Friday, August 17, 2018

উপনিবেশ বিরোধী চর্চা - গ্রাম-বাংলা কি সত্যি অনড় অচল - না কি তাকে অন্য দৃষ্টিতে দ্যাখা যায়

কার্ল মার্ক্স সাহেব সব কিছুকেই প্রশ্ন করতে বলেছিলেন, কিন্তু সেটা নানান কারণে তাঁর অনুগামীরা বাস্তবায়িত করলেন না - মার্ক্স বিষয়ক কোন কিছুকে প্রশ্ন করলেই বিশ্ব যেন ভেঙ্গে পড়ে, গোটা মার্ক্সবাদীপক্ষ রে রে করে মারতে আসেন। মার্ক্স আদতে গুরুঠাকুর ভদ্রলাঞ্ছিতই কর্পোরেটদের হয়ে ভদ্রদের ক্ষমতা দখল আর ভদ্রদের আরেকটু স্বচ্ছল থাকার জন্যে কর্পোরেটদের সঙ্গে দরকষাকষির হাতিয়ার হিসেবেই থেকে গেলেন।
এ ফেবু-চণ্ডীমণ্ডপে মার্ক্স-শাস্ত্র বা সমাজচর্চা নিয়ে আলোচনায় বসি নি। আলোচনাটা আদতে গাঁইয়াদের স্থবিরতার অভিযোগ নিয়ে প্রশ্ন না তোলার অভিযোগ নিয়ে(যে অভিযোগ নিজের যৌবনে স্বয়ং মার্ক্স করেছিলেন এশিয় গাঁইয়াদের নিয়ে) - গাঁইয়াদের কপালে পরিবর্তনের সঙ্গে না মানাতে পারার অভিযোগ ওঠা নিয়ে বিচার দেওয়ার। যে জন্য ইওরোপ তাকে ফোক/পাগান বলে মিউজিয়ামিয় করে নাগরিক সমাজের বাইরে বার করে দিল আর আমরা উপমহাদেশে লোক/কৃষ্টি/সংস্কৃতি লব্জ তৈরি করে সেটাই চেষ্টা করলাম - যেন গাঁইয়াদের জীবন কৃষ্টি-ভাষ্য-প্রযুক্তি-জ্ঞান-ধারনাটারণা অনড় অচল। কিন্তু ইওরোপ পাগানদের ধ্বংস করে দিতে পেরেছিল, আমরা ইওরোপিয়দের মত বাংলার গ্রাম ধ্বংস করতে পারলাম না, ব্রিটিশদের দালাল হয়ে শতষ্টাতেও করেও। এমন কি পাল্টাতেও পারলাম না বরং পলাশীর পর তারা প্রত্যাঘাত করল ফকির-সন্ন্যাসী যুদ্ধের মধ্যে দিয়ে। তারা আজও ভদ্রবিত্তের চক্ষুশূল। কেন? প্রতি পলে কর্পোরেটদের অঙ্গুলি হেলনে ভদ্রবিত্তরা পাল্টে পাল্টে চলেছে - ভোরে টুথপেস্ট থেকে পিঠে ব্যাকপ্যাক থেকে রাতে ঘুমোনোর বিন্দুসম বড়িটি সেবন পর্যন্ত - সেটা গাঁইয়াদের সহজে গেলানো যাচ্ছে না। ভদ্রজীবনে কর্পোরেটদের যে ভূমিকা, গাঁইয়াদের জীবনে কর্পোরেট কালচার তত বড় ভূমিকা নিতে পারছে না। তাত্ত্বিকভাবে গাঁইয়াদের ন্যুন করা দরকার হয়ে পড়ল - তাই দাগিয়ে দাও এরা পরিবর্তিত হয় না বলে।
ফলে গত এক শতকধরে মোটামুটি গাঁইয়াদের মিউজিয়াম পিস বানিয়ে দেওয়ার রাজনীতি, লুপ্তপ্রায় নামক শব্দটা আজও তীব্র সচল আছে। মিউজিয়াম একটা ঔপনিবেশিক দর্শন। আমার দৃষ্টিতে আমি যাকে দেখাতে চাই মিউজিয়ামে এসে আমার মত করে দ্যাখ। সেখানে দর্শকের ভূমিকা গ্রহীতার। গাঁয়ে যেও না। ফোক মিউজিয়ামে এস। কাকে ফোক কালচার বলে আমি তোমায় বোঝাব। কেন তার কৃষ্টি লুপ্তপ্রায় সেটা জানাব - তার কৃষ্টি কেন মহান সেটা অজ্ঞ গাঁইয়ারা জানে না - আমি জানি - নবজাগরণ সেটা আমায় শিখিয়েছে। ফলে একটা ধারনা করে দ্যাওয়ার চেষ্টা হল, গাঁইয়ারা নিজেদের মধ্যে আলাপ-আলোচনা করে না, তারা অসম্ভব গোঁয়ার, সভ্যতার ষড়ৈশ্বর্যের বোধ হীন, শত ধাক্কাতেও অপরিবর্তনীয়, যে তত্ত্ব তাদের পূর্বজরা দিয়ে গ্যাছে তাই নিয়ে তারা কাটিয়ে দ্যায় শত শত বছর। এই যে পশ্চিমী মোডে ধারনাগুলি আমাদের রবিবাবু থেকে হালের ফোকের ডাক্তার বাবুরা করে আসেন সেটাতেই প্রশ্ন তুলছি। রবিবাবু কেন মেয়েদের ছড়া সংগ্রহ করতে বললেন? কেন? ঐ হারিয়ে যাওয়ার লুপ্তপ্রায় তত্ত্ব। আমি এক্ষুনি ধরতে না রাখলে লুপ্ত হয়ে যাবে। আর এই লুপ্তপ্রায় কৃষ্টিকে বাঁচাতে পারে ভদ্রবিত্ত ভ্যানগার্ডএরা।
আমরা গাঁইয়ারা এই তাত্ত্বিক অবস্থানে তুলে প্রশ্ন করতে চাইছি যে এই ধারনাটা কতটা বাস্তবানুগ? আমরা বলতে চাই গাঁইয়াদের তাত্ত্বিক অবস্থান নিয়ে আলোচনা আজও গ্রামের নাটক, গান, গল্প, কথকতায়, বাদ্যে, পুজোয়, আচারে, জীবনযাত্রায় ভুরি ভুরি হয়। গানে, নাটকে, বাদ্যতে, সাধারণ কথাবার্তায়, চিকিৎসায় তাত্ত্বিক আলোচনা হামেসাই চলে - খেউড়, কবিগান, তুখ্যা, বন্ধুপুছা, বন্ধুআলা, বাউল এবং হাজারো প্রকাশভঙ্গীতে মানুষেরা আজও পরস্পরের সঙ্গে আলাপ আলোচনা করেন, তত্ত্ব আর তথ্যকে দিনরাত জাগিয়ে রাখেন - প্রশ্ন করেন, প্রশ্ন তোলেন, প্রশ্নের উত্তর চান এবং সেই তত্ত্বায়নের প্রভাব পড়ে গ্রামীন জীবনে। এই আলোচনা-প্রত্যালোচনা তাত্ত্বিক লড়ায়ে হাজার হাজার বছর অকর্পোরেটিয় গ্রাম সভ্যতা জেগে থাকে - নিজের পায়ে, নিজের তত্ত্বে, কোন রকম ভনিতা ছাড়া, নিজের বুদ্ধি সামাজিকতার জোরে - যে সামাজিকতায় ভোজে সমাজের প্রত্যেকের অংশগ্রহণ জরুরি - এবং যে যত বেশি বাস্তব সম্পদ-রিক্ত, সেই যেন বড় তাত্ত্বিক।
আমরা শহুরে মেকলের নাতিপুতি ভদ্রবিত্তরা গাঁইয়াদের অপটুত্বের পটুত্ব বা স্বভাব কবি বা স্বভাব গায়ক বলে অসীম প্রশান্তি অনুভব করি আর নিজেদের মেধাবী দাগিয়ে দিই - স্বভাবে কিস্যু হয় কি না জানি না - দীর্ঘকাল সারাক্ষণ ধরে গ্রামে গঞ্জে যে বিপুল জ্ঞানচর্চা চলে, এবং প্রত্যেক গাঁইয়াকে যেভাবে প্রত্যেক খনে পরীক্ষা দিতে হয় তার সমাজের সামনে, সে কারিগরিই হোক, নাচ, নাটক, গান যাই হোক - সেই অমধ্যবিত্তিয় পরীক্ষিত জ্ঞানচর্চার পরিবেশে গ্রামীন্দের মধ্যে পরম জ্ঞানী হতে হতে একজন আধজন লালন গোঁসাই, হাউড়ে গোঁসাই, মধুমঙ্গল মালাকার, হরকুমার গুপ্ত, করুণাকান্ত হাজারা, বাদল ঢুলি, নেপাল সূত্রধর বা হরিপদ বসাক হয়ে বেরোন। আর প্রত্যেকই গাঁইয়াই যেন দার্শনিক - কিরকম সান্ধ্যভাষায় কথা বলেন একটু ঘনিষ্ঠ হলে আন্দাজ পাওয়া যায়। ২৫ বছর আগে আমার যৌবনকালে বয়স জিজ্ঞেস করায় লেটোর সংদার হরকুমার গুপ্ত বলেছিলেন ২০০ বছর, আমি আবাল যৌবনে যুক্তিবুদ্ধিমান ভদ্র-অবুঝের মত হেসে দিয়েছিলাম, বুঝেছিলেন বুঝিনি - খুব সাধারণ স্বরে বললেন বাবু বয়স কি দেহে হয়, বয়স হয় মনে, আমি আমার পাঁচ পুরুষের গান এই দেহভাণ্ডে বয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছি - এটাই ত আমার বয়েস। সেই যে পৃথিবীটা হেঁটমুণ্ডউর্ধ্বপদ হয়ে গাঁইয়াদের দিকে সোজা গিয়েছিল ব্যক্তি আমি'র, তারপরে আর সোজা হয় নি।
মনের মানুষ উপন্যাস লেখার সময় লেখক এবং ছবি করার সময় পরিচালকবাবু বুঝতেই পারছেন না যে লালন বিদ্যালয়ে যান নি, পড়াশোনা করেননি বিধিবদ্ধভাবে, তিনি কি করে এত দার্শনিকস্তরের কথা বলেন, যা তিনি তো বটেই, তাঁদের তাত্ত্বিক ব্রিটিশেরাও বলতে পারে নি? এটা যে ছোটবেলা থেকেই পথে ঘাটে শুধু লালন নন, প্রত্যেক গাঁইয়া নদীর পাড়ে চণ্ডীমণ্ডপে, মাজারে, পালাগানে দেখে শুনে আলোচনায় ফেলে, আত্মস্থ করতে করতে বড় হচ্ছেন এবং তার প্রকাশ ঘটছে কারোর কাজে, কারোর গানে, কারোর নাট্যে, কারোর বাদ্যে - কিন্তু পুরোটাই আপনারা বিশ্লেষণ করুন দেখবেন গাঁইয়া বিকেন্দ্রিভূত তত্ত্ব, ক্ষমতাকে প্রশ্ন করার চেষ্টা ভুরভুর করছে। কারোর প্রকাশ ঘটে কারোর ঘটে না।আর কিছু আমরা বুঝতেও পারিনা।
ভারতের অন্যান্য অঞ্চলের কথা আমরা জানি না, কিন্তু বাংলার গাঁইয়ারা অসাধারণ ঔদার্যে ঠাঁই দিয়েছেন তাদের সঙ্গ করার কাজে, বুঝতে পারছি আবছা আবছা, এটা তাত্ত্বিকতার অসাধারণ বৌদ্ধিক প্রকাশভঙ্গী যা আমরা ভদ্ররা ভাবতেও পারি না। এটার অভাব খুব টেরপাই শহরে। খুব হোঁচট খেয়ে খেয়ে এগোতে হয়।

No comments: