Monday, August 20, 2018

সমস্যা হল ভদ্রবাঙ্গালি সব কিছুতেই শুধু নিজেদেরই দোষ খোঁজে

আর সকল ভারতীয় ভদ্র যেন ধোয়া তুলসি পাতা তারা দ্বিধাবিভক্ত নয়, তারা যেন সাম্রাজ্যের কাছে আত্মসমর্পন করে নি ইত্যাদি ইত্যাদি। একমাত্র বাঙালি ভদ্ররা বহুকাল ধরে দ্বিধাবিভক্ত এবং সাম্রাজ্যের আয়ে আত্মসমর্পন করেছিল বলেই নাকি তার দুর্দশা।
সোজা কথা সোজাভাবে বলা দরকার। ভারতীয় সমাজ ঐতিহাসিকভাবে বহুধাবিভক্ত। কোন সমাজে বিভাগ ছিল না? হিন্দু মুসলমানে বিভক্ত কি শুধু বাংলা হয়েছে? সাম্রাজ্যের পায়ে শুধু কি ভদ্র বাঙ্গালিই মাথা দিয়েছে? বিভক্ত হয়ে শুধু আত্মসমর্পন বাঙ্গালিই করেছে? এখানে আমরা যুদ্ধ জাতি পাঞ্জাবিদের নিয়ে একটু আলোচনা করব।
শিখ আর গুর্খা, দুই যুদ্ধ সমাজের মধ্যে পাঞ্জাবিরা কি অনেকভাগে বিভক্ত নয়? উভয়েই কি সাম্রাজ্যের পায়ে আত্মসমর্পন করে নি? ভারতে ব্রিটিশ সেনার মধ্যে শিখ আর গোর্খা এই দুই সমাজ আজও সংখ্যাগরিষ্ঠ। মাত্র কয়েক বছর আগে ব্রিটিশ-শিখ যুদ্ধে হারা শিখেরা সাম্রাজ্য নীতিতে ব্রিটিশ সেনা বাহিনীতে ঢুকতে শুরু করে। ১৮৫৭র পরে সেনা বাহিনীতে শিখেরা হল সংখ্যাগরিষ্ঠ। তখনও শিখেদের আম-জনতার পাগড়ি চিহ্ন নেই। এটা তার পরে এসেছে। পাগড়ি চিহ্ন তাদের সাম্রাজ্যের কাছে আত্মসমরপণের চিহ্ন।
১৬৯৯ সালে গুরু গোবিন্দ সিংহ নির্দেশিত পঞ্চ ক - আকাটা চুল (কেশ) , চুলে চিরুনি (কাঙ্গা), হাঁটু পর্যন্ত জামা (কাচ্ছা), ডান হাতে ইস্পাতের বালা (কাড়া) এবং তরোয়াল (কৃপাণ) নীতিতে পাগড়ি কোথায়? তাদের পাগড়ি পরানো শুরু করিয়েছে সাম্রাজ্য সেনাবাহিনীতে তাদের আলাদা করা উদ্দেশ্যে সিপাহি যুদ্ধের পর।
উপমহাদেশে যত বিদ্রোহ এই দুই রেজিমেন্ট দিয়ে ধ্বংস করা হয়েছে। গোটা শিখ সমাজ ইংরেজ অনুগামী হয়ে উঠল, বিপুল অংশ লন্ডনে বাস করতে শুরু করে। শার্লক হোমস বা অন্যান্য ঔপনিবেশিক লেখাপত্রে ভারতীয় বুঝতে পাগড়ি পরা শিখেদেরই ইওরোপিয় মানুষ বুঝত। কেন? ব্রিটিশদের সহায়তায় বহু শিখ বিদেশে পুনর্বাসিত হয়।
বার্নাড কোহন সাম্রাজ্যের মন ও মান বইতে বলছেন ব্রিটিশ-শিখ যুদ্ধে সাম্রাজ্য জেতার এক বছরের মধ্যে ব্রিটিশ শাসকেরা শিখদের সেনা বাহিনীতে নেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু করে দেয়। যে সব যোদ্ধা আমলা শিখ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিল, তারা বলল কেশধারী শিখদের রেজিমেন্ট বানানো দরকার, খালসা শিখ যারা মাথার চুল ছোট করে না, তাদেরই একমাত্র বাহিনীতে নিতে হবে – কারণ তারা সহি শিখ। যে সব শিখকে, শিখদের মত দেখতে – যারা আদিম চেহারার, চুল দাড়ি কাটে না, তারাই সেনাবাহিনীর চাকরিতে যোগ্য বলে বিবেচিত হল। শিখদের ক্ষেত্রে সরকারি নীতি হল তাদের জাতিবাদিতার ওপর সরকার হস্তক্ষেপ করবে না... তাদের ধর্মীয় এবং সামাজিক চরিত্র বজায় রাখার চেষ্টা হবে।
১৮৫০ সালে শিখ রেজিমেট তৈরির সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। সিপাহী যুদ্ধে ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর বিপুল অংশ বিদ্রোহ করলেও, শিখেরা মহা উৎসাহে তাদের শত্রু মুঘল সেনার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে হারিয়ে দেয় গাঙ্গেয় উপত্যকা জুড়ে। ১৮৬০ সালের পরের দিকে ব্রিটিশেরা প্রাথমিকভাবে পাঞ্জাবী, বিশেষ করে শিখ বাহিনীর ওপর খুব বেশি ভরসা করতে থাকে। ১৯১১ সালে ভারতের জনসংখ্যার ৮ শতাংশ হওয়া সত্ত্বেও পাঞ্জাবের অর্ধেক জনসংখ্যা ব্রিটিশ সেনাবাহিনীতে নিযুক্ত হয়। শিখেরা ভারতের জনসংখ্যার ১ শতাংশ হলেও, সেনাবাহিনীর ২০ শতাংশ সেনা ছিল শিখ।
--
এখানে ছোটলোকেদের আদতে যারা দেশের কারিগর চাষী শ্রমিক, তাদের সম্বন্ধে কিছু বলা দরকার। ব্রিটিশদের পায়ে আত্মসমর্পনকারী শিক্ষিত বাঙ্গালিদের ভয়ে বাঙালি রেজিমেন্ট ভেঙ্গে দেওয়া হয় এটা কারণ নয় - ভদ্ররা কিন্তু সিপাহি হ্যাঙ্গামে ব্রিটিশদের সহায়তাই করেছিল - বিদ্যাসাগরের ব্যারাক বনাতে বিদ্যালয় ছেড়ে দেওয়ার কথা মাথায় রাখুন - প্যারীচাঁদ মিত্তিরের ভাই কিশোরীচাঁদ মিত্তের বই লেখার কথা মাথায় রাখুন।
বাঙালি সেনা বাহিনী ভেঙ্গে দেওয়া হয় সিপাহি যুদ্ধের পরে। লড়াই দিয়েছিল আদতে পলাশীর অর থেকে ছোটলোকেরা ফকির সন্ন্যাসী স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরুর মাধ্যমে - গোটা বাংলায় ব্রিটিশ বিরোধী লড়াই চলে সিপাহি যুদ্ধের পরে পর্যন্ত। সেই ছোটলোকেদের ভয়েই বাংলা সেনা ভেঙ্গে দেওয়া হয়। ছোটলোকেরা লড়াই চালিয়ে যায় - এবং সেই প্রতিক্রিয়ায় লড়াইএর ময়দান পরিবর্তন করতে উপমহাদেশিয় ভদ্রলোকেদের দিয়ে কংগ্রেস তৈরি করেন হিউম - যে মানুষটার দায়িত্ব ছিল ভারত জুড়ে নুনের বেড়া তৈরির।

No comments: