২.২ নবাবি বাংলা,
১৭০০-১৭৫৭
১৭০০ সালে বাংলায় এসে মুর্শিদকুলি খাঁ একাদিক্রমে ১৭২৭
সালের তাঁর মৃত্যু পর্যন্ত(মাঝখানে ১৭০৮-০৯ দু বছর বাদ দিয়ে) সুবার গুরুত্বপূর্ণতম
প্রশাসক হিসেবে আজও পরিগণিত হন। প্রথম থেকেই তিনি দেওয়ান ছিলেন, ১৭১৭র পরে তিনি
সুবাদারও হন। দেওয়ান পদে যোগ দিয়ে তার প্রাথমিক লক্ষ্য ছিল বাংলার রাজস্ব বৃদ্ধি।
এই দিকে লক্ষ্য রেখে তিনি রাজস্ব-প্রশাসনে পকড় দৃঢ় করেন এবং যে উদ্বৃত্ত জমিদার
এবং অন্যান্য ছোট জমিদার/সুবাদার উসুল করছে, সেগুলো রাষ্ট্রের কোষাগারে নিয়ে আসার
ব্যস্থা করেন। তিনিটি সহজ পদ্ধতিতে তিনি রাজস্ব আদায় কাঠামো নির্নয় করেন। প্রথমত
তিনি বাংলার উর্বরতম যে সব জমি সুবাদারদের জায়গির দেওয়া ছিল সে সময় সেগুলি সব কটা
তিনি কম উর্বর উড়িষ্যায় সুবাদারদের বরাদ্দ করেন। রাষ্ট্র সব পড়ে থাকা জায়গির জমির
দখল নেয়। দ্বিতীয়ত তিনি জোর দিয়ে জমিদারদের বরাদ্দ রাজস্ব প্রদান করতে বাধ্য করেন।
যে কোন কারণে তারা সেগুলো দেওয়ায় ব্যর্থ হলে তিনি তাদের কয়েদ করতেন অথবা তাদের ওপর
বিপুল অত্যাচার করতেন। তিনি, অবসর নেওয়া এবং অন্যান্য কার্যকরী আমলাদের প্রত্যেক
রাজস্ব প্রদায়ী এলাকায় পাঠান যাতে তারা সেই এলাকার রাজস্বের সঠিক সমীক্ষা/জরিপ
করতে পারেন। তাদের সাহায্যে তিনি বাংলার সঠিক রাজস্ব খাত তৈরি করেন এবং প্রত্যেক
জমির উর্বরতা নির্ধারণ করে প্রতিটি রায়ত/কৃষক সম্ভাব্য সর্বোচ্চ কত রাজস্ব দিতে
পারে, সে অঙ্ক কষলেন(Riyaz, 248-49, 255-56;
Salimullah, Tarikh-i-Bangala, pp. 32-33, 43-45)। তার সময়ে পারস্যের ঐতিহাসিক সালিমুল্লার বর্ণনা অনুযায়ী
যদিও জরিপের অতটা গভীরে যেতে পারে নি মুর্শিদকুলির উদ্যম, কিন্তু আজ আমরা বলতে
পারি, পুরোনো সমীক্ষা এবং তার সময়ের জরিপের নানান তথ্য অবলম্বন করে মোটামুটি
ঠিকঠাক রাজস্বখাত তৈরি করলেন।
নবাব মুর্শিদকুলির বর্ধিত চাহিদা অনুযায়ী জমিদারদের এখন
সমস্ত রাজস্ব প্রদান করতে হবে, না হলে তারা হয় মহাজনের হাতে অথবা সরকারকে জমিদারি
তুলে দিতে বাধ্য হবে। খাজনা বকেয়া থাকা অবস্থায় যদি কোন জমিদারির দখল ন্যায়
রাষ্ট্র, তাহলে অন্য কোন জমিদার যদি সেই বর্ধিত খাজনার গোটাটা শোধ করে দ্যাওয়ার
প্রতিশ্রুতি দ্যায় তাহলে সেই জমিদারি তাকেই সরকার দিয়ে দেবে(Risala, ff. 7a-9b; also quoted in Calkins,
p.803.) এই সিদ্ধান্ত নেয়। এই নীতিতে অধিকাংশ দুর্বল
এবং ছোট জমিদার জমিদারি থেকে হঠে যায়। উদ্দেশ্যপূর্ণভাবে মুর্শিদকুলি বড় জমিদারির
পক্ষেই রাজস্ব আদায় ব্যবস্থাটা তৈরি করেন এবং বড় জমিদারদের ক্ষমতা আর কলেবর
বৃদ্ধিতে মন দিলে বাংলা জুড়ে বেশ কিছু বড় জমিদারি তৈরি হয়। এই ধরণের জমিদারির বড়
উদাহরণ রাজসাহী জমিদারি। বর্ধমান, নদীয়া, দিনাজপুরের মত বড় জমিদারেরা মুর্শিদকুলির
সময়ে নতুন সংস্কারের পক্ষে দাঁড়িয়ে নিজেদের অবস্থান জোরদার করেন(জমিদারির বৃদ্ধি
নিয়ে জানতে পড়তে হবে নরেন্দ্র কৃষ্ণ সিংহের Economic
History of Bengal, vol. II, pp.
119-22.) । ১৭২৭ সালে মুর্শিদকুলি
যেদিন মারা যান, সে সময় বাংলার মোট রাজস্বের অর্ধেক অংশ পূরণ করে ১৫টি বড় বাংলার
জমিদারি (জমিদারদের জমিদারির বিশদ বিবরণ এবং সেই জমিদারির রাজস্ব জরিপ নিয়ে বিশদ পাবেন
(James Grant, 'Finances of Bengal', in W.K. Firminger
(ed.), Fifth Report, vot. II, pp. 194-9)।
মুর্শিদকুলি খার
নতুন রাজস্ব সংস্কার নীতির উপজাত ফল হিসেবে উঠে আসে মহাজন এবং ব্যাংকিং শ্রেণীরা।
এরা সেই সময় বাংলায় বিপুল বড় ভূমিকা পালন করেন। মুর্শিদকুলির নতুন নীতিতে কাজের
সুযোগ পেয়ে একদল মহাজন একজোট হয়ে একদল জমিদারকে অর্থ সাহায্য দিতে শুরু করে, যাদের
মাথাব্যথা ছিল সঠিক সময়ে রাজস্বভাণ্ডারে পূণ্যাহের দিন প্রয়োজনীয় রাজস্ব জমা দেওয়া(Risala, ff, 7a-7b; also quotecf in Calkins, p.804.)। এই মহাজনদের মধ্যে ক্ষমতা আর প্রভাবে জায়মান হয়ে উঠতে
শুরু করেন জপগতশেঠেদের গদির গৌরব। কিন্তু এর সঙ্গে এটাও বলতে হবে জগতশেঠদের কুঠি
বাংলায় প্রধানতম ব্যাঙ্কিং গদির অর্থনৈতিক শক্তি হয়ে উঠতে পারার পিছনে অবশ্যই আছে
নবাব নাজিম মুর্শিদকুলির অভয় হস্ত। কুঠির একটা বড় রোজগার হত জমিদারদের দেওয়া ঋণের
প্রাপ্ত সুদ থেকে(পঞ্চম অধ্যায় দেখুন)। ১৭৩০এর মধ্যে জগতশেঠেরা নবাব নাজিমের
তোষাখানা হয়ে ওঠে। জগতশেঠেরা রাজস্ব বকেয়া রাখা জমিদারদের জামিন হতেন।