Monday, August 6, 2018

উপনিবেশ বিরোধী চর্চা - হস্তশিল্প বনাম পরম্পরার ছোট উতপাদক

আমরা যাকে হস্তশিল্প বা হ্যান্ডিক্র্যাফট বলছি সেই বলাটা কতটা সামাজিক, বাস্তবসম্মত সেটা ভাবা দরকার। এ বিষয়ে উইভার্স আর্টিজান এন্ড পারফর্মিং আর্টিস্টস গিল্ডের(ওয়াপাগ) একজন হয়ে কিছু কথা বলার অনুমতি চাইছি। লেখাটা একটু বড় হবে -
১৮০০ সাল পর্যন্ত সারা বিশ্বে ৭০টি শিল্প দ্রব্য(সোরা, লোহা পিণ্ড, দস্তা, জং ছাড়া ইস্পাত মণ্ড ইত্যাদি) আর ১০০টির বেশি কৃষি দ্রব্য(কাপড়, নীল, আফিম, চাল, নুন, মোম, সুপুরি, তামাক, ভোজ্যতেল, অন্যান্য বনজ দ্রব্য, পান, কাঠ, হাতি ইত্যাদি) প্রায় একচেটিয়া রপ্তানি করত বৃহত বাংলা - আজকের পোকায় কাটা বাংলা নয়, সে ছিল পূর্বের মায়ানমারের প্রান্ত থেকে পশ্চিমে উত্তরপ্রদেশের প্রান্ত, উত্তরে তিব্বতের সীমা থেকে দক্ষিণে ওডিসা পর্যন্ত অঞ্চল - কিন্তু এর পশ্চাদভূমি আরও বড় ছিল - পশ্চিমে রাজস্থান পর্যন্ত আর দক্ষিণ পশ্চিমে মহারাষ্ট্র পর্যন্ত - তো ভারতে, এশিয়, আফ্রিকার, পরোক্ষে ইওরোপের বাজারে কয়েক হাজার বছর ধরে এই জিনিসগুলি সরবরাহ করেছে গ্রামের ছোট উতপাদকেরা, যাদের আমরা হস্তশিল্পী বলে আসছি উপনিবেশের অনুসরণে।
ঔপনিবেশিক অর্থনীতিবিদেরা মনে করত এবং আজও করেন(তাতে যদিও কিছু যায় আসে না গ্রাম ভারতের), গ্রামীন এই উতপাদকেরা প্রান্তিক, এরা উতপাদন না করলেও অর্থনীতির ক্ষতিবৃদ্ধি নেই। এরা জাদুঘরের সামগ্রী, এরা যদি না বাঁচে তাহলেও খুব একটা ক্ষতিবৃদ্ধি নেই। এই অর্থনীতি মৃত। এদের রাষ্ট্রীয় সহায়তার বাঁচিয়ে রাখতে হবে। এদের তো একটা নাম দেওয়া দরকার। তাই এই প্রয়োজনে অপ্রয়োজনীয়(অবশ্যই রাষ্ট্র ও বড় পুঁজির পায়ে নত ভদ্রবিত্তের দৃষ্টিতে) এই ক্ষেত্রর নাম দিক হস্তিশিল্প - কিছুটা তাচ্ছিল্য করেই।
হস্তশিল্প নামটা চারিয়ে গেল স্বদেশির সময় ভদ্রবিত্ত সমাজে - এবং খেয়াল করবেন এই লব্জটা কিন্তু মূলত কথ্য হয় এই সমাজেই। ইওরোপের পন্যের বাজার জাত করার কাজের বিরোধিতা করে যে আন্দোলনের শুরু, এবং যে আন্দোলনের নামে স্বদেশি, সে আদতে চরিত্রে, ব্যবস্থাপনায় আর পণ্য উতপাদনে বড় পুঁজির অনুসারী এবং গভীরভাবে ইওরোপিয় এবং অতীব সংখ্যালঘু; তাই তার প্রয়োজন হল এক প্রতিপক্ষ তৈরির। চরিত্রে ইওরোপিয় হলেও ইওরোপিয়রা তাকে পাত্তাও দেয় না, বরং হ্যাটা করে।সে আর কাকে প্রতিপক্ষ তৈরি করে, নবজাগরণের প্রথম সময় গাঁইয়াদের উতাদন ব্যবস্থাকেই যে ধরল। পলাশীর অর অযুতবার খিস্তি কঈ মধ্যবিত্ত সমাজে গাঁইয়াদের সম্মান ধুলায় মিটিয়ে দিয়েছে। অথচ বিপুল বিশাল গ্রামীন উৎপাদন ব্যবস্থায় সে তুচ্ছ থেকে তুছতর। তাই সে গোটা গ্রামীন উৎপাদন ব্যবস্থাকেই হস্তশিল দেগে দিল যাতে একে যথেষ্ট ন্যুন দেখায়।
গ্রামীন উতাদন ব্যবস্থা সংখ্যালঘু আর তার মানুষেরা অদক্ষতার চূড়ান্ত, ভাবনার বেলুনটির গ্যাস নির্গত হয়ে গিয়েছে ২০০৮-১১ সালে। আমরা আজও মনে রাখি না যে এই মানুষেরাই -গ্রামের বংশ পরম্পরার ছোট উদ্যোগীরা - এখনও ভারতের অর্থনীতির ৮০%র অংশিদার, এখনও তারা বড় পুঁজির ব্যাঙ্ক ব্যবস্থার বাইর্‌ রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণের বাইরে বলেই ২০০৮ সালের ইওরোপ আমেরিকার অর্থনীতির মন্থনে উদ্ভুত বিষকে গলার্ধকরণ করেছিল এই উতপাদকেরা, অথচ নাম কিনেছিল, ভেঙ্গে পড়তে পড়তে বেঁচে ওঠা রাষ্ট্রীয় অর্থনীতি, পিঠ চাপড়ানি পেয়েছিল ব্যাংক ব্যবস্থার অর্থনীতির মৌলিক চলকগুলির (বেসিক ফান্ডামেন্টালস) ভিত্তিগুলি।
আমরা এখনও মনে করি, সেটাই বাস্তব, গ্রামের আর্থব্যবস্থার জোরে টিকে রয়েছে ভারতের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা - ব্যাংক ব্যবস্থা খুব বেশি হলে ১৫-১৭ শতাংশ মানুষকে জড়িয়ে নিয়েছে নিজের ব্যবস্থায় - উচ্চমধ্যবিত্তের বাইরে কত শতাংশ মধ্যবিত্তের জীবনের কতটা ব্যাংক ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণ করে তা কিন্তু গবেষণাযোগ্য; তার বাইরে রয়েছে বিশাল বিপুল গ্রামীন অর্থিনীতি, যার পরিমাপ আমরা বুঝেশুনে করিনা, করতে গেলেই রাষ্ট্রীয় অর্থনীতির কঙ্কালসার চেহারাটা উলঙ্গ হয়ে দাঁড়াবে, বড় পুঁজির বাহ্বস্ফোটকে প্রকাশ্যে এনে ফেলবে। কয়েকটা প্রকাশনী আগেই বলেছি শুধু বাংলার আন্দাজের পরম্পরার অর্থনীতির পরিমান এক লক্ষ কোটি টাকার অনেক বেশি।
এবং সেই গ্রাম্য আর্থব্যবস্থার মূল ভারসাম্য বজায় রাখছে কৃষক আর গ্রামের ছোট বংশ পরম্পরার উদ্যমীরা।
যদি আমরা ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে স্থিতিশীল বাংলা চাই, তাহলে শহরের বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে গ্রামের অর্থনীতির সবলীকরণ করার দিকে এগোতে হবে, শহরের অর্থ গ্রামে পৌঁছে দিতে হবে, গ্রামের অর্থনীতিকে আঘাত না করে তাকে জোরদার করতে হবে - যে কাজটা আজ বাংলা সরকার শুরু করেছে - আর আমরাও সাঙ্গঠনিকভাবে পয়াপাগ করতে যাচ্ছি।
একটা প্রশ্ন উঠবে, যদি গ্রামীন অর্থনীতি এতই সবল হয়, তা হলে আমাদের একে নতুন করে কাজ করার দরকার কি? আমাদের সহজ উত্তর আমাদের জন্য, ধ্বংসের মুখোমুখি দাঁড়ানো বিশ্বকে বাঁচাবার জন্য। আজ প্রমাণিত এই দুষণের রাজা, লুঠের সম্রাট শিল্পবিপ্লবীয় উতপাদন ব্যবস্থা বিশ্বকে ধ্বংস করার মুখোমুখি করে ফেলেছে - সেটা অনেকে বুঝলেও অন্তত মধ্যবিত্ত সমাজের কিস্যু করার নেই - কেননা তারা এই ব্যবস্থার চালকের আসনে। দিনের পর দিন এটি বিশ্বকে ধ্বংসের দিকে নিয়ে যাবে। আমরা এই গ্রাম্য অর্থনীতির মৌলিক তত্ত্বগুলি আলোচনা করার মাধ্যমে, এই অর্থনীতিকে জোরদার করার মাধ্যমে, ধ্বংস হতে বসা মধ্যবিত্ত, এই অর্থনীতি আর সর্বোপরি এই বিশ্বকে বাঁচাতে চেষ্টা অন্তত করতে পারি।
উইভার্স আর্টিজান এন্ড ট্রাডিশনাল পার্ফর্মিং গিল্ডের(ওয়াপাগ) পক্ষ থেকে বন্ধুদের বিনীত নিবেদন, যাদের জোরে আজকের বাংলা দাঁড়িয়ে রয়েছে, তাদের হস্তশিল্পী না বলে গ্রামভিত্তিক ছোট উতপাদক বলা চালু করি। অন্তত নবতম ভাষ্যটা চালু করার আমরা ভগীরথ হওয়ার সম্মান অর্জন করি।

No comments: