Tuesday, August 21, 2018

সোমনাথের লেখার উত্তরে

আমি সত্যিকারের আনপড় - আমি যেমন ঘোরতর মেদিনীপুরী, এই কথাটা বলতে কোন দ্বিধা নেই, তেমনি আমি আমাদের পরম্পরা ঐতিহ্য সাহিত্য দর্শন কিছুই যে পড়ি নি এটা বলতেও আমার কোন সমস্যা নেই। এটা আমার সমস্যা এবং সুবিধে দুটোই। আপনি বা Arjundeb বা Dipankarদা বা Arupsankarদা বা আরও জ্ঞানী পড়াশোনা জানা মানুষের সঙ্গে ফেবুতে বুক বাজিয়ে স্রেফ তক্ক করি একদা হকার সংগঠন করার সুবাদে আর কিছুটা কারিগর, অভিকর শিল্পীদের সংগঠন করার শিক্ষায়। প্রথম বয়সে রুশ/চিনা বা দেশিয় বাম ঘরানার বই কেনা বামপন্থী পরিবারের বাঙালি হবার সুবাদে বলতে পারি - ছোকরা বয়স থেকে যৌবন বয়ে প্রৌঢ় বয়সে এসে পড়াশোনা করা এই ধরণের আম-মানুষ যতটুকুও পড়েছেন আমি তার অংশ টুকুও পড়ি নি। বাড়িতে অনেক বই ডাঁই করা আছে এবং গত কয়েক দিন আগে ৬৪ কিস্তিতে যে বইএর তালিকা দিয়েছিলাম ফেবুতে তার ৯৯% পড়া নয়। আপনি বা অর্জুনদেব বা দীপঙ্করদা বা অরূপদা যা বলেন সেখানে অজহস্তিমুর্খের মত তক্ক করি শুধু দুটি সমাজের হকার আর কারিগরদের শিক্ষায়। ব্রিটিশ পূর্ব সময় আর কিছুটা ব্রিটিশ সময়ে এই মানুষদের অবস্থা জানতে যতটুকু ফাংশানাল পল্লবগ্রাহী পড়াশোনা করা দরকার - যার প্রাতিষ্ঠানিক অস্তিত্ব প্রায় নেই বললেই চলে সেটাকে জ্ঞানচর্চা বিন্দুমাত্র বলা মানে আপনাদের মত সত্যিকারের জ্ঞানচর্চা যারা করেন তাদের সরাসরি অপমান কোড়া। ফলে দ্বিতীয় স্তবকে আপনি যেসব উদাহরণ দিলেন সেগুলি মোদ্দাভাবে বুঝতে হল, নাঢ়াপাদ, রত্নাকর শান্তি ইত্যাদি নিয়ে আমার দৌড় বড় জোর হরপ্রসাদ, অলকা কিছুটা কল্যাণী। পড়াশোনা না করার বড় সুবিধে হল কোন কিছুকে এক কথায় নস্যাৎ করে দেওয়া যা আমি নিচে করব। 
এটা ছদ্ম বিনয় বলে ভুল করার নয় - এটাই বাস্তব। কিন্তু আমার যৌবনবেলা থেকেই কেন যেন ঔপনিবেশিকতা বিরোধী মানসিকতা গড়ে উঠেছিল তার কারণ আমার মেদিনীপুরিত্ব কলকাতা ভুলিয়েছে। আর যৌবনটা আর প্রৌঢ়ত্ব কেটেছে এই দুই সমাজের মানুষদের জীবন আর জ্ঞানচর্চার মধ্যেই। এই অনঔপনিবেশিক মানুষেরা আমায় হাত ধরে শিখিয়েছেন আমি যা বিদ্যালয়ে, মহাবিদ্যালয়ে, বিখ্যাত বিখ্যাতদের সঙ্গ করে থান থান বই পড়ে শিখিনি। যখন লেটোর প্রণম্য সংদার দার্শনিক হরকুমার গুপ্ত বলেন তার বয়স ২০০ কেন তার বা ঠাকুদ্দা ৬/৭ পুরুষের অভিজ্ঞতা তিনি বইছেন, বা যখন ট্রেনে এক গুরুজী বলেন তিনি ধনিক রেখা করতে আন্দোলন করছেন, যখন এক দিন আনি দিন খাই ভাগ চাষী বর্ষার রাতে আমাদের চার জনের জন্যে তার একটা ঘর ছেড়ে দিয়ে পরিবার নিয়ে বাইরে শোন বা ফুটপাথে চরম গরমের দিনে বিরিয়ানি করা সাহাদা দিনের শেষে শেষ পড়ে থাকা ১২/১৪ প্লেট বিরিয়ানি বাড়ি না নিয়ে গিয়ে বেঁটে দেন স্থানীয় নানান উদ্বৃত্ত মানুষদের, যখন দেখি ১২ বার বিদেশ যাওয়া মধুমঙ্গল মালাকার তার চায়ের দোকানে বসেন আর ছুরিটা দিয়ে বাপ দাদার শেখানো শোলা কাটেন বা শ্রীনাথ টুডুকে বাঁশের মাল নিয়ে মেলায় ডাকলে সে তার সঙ্গে তার আরেকজন প্রতিযোগীকে নিয়ে আসেন, তখনই তারা আমার প্রণম্য শিক্ষক হয়ে ওঠেন।
এই মানুষদের থেকে যে শিক্ষা সেখান থেকে আমার মনে হয়েছে ভারত একটা শূদ্র সমাজ। এখানে চিরকাল ভদ্ররা ছিল, কিন্তু আজকের মত কৃপান হাতে নয়, অনেকটা মাথা নিচু করে - সমাজটা সেভাবেই তারা গড়ে তুইলেছিলেন। তাতেই আমার মনে হয়েছে সীমিত পড়াশোনায় তাঁরা যেভাবে ছোটলোকেদের সম্বোধন করে গিয়েছেন, সুযোগ পেলে তারা তাদের হাতে মাথা কাটতেন। রাজা সম্রাটেরা বাদশাহেরা নবাবেরা সুলতানেরা তাঁদের সে সুযোগ দেন নি। এটা আমার অনুভূতি। সেদিন ইংরেজির বদলে ছিল সংস্কৃত। ভদ্রদের সমস্যা ছিল সে সময়টা উপনিবেশের সময় ছিল না 
যেখানে শুরু করেছিলাম সেখানেই ফিরে আসি, আমি যেহেতু আনপড়, আমার বংশের কুলাঙ্গার, আমায় যদি যুক্তি দিয়ে বোঝাতে বলেন, পারব না, খালি একগাদা গ্যাদগ্যাদে আবেগ ঢালব। সেটা আমার জোর যে আমায় এখনও যারা শিখিয়েছেন হকারকারিগর তারা বুঝিয়েছেন ছোটলোকের দৃষ্টিভঙ্গী। তবে আপনাদের প্রভাবে যদি নতুন দৃষ্টি পাই তাহলে নতুনভাবে ভাবতে শিখব। কিন্তু এখনও পর্যন্ত আমার পথের মাঠের গুরুদের থেকে পাওয়া জ্ঞান বদলাবার কারণ ঘটছে না। হয়ত সেই যৌবনকালের ঔপনিবেশিক দৃষ্টিটা কাটে নি। সেটাও একটা কারণ হয়ত Somnath
এটা লিখেছিলাম সোমনাথের এই লেখাটার উত্তরে
বিশ্বেন্দুদা, এই পোস্টের মূল ভাব প্রসঙ্গে আমার একটা বক্তব্য আছে। সেটা টুক করে লিখে ফেলি। এই যখন সাধারণ মানুষের জ্ঞানচর্চা আর প্রাতিষ্ঠানিক জ্ঞানচর্চার মধ্যে জলবিভাজন করছি, তখন আসলে ঔপনিবেশিক জ্ঞানচর্চার কাঠামোকে ধরে ভেবে ফেলছি না তো? সাধারণ মানুষের সঙ্গে কি প্রতিষ্ঠানের এত দূরত্ব ছিল যা আমরা আজকে দেখি?
হরপ্রসাদের অনুমান মানলে নালন্দার নাঢ়াপাদ, রত্নাকর শান্তি সাধারণ মানুষের মধ্যে থেকেই শিষ্য শিষ্যা নিতেন আর তাঁদের অভ্যাসের জন্যই চর্যার তত্ত্বে গান বাঁধেন। বৌদ্ধদের পালিচর্চা তো সাধারণের ভাষাতেই কথা বলতে। (এই ভাষা ব্যাকরণ নিয়ে একটা বড় দার্শনিক হৈচৈ নিশ্চয়ই হয়েছিল তাই সাধারণ বেদ-অভ্যাস করতে পারবেনা বলে কুমারিল প্রভাকরকে ব্যাকরণে অত জোর দিতে হয় ।) মহাভারতকে পঞ্চমবেদ হিসেবে লেখেন সেযুগের শ্রেষ্ঠ পন্ডিতরা, যাতে সাধারণ লোক বুঝতে পারে। অ্যাকাডেমিয়া নিশ্চয়ই ছিল, কিন্তু তার মূল্যায়ণের একটা মাপকাঠি ছিল সাধারণের ভাষায়, সাধারণ লোকের অভ্যাসের জন্য সে কী ডিস-সেমিনেট করতে পারছে।
কীর্তন জিনিসটা নরোত্তম দাস তৈরি করছেন সেই আঙ্গিক থেকে যাতে সাধারণ বৈষ্ণব দুরূহ তত্ত্বগুলি অভ্যাস করতে পারে (প্রাক্সিস?), আরও বহু রচনাই তাই হচ্ছে। সে জন্য ছন্দে সুরে পদ বাঁধার ওপর জোর দেওয়া। কোনও পদকর্তা আধুনিক কবির মতন ব্যক্তিগত নিঃসঙ্গতা রচনা করেন নি, বরং সাধারণের কথা ভেবে তত্ত্ব আলোচনা করেছেন, ঘটনা ডকুমেন্ট করেছেন।
- এই ব্যাপারটা আমার মধ্যযুগ অবধি সাহিত্য, দর্শন, কারিগরি যেটুকু বুঝেছি তা পড়ে ভাসাভাসা মনে হয়েছে।





No comments: