Tuesday, August 7, 2018

উপনিবেশ বিরোধী চর্চা - ঔপনিবেশিক মিথ-মিথ্যে আর কতদিন - "পরাধীন মহিলা" বনাম বাংলা বাস্তব

আমরা লিখেছিলাম "কাঁথা মহিলাদের ব্রহ্মাণ্ড ধারনা। ফোঁড়াইই জীবন। আঁকতেন না। এই দক্ষতা, জ্ঞানচর্চা বাংলা কৃষ্টির ভিত্তি। পুরুষদের তাঁরা মানুষ করেছেন।"

এর উত্তরে এক যুবা বলেছেন "এই মায়েদের কাছে নতুন সুতো কেনা টাকা ছিল না। ব‍্যবহৃত কাপড়ের পাড়ের সুতো হয়েছিল কল্পনার(কাঁথার) আশ্রয়"।

আমাদের উত্তর ছিল
এটা ইওরোপিয়দের কলোনি বিষয়ে নোংরা তত্ত্বায়ন। একটু বাংলার ইতিহাস জানা দরকার - উপনিবেশ তার স্বার্থে অনেক কিছু শিখিয়ে গিয়েছে, তার বাইরে বেরোতে হবে তো।
কেন বললাম?
১) আমরা দেখিয়েছি আজ থেকে ১০০ বছর আগেও, বহু মহিলা বাড়িতে চরকায় সুতো কাটতেন। তার আগে ১৮০০ সাল নাগাদ যখন আদতে কাঁথার সময় তখন এত কাপড় উতপাদন হত বাংলায় প্রত্যেক বাড়িতে প্রায় প্রত্যেক মেয়েকে সুতো কাটতে হত। উপমহাদেশ আর এশিয়া আফ্রিকায় মোট দেশিয় উতপাদনের ৯০% বিক্রি হত। শুধু ইওরোপের চাহিদা ছিল মাত্র ১০%। বর্ণ নির্বিশেষে প্রত্যেক বাড়ির মহিলা চরকা না চালালে সারা দেশে ঐপরিমান তাঁত চলে না, কাপড়ও তৈরি হয় না, বাংলাও উদ্বৃত্ত অঞ্চল হয় না। সুতো কেটে যে তারা সংসার চালাতেন তার বড় উদাহরণ সংবাদ চন্দ্রিকায় ১৮২৮ সালের সুতা কাটনির চিঠি। এ ছাড়া ব্রিটিশ পূর্ব সাহিত্যেও পাওয়া যায়। ফলে তাদের হাতে সুতো ছিল না এই তথ্যটা ঠিক নয়।
২) প্রয়োজন ছিল একটু মোটা সুতো। তাই তারা পুরনো শাড়ির পাড় ব্যবহার করতেন। শুধু কাঁথা নয় আরেওও পরিবারের নানান কাজে।
৩) আর মানসিকভাবে এটা পুণর্নবীকরণ উদ্যম। বাড়ির কাজে যে কোন শ্রেণীর মহিলা তাইই করতেন - আজও করেন - কিভাবে একটু হলেও সংরক্ষণ করা যায় প্রকৃতিকে। তাই মরা আঁচে মশলাগুলো টেলে নিতেন। রাতে কম উনুনে পিঠা করতেন, আলু, বেগুণ ইত্যাদি পোড়া বানাতেন। এরকম হাজারো উদাহরণ দেওয়া যায়। আমার মাকে দেখি গ্যাস চালালোর সময় বার্নারের নিচে কিনে আনা মশলা ধুয়ে শুকিয়ে নেন। রোদও ব্যবহার করেন। মিস্টির প্যাকেটকে ফালা ফালা করে ছিঁড়ে ছিঁড়ে উনুন ধরাবার কাজে ব্যবহার করেন। মহিলাদেরে এই চরিত্রটা ফুটে উঠেছে পাট থেকে নানান রঙের সুতো বের করে কাঁথায় ব্যবহার করায়।
৪) বাংলার ইতিহাস উচ্চবর্ণের পরিবারের মহিলাদের ইতিহাস নয়(সেই পরিবারের মেয়েরাও সুতো কাটতেন চরকা চালাতেন), কারিগরদের পরিবারের ইতিহাস। বাংলার জনসংখ্যায় উচ্চবর্ণের সংখ্যা ১ শতাংশও ছিল না। আজও এবং সেদিনও শূদ্র নমঃশূদ্র পরিবারের মেয়েরা কাজ করতেন। আজও এই কারিগরদের ভেঙ্গে পড়া অর্থনীতির যুগে মেয়েরা যদি কাজ (নিজের পরিবারের কাজ ধরছিই না, উতপাদনের সঙ্গেও যুক্ত থাকার কাজ বলছি) না করে তাহলে গোটা অর্থনীতি দাঁড়িয়ে যাবে। এডামের ১৮৩৫-৩৮এর শিক্ষা সমীক্ষায় ১৯টা মেয়েদের বিদ্যালয় দেখেছিলেন (ততদিনে পলাশী, ছিয়াত্তর, চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত, লুঠ বিশিল্পায়ন পেরিয়ে এসেছে বাংলা)। ১৮০৮ সালে যতদূর সম্ভব হ্যামিলটন বুকানন বুকানন পাটনা জেলায় সাড়ে তিন লক্ষ চরকা কাটনি দেখছেন - এবং পাটনা কাপড় বোনার জন্যে খুব বেশি প্রসিদ্ধ ছিল না।
৫) খুল্লনা তার স্বামীর হাতের লেখা দেখে চিনতে পেরেছিল। সে পড়তে জানত বলে। কর্ণাটের রাজকন্যা ছেলেদের মুরগি বানাতেন পড়াশোনা জানতেন বইলেই। মাধবমালঞ্চি কইন্যায় মালঞ্চী পাঠশালায় যাচ্ছেন(গীতিকায় মেয়েদের পাঠশালার যাওয়ার উদাহরন প্রচুর), হটু হটি বিদ্যালঙ্কার পাঠশালা চালাতেন, আকবরের স্ত্রী মারিয়ুজ্জামানি জাহাজের ব্যবসা চালাতেন, হজে মুঘল মেয়েদের নিয়ে যান, হজে লোক নিয়ে যাওয়া তার ব্যবসা ছিল, নুরজাহানের কথা ছেড়েই দিচ্ছি।

মহিলাদের স্বাধীনতা নেই, জ্ঞান কারিগরেরা লুকিয়ে রাখত(পশ্চিমি পেটেন্টওয়ালারা, জ্ঞানচোরেরা এই অভিযোগ করে), বাংলা জুড়ে সতীদাহ (এটা খুব কম সংখ্যায় উচ্চবর্ণের সমস্যা) হত এ সব ঔপনিবেশিক মিথ আর কতদিন?

No comments: