জগদীশ নারায়ণ সরকার
মীর জুমলার খুব বড় এবং দক্ষ ব্যবস্থাপনাযুক্ত ব্যবসা দেশ এবং বিদেশে ছড়ানো ছিল। এই ব্যবসাও তার নিজের আর রাজত্বের রাজস্বের বড় উৎস ছিল। এছাড়াও তার অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা ছিল একচেটিয়া চরিত্রের। তিনি পণ্যের একচেটিয়া দাম ধার্য করতেন এবং উতপাদন নিয়ন্ত্রণ করতেন। তিনি বিজিত এলাকাগুলিতে কোরা(ব্রাউন, ব্লিচ না করা) কাপড়ের উতপাদনের ওপর একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ কায়েম করেছিলেন এবং ২০% লাভে সেগুলি বিক্রি করতেন। এছাড়াও দানা শস্যের ব্যবসাতেও তার দখল ছিল। ধান এবং অন্যান্য শস্য, মাদ্রাজে তার প্রশাসনের আওতায় এলে তাকে আমদানি শুল্ক দিতে হত, এবং বাজারের দামের তুলনায় শহরে ধান ২৫% বেশি দামে বিক্রি হত। ব্রিটিশদের, নবাবের ঠিক করে দেওয়া নির্দিষ্ট কৃষক থেকে দ্রব্য কিনতে হত, এবং তা তার প্রতিবেশীর কৃষকের তুলনায় ৫০% বেশি দামে। সব ধরণের আমদানি দ্রব্যের ওপর তিনি একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ কায়েম করেছিলেন। অথচ তার পণ্যগুলি পারস্য এবং পেগুতে যেত কোন রপ্তানি শুল্ক ছাড়াই।
তার আমদানি রপ্তানি প্রশাসন ছিল কুতুবশাহী আর বিজয়নগরীয় প্রশাসনিক ব্যবস্থার জোড়াতালি। সুলতান, ব্রিটিশদের ১৬৩৪ সালে যে বাণিজ্য স্বর্ণ ফরমান দেন, তিনি তার শর্তগুলি কড়া হাতে প্রয়োগ করেন। দ্বিতীয়ত হিন্দু রাজা শ্রী রঙ্গের উত্তরাধিকারী হিসেবে মাদ্রাজ শহর আর মাদ্রাজপত্তনম বন্দরের অর্ধেক শুল্ক নিজে নিতেন। মাদ্রাজ, স্যান থোম, মাইলাপুর এবং অন্যান্য এলাকায় এই শুল্ক সংগ্রহ করার জন্য নবাব তার কর্মচারী (আদিগর বা আধিকারিক) নিয়োগ করেছিলেন। এই কর্মচারীদের সঠিকভাবে কাজ করিয়ে নেওয়া তার প্রশাসনের জন্য প্রয়োজনীয় ছিল, কেননা শুল্ক ফাঁকির, লুঠের প্রবণতা সর্বব্যপ্ত ছিল। মাদ্রাজের প্রশাসক(আদিগর) মাল্লাপ্পা নিজে থেকে ব্রিটিশ চোল্ট্রিতে দাঁড়িয়ে থেকে দেখতেন যাতে সঠিক শুল্কের অংশ মীর জুমলার কাছে সঠিকভাবে পৌঁছয়।
ব্রিটিশদের আপত্তি সত্ত্বেও পথ কর লাগু ছিল। এছাড়া দাসেদের পঞ্জীকরণ করানোর জন্য অর্ধেক টাকা নবাব নিতেন। পাট্টাপল্লীর ব্রিটিশ কুঠিয়াল, জন লে’কে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল মাদ্রাজের চোল্ট্রিতে এক হপ্তা অন্তর বিচার করার, তিনি লিখছেন, ‘১৮ ডলারের শুল্কের অর্ধেক তারা(শুল্ক আদায়কারী আধিকারিকরা) পেতেন বাকি অর্ধেক নবাব।’ মীর জুমলাকে বিভিন্ন কোম্পানির দেওয়া উপহার তার বড় রোজগার ছিল। প্রয়োজনে, অতিরিক্ত অর্থ চেয়ে নেওয়া হত।
তার অপরাধ বিচার ছিল ত্বড়িতগতির এবং নির্মম। ১৬৫২ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর তাভার্নিয়ে লিখছেন, ‘কাউকে জেলে বন্দী করে রাখার নীতি ছিল না। কেউ যদি অপরাধে অভিযুক্ত হত তাকে ধরে এনে সঙ্গে সঙ্গে বিচার করা হত। সে যদি নির্দোষ হত তাকে সঙ্গে সঙ্গে ছেড়ে দেওয়া হত। বিচার হত অপরাধের চরিত্র অনুযায়ী।’ একদিন তিনি এই ধরণের বিচারে ছিলেন, ‘...পরের দিন গিয়ে দেখলাম চার জন তার তাঁবুর বাইরে দাঁড়িয়েছিল। তিনি প্রায় আধ ঘন্টা চুপচাপ রইলেন; তিনি এবং তাঁর সহকারী লিখেই যেতে লাগলেন; হঠাত তিনি চারজনকে ভেতরে নিয়ে আসতে বললেন; চার জন এলে, তিনি তাদের মুখ থেকে অপরাধের স্বীকারোক্তি করিয়ে নিলেন, তার পর একঘন্টা চুপকরে থেকে নিজে আর তার সহকারী সচিব আরও কিছু লিখে চললেন।’ কয়েকজন সেনা আধিকারিক ঘরে ঢুকে এসে তাকে অভিবাদন করে দাঁড়াল, তিনি তার মাথা নামিয়ে উত্তর দিলেন শুধু। এক জন অভিযুক্ত, যে একটা ঘরে ঢুকে মা আর তার তিন শিশুকে খুন করেছিল, তার হাত পা কেটে তাকে মাঠে ছুঁড়ে ফেলে দিতে, একজন যে চুরি করেছিল, তার পাকস্থলি কেটে বার করে রাস্তায় ফেলে দিতে বললেন, অন্য দু জনের অপরাধ আর শাস্তি না শুনেই তাভার্নিয়ে পালিয়ে যান।
ওপরের চোখে দেখা ঘটনার বর্ণনা থেকে আমরা বুঝতে পাচ্ছি যে, কিভাবে মীর জুমলা তার প্রশাসন চালাতেন। তাভার্নিয়ের আরও একটা বর্ণনা থেকে তুলে দেওয়া যাক আরেকটি উদাহরণ, ’১৫ সেপ্টেম্বর সাতটায় নবাবের কাছে গেলাম। তিনি আমাদের তাঁবুতে ঢুকতে বললেন। দেখলাম সেখানে তিনি তার দুজন সচিবকে নিয়ে বসে রয়েছেন। ভারত আর পারস্যের রাজসভার রীতি অনুযায়ী নবাবের কাছে যেতে হয় খালি পায়ে মোজা ছাড়া শুধু একটা চপ্পল পরে, কেননা আমাদের মাটিতে গালিচার ওপরে বসতে হবে। এছাড়াও যেভাবে আমাদের দেশের দর্জিরা(মাটিতে বসে) কাজ করে, দেখা গেল নবাবের বাঁ হাতে আর পায়ে ধরা রয়েছে প্রচুর চিঠির গোছা। সেই চিঠিগুলিতে তিনি হয়ত কখনো সখনো পায়ে ছবি আঁকেন, কখনো আবার হাতে, এবং তার দুজন সচিবকে দিয়ে লেখাচ্ছেন, কখনো তিনিও লিখছেন। এরপর চিঠিগুলি প্রাপকদের কাছে পৌছন হয়।’ মীর জুমলা দুজন সহকারীকে চিঠিগুলি জোরে পড়তে বলে, নিজে হাতে নেন এবং নিজের হাতে সেগুলি সিলমোহর করেন। কিছু চিঠি যায় রাণার মার্ফত আর কিছু যায় ঘোড়সওয়ার মার্ফত।
খবর আদান প্রদানের জন্য হায়দ্রাবাদ কর্ণাটকের মধ্যে ডাকচৌকি স্থাপন করেছিলেন। এই চৌকিগুলোর কাজ তাভার্নিয়েকে যথেষ্ট প্রভাবিত করেছিল। সেগুলিরই অসামান্য বিশদ বর্ণনা তিনি দিয়েছেন, ‘প্রত্যেক দু লিগ(১১ কিমি) অন্তর একটি করে ছোট চৌকি(কুঁড়ে ঘর)তে রয়েছে, দু থেকে তিন জন রাণার। কোন রাণার দৌড়ে চিঠি নিয়ে কোন একটা চৌকিতে পৌছলে, চৌকিতে বসে থাকা একজনের সামনে সেটি ছুঁড়ে দেন, তিনি সেই চিঠিটি কুড়িয়ে নিয়ে বিদ্যুতগতিতে ছুটে বেরিয়ে যান। কোন রাণারকে চিঠি হাতে দেওয়া প্রথা ছিল না – অমঙ্গল হিসেবে ধরা হত, সেটি তাঁর পায়ের কাছে ছুঁড়ে দেওয়া হত। অন্য জন সেটি কুড়িয়ে বেরিয়ে যেতেন।’ তাভার্নিয়ে বলছেন ঘোড়ার ডাকের তুলনায় রাণারদের ডাক খুব দ্রুতগামী ছিল, সেই জন্য সারা দেশে রাণার ডাকচৌকি বসানো ছিল। তাভার্নিয়ের আর তার দলবল যখন গোলকুণ্ডা থেকে ১৩ লিগ(প্রায় ৭০ কিমি) সীমান্তের কোন এক নদীর দিকে যাচ্ছিলেন, তখন মীর জুমলা তাদের ১৬ ঘোড়ার পথপ্রদর্শনকারী দল দিয়েছিলেন পথ দেখাবার জন্য।
পথের পথিক আর বণিকদের নিরাপত্তার একটা ব্যবস্থা ছিল সেই সময়। মীর জুমলার কর্ণাটক আর গুটির রাজত্বের (১৬৫০) সময় বণিকদের পথে পণ্য লুঠ হয়ে যাওয়ার ক্ষতিপূরণ দেওয়ার উদাহরণ পাওয়া যচ্ছে সে সময়ের লেখগুলি থেকে। এটা ধরে নেওয়া যায় তার আগের হিন্দু প্রশাসনেও এটিই নীতি ছিল। পাটাকোট্টাচেরুভুর এক নায়েকের প্রশাসনিক এলাকায় ব্যবসায়ীদের পণ্য লুঠ হয়ে গেলে তাকে শুধু ক্ষতিপূরণ দিতেই হয় নি, তাকে বহু ঝামেলা পোয়াতেও হয়েছিল। মীর জুমলা এ সম্বন্ধে একটি পরওয়ানাও জারি করেন, ‘ওপরে উল্লিখিত গ্রামের কাছাকাছির এলাকায় কিছু ব্যবসায়ীর পণ্য লুঠ হয়েছে, যদিও গ্রামের মানুষেরা এটিকে তাদের এলাকার জমি বলতে নারাজ। এই পণ্যগুলি অন্য গ্রামের(নাক্কাডোডি) দুই ভাই পেড্ডা-তিম্মা আর চিন্না-তিম্মার, তাই পূর্বের গ্রামবাসীরা তাদের ক্ষতিপূরণ দিতে রাজি হয়েছে।’
(চলবে)