আকবরের তৈরি প্রশাসনিক কাঠামোটা জানা খুব জরুরি। কেননা তার এই রাজস্ব এবং প্রশাসনিক কাঠামোর ওপর নির্ভর করে তারপরের দেড়শ বছরের গোটা মুঘল সাম্রাজ্য, বাংলায় ৫০ বছরের নবাবী প্রশাসন এবং তার পরের ব্রিটিশ প্রশাসনিক এবং রাজস্ব আদায়ের ব্যবস্থা গড়ে উঠেছিল, যদিও ব্রিটিশদের লুঠ উদ্যমের সঙ্গে আকবরের উৎকর্ষময় পরিকল্পনার কোন তুলনাই চলতে পারে না।
প্রত্যেক সুবা বিভক্ত ছিল অনেকগুলো সরকারে। সরকার আবার অনেকগুলি পরগণায়। পরগনাগুলি আবার মহলে। মহল তৈরি হত কতগুলি মৌজা বা গ্রাম নিয়ে।
সুবা
সুবাদার - তাঁর সময়ের সুবার শাসনতান্ত্রিক কাঠামোর মাথায় ছিলেন ছিল সুবাদার বা সিপাহসালার। আওরঙ্গজেব বাংলায় মুর্শিদকুলি খাঁকে দেওয়ান হিসেবে পাঠালে তাঁর নিজস্ব যোগ্যতায় তিনি প্রধান শাসনকর্তা হয়ে ওঠেন। তাঁর আগে সুবাদারেরা শাসনপ্রধান ছিলেন।
দেওয়ান – ইনি রাজস্ব সংগ্রহ করতেন। প্রাদেশিক কর্মচারীদের বেতন দিতেন, দেওয়ানি বিচার করতেন এবং রাজস্ব বিভাগ দেখাশোনা করতেন। যদিও দেওয়ান আর সুবাদারের পদ একই শ্রেণীর ছিল কিন্তু সুবাদার সেনা প্রধান হওয়ায় একটু বেশিই ক্ষমতা ভোগ করতেন
যাইহোক এই দুজনকে রাজকীয়ভাবে একই শ্রেণীর পদ দেওয়ায় এটা পরিষ্কার যে পাদশাহেরা আন্দাজ করেছিলেন দুজনের মধ্যে ঈর্ষার যে লড়াই চলবে তাতে কেন্দ্রিয় শাসন আরও জরদার হবে এবং ভিতরের গুপ্ত তথ্য আরও বিশদে পাওয়া যাবে।
সুবার কাজকর্ম বিষয়ে সুবাদার এবং দেওয়ান পৃথক পৃথকভাবে তাদের মন্তব্য নিয়মিত পাঠাতেন পাদসাহের কাছে।
সদর – মানুষকে বৃত্তি বা নিষ্কর জমি দেওয়ার জন্য সুপারিশদার
কাজি – বিচার বিভাগের প্রধান। সরকার আর পরগণার কাজিদের বিচার ইত্যাদি পরিদর্শন করতেন।
বকশী – সৈন্যদলে লোক নিয়োগকর্তা, হিসাবও রাখতেন, মাইনে দিতেন(বলছেন আচার্য যদুনাথ), প্রাদেশিক সৈন্যরা যাতে কর্মক্ষম থাকে তারজন্য উনি দেখাশোনা করতেন।
ওয়াকিয়ানবিশ – সংবাদলেখক। রোজ পাদশাহকে প্রদেশের সংবাদ পাঠতেন। গুপ্তচর নিয়োগ করতেন।
কোতয়াল – রাজধানীর আইনকানুন, শৃঙ্খলা, পরিচ্ছন্নতা, স্বাস্থ্য ইত্যাদি দেখতেন
মীরবহর – নৌকোর, ফেরি, আমদানি শুল্ক ইত্যাদি আদায়ের ব্যবস্থা করতেন।
সরকার বা জেলার শাসনকাঠামো
ফৌজদার – সৈন্যদলের সাহায্যে সরকারের শৃঙ্খলা বজায় রাখতেন।
আমলগুজার – রাজস্ব কর্মচারী। বন্দোবস্ত নেওয়া প্রজাদের জমির বন্দোবস্ত নিতেন, খাজনা ধার্য, খাজনা আদায়, কৃষকদের নিরাপত্তা/সুরক্ষার ব্যবস্থা করতেন। কৃষকদের চাষ পতিত জমি উদ্ধারের জন্য অগ্রিম অর্থ দাদন দিতেন।
কাজি – সরকারের মামলা মোকদ্দমার বিচার করতেন।
কোতয়াল – নগররক্ষল্ক
বিতিকিচি – রাজস্ব কর্মচারী, কানুনগোদের বড় আধিকারিক। পরগনার কানুনগোরা যে সমীক্ষা পাঠাতেন সেগুলো পরীক্ষা করে খাজনা ধার্য করতেন।
খাজনাদার – জেলা বা সরকারের কোষাধ্যক্ষ্য। গ্রাম বা পরগণার আদায়ীকৃত সমস্ত খাজনা এরই মাধ্যমে রাজস্ব বিভাগে জমা পড়ত।
পরগনার শাসন কাঠামো
শিকদার – পরগনা প্রধান। তার অন্ত্যতম প্রধান কাজ ছিল কৃষক বা প্রজাদের থেকে খাজনা আদায় করে রাজস্ব দপ্তরে জমা দেওয়া।
আমিল – চাষীর সঙ্গে প্রত্যক্ষ যোগ থাকত। খাজনা ধার্য আর আদায় করতেন।
ফোতেদার – পরগনার রাজস্ব আধিকারিক
কারকুন – পরগনার হিসাবলেখক। যে খাজনা আদায় হত তার হিসেব লিখতেন।
কানুনগো - পরগনার কানুনগোরা ছিলেন জমিজমার আইন বিশারদ। এরা গ্রামের পাটোয়ারিদের প্রধান ছিলেন। কানুনগোরা ভূমি আইন, বিভিন্ন প্রকার বন্দোবস্তের স্বরূপ ও খুঁটিনাটি, খাজনা ধার্যের হিসেব আর খাজনা আদায় বিষয়ে নিয়মিত নজরদারি করতেন। এরা আদায়ের ওপর ১টাকা আদায় পেতেন। পরে তাদের কিছু জমির ব্যবস্থা করে দেওয়া হয় এবং মাসিক ২০-২৫ টাকা বেতন দিতেন।
চৌধুরী – পরগনার জমিদার, আর খাজনা আদায়ে সাহায্য করতেন।
মৌজা বা গ্রামস্তরের শাসনব্যবস্থা
মুকদ্দোম – গ্রাম প্রধান। তার কাজ ছিল আইনশৃঙ্খলা দেখা, মামলা মোকদ্দমার বিচার করা আর খাজনা আদায়ে সাহায্য করতেন।
পাটোয়ারি – প্রজাদের বন্দোবস্ত নেওয়া জমির খাজনা ধার্য করতেন এবং আদায়ে সাহায্য করতেন।
এছাড়াও ছিলেম আমিন সহ আরও বহু কর্মচারী যাদের পরিশ্রমে সঠিক সময়ে সঠিক রাজস্ব আদায় হত।