Tuesday, May 8, 2018

ইওরোপিকেন্দ্রিকতা বিরোধী চর্চা - ইওরোপবিদ্য ভাবনার শেষ বিদায়৫ - ক্লদ আলভারেজ

বিনয় লালের মুখবন্ধ

পেনাং মালেশিয়ায় মাল্টিইউনিভার্সিটির পক্ষ থেকে এই চটিগ্রন্থাবলী প্রকাশিত হচ্ছে বিদ্বান, শিক্ষক, কর্মী এবং জনবুদ্ধিজীবিদের ২০০২ সালে একসঙ্গে হওয়ার পর। উদ্দেশ্য নতুন একটা মঞ্চ গড়ে তোলা। আধুনিক জ্ঞানচর্চার তীব্র সমালোচক হয়ে উঠতে চায় মাল্টিভার্সিটি যাতে জগদ্ব্যাপী নতুন ধরণের রাজনৈতিক এবং কৃষ্টিগত ভবিষ্যত নির্মান করা যায়। মাল্টিভার্সিটির সদস্যরা পশ্চিমের সঙ্গে আলোচনার বদলে অনেক বেশি দক্ষিণের মানুষদের মধ্যে আলোচনার পরিকাঠামো তৈরি করতে আগ্রহী। ভারত, চিন, দক্ষিণপূর্ব এশিয়া এবং আফ্রিকা, ইওরোপের সঙ্গে আলাপ শুরু করার বহু আগে থেকে তারা নিজেদের মধ্যে আলাপ চালিয়েছে। একক সময় ভারত সাগর ছিল বিশ্বকেন্দ্র, বহু রাস্তার মিলনের ক্ষেত্র, কিন্তু উপনিবেশের একটা সাফল্য হল তারা এই পুরোনো ইতিহাসকে ভুলিয়ে দিতে পেরেছে। আজ বিশ্ব বলতে বহু মানুষই বোঝেন তার নিজের দেশের চারিয়ে যাওয়া ইওরো-আমেরিকিয় বিশ্বের জ্ঞান। আমাদের আন্তর্জাতিকতাবাদের এটাই সীমান্ত।
পশ্চিম তার শর্তে যতদিন আলাপ আলোচনার কাঠামো তৈরি করে দেবে, ব্যবস্থাপনা তৈরি করে দেবে, ততদিন সত্যকারের আলাপ-পরিচয় আদানপ্রদান সম্ভব নয়। আজকে বলতে হবে, আমাদের নিজেদের উদ্যোগেই মাল্টভার্সিটি আর মাল্টিওয়ার্ল্ডের মাল্টি শব্দটিকে, মাল্টিকালচারিজমের মাল্টি থেকে সযত্নে আলাদা করে রাখতে হবে। আজকের পশ্চিমের অবিসংবাদী নেতা, আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র এতদিন বর্বরভাবে এককেন্দ্রিকতাবাদ চর্চা করে এসে আজকে সে সারা বিশ্বে মাল্টিকালচারালিজমের প্রচারবিদ হিসেবে নিজেকে উপস্থাপিত করতে চাইছে এবং দেখাতে চাইছে সে খোলামেলা সমাজ এবং সহ্যশক্তির চূড়ান্ত রূপ। আমেরিকয় বৈচিত্রের মাল্টিকালচারালিজমএর যার এক এবং একমাত্র অর্থ হল ভোক্তার পছন্দ আর সাদা চামড়ার কর্তৃত্ব(যা অনেক সময় primus inter paresএর কৃপালু সংস্করণ বলে মনে হয়), তারা আজকাল দেখাতে চাইছে তারা নাকি এমন একটা সমাজ বানিয়েছে যেখানে বাস্তবতাই হল বহুত্ববাদ। মাল্টিভার্সিটি এই চটিপ্রকাশনাগুলির মাধ্যমে নব্য উপনিবেশিকতাবাদের উতসারকে রুখতে চাইছে এবং এমন একটা পরিবেশ তৈরি করতে চাইছে যেখানে প্রতিবাদী জ্ঞানচর্চা বিকশিত হয়।
বহুকাল ধরে চটিবই বিদ্রোহ, সামাজিক পরিবর্তনের, জনদাবিতে সরকারের সংস্কার কর্মের অন্যতম উপাদান আর বাহক ছিল। পশ্চিমের রাজনৈতিক বিদ্রোহ আর বিরুদ্ধতার গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার হয়ে উঠেছিল, টম পেইনের কমন সেন্স থেকে থুরোর অন দ্য ডিউটি অব সিভিল ডিসওবিডিয়েন্সএর মত চটিবই। যখন শিক্ষার হার অতি কম, এবং শিক্ষা মাত্র কিছু উচ্চশ্রেণীর হাতিয়ার তখন চটিবইগুলি মানুষের হাতিয়ার হয়ে উঠেছিল। জন মিলটনের এরিওপাজিটিকা নামক চটির নিচে লেখা ছিল For the Liberty of Unlicensed Printing। এই বক্তব্য আমাদের বুঝতে সাহায্য করে কোন সময়ে কোন মুহূর্তে চটিসাহিত্য বিকাশলাভ করেছিল। আমেরিকার বিপ্লব বলা হয়ত অতিশোয়াক্তি হবে না, যতটা সে কামান বন্দুক দিয়ে সফল লড়াই করেছিল এর সঙ্গে মনার্কিস্ট, দেশহিতৈষী এবং বিদ্রোহীরা আটলান্টিকের উভয় পাশে চটিবই হাতবদল করেও বিপ্লবকে চালনা করে নিয়ে গিয়েছিল। ইতিহাসের বিখ্যাততম চটিলেখকের নাম কার্ল মার্ক্স। ১৮৮৩ সালে ১৭ মার্চ বন্ধুর স্মৃতিতে এঙ্গেলস দ্মরণ করছেন দুটি গুরুত্বপূর্ণ বিদ্রোহাত্মক চটিবই ১৮৪৮এর বিদ্রোহের স্মরণের লিখিত ক্লাস স্ট্রাগলস ইন ফ্রান্স এবং এইটিনথ ব্রুম্রেয়ার অব লুই বোনাপোর্ট। ১৮৭১ সালে মার্ক্স তাঁর হৃদয় দিয়ে প্যারি কমিউনকে সমর্থন করে লিখছেন দ্য সিভিল ওয়ার ইন ফ্রান্স।
চটিগ্রন্থগুলির সামাজিক ইতিহাস আমাদের বলছে এটি শ্রমিক শিক্ষার বাহন হয়েছে এবং আত্মশিক্ষিত শ্রেণী সৃষ্টি করেছে। উনবিংশ শতকের প্রায় প্রত্যেক সমাজে চটিগ্রন্থ জনগনের মনের কথার বাহন। ভোটাধিকারের ওপরে বিধিনিষেধ তোলার দাবিতে চটিপুস্তক একটা বড় ভূমিকা গ্রহণ করেছিল। আমরা আজ বলতে পারি কয়েক শতাব্দের চটিপুস্তক রচয়িতাদের চেষ্টায় সার্বজনীন ভোটাধিকারের ফলে রাজনীতিতে জনগণের প্রবেশে চটিপুস্তকের ভূমিকা প্রায় লোপ পেয়েছে। এটা পরিষ্কার আধুনিক পশ্চিমে বিপুল বিশাল প্রচার মাধ্যমের জয়যাত্রা – যাকে বলা হয় তথ্যবিপ্লব - তার ফলে বিংশ শতকে চটিপুস্তক রচনার তাগিদ প্রায় নেই বললেই চলে। তবে মাধ্যমগুলোর বিগণতন্ত্রীকরণ, মাধ্যমগুলিতে একচেটিয়াকরণের উদ্যমে নতুন ধরণের তথ্য সরবরাহের চাহিদা দেখা যাচ্ছে। হয়ত মিলটনের সময় চটিপুস্তকগুলি নতুন ধারণা, নতুন কৃষ্টি, এবং বিদ্রোহের সংস্কৃতি তৈরির পরিবেশ এবং বিপুল অনুগামী সৃষ্টি করেছিল, কিন্তু তারপরে উতকর্ষের দিকে নজর দিতে গিয়ে তারা সত্যকারের পাঠক হারিয়েছে আর চটি হয়ে উঠেছে অন্তঃসারশূন্য শব্দভাণ্ডার। আজকের ভারতে নাগরিক সমাজ এবং মানবাধিকার কর্মীরা মূলত চটিপুস্তকের ওপর নির্ভর করেই তথ্য আদানপ্রদান করেন। নতুন সময়ের নতুন দাবি চটিপুস্তকের আবহাওয়া আবার নতুন করে তৈরি করা।
নয়া দিল্লি
২০১১

No comments: