ভারতীয় পড়াশোনায় কি ধরণের অঙ্ক শিক্ষা হত তার উদাহরণ পাই চন্দ্রকান্ত রাজুর ভারতীয় অঙ্কের ইতিহাসে। যেহেতু তিনি মনে করতেন ভারতীয় ছোটলোকেরা জ্ঞানচর্চার কুড়টা ধরে রেখেছিলেন, সেটা অনেকের অপছন্দ। আর্যভট(আর্যভট্ট নয়) নিজে শূদ্র ছিলেন। ফলে তথ্য যখন উন্মুক্ত হয় ভদ্রদের আঁতে ঘা লাগে।
যে যাককে যাক - শুধু উদাহরণ দেব ১৯৯১ সালের ইন্ডিয়ান জার্নাল অব হিস্ট্রি অব সায়েন্সে লিখত কে ভি শর্মা আর এস হরিহরণের লেখা জৈষ্ঠদেবের যুক্তিভাষা নামক প্রবন্ধটি, যেখানে ২নম্বর পাতায় বলা হয়েছে , দ্য ওয়ার্ক ফাইন্ডস ইটস ফার্স্ট রেফারেন্স ইন মডার্ন রাইটিং ইন এন আর্টিকল বাই সি এম উইশ ইন ১৮৩৫ হওয়ার ইট ইস রেফার্ড টু টুওয়ার্ডস দ্য ভেরিফায়িং দ্য অথার অব তন্ত্রসংগ্রহ। উইশ হ্যাড কন্টেমপ্লেটেড 'আ ফারদার একাউন্ট অব যুক্তিভাষা, ইত উইল বি গিভন ইন আ সেপারেট পেপার' (সূত্র https://web.archive.org/.../insa/INSA_1/20005ac0_185.pdf)। অর্থাৎ রামমোহন আর বিদ্যাসাগর যখন পশ্চিমি বিদ্যাচর্চার ওকালতি করছেন তখন সে সময়েই এদেশেই যুক্তিভাষার মত কলন বিদ্যা পড়ানো হচ্ছে।
আজ এই কলনবিদ্যার শিক্ষা দিচ্ছেন নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ে চন্দ্রকান্ত রাজু ক্যালকুলাস উইদাউট লিমিটস নামে - যার দুটি মানে - ১) কেরল থেকে যখন জ্ঞানটা জেসুইটসরা ইওরোপে নিয়ে গেল নকল করে, নিউটন বা লিবনিতজ এই অঙ্কবিদ্যার মূল সূত্র বুঝতে পারছেন না, ফলে তারা লিমিটএর ধারণা নিয়ে এলেন কলন বিদ্যায়, ভারতে যে বিদ্যা মাধ্যমিক শ্রেণীতে পড়ানো হত, সেটা ইওরোপে গিয়ে দুর্বোধ্য উচ্চশ্রেণীর অঙ্কে রূপান্তরিত হল, এই নিয়ে চন্দ্রকান্ত রাজুর ক্যালকুলাস উইদাউট লিমিটস লেখা পড়তে পারেন (সূত্র - http://ckraju.net/.../calculus-without-limits-background...)। আর ২) কলন বিদ্যার প্রয়োগ আসীম কারণ তাঁর মতে ভারতে দুটি পেশা কলন বিদ্যা প্রায়োগিক/ফলিত চর্চা করত কৃষক - যাদের মৌসম বুঝতে কলন চর্চা করতে হত আর নাবিক - যারা দিনের বেলায় তারা ছাড়া আলোকোজ্জ্বল আকাশে যখন মাঝ সমুদ্রে যাত্রা করতেন তখন দিক খুঁজে পেতেন। এইগুলো আমাদের ভদ্রদের গায়ে লাগবে যারা খুব কষ্ট করে কলনবিদ্যা অর্জন করেছি, সেটা ছোটলোকেরা কিভাবে শিখতে পারে এই বিতর্কে।
যাই হোক দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা ধর্মমূলক এই অভিযোগে রামমোহন-বিদ্যাসাগর পাশ্চাত্য জ্ঞানবিজ্ঞানের চর্চা চালিয়ে যেতে বলেছিলেন।
হায় তারা জানার চেষ্টা করেন নি, এদেশে কয়েক হাজার বছর ধরে কলনবিদ্যা চর্চার শেকড় সেদিনও শেষ হয়ে যায় নি।

শূদ্র ভারতীয় জ্ঞানচর্চার ইতিহাস এবং কতগুলো সমস্যা - যে শূদ্র ইতিহাসের সামনে সব উচ্চবর্ণ মূক

১। সমস্যা হল সেই আর্যভটের(ভট্ট = বামুন আর ভট = শূদ্র, আমরা উচ্চবর্ণ আজও উচ্চারণ করি আর্যভট্ট, যা মিথ্যা। এবং ইতিহাস পাল্টাতে তার গলায় পৈতে পরিয়ে দিয়েছে ভারত সরকারের এক মহাকাশ বিদ্যা সংগঠন, ঠিক যেমন করে কালো গ্রিসকে দেখায় না ইওরোপ,আফ্রিকার আলেকজান্ড্রিয়ার অঙ্কবিদেরা সক্কলে ত কালো হওয়ার কথা, অঙ্ক বইতে কেন তাদের চেহারা ককেসাসিয়?) সময় বা তারও আগে থেকে জ্ঞানচর্চা শূদ্রদের পকড় ছিল। যে পকড়ের জোরে বিদ্যা আর জ্ঞানচর্চায় এবং তার ফল উৎপাদন ব্যবস্থায় শূদ্র-বৈশ্য(বাংলায় বৈশ্যরা সেদিন পর্যন্ত শূদ্র ছিল)এবং মুসলমান এবং অন্যান্য পরম্পরার সমাজের দখল। তারই ফল কিছুটা পাই এডামের সমীক্ষায় যেখানে দেখা যায় বাংলা বিহারের ১ লক্ষ গাঁইয়া পাঠশালায় শূদ্র সন্তানের সংখ্যা ৮৫%।
২। এটা দীর্ঘকালে লেগ্যাসি - এবং মোগল এবং নবাবী আমল এতে হাত দিতে চায় নি - আপনি যদি মুঘল বিরোধী আচার্য যদুনাথের এডমিনিস্ট্রেশন পড়েন দেখবেন চাষী আর কারিগর(যারা মূলত শূদ্র)দের রক্ষা করা রাষ্ট্রের ঘোষিত নীতি - নবাবি আমল নিয়ে কয়েক দিন আগে লিখেছি কিভাবে কারিগর আর চাষীদের রক্ষা করতেন নবাবেরা।
৩। এক হাজার বছর ধরে আরব-পারস্য-ভারত-চিনের মিলিত জ্ঞানচর্চায় ইওরোপ নস্যি। সেই শূদ্রভিত্তিক জ্ঞানচর্চায় জেরে বাণিজ্যে আর উৎপাদনে বাংলা ছিল উদ্বৃত্ত অর্থনীতির দেশ। ইওরোপের পঞ্জিকা ছিল এক্কেবারে ভুলে ভরা, পৃথিবীর ব্যাসার্ধের মাপ তখনও দাঁড় করাতে পারে নি, ফলে সমুদ্রে নামলে সে এক যাওয়ার যায়গায় অন্য যায়গায় পৌঁছে যেত - আমেরিকা বা ওয়েস্ট ইন্ডিজ তো আবিষ্কার করতে চায় নি, ওরা আসতে চেয়েছিল ভারতে। মালামো কানা নামক এক গুজরাটি মুসলমান নাবিক হাতে রূপলাগি নামক খেলনা দিগদর্শক যন্ত্র নিয়ে আফ্রিকার মেলিন্দের উপকূলে পথ ভোলা ভাস্কোকে পথ দেখিয়ে না আনলে ইওরোপের ভারতে আসা যে আরও কত দিন পিছত কে জানে, হয়ত ভারতের ইতিহাসটাই পাল্টে যেত চিরতরে। বাংলা-তথা ওডিসা বা গুজরাট বা কোঙ্কণের নাবিকেরা যেখানে যেতে চেয়েছেন সেখানেই গেছেন দিক না ভুলে। এটা শূদ্র জ্ঞানচর্চার জন্যেই।
৪। তো তারা প্রথমে ধর্মযুদ্ধে বুঝল ইওরোপ আরবের থেকে জ্ঞানচর্চায় কতটা পিছিয়ে, ভারতে এসে পর্তুগিজেরা সেটা হাড়ে হাড়ে সেটা টের পেল। ফলে ইওরোপ গোটা এশিয়ায় জ্ঞানচুরির কাজটা করতে হয়েছে দীর্ঘসময় ধরে, যে কাজটা নথিকরণ করেছেন গীতা ধরমপাল পর্তুগাল, ফ্রান্স, ইটালি এবং অন্যান্য পুরোনো গ্রন্থাগারে ভারতীয় পুঁথির টাল দেখে, যেখানে জেসুইট পাদ্রিদের নথিকরা পুঁথি প্রচুর।
৫। এদেশে ইওরোপকে তার জ্ঞানচর্চার অনুপস্থিত হেজিমনিটা তৈরি করার চেষ্টা করতে হল। তার জন্য তৈরি হল ক্ষমতার কাছাকাছি যাওয়া উচ্চবর্ণ, যারা দীর্ঘকাল ধরে প্রথমত শূদ্র এবং মুসলমান বিদ্বেষী। নবাবেরা তাদের পাশে থাকায় তারা কিছু একটা করে উঠতে পারে নি। ব্রিটিশেরা উচ্চবর্ণের মাথায় হাত রাখল। প্রথমে জ্ঞানচর্চার ফলিত বিদ্যা উৎপাদন ব্যবস্থা ধ্বংস করা হল, দখল করা হল, বিশ্ব বাজার থেকে বাংলার কারিগরদের উচ্ছেদ করা হল। একে একে বাংলার বেশ কিছু প্রযুক্তি ধ্বংসের কাজ শুরু হল। বাংলার শূদ্র-জ্ঞানচর্চা ধ্বংস করা হল ইওরোপিয় জ্ঞানচর্চার হেজিমনির প্রতীক হিসেবে - সঠিকভাবেই কোপ ফেলা হল বাংলার পাঠশালায় আর নবাবী আমলের মক্তবে। প্রথমে মেকলে ট্রেভলিয়ান পরে ম্যাক্সমুলারকে দিয়ে বলানো হল ভারত এখন অজ্ঞতার অন্ধকারে ডুবে আছে, তার বর্ণিল অতীত(উচ্চবর্ণ সঞ্জাত, যা অর্ধসত্য)এর জ্ঞানচর্চা ধ্বংস হয়ে গেছে।
সমস্যা হল যে সময় মেকলে যখন পাইকারি হারে আরবি ভারতীয় জ্ঞানচর্চাকে তুমুল খিস্তি করছেন, সমস্যা হল সেই বছরেই চার্লস উইশ কলনবিদ্যা খুঁজে পেলেন দক্ষিণ ভারতে। তারপর ছাপা হল এশিয়াটিক সোসাইটির পত্রিকায়। চাইলেও সে তথ্যকে আজ আর অস্বীকার করা যাবে না। আজ সে সব লিখিত ইওরোপের ইতিহাসে। বলা যাবে না এটা তোমরা কালোরা তৈরি করেছ নিজেদের উদ্দেশ্য পূরণে, ইওরোপকে হেয় করতে।
৬। সে ইতিহাস আজও মুখ গুঁজে আছে। এই ইতিহাসের সামনে সব উচ্চবর্ণ পশ্চিমবিদ্যরা মূক।
৭। শূদ্র-বৈশ্য-মুসলমান ছোটলোকেরা জ্ঞানচর্চা, অঙ্ক, কলনবিদ্যা শিখত এবং প্রয়োগ করত, এটা ভদ্রলোকের কাছে দারুণ জ্বালা। এই তত্ত্বে আমাদের ভদ্রদের মাথায় চিনিচিনে ব্যথা, রাগে গা জ্বলে ওঠে মশাই। আমরা ভদ্রশ্রেণীর ছাত্রছাত্রীরা কি কষ্ট করে, পয়সা খরচ করে, মেধা প্র্যোগ করে হায়ারসেকেন্ডারি আর কলেজে উচ্চঅঙ্কর ক্যালকুলাস শিখি। সেটা ছোটলোকেরা কিভাবে সেই আদ্যিকালে কোথায় কোথায় শিখত আর প্রয়োগ করত। শালারা আমাদের শ্রমের খ্যাতিতে, মেধায় ভাগ বসাচ্ছে ভাবলেই রাগে শরীর থরথর করে কাঁপতে থাকে।
৮। তাঁরা কিভাবে শিখতেন এটা আমরা জানি না - চন্দ্রকান্ত রাজুর লেখায় পেয়েছি। চন্দ্রকান্ত রাজু ভারতীয় মতে সাতদিনে কলনবিদ্যা শেখাচ্ছেন বুদ্ধ বিশ্ববিদ্যালয়ে - নাম ক্যালকুলাস উইদাউট লিমিটস - যোগাযোগ করতে পারছি না। খুব শেখার ইচ্ছে।
৯। কেউ সাহায্য করতে পারেন?
লাইকআরও প্রতিক্রিয়া প্রদর্শন করুন
মন্তব্য করুন
মন্তব্যগুলি
লাইকআরও প্রতিক্রিয়া প্রদর্শন করুন
প্রত্যুত্তর
1
16 ঘণ্টা
পরিচালনা করুন
Dinēśa-Ratna Prabhākara এতে ১০০% সহমত।
লাইকআরও প্রতিক্রিয়া প্রদর্শন করুন
প্রত্যুত্তর13 ঘণ্টা
পরিচালনা করুন
Taher Almahdi কলনবিদ্যা কী?
লাইকআরও প্রতিক্রিয়া প্রদর্শন করুন
প্রত্যুত্তর9 ঘণ্টা
পরিচালনা করুন
লাইকআরও প্রতিক্রিয়া প্রদর্শন করুন
প্রত্যুত্তর8 ঘণ্টা
পরিচালনা করুন
Sadhan Ghosh · 5 জন পারস্পরিক বন্ধু
ভারতীয় মতে সাতদিনে কলনবিদ্যা যেটা ক্যালকুলাস উইদাউট লিমিটস বলা হচ্ছে, বিষয়টা খুব ইন্টারেস্টিং মনে হচ্ছে |
লাইকআরও প্রতিক্রিয়া প্রদর্শন করুন
প্রত্যুত্তর47 মিনিট
পরিচালনা করুন
Biswendu Nanda দেখা যাক। আমরা শিখতে চেষ্টা করছি। চন্দ্রকান্ত রাজুর এই নিয়ে ছোট একটা লেখা আছে নেটে দেখতে পারেন।
লাইকআরও প্রতিক্রিয়া প্রদর্শন করুন
প্রত্যুত্তর36 মিনিট