Friday, August 17, 2018

আষাঢ় আর শ্রাবণ পরপর দুই মাস ছোটলোক বাঙ্গালির ভবিষ্যত বিপর্যয়ের মাস।

১১৬৪এর ঘণ আষাঢ়ে হয়েছিল সিরাজের পরাজয় এবং সেই সঙ্গে কারিগরদের বিশ্ববাণিজ্যের ইতি আর ভদ্রবিত্তের চমকপ্রদ উত্থানে বাংলার সম্পদ আর জ্ঞান প্রযুক্তি লুঠ খুন আর ধ্বংস।
তার প্রায় ১৯০ বছর পরে ১৩৫৪র শ্রাবণে হয়েছিল বাংলা ভাগ। ছোটলোক বাঙ্গালির ভবিষ্যৎ খুন হল দুরাষ্টের উচ্চবর্ণের ক্ষমতায় আসার মধ্যে দিয়ে। যোগেন মণ্ডল কিছুটা লড়েছিলেন। কিন্তু সেটাও ব্যর্থ হল।
আজ স্বাধীনতা ভদ্রবিত্তের। তাদের পুনর্বাসনের জন্যে উপমহাদেশের কোটি ছোটলোক বাঙালি আর পাঞ্জাবিকে উচ্ছন্নে যেতে হয়েছিল শুধু বঙ্গ, পাঞ্জাবের ভাগের সময় নয়, তারপরেও ভদ্রবিত্ত আরে কর্পোরেটদেরর চাকরি, ব্যবসা উৎপাদন ব্যবস্থা করে দেওয়ার জন্যে। একদিকে জিন্না আরেক দিকে নেহরু - দুই বিলেত ফেরত আর তাদের উত্তরসাধকের হাতে পড়ে বাঙালি ছোটলোক উচ্ছেদ হল, ভাগ্যবিপর্যয় ঘটল।
ব্রিটিশ গেল। কিন্তু উপনিবেশের অবসান হল না। ঔপনিবেশিক নীতিগুলি থেকেই গেল ভদ্রলোকেদের পুনর্বাসন দিতে।১৩৫৪র পরে যারা ক্ষমতা পেলেন তাদের অনেককেই আমরা চিনি। তাদের অধিকাংশ ১১৬৪র ভাগ্যবানদের উত্তরসূরী। ক্ষমতায় যাওয়া ডান, বাম বা মধ্যপন্থী কেউই ঔপনিবেশিক নীতি বদলাল না।
যে পরিবারগুলো পলাশী আর তার পরের বিপুল বাংলা লুঠের অর্থে ব্রিটিশদের গোলামি করে জেলা ছেড়ে কলকাতার বিভিন্ন এলাকায় এসে বসতিস্থাপন করেন, তাদের মধ্যে অগ্রগণ্যরা চৌদ্দ পরিবার হলেন
১) ঠাকুর পরিবার
বহুবিস্তৃত সমৃদ্ধশালী পরিবার। প্রধান শাখার আদিপুরুষ দর্পনারায়ণ ঠাকুর হুইলার সাহেবের দেওয়ানি করে বহু অর্থ উপার্জন করেন। গোপীমোহন ঠাকুর, দ্বারকানাথ ঠাকুর, প্রভৃতি ইংরেজদের সঙ্গে চাকরিসহ নানান রকম ব্যবসা বাণিজ্য করে বহু অর্থ উপার্জন করেন।
২) শেভাবাজার রাজ-পরিবার
প্রথমে মুন্সি পরে রাজা উপাধি পাওয়া নবকৃষ্ণ ক্লাইভের দেওয়ান ছিলেন। ক্লাইভের ভাগ্যের সঙ্গে এই পরিবারের ভাগ্যও জুড়ে গিয়েছিল। গোপমোহন দেব, রাধাকান্ত দেবসহ আরও অনেকে কলকাতার ইঙ্গ-বঙ্গ সমাজে যথেষ্ট প্রতিপত্তি লাভ করেন।
৩) পাথুরিয়াঘাটার কয়েকটি পরিবার
পাথুরিয়াঘাটার ঠাকুর পরিবার বাদ দিলে, ছিল ঘোষ পরিবার। রামলোচন ঘোষ হেস্টিংসএর সরকার ছিলেন। ছিল এলিজা ইম্পের দেওয়ান রাজা সুখময় রায়ের পরিবারের প্রতিষ্ঠাতা লক্ষ্মীকান্ত(সুখময় তাঁর দৌহিত্র) ক্লাইভ ও অন্যান্য বড়লাটদের বেনিয়া হিসাবে বেহিসেবি অর্থ উপার্জন করেন। বৈদ্যনাথ রায়, শিবচন্দ্র রায়, নরসিংব রায় বাঙলার সমাজে প্রভুত্ব করেছেন। দেওয়ান বৈদ্যনাথ মুখোপাধ্যায়ের পরিবারসহ মল্লিক, শেঠ, বসাক পরিবার এ অঞ্চলে বাস করতেন।
৪) হাটখোলার দত্ত পরিবার
রামচন্দ্র দত্ত, জগত্রাম দত্ত প্রভৃতি কোম্পানির বেনিয়ানি করেছেন। শিপওনার মদনমোহন দত্ত যথেষ্ট ধনসঞ্চয় করেন।
৫) কুমারটুলির মিত্র পরিবার
সেকালের ছড়ায় গোবিন্দরামের ছড়ি, বনমালী সরকারের বাড়ি, আমিচাঁদের দাড়ি আর জগতশেঠের কড়ি মুখে মুখে ঘুরত। গোবিন্দরাম মিত্র কলকাতার ব্ল্যাক ডেপুটি আর নেটিভ জমিদার। এই পরিবারের শম্ভুচরণ মিত্র, কাশীশ্বর মিত্রও কলকাতার সমাজে যথেষ্ট প্রভাবশালী ছিলেন।
৬) জোড়াসাঁকোর ঘোষ আর সিংহ পরিবার
দেওয়ান অভয়চরণ ঘোষের পুত্র হরচন্দ্র ঘোষ বাঙলার পরিবারের অন্যতম গৌরব ছিলেন। সিংহ পরিবারের প্রতিষ্ঠাতা শান্তিরাম পাটনার চিফ মিডলটন আর রামবোল্টের দেওয়ানি করে ধনবান হন। প্রাণকৃষ্ণ আর জয়কৃষ্ণ দুই পুত্র। প্রাণকৃষ্ণের পুত্র শ্রীকৃষ্ণ আর জয়কৃষ্ণের পৌত্র কালীপ্রসন্ন বাঙলার গৌরব।
৭)পাইকপাড়ার সিংহ পরিবার
গঙ্গাগোবিন্দ সিংহ হেস্টিংসের আমলে কাউন্সিল অব বোর্ড অব রেভিনিউএর দেওয়ান ছিলেন। পরিবারের লালাবাবু-কৃষ্ণচন্দ্র, প্রতাপচন্দ্র, ঈশ্বরচন্দ্র নাম উল্লেখযোগ্য।
৮) সিমলের দে পরিবার
রামদুলাল ফেয়ারলি কোম্পানির দেওয়ান ছিলেন, আর আমেরিকার নানান কোম্পানির সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ ছিল। বস্টন, ফিলাডেলফিয়া, নিউইয়র্ক, সালেন, মারভেলহেড, নিউবেরি পোর্ট প্রভৃতি এলাকায় সরাসরি ব্যবসা করতেন। পুত্র আশুতোষ দে ছিলেন কলকাতার সমাজের মধ্যমণি।
৯) কলুটোলার শীল আর সেন পরিবার
পরিবারের প্রতিষ্ঠাতা মতিলাল শীল ব্যবসা করে অজস্র অর্থ উপার্জন করেছেন। তাঁর নামে আজও কলকাতায় প্রচুর মাইলস্টোন রয়েছে। সেন পরিবারের রামকমল সেন ছিলেন বেঙ্গল ব্যাঙ্কএর দেওয়ান। উত্তরপুরুষদের মধ্যে হরিমোহন, কেশবচন্দ্র, মাধবচন্দ্র আজও সম্মান পান
১০) রামবাগানের দত্ত পরিবার
সরকারি চাকরি করেই রসময় দত্ত, গোবিন্দচন্দ্র দত্ত পরিবারের ভিত্তি স্থাপন করেন। অরু আর তরু দত্ত এই পরিবারেরই সন্তান
১১) বৌবাজারের বন্দ্যোপাধ্যায় পরিবার
প্রতিষ্ঠাতা হিদারাম হিকি ও অন্যান্য সাহেবের দেওয়ানি করে বড়লোক হন। হিদারামের পৌত্র রাজকৃষ্ণ ঈশ্বরচন্দ্রের অন্তরঙ্গ বন্ধু ছিলেন।
১২) মলঙ্গার দত্ত পরিবার
বেনিয়ানি করে ধনলাভ করে অক্রুর দত্ত এই পরিবারের প্রতিষ্ঠা করেন। রাজেন্দ্র দত্ত বিদ্যাসাগরের বন্ধু ছিলেন। এদেরই পরিবারের গিরীন্দ্রমোহিনী কবিতা লিখে নাম করেন।

No comments: