Tuesday, August 7, 2018

সোমনাথের বিদ্যাসাগর মূল্যায়ণ

Somnath Roy আমাদের হয়ে অসাধারণ বিদ্যাসাগর মূল্যায়ণ করেছেন -
সরোজ দত্তর রাষ্ট্রীয় গুমখুন বার্ষিকী উপলক্ষ্যে বিদ্যাসাগরের প্রসঙ্গ এলো। আমরা যাঁরা সরোজ দত্তকে বিদ্যাসাগরের ভাবমূর্তি অবমাননার পথিকৃৎ মনে করি, তাঁরা মূলতঃ মনে করি ব্রিটিশ শাসন ভারতের জন্য এক দুর্যোগ ছিল, যা আজও ঘোচে নি। এবং এই দুর্যোগ ভারত ছাড়িয়ে সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ে আর পৃথিবীর বর্তমান বিভিন্ন সমস্যার জন্য কোম্পানির কলোনিস্থাপন ও লুণ্ঠনের উত্তরাধিকারই মূলতঃ দায়ী। এই পরিপ্রেক্ষিতে বিদ্যাসাগরের শত অবদান স্বত্তেও তাঁর ভূমিকা হয়ে যায় এমন এক অনুঘটকের যা কোম্পানির শাসন, লুঠেরা পুঁজির বিকাশ এবং তার ফলশ্রুতিতে মানুষ-পরিবেশ-সমাজ ধ্বংসকারী বাজারকে প্রজন্মান্তরেও বৈধতা দিচ্ছে।
এই বৈধতা এইভাবে আসে যে, ভারত বা বাংলা অন্ধকার পঙ্কিল ইতিহাসে পড়ে ছিল, তাঁকে কোম্পানি শাসনের সাহায্য নিয়ে বিদ্যাসাগর প্রমুখ মণীষীরা সভ্যতার আলোয় আনলেন। এই বৈধতাকে চ্যালেঞ্জ করার দায় থেকে বিদ্যাসাগরের অবদানগুলিকে পুনরালোচনা করার দরকার মনে করছি। মূল তিনটি অবদানকে লিস্ট করি, অন্য কিছু থাকলে যোগ করতে পারেন।
ক) শিক্ষাব্যবস্থা প্রসার, প্রচুর স্কুল স্থাপনা করা এবং বিশেষ করে নারীশিক্ষা-- এর উল্টোদিকে আমরা এডামস সমীক্ষা দেখতে পাই। বিদ্যাসাগর এবং তাঁর নিয়োগকর্তার সাহায্য ছাড়াই বাংলা বিহার মিলিয়ে এক লক্ষ প্রাথমিক শিক্ষাকেন্দ্র ছিল যা সামাজিক সাহায্যে চলত। ১৮৩৫-৩৭ সালে উইলিয়াম এডামস এই রিপোর্ট পেশ করেন। লক্ষ্যণীয় তাঁর সার্ভেকালীন সময় বিদ্যাসাগরের কর্মজীবন শুরুর আগের। আরও লক্ষ্যণীয় এই রিপোর্ট ৭৬ এর মন্বন্তরের পরে। অর্থাৎ এক-তৃতীয়াংশ লোক মারা যাচ্ছে এমন দুর্যোগের পরও এক লক্ষ প্রাথমিক শিক্ষাকেন্দ্র টিকে আছে। এডামস বলছেন প্রতি চারশ বাসিন্দা একটি করে স্কুল দেখেছেন গড়ে। এডামস অতিরঞ্জন করছেন ধরে নিলেও মন্বন্তর দুর্ভিক্ষগুলির আগে, ব্রিটিশ শাসন ভাঙার আগে শিক্ষাব্যবস্থা কেমন ছিল ধারণা হয়?
এবার প্রশ্ন হয় এই শিক্ষাপরিকাঠামো আজ নেই। তা ভেঙে গেল কী করে? আমার ধারণা মেকলের নীত আর বিদ্যাসাগরের ইস্কুল-উদ্যোগের প্রকোপে। এনিয়ে বিশদ পড়াশুনোর দরকার আছে মনে করি। কিন্তু বিদ্যাসাগরীয় উদ্যোগ চারশ কেন চারহাজার বাসিন্দাতেও একটা ইস্কুল বানাতে পারে নি।
নারীশিক্ষা নিয়ে এডামসের খুবই পজিটিভ অবজার্ভেশন ছিল , নিম্নবর্ণের মধ্যে শিক্ষা নিয়েও। এবং এ তথ্য একটু ঘাঁটলেই পাওয়া যায় যে উনিশ শতকের মধ্যভাগেও সাধারণ গ্রামের মেয়েরা লিখতে পড়তে জানতেন। বিখ্যাত বৈষ্ণবী মা-গোঁসাই বা রানি-জমিদারনির কথা ছেড়েই দিলাম। নারীশিক্ষা বলে কিছু ছিল না, বিদ্যাসাগর এসে শুরু করলেন এমন হলে আমরা কেনারামের পালা পেতাম না, রানি ভবানিকেও পেতাম না।
https://archive.org/…/AdamsReportsOnVernacularEducationInBe…
খ)বাংলা ভাষা।- আধুনিক বাংলার জনক হিসেবে বিদ্যাসাগরের রূপায়ন কতটা বাস্তবসম্মত? বিদ্যাসাগরের শ খানেক বছর আগে রামপ্রসাদের যে বাংলা পাই, তা বিদ্যাসাগরের কালোয়াতির থেকে অনেক সাবলীল। বাংলায় এমন কোনও তত্ত্ব বা তথ্য আলোচনা, সন্দর্ভ আছে যা বিদ্যাসাগরের সংস্কৃত-অভ্যাসে হতে পারে কিন্তু রামপ্রসাদের ভাষায় সম্ভব না? উৎপল দত্ত লিখছেন "আজ যে কথায় কথায় চেঁচাস গ্রামে যাও, কৃষককে রাজনীতি দাও— বিদ্যাসাগর না থাকলে গাঁয়ে গিয়ে বলতিস কি রে হতভাগা? কি ভাষায় কথা কইতিস কৃষকের সঙ্গে? শিখতিস তো সংস্কৃত আর বলতিস, ভো ভো হলধর, বিপ্লবস্য ফৌজম!" !!! ভেবে দেখুন কী ভয়ঙ্কর অপমান বাংলাভাষাকে করা হল? রামপ্রসাদ ছেড়ে দিন, বৈষ্ণব সাহিত্য মঙ্গলকাব্য বলে কিছু ছিল না? সংস্কৃত বাদ দিয়ে লোকে কথা কইত না? কাজের কথা এগোত না? অথচ আমরা দেখি সাবলীল বাংলাভাষাকে সংস্কৃত আশ্রয়ী, তৎসম-ভারে ন্যুব্জ করে ফেলা হচ্ছে, সাধারণ লোকের বদলে শুধু সাধুর ব্যবহারের ভাষা হয়ে উঠছে আর কথ্য ভাষার সঙ্গে এত পার্থক্য হচ্ছে বিদ্যাসাগরের হাতে যে কথ্যভাষায় সিরিয়াস কথা বলার জন্য এক রবীন্দ্রনাথ জীবনকাল অতিবাহিত করতে হচ্ছে বাংলাভাষাকে। অথচ এর আগে ঢের ঢের দরকারি কথা বাংলায় বলা ও লেখা হয়েছে। যখন বিদ্যাসাগরের আগে বাংলা ছিল না বলি, সেই সমস্ত অবদানকে অস্বীকার করি। আর খুবখুঁটিয়ে দেখলে মুসলিম বাঙালির ভাষা অস্বীকার করে আরেকটা বঙ্গভঙ্গ করে ফেলি।
গ) বিধবা বিবাহ- বাল্যবিধবাদের বিবাহ বাংলার আদ্ধেকের বেশি লোকের মধ্যে প্রচলিত ছিলই। হিন্দু উচ্চবর্ণ বাদ দিয়ে সব শ্রেণীতেই প্রায় হোতো। আর উচ্চবর্ণের মধ্যে যদি বিধবা বিবাহ হয়ে থাকে, সেটার হার কত জানতে ইচ্ছা করি।

এই লেখার যা উদ্দেশ্য, বিদ্যাসাগরের অবদান পুনর্মূল্যায়ণ করা। তিনি একজন মহাপ্রাণ ক্ষণজন্মা ছিলেন, অসামান্য প্রতিভাশালী ছিলেন এবং তাঁর জন্য বহুমানুষের উপকার হয়েছে সন্দেহ নেই। কিন্তু প্রাপ্য কৃতিত্বের বেশি তাঁকে দেওয়া সমাজের ও ইতিহাসের বাকি উপাদানগুলির অবমাননা করে। এবং ভুল ভাবতে শেখায়। ভাবমূর্তি ভাঙার দরকার তাই-ই হয়

No comments: