Monday, November 28, 2016

বাংলা যখন বিশ্ব সেরা২১ - লাইফ অব মীর জুমলা, জেনারেল অব আওরঙ্গজেব

জগদীশ নারায়ণ সরকার

মীর জুমলার খুব বড় এবং দক্ষ ব্যবস্থাপনাযুক্ত ব্যবসা দেশ এবং বিদেশে ছড়ানো ছিল। এই ব্যবসাও তার নিজের আর রাজত্বের রাজস্বের বড় উৎস ছিল। এছাড়াও তার অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা ছিল একচেটিয়া চরিত্রের। তিনি পণ্যের একচেটিয়া দাম ধার্য করতেন এবং উতপাদন নিয়ন্ত্রণ করতেন। তিনি বিজিত এলাকাগুলিতে কোরা(ব্রাউন, ব্লিচ না করা) কাপড়ের উতপাদনের ওপর একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ কায়েম করেছিলেন এবং ২০% লাভে সেগুলি বিক্রি করতেন। এছাড়াও দানা শস্যের ব্যবসাতেও তার দখল ছিল। ধান এবং অন্যান্য শস্য, মাদ্রাজে তার প্রশাসনের আওতায় এলে তাকে আমদানি শুল্ক দিতে হত, এবং বাজারের দামের তুলনায় শহরে ধান ২৫% বেশি দামে বিক্রি হত। ব্রিটিশদের, নবাবের ঠিক করে দেওয়া নির্দিষ্ট কৃষক থেকে দ্রব্য কিনতে হত, এবং তা তার প্রতিবেশীর কৃষকের তুলনায় ৫০% বেশি দামে। সব ধরণের আমদানি দ্রব্যের ওপর তিনি একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ কায়েম করেছিলেন। অথচ তার পণ্যগুলি পারস্য এবং পেগুতে যেত কোন রপ্তানি শুল্ক ছাড়াই।

তার আমদানি রপ্তানি প্রশাসন ছিল কুতুবশাহী আর বিজয়নগরীয় প্রশাসনিক ব্যবস্থার জোড়াতালি। সুলতান, ব্রিটিশদের ১৬৩৪ সালে যে বাণিজ্য স্বর্ণ ফরমান দেন, তিনি তার শর্তগুলি কড়া হাতে প্রয়োগ করেন। দ্বিতীয়ত হিন্দু রাজা শ্রী রঙ্গের উত্তরাধিকারী হিসেবে মাদ্রাজ শহর আর মাদ্রাজপত্তনম বন্দরের অর্ধেক শুল্ক নিজে নিতেন। মাদ্রাজ, স্যান থোম, মাইলাপুর এবং অন্যান্য এলাকায় এই শুল্ক সংগ্রহ করার জন্য নবাব তার কর্মচারী (আদিগর বা আধিকারিক) নিয়োগ করেছিলেন। এই কর্মচারীদের সঠিকভাবে কাজ করিয়ে নেওয়া তার প্রশাসনের জন্য প্রয়োজনীয় ছিল, কেননা শুল্ক ফাঁকির, লুঠের প্রবণতা সর্বব্যপ্ত ছিল। মাদ্রাজের প্রশাসক(আদিগর) মাল্লাপ্পা নিজে থেকে ব্রিটিশ চোল্ট্রিতে দাঁড়িয়ে থেকে দেখতেন যাতে সঠিক শুল্কের অংশ মীর জুমলার কাছে সঠিকভাবে পৌঁছয়।

ব্রিটিশদের আপত্তি সত্ত্বেও পথ কর লাগু ছিল। এছাড়া দাসেদের পঞ্জীকরণ করানোর জন্য অর্ধেক টাকা নবাব নিতেন। পাট্টাপল্লীর ব্রিটিশ কুঠিয়াল, জন লে’কে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল মাদ্রাজের চোল্ট্রিতে এক হপ্তা অন্তর বিচার করার, তিনি লিখছেন, ‘১৮ ডলারের শুল্কের অর্ধেক তারা(শুল্ক আদায়কারী আধিকারিকরা) পেতেন বাকি অর্ধেক নবাব।’ মীর জুমলাকে বিভিন্ন কোম্পানির দেওয়া উপহার তার বড় রোজগার ছিল। প্রয়োজনে, অতিরিক্ত অর্থ চেয়ে নেওয়া হত।

তার অপরাধ বিচার ছিল ত্বড়িতগতির এবং নির্মম। ১৬৫২ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর তাভার্নিয়ে লিখছেন, ‘কাউকে জেলে বন্দী করে রাখার নীতি ছিল না। কেউ যদি অপরাধে অভিযুক্ত হত তাকে ধরে এনে সঙ্গে সঙ্গে বিচার করা হত। সে যদি নির্দোষ হত তাকে সঙ্গে সঙ্গে ছেড়ে দেওয়া হত। বিচার হত অপরাধের চরিত্র অনুযায়ী।’ একদিন তিনি এই ধরণের বিচারে ছিলেন, ‘...পরের দিন গিয়ে দেখলাম চার জন তার তাঁবুর বাইরে দাঁড়িয়েছিল। তিনি প্রায় আধ ঘন্টা চুপচাপ রইলেন; তিনি এবং তাঁর সহকারী লিখেই যেতে লাগলেন; হঠাত তিনি চারজনকে ভেতরে নিয়ে আসতে বললেন; চার জন এলে, তিনি তাদের মুখ থেকে অপরাধের স্বীকারোক্তি করিয়ে নিলেন, তার পর একঘন্টা চুপকরে থেকে নিজে আর তার সহকারী সচিব আরও কিছু লিখে চললেন।’ কয়েকজন সেনা আধিকারিক ঘরে ঢুকে এসে তাকে অভিবাদন করে দাঁড়াল, তিনি তার মাথা নামিয়ে উত্তর দিলেন শুধু। এক জন অভিযুক্ত, যে একটা ঘরে ঢুকে মা আর তার তিন শিশুকে খুন করেছিল, তার হাত পা কেটে তাকে মাঠে ছুঁড়ে ফেলে দিতে, একজন যে চুরি করেছিল, তার পাকস্থলি কেটে বার করে রাস্তায় ফেলে দিতে বললেন, অন্য দু জনের অপরাধ আর শাস্তি না শুনেই তাভার্নিয়ে পালিয়ে যান।

ওপরের চোখে দেখা ঘটনার বর্ণনা থেকে আমরা বুঝতে পাচ্ছি যে, কিভাবে মীর জুমলা তার প্রশাসন চালাতেন। তাভার্নিয়ের আরও একটা বর্ণনা থেকে তুলে দেওয়া যাক আরেকটি উদাহরণ, ’১৫ সেপ্টেম্বর সাতটায় নবাবের কাছে গেলাম। তিনি আমাদের তাঁবুতে ঢুকতে বললেন। দেখলাম সেখানে তিনি তার দুজন সচিবকে নিয়ে বসে রয়েছেন। ভারত আর পারস্যের রাজসভার রীতি অনুযায়ী নবাবের কাছে যেতে হয় খালি পায়ে মোজা ছাড়া শুধু একটা চপ্পল পরে, কেননা আমাদের মাটিতে গালিচার ওপরে বসতে হবে। এছাড়াও যেভাবে আমাদের দেশের দর্জিরা(মাটিতে বসে) কাজ করে, দেখা গেল নবাবের বাঁ হাতে আর পায়ে ধরা রয়েছে প্রচুর চিঠির গোছা। সেই চিঠিগুলিতে তিনি হয়ত কখনো সখনো পায়ে ছবি আঁকেন, কখনো আবার হাতে, এবং তার দুজন সচিবকে দিয়ে লেখাচ্ছেন, কখনো তিনিও লিখছেন। এরপর চিঠিগুলি প্রাপকদের কাছে পৌছন হয়।’ মীর জুমলা দুজন সহকারীকে চিঠিগুলি জোরে পড়তে বলে, নিজে হাতে নেন এবং নিজের হাতে সেগুলি সিলমোহর করেন। কিছু চিঠি যায় রাণার মার্ফত আর কিছু যায় ঘোড়সওয়ার মার্ফত।

খবর আদান প্রদানের জন্য হায়দ্রাবাদ কর্ণাটকের মধ্যে ডাকচৌকি স্থাপন করেছিলেন। এই চৌকিগুলোর কাজ তাভার্নিয়েকে যথেষ্ট প্রভাবিত করেছিল। সেগুলিরই অসামান্য বিশদ বর্ণনা তিনি দিয়েছেন, ‘প্রত্যেক দু লিগ(১১ কিমি) অন্তর একটি করে ছোট চৌকি(কুঁড়ে ঘর)তে রয়েছে, দু থেকে তিন জন রাণার। কোন রাণার দৌড়ে চিঠি নিয়ে কোন একটা চৌকিতে পৌছলে, চৌকিতে বসে থাকা একজনের সামনে সেটি ছুঁড়ে দেন, তিনি সেই চিঠিটি কুড়িয়ে নিয়ে বিদ্যুতগতিতে ছুটে বেরিয়ে যান। কোন রাণারকে চিঠি হাতে দেওয়া প্রথা ছিল না – অমঙ্গল হিসেবে ধরা হত, সেটি তাঁর পায়ের কাছে ছুঁড়ে দেওয়া হত। অন্য জন সেটি কুড়িয়ে বেরিয়ে যেতেন।’ তাভার্নিয়ে বলছেন ঘোড়ার ডাকের তুলনায় রাণারদের ডাক খুব দ্রুতগামী ছিল, সেই জন্য সারা দেশে রাণার ডাকচৌকি বসানো ছিল। তাভার্নিয়ের আর তার দলবল যখন গোলকুণ্ডা থেকে ১৩ লিগ(প্রায় ৭০ কিমি) সীমান্তের কোন এক নদীর দিকে যাচ্ছিলেন, তখন মীর জুমলা তাদের ১৬ ঘোড়ার পথপ্রদর্শনকারী দল দিয়েছিলেন পথ দেখাবার জন্য।

পথের পথিক আর বণিকদের নিরাপত্তার একটা ব্যবস্থা ছিল সেই সময়। মীর জুমলার কর্ণাটক আর গুটির রাজত্বের (১৬৫০) সময় বণিকদের পথে পণ্য লুঠ হয়ে যাওয়ার ক্ষতিপূরণ দেওয়ার উদাহরণ পাওয়া যচ্ছে সে সময়ের লেখগুলি থেকে। এটা ধরে নেওয়া যায় তার আগের হিন্দু প্রশাসনেও এটিই নীতি ছিল। পাটাকোট্টাচেরুভুর এক নায়েকের প্রশাসনিক এলাকায় ব্যবসায়ীদের পণ্য লুঠ হয়ে গেলে তাকে শুধু ক্ষতিপূরণ দিতেই হয় নি, তাকে বহু ঝামেলা পোয়াতেও হয়েছিল। মীর জুমলা এ সম্বন্ধে একটি পরওয়ানাও জারি করেন, ‘ওপরে উল্লিখিত গ্রামের কাছাকাছির এলাকায় কিছু ব্যবসায়ীর পণ্য লুঠ হয়েছে, যদিও গ্রামের মানুষেরা এটিকে তাদের এলাকার জমি বলতে নারাজ। এই পণ্যগুলি অন্য গ্রামের(নাক্কাডোডি) দুই ভাই পেড্ডা-তিম্মা আর চিন্না-তিম্মার, তাই পূর্বের গ্রামবাসীরা তাদের ক্ষতিপূরণ দিতে রাজি হয়েছে।’
(চলবে)

Sunday, November 27, 2016

বাংলা যখন বিশ্ব সেরা২০ - লাইফ অব মীর জুমলা, জেনারেল অব আওরঙ্গজেব

জগদীশ নারায়ণ সরকার

এখানে বিশদে আর গভীরে গিয়ে কর্ণাটকে মীর জুমলার প্রশাসনিক ব্যবস্থার বিস্তৃত বিবরণ দেওয়া এখানে সম্ভব নয়, এছাড়াও সেখানে থাকার তার সময় এত বেশি ছিল না যে তিনি তার অনপণেয় দক্ষতার ছাপ সেখানকার প্রশাসনে ছেড়ে আসতে পারেন। তিনি কোন দিনই থিতু হওয়ার সময় পাননি- সারাক্ষণ খুবই ব্যস্ত ছিলেন, একদিকে যুদ্ধের পর যুদ্ধ করে দেশ জয়ের পরিকল্পনা, তার পরে গোলকুণ্ডা সুলতানির সংগে তার ক্রমাগত বিরোধ এবগ সম্পর্কের অবনতি এবং সব শেষে কর্ণাটক ছেড়ে মুঘল সাম্রাজ্যের কাজে যোগ দেওয়া।

আমাদের ধারণা মীর জুমলা বিজয়নগর সাম্রাজ্যের গ্রামীন সংগঠনের ধারাটি গ্রহন করেছেন, কেননা বহু ইওরোপিয় নথিতে বিজয়নগর রাজ্যের প্রশাসনের যে সব পদের নাম পাওয়া যায় – যেমন নটবর বা নাড়ু বা কয়েকটি গ্রামের প্রধান, বা কারনাম বা কাণক্কপিল্লাই বা হিসেব রক্ষক, তালয়ারি(স্থলওয়ার) বা টুকরি বা গ্রাম রক্ষক, পোলিগার বা পুলিশ প্রধান, ইত্যাদি, সেগুলি তার প্রশাসনেও ব্যবহার করেছেন তিনি।

গোলকুণ্ডা ছিল মীরজুমলার প্রশাসনের মূল কেন্দ্র। এক দিকে হায়দারাবাদ (কাম্বম, মাছরেলা, দাবারকোণ্ডা এবং হায়াতনগর হয়ে) পর্যন্ত অন্যদিকে মাদ্রাজ পর্যন্ত। ছড়িয়ে থাকা ব্রিটিশ কুঠি নথি সূত্রে আন্দাজ করে নেওয়া যায় যে, যে সব এলাকা মীর জুমলা দখল করেছেন, বিশেষ করে মাদ্রাজের আশেপাশের এলাকা, সেগুলিকে কতগুলি ছোট ছোট প্রশাসনিক এলাকায় ভাগ করেছিলেন এবং প্রত্যেক এলাকায় প্রশাসক(গভরণর) নিযুক্ত করেন।

ব্রিটিশ নথি সূত্রে পাচ্ছি, মাল্লাপ্পা, সৈয়দ ইব্রাহিম তিম্মাজি বালা রাউ এবং মীর সৈয়দ আলি মীর জুমলার পক্ষ থেকে ১৬৫৫-৫৮ সালে ব্রিটিশ কুঠিয়ালদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতেন। উইলিয়ম ফস্টার এবং মিস্টার লাভ, মাল্লাপ্পা আর তিম্মাজির সম্পর্কে লিখেছেন, মাদ্রাজ কুঠিতে(চোল্ট্রি) তারা ছিলেন নবাবের আদিগর বা প্রতিনিধি। কিন্তু এটাও মনে হয় মাল্লাপ্পা শুধু যে মাদ্রাজে নবাবের আদিগরের কাজ করতেন তাই নয়, তিনি পুনামাল্লিতে প্রশাসকরূপেও দায়িত্বপ্রাপ্ত ছিলেন। ১৬৪৭ সালের জুন মাসে ব্রিটিশদের শ্রী রঙ্গ বাণিজ্য সুবিধে দেওয়ার পরে মীর জুমলা মাল্লাপ্পা এবং ব্রিটিশ কুঠিয়ালকে মাদ্রাজে পাঠিয়েছিলেন তার প্রশাসনের দেখাশোনা করতে। মাল্লাপ্পা সেখানে পূর্বের প্রশাসকের চরিত্রের মতই সাত বছর ধরে প্রশাসন কার্য পরিচালনা করেন। সৈয়দ ইব্রাহিম, মাল্লাপ্পার স্থলে পুনামাল্লিতে প্রশাসক নিযুক্ত হলেন, এবং তিনি তিম্মাজীকে নবাবের আদিগর হিসেবে মাদ্রাজে পাঠালেন। ১৬৫৩ সালে জুলফিকার আস্তারাবাদীর পুত্র রুস্তম বেগ, পুনামাল্লির হাবিলদার নিযুক্ত করেন।

মীর জুমলা যে শুধু ভাল দেশ নায়ক ছিলেন তাই নয়, তিনি ভাল আর্থিক প্রশাসকও ছিলেন। তিনি কর্ণাটকের আর্থিক শৃঙ্খলার ভার গোলকুণ্ডা নিয়োগী নামক ব্রাহ্মণ প্রশাসাকদের হাতে ছেড়ে দিয়েছিলেন। কর্ণাটক থেকে সারা বছরে তিনি ৪৩ লক্ষ টাকা রাজস্ব তুলতেন। তার রাজত্বের আয়ের জায়গাগুলি ছিল ১) ভূমি রাজস্ব। ২) কর্ণাটক জোড়া লুঠ, ৩) হীরের খনি, ৪) একচেটিয়া ব্যবসা সহ রাজত্বের উতপাদনের ওপর আর ব্যবসা থেকে আয়, ৫) আমদানি-রপ্তানি শুল্ক, ৬) পথ কর, ৭)দাস ব্যবসা চালানোর পঞ্জিকরণ, 8) উপহার সামগ্রী, ৯) আদায়(ইম্পোজিসন্স)।

তার ভূমি রাজস্বএর প্রশাসন, চাষ থেকে আদায়ের ওপর জোর দিয়েছিলেন। ইসলামি আইনে জমি আর জমির সঙ্গে জুড়ে থাকা মানুষের চরিত্র আর শ্রেণী বদলে গেল, ফলে জমির পরিমাণ অনুযায়ী গ্রামের সম্পত্তি আর জমির রাজস্ব নির্ধারণ করা হল।

তিনি দুর্গ দখল, অঞ্চল লুঠ, বিভিন্ন মন্দিরের সিন্দুক লুঠ করে বিপুল পরিমান সঞ্চয়ে থাকা সম্পত্তি, লুকোনো ধনসম্পদ উদ্ধার করেন। কারটু বলছেন, কর্ণাটকী সম্পদশালীদের প্রত্যেকের বাড়িতে যা সোনা দানা রত্নরাজি যা আছে সেগুলি তাকে দিতে তিনি বাধ্য করেছিলেন। এবং যারা রত্নরাজি জমির ভিতরে লুকিয়ে রেখেছিলেন, সেগুলি উদ্ধার করে দেশের তাদের আইন অনুযায়ী তাদের চাবুক মারা হত। থেভেনট বলছেন মীরজুমলা, একজন রাজার মত সম্পত্তি দখল করেছিলেন, তার ছিল কর্ণাটক লুঠ করে উদ্ধার হওয়া ২০ মনের হিরে।

গোলকুণ্ডার বিশ্ব খ্যাতি ছিল তার হীরের জন্য। সেখানে শুধু হীরের খনিই ছিল না, সেগুলি পালিস করা আর কাটার কাজও সেখানে হত। এই কাজ থেকে রাষ্ট্র বিপুল প্রমান রাজস্ব উদ্ধার করত। কর্ণাটকে হিরের খনি রয়েছে, এই খবর পেয়ে মীর জুমলা সে দেশ আক্রমন করার এক বছর আগেই বারো হাজার শক্তপোক্ত চুক্তিভূক্ত কৃষি শ্রমিককে সেই অঞ্চলের খনিগুলিতে পাঠান হিরে তোলার কাজ করতে এবং যখন এক বছর পরে সেখান থেকে পাঁচটা ছোট থলে ভরা হিরে পেলেন, তাতে তার মন ভরল না, তার আফসোস হল, তিনি প্রত্যেককে ক্ষতিপূরণ দিয়ে কৃষিকাজে পাঠিয়ে দিলেন। গোলকুণ্ডার কৃষ্ণা নদীর তীরে সব থেকে বড় হিরে তোলার কুল্লার খনি তার প্রশাসনিক ব্যবস্থার মধ্যেই ছিল, সেগুলি তাকে ধনীতম ব্যবসায়ী বানিয়েছিল। সেগুলি তিনি তার আত্মীয় আর বন্ধুদের মধ্যে বেঁটে দিয়েছিলেন, কিন্তু সব থেকে বড় আর সব থেকে কাজের খনিটি নিজের জন্য রেখেছিলেন। তার খনিতে ৬০ হাজার বাচ্চা, পুরুষ আর নারী কাজ করত, যে পাথরগুলি উঠত তার ওজন ছিল ৪০ থেকে ৯০০ ক্যারট। তার হীরে ব্যবসার প্রশাসনটা বীজাপুরী কর্ণাটকের রাওলকোডা খনির মত করে চলত – মধ্যস্থরা হিরের খনির জন্য ২ শতাংশ এড ভ্যালোরেম ট্যাক্স দিতে হত সরকারকে। আমরা জানি না মীর জুমলার খনি হিরে ছাড়া গন্ধর্বমণি(এগেট), পদ্মরাগমণি/নীলকান্তমণি(আমেথিস্ট), পোখরাজ(টোপাজ)এর মত দামি রত্ন উঠত কি না। তবে তিনি পারস্য উপসাগর থেকে মুক্তো আমদানি করে তা রপ্তানি করতেন। তাভার্নিয়ে যখন প্রথম গোলকুণ্ডা আসেন(১৬৫২) তিনি মীর জুমলাকে এই ধরণের মুক্তো বিক্রি করতে চেয়েছিলেন। হীরে ছাড়া মীর জুমলার কর্ণাটকে বিজোয়ার(bezoar??), লোহা-ইস্পাত, সোরা উতপাদন হপ্ত। মীর জুমলা বিপুল পরিমান সোরা উতপাদন এবং সংগ্রহ করতেন প্রতি বছর।
(চলবে)

বাংলা যখন বিশ্ব সেরা১৯ - লাইফ অব মীর জুমলা, জেনারেল অব আওরঙ্গজেব

জগদীশ নারায়ণ সরকার

তৃতীয় অধ্যায়
কর্ণাটকে মীর জুমলার প্রশাসন
১। কর্ণাটক বিজয়ে মীর জুমলার আবিসংবাদী আধিপত্য
অসম্ভব বীরত্ব, অসাধারণ শক্তি স্ফূর্তি, এবং গভীর কূটনৈতিক দক্ষতা, বিশাল প্রশিক্ষিত বাহিনী এবং ইওরোপিয় গোলান্দাজদের সহায়তায় মীর জুমলা পূর্ব উপকূলের বিস্তীর্ণ এলাকা – মাদ্রাজ এবং পূর্ব কর্ণাটকই দখলই শুধু করেন নি, বিজাপুরি কর্ণাটকেও তাঁর দাঁত ফুটিয়েছিলেন। তাত্ত্বিকভাবে ৩০০ মাইল লম্বা আর ৪০ থেকে ২০০ মাইল চওড়া বহু হিরের খনির, বছরে ৪৩ লক্ষ টাকা রাজস্বের, বহু সুরক্ষিত গড়ের এই অঞ্চল আবদাল্লা কুতুব শাহের হাতে এসে পড়ল। স্বাভাবিক ভাবেই তিনি তাঁর নতুন প্রাপ্তিতে খুবই উচ্ছসিত হয়ে, বিশেষ করে গণ্ডিকোটা দখল করার পর তাঁর মূল সেনাপতিকে নওরোজইখিলাত উপাধি দেন তা আগের অধ্যায়ে বলেছি। এ ছাড়াও তিনি কর্ণাটকের বহু ওয়াকফ গ্রামের মুতাওয়ালি তাঁকে দান করেন। তিনি তাঁর সেনাপতির ক্ষমতায় এতই বিশ্বাস করতেন যে তিনি মীর জুমলাকে কর্ণাটক সরকারের তরফদারের পদটিও দান করেন।
অন্তত কয়েক কাল ধরে মীর জুমলার আচরণ ছিল যেন সরইলস্কর বা সুলতানের সেনাধ্যক্ষ। তিনি সুলতানকে লিখলেন, ‘প্রায় সব উজির জমিদার, মানিওয়ার এবং সর্দার এবং মধ্যসত্ত্বভোগী এই অভিযানে তাদের শেষ ক্ষমতা টুকু দিয়েছেন। আপনি যে উপহারগুলি পাঠিয়েছেন, তাঁর সবইটাই তাদের দিয়ে দেওয়া হয়েছে এবং তারা আপনার প্রতি গভীর কৃতজ্ঞতা প্রদর্শন করেছেন। প্রত্যেকেই আপনার কৃপাদৃষ্টি অর্জন করতে চায়, এবং প্রত্যেকজন যুদ্ধের মাঠে তার ক্ষমতা দেখিয়ে সেই কৃপাদৃষ্টির যোগ্য হয়ে উঠুক। আর আমার বিষয় নিয়ে বলি, আমি এই অঞ্চলের প্রশাসন, তাকে গড়ে তোলা, ছোট থেকে বড় সকলের ভালবাসা অর্জন, সেনার সুখ আর প্রজাদের শান্তি প্রদান এবং শত্রুকে পরাজিত করার কাজে ক্ষান্তি দেব না। আমি আমার ক্ষমতার সব কিছু উজাড় করে দিয়েছি। আমার বিনীত প্রার্থনা, আপনি আমায় সবসময় পথ প্রদর্শন করুণ।’ ১৭ জানুয়ারি ১৬৫১ সালের ব্রিটিশ কোম্পানি ওয়াল্টার লিটন আর ভেঙ্কট ব্রাহ্মণকে নবাবের কাছে দৌত্যে পাঠিয়েছিল। তারা সেখানে আবিষ্কার করে, নবাব(মীর জুমলা)বছরে ২০ লক্ষ প্যাগোডা পরিমান রাজস্ব রাজার (সুলতান) কাছে পাঠাচ্ছে।
কূটনৈতিক দক্ষতায় এবং সুতচুর পদক্ষেপে মীর জুমলা ক্রমে ক্রমে বিজিত এলাকার সমস্ত ক্ষমতার দখল নিজের তাঁবেতে নিয়ে আসেন। সেন্ট জর্জ দুর্গের কুঠিয়াল দেখছেন(৪ জানুয়ারি, ১৬৪৭)), ‘যুদ্ধ পরবর্তী মন্বন্তর এই এলাকায় গেড়ে বসেছে। আনা বব(নবাব) মীর জুমলা পুলিকান(পুলিকট) আর সেন্ট থোম দখল করে সারা দেশ কব্জা করে নিয়েছে...’। আদতে এটা কুতুব শাহের কূটনৈতিক চাল। তিনি পুলিকটে ডাচেদের নির্দেশ(হাসবুল হুকুম) দিয়ে বলেন মীর জুমলার সাথে সম্পাদিত চুক্তি পালিন করতে হবে, ‘যাতে তিনি কসবা, গড়টি আর পুলিকট বন্দরটি তার প্রশাসনের আওতায় নিয়ে আসতে পারেন।’ মীর জুমলা মাদ্রাজের ওপর ব্রিটিশদের দখলের ১৬৩৯ সালে দেওয়া দারমালা ভাইদের আর ১৬৪৫ সালের দেওয়া শ্রী রঙ্গার পাট্টা বজায় রাখলেন।
সুলতানের সঙ্গে তার সেনাপতির অদর্শনে বিচ্ছেদ বাড়তে থাকায়, মীর জুমলা নিজে কর্ণাটককে নিজের খাস তালুক বানাতে নতুন করে যুদ্ধে যাওয়ার উদ্যোগ নিলেন। পারস্যের উজির খালিফাইসুলতানকে লেখা এক চিঠিতে মীর জুমলা লিখছেন, ‘এই অঞ্চলের(অর্থাৎ কর্ণাটকের) সব রাজা, বিদ্রোহী আমার আওতায় এসেছে।’ দেখা যাচ্ছে, চন্দ্রগিরির রাজ মুকুট প্রথমে কুতুব শাহ নিজের মাথায় তুলে নিলেও, তা পরে স্বেচ্ছায় এবং চাতুর্যের সঙ্গে মীর জুমলা নিজের মাথায় পরাচ্ছেন।
২। মীর জুমলার প্রশাসন
মীর জুমলার প্রশাসনিক ব্যবস্থা তার রাজত্বের দ্বৈতসত্ত্বা চরিত্রের প্রকাশ। তিনি পূর্ব কর্ণাটকের প্রাক্তন বিজয়নগর রাজ্যের প্রধান হয়ে উঠেছিলেন, এবং সেই রাজ্যের এবং নায়কদের যে প্রশাসন তিনি উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়েছিলেন, তাতে তিনি কিছুটা পরিবর্তন আনেন – রাজা পরিবর্তন হলে প্রশাসনের চরিত্র ও কর্মশক্তিরও বদল হয়। এছাড়াও কুতুব শাহী জায়গিরের প্রধান হওয়ায় তিনি সেগুলিকে স্বাধীন রাজ্যে রূপান্তরিত করেন এবং গোলকুণ্ডায় যে প্রশাসনের স্বাদ তিনি পেয়েছিলেন, সেটি সেখানে প্রয়োগ করার উদ্যোগ নিলেন।
(চলবে)

বাংলা যখন বিশ্ব সেরা১৮ - লাইফ অব মীর জুমলা, জেনারেল অব আওরঙ্গজেব


জগদীশ নারায়ণ সরকার

অন্যদিকে কুতুব শাহ দিল্লিতে তাঁর দূত মুল্লা আবদুস সামাদকে পাদশাহের রাজসভায় গিয়ে জানাতে বলেন, আদিল শাহের সমস্ত অভিযোগ মিথ্যে, গান্ডিকোটা দখল গোলকুণ্ডার চুক্তি অনুযায়ী হয়েছে, সেটা ক্ষমতা প্রদর্শন নয়। আদিল শাহ মীর জুমলার বিরুদ্ধে করা অভিযোগ অশালীন। তাতে তাঁর সেনাপতির সম্মান হানি হয়েছে। তিনি তাঁর দূতকে আরও অভিযোগ করতে বলেন, কুতুব শাহ, আদিল শাহকে বার বার বলেছিলেন যদি কোন মতবিরোধ হয় তাহলে তিনি যেন তা পাদশাহের কাছে জানিয়ে তাঁর থেকে পরিষ্কার করে ভবিষ্যতের কৃত কর্তব্য জেনে নেন। তিনি আদিল শাহের বিরুদ্ধে ঘৃণ্য শয়তানি চাল(হরকৎ নাহানজার) চালার অভিযোগ আনেন এবং বলেন যে যে আদিল শাহ গোপনে কর্ণুলের সিদ্দি ঝাউহরকে দিয়ে গাণ্ডিকোটা আর গুটি এবং তাঁর আশেপাশের এলাকায় অভিযান চালাবার নির্দেশ দিয়েছিলেন। এমন কি এই কাজের বিরুদ্ধে তিনি তার বোন বড়ি সাহেবাকে(আদিল শাহের স্ত্রী)র মধ্যস্থতা চেয়েছিলেন। কুতুব শাহ, তাঁর বিজাপুরী দূত হাজি নাসিরাকে নির্দেশ দেন, তিনি যেন সুলতানকে চাপ দিয়ে ঝাউহরকে নিবৃত্ত করেন এবং এবং যদি প্রয়োজন হয় তাহলে তাকে হুমকি দেন; যে কোন ভাবে তাকে চাপে রাখতে তাকে বলেন সুলতান। তিনি স্বীকার করেন, আদিল শাহের সঙ্গে তাঁর এই বিরোধ তাদের যৌথ স্বার্থের বিরোধী, এবং তাঁর ফলে হয়ত তাদের শক্তিশালী শত্রুর হাতকেই শক্ত করা হবে, যারা এ ধরণের ঘটনা ঘটার জন্য অপেক্ষা করে রয়েছে। মীর জুমলা নিজে খান মহম্মদ ইখলাস খান এবং কুর্ণুলের সুবাদার সিদ্দি আবদুল ওয়াহবকে কে চিঠি লিখে সমস্ত ভুল বোঝাবুঝি মিটিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করেছেন।

কথার যুদ্ধের পর শস্ত্রের যুদ্ধ লেগে গেল দুপক্ষের মধ্যে। এই ঘটনা ১৪ জানুয়ারি ১৬৫২ সালের সেন্ট জর্জের একটা চিঠি থেকে আমরা জানতে পারি, ‘গোলকুণ্ডা আর ভিজাপুরের মুর(মুসলমান)দের মধ্যে যুদ্ধ লেগেছে, দূর থেকে জেন্টু (রয়াল) রাজা সুযোগের অপেক্ষায় রয়েছে, যাতে সে তাঁর দুরবস্থা বদলাতে পারে...’
আদিল শাহ খনইখানান, খান মহম্মদকে মীর জুমলার অধিকার করা দুর্গ দখলের জন্য পাঠায়। গাণ্ডিকোটায় যাওয়ার পথে চন্দ্রগতিতে একটা দুর্গ দখল করেন। আক্রমণকারীরা বাইরে থেকে কামান দাগে আর দুর্গের বাসিন্দারাও তাঁর জবাব দেয়। কিন্তু আদিল শাহের পক্ষে এত পরিমান গোলা বর্ষণ করা হয় যে দুর্গের আর কেউ বেঁচে ছিল না। এরপর তারা দুর্গ ছেড়ে এগিয়ে গিয়ে মীর জুমলার গাণ্ডিকোটায় আক্রমনের জন্য অভিযান শুরু করে। তাদের পরিকল্পনা ছিল দুর্গ আর গোটা গ্রামকে ধুলায় মিশিয়ে দেওয়া।

মীর জুমলার সেনাবাহিনীতে ছিল মুঘল, আফগান, পাঠান এবং রাজপুতদের বিশাল ফৌজ। তিনি বহু কষ্টে তাদের সংগ্রহ করেছেন এবং তাদের দক্ষতার জন্য তিনি খুব গর্বিতও ছিলেন। এই বিশাল বাহিনী নিয়ে তিনি খানইখানানের বাহিনীর বিরুদ্ধে দাঁড়ালেন। দুর্গের পিছনের দিকে গিয়ে বাহিনীকে তিনি কয়েকটা টুকরো করে ভাগ করলেন নানান কৌশলগত যায়গায় রাখলেন। তাঁর বিশ্বস্ত সেনাপতি মহম্মদ খান লোদি একটি গাড়িতে তুলে তাঁর পিছিনে বিশাল বাহিনী জড়ো করা হল। যুদ্ধে তাঁর মুখোমুখি হলেন বীজাপুরি সেনাপতি বাজি ঘোরপাড়ে(মুঢৌলএর)। যুদ্ধ শুরু হতে না হতেই বিজাপুরী অশ্বারোহী বাহিনী বিপক্ষের অশ্বারোহী বাহিনীকে বল্লম নিয়ে দুপাশ থেকে আক্রমন করে, প্রচুর হতাহত হয়।

মুহম্মদ খান লোদি ঘোড়া থেকে পড়ে যান এবং তাঁর মাথা থেঁতলে যায় সেনাবাহিনীর মধ্যে পড়ে গিয়ে, তাঁর মধ্যেই প্রচুর সেনা নিহত হল। গাণ্ডিকোটা থেকে বাজি ঘোড়পাড়ে মীর জুমলাকে বহিষ্কার করল। দুর্গের অধিবাসীরা দূরের জঙ্গল আর পাহাড়ে গিয়ে লুকোল। বিজাপুরী ঐতিহাসিক বিজয় গর্বে লিখছেন, ‘কুতুব শাহের সেনাবাহিনীতে মীর জুমলার মত শক্তিশালী সেনানায়য়ক, সাধারণ একজন উজির বাজি ঘোরপাড়ের হাতে পরাজয় স্বীকার করলেন, এবং মুঠি খোলা ধুলোর মত মিলিয়ে গেলেন।’ এই অপমান জনক হারের পর মীর জুমলা তাঁর উকিলের মার্ফৎ খান মহম্মদের সঙ্গে শান্তি চুক্তির প্রস্তাব পাঠালেন এই শর্তে, ১) দু লাখ পঞ্চাশ হাজার হুণ ক্ষতিপূরণ দেওয়া হবে, যতক্ষণনা এই অর্থ পাওয়া যাচ্ছে ততক্ষণ কিছু ঘোড়সওয়ার বন্দী থাকবে, ২) গোণ্ডিকোটা এবং কোক্কানুর দেশটি মীর জুমলার হাতে অর্পণ করতে হবে।

আদিল শাহ শান্তি চাওয়ায় খান, মীর জুমলার উকিলকে সম্মান জানালেন, এই শর্ত তারা মেনে নিচ্ছেন এই কারণে যে, দুর্গের এবং দুই পক্ষের ক্ষতির অর্থ দুর্গে রক্ষিত অমেয় পরিমাণ সম্পদের বিনাশ সাধন। আদিল শাহ এই চুক্তি মেনে নিলেন। স্বাক্ষর হল ১৬৫২ সালের ১৪ জানুয়ারি থেকে ১২ ফেব্রুয়ারির মধ্যের কোন এক সময়ে – শর্ত হল – ১) মীর জুমলা যে গোণ্ডিকোটা আর কোক্কানুর দেশ দখল করে ছিলেন সেটি তাঁর দখলে থাকবে; ২) খান মহম্মদ পেল ৫ লাখ ৫০ হাজার হুণ অর্থ এবং মণিকারের চোখ ছানাবড়া হওয়ার মত বিশালাকার চারটি হীরে, এগুলি সব আদিল শাহের সভায় পাঠানো হল।

হারের পর মীর জুমলা আর বীজাপুরী সেনানায়ক খান মহম্মদ যৌথ বাহিনী নিয়ে কর্ণাটক উচ্চভূমির রাজধানী পেনুকোণ্ডা। যদিও সিদ্দি রাইহান শোলাপুরী(যার অভিভাভক, অম্বর কালা সুলতানের নির্দেশে নিহত হয়) সেরায় স্থানীয় রাজাদের সঙ্গে মিলে বিদ্রোহী হয়েছিলেন – বিশেষ করে মহীশূরের রাজা, যিনি জগদেব দেশ দখল করেন, এবং কর্ণাটক আর মুলুন্দে ইনকিলাব আনেন, এবং তার বাহিনীতে ৪ লক্ষ পদতিক, ৪০০০০ হাতি ছিল। খান মহম্মদ এ সব নিয়ে চিন্তা করতে রাজি ছিলেন না। পেনুকোণ্ডা আক্রমন করেন এবং রাজা শান্তি চুক্তি চান এবং দুর্গ পরিত্যাগ করে কান্দর্পিতে চলে যান, পেণ্ডুকোটার নাম হয় তাখাতইমুবারক।
কিন্তু কর্ণাটকে যুদ্ধ থামার কোন সম্ভাবনাই দেখা যাচ্ছিল না। আগের মতই দুর্দমভাবে চলতে লাগল। খান মহম্মদ সভায় ফিরে এসে আক্রমনে বিরতি দিলে শ্রী সঙ্গ রয়াল মহীশূরের রাজার সঙ্গে হাত মিলিয়ে হারানো গড় ফিরে পেতে চাইলেন। তিনি কুতুব শাহী বাহিনীকে ঠেকিয়ে দিলেন। কিন্তু মহীশূরের বাড়বাড়ন্তিকে ছেঁটে দিতে প্রথমে জগদেব দেশ, তারপর কৃষ্ণগিরি দুর্গ দখল করে মহীশূরের দুর্গ অবরোধ করলেন এবং শেষ পর্যন্ত রাজার চারটি দুর্গ নিজের আয়ত্ত্বে আনলেন। জিঞ্জির দিকে যেতে গিয়ে, গোলকুণ্ডার অধিকৃত এলাকা পার হতে বিজাপুরী সেনানায়ক, মীর জুমলার অনুমতি চাইলেন। বিজাপুরীদের কর্ণাটকের বিভিন্ন অঞ্চলে অগ্রগতিতে শঙ্কিত হলেন মীর জুমলা কেননা তাতে তাঁর আধিপত্যের, ক্ষমতা ধরে রাখার পরিকল্পনায় আঘাত লাগতে পারে। তিনি বিভিন্ন নায়ককে এবং কর্ণাটকের রাজাকেও উসকাতে শুরু করলেন। মহীশুরের নায়ক, বিজাপুরী বিদ্রোহী, সিদ্দি রাইহানের সঙ্গে হাত মেলালেন, সিদ্দি সম্প্রতি মুস্তাফার দখল করা দুর্গগুলি দখল করেছেন। মীর জুমলার আশ্বাসে শ্রী রঙ্গ রয়াল ভেলোরে ফিরে এসে লড়াই দেওয়ার জন্য বড় সেনা তৈরি করার চেষ্টা করতে লাগলেন। বিজাপুরের ঐতিহাসিক লখছেন, ‘আদিল শাহ নির্দেশ দিলেন শ্রী রঙ্গ ঝামেলা শুরু করে দিয়েছে, এবং উকিলের মাধ্যমে মীর জুমলার সঙ্গে কথা বার্তা চলছে। তারা ৫০ লাখ হুন আর ৪৫ টা হাতি মুঘলদের দিতে রাজি। এই বাবদে মীর জুমলা দায়িত্ব নিয়েছে। সে মুঘলদের প্ররোচিত করছে রাজাকে সাহায্যের জন্য এগোতে।’

মীর জুমলার কূটনীতি বিজাপুরের রণনীতিতে পরিবর্তন ঘটাতে বাধ্য করল। খান মহম্মদ তাঁর সব বিজিত ভূমি দুর্গ ইত্যাদি পিছনে ফেলে মহিশূরের নায়কের সঙ্গে যুদ্ধ করতে এগিয়ে গেল। বিজাপুরের সুলতান, খান মহম্মদকে নির্দেশ দিলেন প্রথমে রয়াল রাজ্যকে আক্রমন করার, যাতে সে মীর জুমলার সঙ্গে যোগাযোগ না করতে পারে। ১৬৫৪ সালের ৭ নভে বিজাপুরী সেনা ভেলোর দখল করে। রয়াল খান মহম্মদের সঙ্গে রাজস্ব বাঁটোয়ারা এবং চন্দ্রাগিরি হাত বদল করার চুক্তি করে। রয়াল উত্তর তাঞ্জোরের আকল নায়েকের জঙ্গলে পালিয়ে যান। রাজত্ব ছাড়া রাজা গভীর জঙ্গলে চরম দারিদ্রে দিন কাটাতে থাকলেন। শেষে একদা তাঁর অধীনস্থ মহীশূরের রাজার আশ্রয়ে থাকলেন।

চন্দ্রগিরি আর মহীশূরের দুই রাজা গোলকুণ্ডা বাহিনী যে সব এলাকা দখল করেছিল সেগুলি তারা দখল করতে চাইল। কিন্তু মাদুরার নায়ক তাদের সাহায্য না করে খান মহম্মদকে মহীশূর বাহিনীকে তাড়াবার এবং পাহাড়ি রাস্তা খুলে দেওয়ার জন্য আবেদন করলেন। আতুর থেকে মাদুরা পর্যন্ত তিনি লুঠ করলেন। মহীশূরের রাজা বালাজী হইবত রাওকে পাঠালেন খান মহম্মদের সঙ্গে যুদ্ধ করতে। তিনি সিদ্দি মাদুদকে পাঠিয়ে ফিরে গেলেন। সিদ্দি, বালাজীর মাথা কেটে নেন। রাজা ক্ষমা প্রার্থনা করেন। মাদুরার রাজা তাঁর শত্রুকে ধ্বংস করার জন্য খান মহম্মদকে নগদ অর্থ, ৫০টা হাতি, বিপুল রাজস্বর প্রতিশ্রুতি দিলেন। শ্রী রঙ্গ তাঁর শেষ বন্ধুও হারালেন।

১৬৫৩ সালে দাক্ষিণাত্যের শেষ হিন্দু রাজ্যগুলি নিজের দুর্বলতা, ব্যক্তিগত অসূয়ার জন্য মানচিত্র থেকে উধাও হয়ে যায়। তবে মহীশূর আর মাদুরা কিছু দিন লড়াই করে। বিজয়নগর রাজ্য মুছে ফেলার একটা বড় কাজ করেছেন আর্দিস্তানি মীর জুমলা, তাঁর কূটনৈতিক দক্ষতা প্রয়োগ করে।
(চলবে)

দ্বিতীয় অধ্যায় শেষ

বাংলা যখন বিশ্ব সেরা১৭ - লাইফ অব মীর জুমলা, জেনারেল অব আওরঙ্গজেব

জগদীশ নারায়ণ সরকার

গোলকুণ্ডা থেকে নতুন করে ৬০ মাইল দূরে উত্তর-পূর্বে অনন্তপুর জেলায় মীর জুমলা গুটি দুর্গ দখল করেন। সঠিক তারিখ জানা যায় না। প্রেমাদুর স্মৃতি কথায় জানা যাচ্ছে এটির পতন হয়েছিল ১৬৪৬ সালে। কিন্তু ১৫৭২ শক বা ১৬৫০ সালের তেলুগু লেখ সূত্রে জানা এটি মীর জুমলা শাসন করেছিলেন(হাজারাতি নবাবৌ বা রাজাধিরাজা রাজাপরমেশ্বর), অন্য দিকে তাভার্ণিয়ের ১৬৫২ সালের গাণ্ডিকোটা ভ্রমণ সূত্রে জানা যাচ্ছে, মীর জুমলা গুটি তালুকের বজ্রকোটির হীরে খনির মালিক ছিলেন।

গুটি থেকে মীর জুমলা, রাচুতি হয়ে দক্ষিণ পূর্বের দিকে আগ্রসর হয়ে গুরুমকোণ্ডা দখল করেন। সেই দিকে আরও এগিয়ে গিয়ে উত্তর আর্কোট জেলার চন্দ্রগিরি এবং তিরুপতি পর্যন্ত ঢুকে যান। ৬০০ ফুট উঁচু ওপরে তিরুমালা পাহাড়ের দক্ষিণ দিকে গ্রানাইট পাথরে তৈরি চন্দ্রগিরি দুর্গ যাদবদের তৈরি জোরদার দেওয়ালে(১০০০ সালে তৈরি) এবং একটি পরিখায় সুরক্ষিত। তাভার্নিয়ে সেখানে দেখেছেন প্রচুর সেনা যেতে। এবং পরে সেখানে তিনি গিয়ে মীর জুমলার সঙ্গে দেখা কররেন এবং দেখেন তিনি অভিজাতদের সঙ্গে শিবিরে আলাপচারিতায় রত।

১০। কর্ণাটক ভাগাভাগি নিয়ে যুদ্ধ
ফলে এটা বোঝাই যাচ্ছিল যে সীমান্ত বা ভাগাভাগি চুক্তি হয়েছে সেটি শুধু যে চন্দরগিরির রাজার বিপক্ষে গিয়েছে তাই নয়, এই চুক্তিতে আদিল শাহের থেকে বেশি লাভ হয়েছে কুতুব শাহএর – বা এই ধারণাটা আদিল শাহের মনে গেঁথে গিয়েছে। অস্থায়িত্বই ছিল চুক্তির চরিত্র। সে সময়ের দাক্ষিণাত্যের রাজনীতি কোন নির্দিষ্ট খাতে না বয়ে এলোমেলোভাবে চলেছে; বিশেষ করে দাক্ষিণাত্যের দুই সুলতানি রাজ্যের মধ্যে। যে গভীর অবিশ্বাসের পরিবেশ তৈরি হয়েছিল বহু কাল ধরে, তা এই চুক্তিতে ওপড়ানো সম্ভব ছিল না। দুই সুলতানই প্রত্যেকে প্রত্যেকের বিরুদ্ধে অবিশ্বাসের আঙ্গুল তুলতে থাকেন। জিঞ্জি অবরোধের সময় আবদুল্লা, পাদশাহকে একটা নাকি সুরে লেখা কান্না ভরা চিঠিতে বলেছিলেন, ‘আদিল শাহ কিন্তু তাঁর চরিত্র অনুযায়ী সম্রাটের তৈরি করা চুক্তির নির্দেশ মানবে না এবং যে ভাগাভাগির শর্ত হয়েছে তাও উল্লঙ্ঘন করবে।’

কুতুব শাহ তাঁর দিল্লির উকিল(এজেন্ট) ফাসিউদ্দিন মহম্মদকে বললেন, পাদশাহ যাতে দুজন আমিন – একজনকে বিজাপুর অন্যজনকে গোলকূণ্ডায়য় নিযুক্ত করেন, অথবা তিনি যেন গোলকুণ্ডায় আওরঙ্গজেবের দূত মীর মহম্মদ তাহিরকে সঠিকভাবে তদন্ত করে বিষয়টির সমাধান করান, সে বিষয়টি পাদশাহের সভায় গিয়ে জোর দিয়ে বলেন। সুলতান যুদ্ধের (জিঞ্জি ঘেরাওয়ের আগে) আগে একজন আমিন চাইলেন, যাতে আদিল শাহ কোন গণ্ডগোল না করতে পারে। অন্য আরেকটি চিঠিতে কুতুব শাহ পাদশাহকে অভিযোগ করে লিখলেন, বিজাপুর যে চুক্তি ভঙ্গ করেছে, সেটি ইসলাম খান জানেন, এবং ভেতরে ভেতরে বিভেদ যাতে আরও বাড়ে তাঁর ব্যবস্থা করছেন। কুতুব শাহ তাই চুক্তির কতগুলি বিষয় পুনর্বিবেচনা করতে অনুরোধ করেন, ১) রাজপরিবার, নায়কদের লুঠে যে নগদ, গয়না-রত্ন, হাতি এবং জিনিসপত্র পাওয়া গিয়েছে, সেগুলির ভাগাভাগির পুনর্মূল্যায়ন করা, এবং কুতুব শাহ উদার মনে চান আদিল শাহ নিজে এগুলি মূল্যায়ন করুণ; ২) কর্ণাটকে কুতুবশাহী দখল করা অঞ্চল অর্ধেক করে বাঁটোয়ারা করার কথা চুক্তি হয়েছে। কিন্তু এই চুক্তি পাদশাহ দ্বারা প্রত্যায়িত নয়। তিনি আরও অভিযোগ করেন, কুতুব শাহ অভিযোগ করেন ইসলাম খাঁ প্রাথমিক চুক্তি জানতেন, কিন্তু তাঁর মৃত্যুর(নভেম্বর ১৬৪৭) সুযোগ নিয়ে আদিল শাহ শাহজীর অধীনে বহু উজির পাঠিয়ে কর্ণাটকের হিন্দুদের সাহায্য করেন, বিশেষ করে রয়াল এবং অন্যান্য জমিদারকে; কিন্তু মীর জুমলা সক্কল শত্রু পরাজিত করে বিজাপুরীদের বিদরের সীমান্তে তাড়িয়ে দেন; এবং আদিল শাহ নিজে বিদরে আসেন, যেটা আসলে যৌথ সীমান্ত; তিনি তাঁর চুক্তি এবং প্রতিশ্রুতি অমান্য করে জোর খাটিয়ে কুতুব শাহের অধিকৃত জায়গা দখল করেছেন, তাঁর অভিযোগ। আদিল শাহের বিরুদ্ধে আরও অভিযোগ যে তিনি হড়বড় করে তাঁর দুই-তৃতীয়াংশ ভাগ নিয়ে নিতে চেয়েছেন, অথচ কুতুব শাহের পাওনা(তিনি যে পাদশাহকে এ বিষয়ে অভিযোগ করেছেন তা না জেনেই)আটকে দিয়েছেন এবং তাঁর যা পাওনা তাঁর থেকেও বেশি তিনি কেড়ে নিয়েছেন। ব্রিটিশ সূত্র এই তথ্য প্রমান করে যে ভেলোর(১৬৪৭) দখলের সমস্ত ক্ষতিপূরণ বাবদ প্রাপ্ত অর্থ বিজাপুর নিয়েছে।

দুই সুলতানি রাজ্যের মুখোমুখি দ্বন্দ্ব খুব পুরোনো নয়, কিন্তু গভীর। সেটি শুরু হয়েছে জিঞ্জি অবরোধের সূত্রে – যদিও মুস্তাফা আর মীর জুমলা এই চুক্তি সম্পাদন করেন, কিন্তু আবিশ্বাসের মাত্রা এতই কড়া ছিল যে, সেই চুক্তির বোঝাপড়া এড়িয়ে নতুন গোলযোগ পেকে উঠতে শুরু করেছে। এবারে গোলকুণ্ডার বিরুদ্ধে বিজাপুরী উজির খান মহম্মদের অভিযোগ, সম্পর্ক ভাঙ্গার। পাদশাহকে আদিল শাহ লিখলেন, তাঁর নির্দেশ ছাড়াই এবং তাকে অন্ধকারে রেখেই কুতুব শাহ গোন্ডিকোড়া দখল করেছেন। তাঁর আরও অভিযোগ মীর জুমলা যুদ্ধে সাফল্য পেয়ে কুতুব শাহকে জানিয়েই বিজাপুরের বিরুদ্ধে অস্ত্র শানাতে শুরু করেছেন। ঝাউর লিখছেন ‘দুটি-তিনটি জয়ের পর(ভুল বোঝাবুঝির জন্য হয়েছিল), যা আসলে হাজারটা পরাজয়ের থেকেও কলঙ্কের, মীর জুমলা তাঁর কাজ কর্ম গোলকুণ্ডার সুলতানকে না জানিয়েই সম্পাদন করতে শুরু করে। এই শয়তানি যুদ্ধ তাঁর প্রভুর নির্দেশের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে করতে করতে সে এলাকা দখল করতে আদিল শাহের এলাকায় ঢুকে আসত। কুতুব শাহ কাজকর্মের সুতো একজন ভয়ানক মানুষেরর হাতে ছেড়ে দিয়েছেন দেখে আদিল শাহ মুচকি হেসেছেন এবং মীর জুমলার কাজগুলিকে ক্ষমা করে দিয়েছেন।’ বিজাপুরী ঐতিহাসিকদের অভিযোগের মূল সূত্রটা হল মীর জুমলা মুলুন্দ আর কর্ণাটকে গিয়ে গোলযোগ সৃষ্টি করছেন। কিন্তু তারা ভুলে গিয়েছেন, গোণ্ডিকটার বিজয় ঘটেছে আদিল শাহের সেটি ছেড়ে যাওয়ার জন্য। এছাড়াও বিজাপুর কুতুব শাহের বিরুদ্ধে অভিযোগ করে আদিল শাহ যে ক্ষমা প্রদর্শন করেছেন, সেই কাজ কুতুব শাহ করেন নি – বিশেষ করে জিল্লালা এবং নান্দিয়ালের দুটি গ্রাম দখল বিষয়ে, গোয়েন্দাদের সঙ্গে খারাপ ব্যবহারে আর সর্বশেষ অভিযোগ, গুটি দখল করায় গোলকুণ্ডার সঙ্গে তাদের বিরোধ বেড়েছে।
(চলবে)

Saturday, November 26, 2016

বাংলা যখন বিশ্ব সেরা১৬ - লাইফ অব মীর জুমলা, জেনারেল অব আওরঙ্গজেব

জগদীশ নারায়ণ সরকার

৭। সিধোউত(siddhout বা সিদ্ধবাতম)
১৬৪৮এ জিঞ্জি আর পরের বছরে তাঞ্জোরের পতনের পর দুই সুলতানি রাজ্য বাকি থাকা ক'একটা হিন্দু রাজ্য দখলের জন্য সর্বশক্তি নিয়োগ করল। বিজাপুর দক্ষিণে আর গোলকুণ্ডা শক্তির সেনাপতি মীর জুমলা উত্তর দিকে নজর দিলেন নতুন করে। বিজাপুর, বিজয়নগরের পশ্চিমের তেলুগু আর পূর্বের তামিল পশ্চাদভাগের অংশটার পাশাপাশি পেনুকোণ্ডা এবং বাসবপত্তনম, বেলোর, জিঞ্জি এবং আর্নি দখলে রেখেছে। মীর জুমলা দখল করতে লাগলেন উত্তরের siddhout, গাণ্ডিকোটা এবং গুটি আর দক্ষিণের উপকূলভাগ। কার পরে কোনটা দখল করেছেন মীর জুমলা, সেই ক্রম বোঝা দুষ্কর বিভিন্ন ডাচ, পারসি, তেলুগু, তামিল, ব্রিটিশ পরস্পর বিরোধী সূত্রে। তবুও আমরা তেলুগু সূত্র, সাহিত্যিক এবং লেখমালা আর ভৌগোলিক অঞ্চলের সূত্র তুল্যমূল্য বিচার করে ধরে মীর জুমলার বিজয় পথ নির্ধারণ করতে চেষ্টা করতে পারি।
মীর জুমলার পরের নজর ছিল কুডাপ্পা জেলার siddhout বা সিদ্ধবাতম। ১৬৪৬ সালে তিনি উদয়গিরি নতুন করে দখল করে চিট্টিভেলির একাংশ কবলে নিয়ে আসেন। কিন্তু এই জেলারই, বালাঘাট কর্ণাটকের খুব গুরুত্বপূর্ণ অংশ শাসন করছেন কুলাপ্পা জেলার পূর্বাংশের মাতলি সমাজের নায়ক দ্বিতীয় কুমার অনন্তের পালিত পুত্র, অনন্তরাজা দেবছোড়া মহারাজা যার রাজধানী সিদ্ধবাতম। তেলুগু সূত্রে জানতে পারছি, যুদ্ধে তিনি মীর জুমলার দুই মুসলমান আধিকারিক (সর্দার)এর মাথা কেটে নেন এবং ব্রাহ্মণ বক্সী ত্রিম্বকম রাউ(ত্রিম্বক রাও) পালিয়ে বাঁচেন(শক ১৫৭১ বিকৃতি, ১৬৪৯-৫০)। তবে পরের দিকে যুদ্ধ করে টিকে থাকা যাবে না বুঝেই তাঁর কাকা এলামারাজা এবং অন্যান্য আধিকারিকের সঙ্গে আলোচনা করে মহিলা, অন্যান্য আত্মীয়স্বজন ইত্যাদি নিয়ে ইক্কেরি বাসবপুরমে পালিয়ে যান(১৬৫০)। সিদ্ধবাতমকে মীর জুমলা সেনা ঘাঁটি বানান এবং এখানে ত্রিম্বক রাও শঙ্করজী পন্তকে শাসনের দায়িত্ব দেওয়া হয়।

৮। গাণ্ডিকোটা
আধুনিক মাদ্রাজের কুডাপ্পা আর অনন্তপুর জেলার গাণ্ডিকোটার রাজা ছিলেন তিম্মা নায়ার(তেলুগু সূত্রে প্রেমাসানি চিনা(চিন্না), তিম্মা নায়ডু)। তিনি বিজয়নগরের এবং জিল্লালার রেড্ডিদের করদ রাজা ছিলেন। পেন্নার উপত্যকার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ এলাকা গাণ্ডিকোটা। এর দুর্গ বিষয়ে আলোচনা করতে গিয়ে তাভার্নিয়ে বলেছেন, এটি গোলকুণ্ডার অন্যতম শক্তিশালী প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা। কুডাপ্পা জেলার য়ারামালাই পাহাড়ের ওপর সমুদ্র তল থেকে ১৬৭০ ফুট উঁচুতে অবস্থিত। পাহাড়ের পাদদেশেই শহরটি। দুই সাম্রাজ্যবাদী সুলতানি রণনীতিতেই এই অঞ্চল্টাকে গুরুত্ব দেওয়া হয়। গোলকুণ্ডা কয়েকবার চেষ্টা করেও গাণ্ডিকোটার রাজাকে দমন করতে পারে নি।

বিজাপুরের ইক্কেরি দখলের সমসময়ে(১০৪৭/১৬৩৮) খান মহম্মদ, মালিক রাইহান, আলি খুদাবন্দ খান এবং অন্যান্য বিজাপুরী উজির এটি অবরোধ করে। কিন্তু সাহজী ভোঁসলা আর আসদ খানের বাহিনীকে (১০৫৭/১৬৪৮ সালে) ভিল্ভুয়ার আর কৃষ্ণা তুপাক্কির নেতৃত্বে রয়ালের বাহিনী হারিয়ে দিলে, আদিল শাহের নির্দেশ সেই অবরোধ তুলে নিয়ে মুস্তাফা খাঁয়ের বাহিনীর শক্তিকে জোরদার করতে যোগ দিতে হয়। আন্দাজ করা হচ্ছে এই সময় বিজাপুর শক্তি জিল্লালা দখল এবং রেড্ডিদের বন্দী করে। রেড্ডিরা পালিয়ে গিয়ে তিম্মা নায়ারের সাহায্যে তাদের রাজ্য আর নান্দিয়ালের দু/তিনটি গ্রাম দখল করে। খান মহম্মদ তিম্মা নায়ারের সঙ্গে চুক্তি করে দখলি গ্রামের জন্য ক্ষতিপূরণ জোগাড় করেন। কিন্তু সীমান্ত চুক্তি না হওয়া পর্যন্ত, বিজাপুরের মনে হয়েছে এই এলাকাগুলি তাঁর দখলে আসা দরকার এবং চুক্তির পরে এর আশেপাশের এলাকাগুলি কুতুব শাহের জন্য ছেড়ে রাখে তারা, তাঁর জন্য কুতুব শাহ বেশ ভাল রকমের ক্ষতিপূরণ দেন (১৬৪৯)।

১৫১৭র ভিক্রি শকে মীর জুমলা গোলকুণ্ডা থেকে গান্ডিকোটার দিকে বিপুল বাহিনী নিয়ে এগোতে এগোতে জাম্বুলামাদক তালুকের মাইলাবর্ণ গ্রামে উপস্থিত হন। সেখান থেকে মাত্র একটাই রাস্তা দিয়ে দুর্গ পর্যন্ত পৌঁছনো যায়। রাস্তাটির সব থেকে চওড়া অংশ ২০ থেকে ২৫ ফুট আর সব থেকে ন্যারো অংশ ৭-৮ ফুট। থেভেনটের মতে গুঁড়ি দিয়ে সে দুর্গে পৌঁছতে হয়। পাশেই খাড়া পাহাড় তাঁর পাশে দুটি খরস্রোতা নদী। পাহাড়ের মাথায় একটা ছোট সমতল ভূমি - সেখানে ছোট ছোট ঝর্ণার জলে ধান আর বজরা চাষ হয়। তাভার্নিয়ে লিখছেন, ‘দক্ষিণের সমতলে এই শহরটা এমন একভাবে তৈরি করা হয়েছে যে এক দিকে খাড়া পাহাড় আর দুটি নদী, তিনদিকের বিশাল পাথরের দেওয়াল দিয়ে ঘেরা। শহরে ঢোকার জন্য সমতলের দিকে রয়েছে একটিই দরজা আর তাঁর পাশে পরিখা কাটা। দুর্গে মাত্র দুটি কামান রয়েছে, একটি ১২ পাউণ্ডের(নাম রামাবনম), দরজার সামনে বসানো, অন্যটি ৭-৮ পাউণ্ডের কামান দুর্গ প্রাচীরের মত জায়গায় বসানো।’ এর রাজা তিম্মা নায়ার এই এলাকার মধ্যে সুকৌশলী সেনা নায়কদের মধ্যে অন্যতম। তাঁর পাশে ছিল রেড্ডি রাজারা। ঘেরাও হলে ১২ বছরের খাদ্য পানীয়ের সমস্যা হবে না এমন অবস্থা তৈরি করে রাজা মীর জুমলার বশ্যতা অস্বীকার এবং যুদ্ধে আহ্বান করেন। ছোট ছোট আক্রমনে স্থানীয়েরা আক্রমণকারীদের বিপুল ক্ষতি করতে থাকেন এবং এক সময় দেখা যায় মীর জুমলার ৩০০০ সেনা নিহত হয়। ফলে মীর জুমলাকে তাঁর শিবির পিছিয়ে গুদেমচেরুভু আর গোরিগানুরুতে নিয়ে যেতে হয়। থেভেনট আবদুল্লার সময় গোলকুণ্ডা এসেছিলেন তাঁর লেখনী আর তেলুগু সূত্র থেকে পরিষ্কার মীর জুমলার জয় বাহুবলে হয় নি, বরং ছলে-কৌশলে হয়। তাভার্নিয়ে বলছেন, শেষ পর্যন্ত মীর জুমলা পাহাড়ের চূড়ার উচ্চতা পর্যন্ত কামান বয়ে তোলার সিদ্ধান্ত নেন। তিনি রাজার ফরাসী গোলান্দাজদের চার মাসের সাধারণ বেতনের তুলনায় অনেক বেশি বেতনের অর্থ দক্ষিণার টোপ দিয়ে কাজটি করাতে পেরেছিলেন। চারটি কামান উচ্চতায় তুলে দুর্গটিতে গোলা দাগা হতে থাকলে সদর দরজার কাছে থাকা কামানটিকেও অকেজো করে দেওয়া হয়। সুরক্ষিত দরজাটি প্রায় ধ্বংস হয়ে পড়ছে দেখে দুর্গের অধিবাসীরা নিজেদের সুরক্ষার শর্তে দুর্গ ছেড়ে চলে যায়। তাভার্নিয়ে বলছেন, গাণ্ডিকোটায় মীর জুমলা সফল হয়েছেন ফরাসী গোলান্দাজদের দক্ষতার জন্য, খারাপ ব্যবহার পেয়ে এরা ডাচেদের ছেড়ে এসেছিল। তাদের সঙ্গে ব্রিটিশ আর ডাচ এবং ২/৩ জন ইতালির গোলান্দাজও ছিল। আবার তেলুগু সূত্র বলছে – বহিদিন ধরে অবরোধ করেও যখন দুর্গটি দখল করা সম্ভব হল না, তখন মীর জুমলা প্রস্তাব দিলেন তাদের গুটি দুর্গের সঙ্গে এই দুর্গটি বদল করার। কিফায়তিতে যে কারণ দেওয়া হয়েছে তা যদিও হয়ত সত্য নাও হয়, কিন্তু মীর জুমলার কূটনৈতিক চাল যে কাজ করেছে তার উদাহরণ পাই থেভার্নের কথায়, ‘মীর জেমলা বল প্রয়োগে দুর্গটি দখল করতে না পেরে কৌশল আর অর্থ বলে(শান্তি আলোচনায় তাঁর সকাশে আসা নায়েককে) রাজাকে দুর্গের বাইরে বের করে নিয়ে এসে, তাকে দেওয়া শর্ত ভঙ্গ করে তাকে নজরবন্দী করে রেখে গাণ্ডিকোটা দুর্গ দখল করেন।’ তাভার্নিয়ের এই বর্ণনার সঙ্গে মীর জুমলার ঘুষের বর্ণনা খাপ খেয়ে যাচ্ছে।

কর্ণাটকের অভেদ্য এই দুর্গটি পতন মীর জুমলার জীবনে বড় প্রাপ্তি।

কিন্তু বিজাপুরী ঐতিহাসিক ঝাউর, এই জয়ে মীর জুমলার কোন কৌশলকেই বিন্দুমাত্র গুরুত্ব দিতে নারাজ, ‘দুর্গের রাজা বিপুল রত্নরাজি আর সম্পত্তি গর্বে অন্ধ হয়ে মীর জুমলার আক্রমনকে মরুভূমিতে মরীচিকার ছোট করে দেখেছিল। যখন মীর জুমলা আক্রমন করা শুরু করে, তাকে প্রতিহত করার কোন প্রচেষ্টাই তিনি করেন নি। দুর্গেই তিনি বসে ছিলেন। মীর জুমলা দুর্গের কাছাকাছি এসে দুর্গটি ঘিরে ফেলে। প্রতিরোধের চেষ্টা করলে হয়ত রাজা সফল হতেন, কিন্তু ভিষগের হাতের তলায় যেমন রোগীর নাড়ি ফড়ফড়ায়, আদিল শাহের নাম শুনে কোন প্রতিরোধ ছাড়াই রাজা মীর জুমলার হাতে পরাজয় মেনে নেন। আর যেহেতু তাঁর আশেপাশের সব রাজাই আদিল শাহের কাছে আত্মসমর্পণ করেছেন, সেহেতু তিনিও তা ছাড়া কোন পথ দেখলেন না।’

মীর জুমলার এই জয়ে কুতুব শাহ তাকে নওরোজইখিলাত উপাধি দেন। তখন মীর জুমলা মধ্য বয়সে পৌছেছেন, যুদ্ধের ধকলে তিনি প্রচুর শক্তিও ক্ষয় করেছেন, এছাড়াও তাঁর দৈহিক অসুস্থতা(শিকস্তগি)ও সারানোর দরকার ছিল। তিনি সুলতানের কাছে মক্কা যাবার ছাড়পত্র চাইলেন। কুতুব শাহ যুদ্ধের আগে তাকে উপহার দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। এছাড়াও দীর্ঘ ২০ দিন ধরে অজীর্ণতা, নিদ্রাহীনতায় ক্রমাগত বমি করেছেন। বিগত পাঁচ বছরের নিত্যদিনের যুদ্ধে যাওয়ার কারণে তাঁর দীর্ঘ একতা রেস্ট এবং রোগ সারানোর দরকার ছিল।
(চলবে)

স্বধর্মে নিধনং শ্রেয় - একটি সুখকর অভিজ্ঞতা - হেরিটেজ ক্রুজে বাঙলা তথা ভারতের পরম্পরা

আমাদের জীবনের অধিকাংশ সময়ই জোড়াতালি দিয়ে চালাবার মত করে এগিয়ে যেতে হয়। মাঝে মাঝে এক্কাদোক্কা সময় এসে বন্ধুদের সঙ্গে ভাল কিছু ঘটা ঘটনার গল্প ভাগ করে নেওয়ার সুযোগ ঘটে। ঠিক তেমনই একটা ঘটনা ঘটেছিল চার বছর আগে, আবার গত কালই। প্রায় একই ধরণের কিছুটা।
কলাবতী মুদ্রার একটা নাচের দল আছে। আমরা মূলত ভারতের পুরোনো নাচগুলি, যাকে ঔপনিবেশিক ভাষায় ধ্রুপদী বলা হয় আর অধিকাংশ গ্রামীন নাচ যাদেরকে লোক বা আদিবাসী নৃত্য বলা হয়, সেগুলি দেখিয়ে থাকি। ভারতের বিভিন্ন স্থানে গিয়ে সেই সমাজের মানুষদের থেকে সেগুলি সংগ্রহ করে এবং দেখাই।
মাঝে মধ্যে চটুল নাচ করার যে চাপ আসে নি বলব না, কিন্তু আমরা অনড় থেকেছি। বলেছি, এটা হেরিটেজ ক্রুজ। যে বিদেশিরা বাংলায় ঐতিহ্যের সন্ধানে আসেন, তাদের সেটাই দিন। মুখ মুড়ে, তেতো খাওয়ার মত করে তারা মেনেও নিতেন। কেননা অতিথিরা সেগুলিই পছন্দ করতেন।
গত কালও আমাদের অনুষ্ঠান ছিল বোটানিক্যাল গার্ডেন জেটিতে - আমাদের দলের প্রত্যেক জন নৃত্যাঙ্গনা নাচ নিয়েই পড়াশোনা করেছেন। একজন তো গবেষনাও করেছেন - দুটি নৃত্য শৈলী নিয়ে।





 তো বছর চারেক আগে হেরিটেজ গঙ্গা ক্রুজ নামে একটি বাংলার গঙ্গা ধরে নানান স্থান দেখানোর একটি জাহাজে বেড়াতে আসা বিদেশিদের দলগুলিকে বাঙলা তথা ভারতের পরম্পরার নাচ দেখানোর জন্য বরাত পাই। কোন কিছুই না জেনে জাহাজে অনুষ্ঠানের জন্য গেলে দেখা গেল তারা চাইছেন চটুল নৃত্য 'বলিউডি' - কেউ কেউ যেচে এসে শুনিয়ে গেলেন এর আগে কয়েকজন মহিলা শুধু গোপন অঙ্গ ঢেকে চকমকে পোষাকে নাচ করতেন। আমাদের মন খারাপ। কিন্তু আমরা আমাদেরই পরিকল্পনার ডেঁটে থেকে রবীন্দ্র নৃত্য থেকে বাঙলার গ্রাম হয়ে ভারতের বিভিন্ন প্রান্তের নাচ দেখালাম। তাঁর পের ঘটনা অন্তত আমাদের কাছে ইতিহাস - এত ভাল অনুষ্ঠান এর আগে নাকি আর হয় নি। আজ, চার বছর পরে তাঁদের আরও দুটো জাহাজ যোগ হয়েছে, দুটোতেই আমাদের দল নাচ করছি।



তো আমরা দাবি করেছিলাম আমাদের প্রাচীন নাচগুলী দেখানো হোক। ওরা কেমন যেন রাজি হয়ে গেলেন। একটু ভয়ে ভয়েই ভারতনাট্যম, কথক, ওডিশি আর মণিপুরীর কিছু মৌলিক অঙ্গভঙ্গীমা আর হস্তমুদ্রা দেখালাম। হাততালি আর থামতে চায় না। ৫২ জনের দলের প্রত্যেকে এসে কলাবতী মুদ্রার নৃত্যাঙ্গনাদের সঙ্গে সানন্দে ছবি তুললেন।
এবার থেকে কর্তৃপক্ষ বিনীতভাবে চাইছেন আমরা অনুষ্ঠানে যদি আমাদের পরম্পরার কিছু নাচ নাচি - সঙ্গে সেগুলি বর্ণনা করে দিই।



'যতই হোক হেরিটেজ ক্রুজ!'

Friday, November 25, 2016

বাংলা যখন বিশ্ব সেরা১৫ - লাইফ অব মীর জুমলা, জেনারেল অব আওরঙ্গজেব

জগদীশ নারায়ণ সরকার

৬। জিঞ্জি
ব্রিটিশদের সঙ্গে মাদ্রাজে সন্ধি করে ১৬৪৭-৪৮এর শীতে মীর জুমলার নেতৃত্বে কুতুব শাহী বাহিনী চলল উত্তর থেকে জিঞ্জির দিকে। সেনাবাহিনী যতই এগিয়ে আসতে থাকে, বিপদের আশংকায় তাঞ্জোরের নায়ক থরথর করে কাঁপতে কাঁপতে মীর জুমলার সঙ্গে সন্ধি করে নিলেন। মীর জুমলার পরিকল্পনা ছিল জিঞ্জিকে উত্তর, পূর্ব এবং দক্ষিণ দিক থেকে আক্রমন করা। তিনি দক্ষিণ আর্কট জেলার তাঞ্জোরের তাণ্ডিভরম আর আসিউর(আলিউর?) দখল করলেন। মাদুরার তিরুমালার নায়ককে একদা তাঞ্জোরের নায়ক বিশ্বাসঘাতকতা করেছিল। তিনি এবারে শোধ নিতে বদ্ধ পরিকর হয়ে আদিল শাহকে তাঁর দূত পাঠিয়ে সমস্ত সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দিলেন। আদিল শাহ জিঞ্জি দখল করার মনস্থ করেছিলেন, কিন্তু জিঞ্জি গোলকুণ্ডার আশ্রয় চাইল। কুতুব শাহ শাহজাহানকে লিখে জানালেন জিঞ্জি আর তাঞ্জোরের জমিদার তাঁর নিরাপদ আশ্রয়ে রয়েছে। আদিল শাহ এই জোটের পূর্বলক্ষ্মণ হয়ত দেখতে পেয়েছিলেন। তিনি বুঝলেন মীর জুমলার কূটনীতিতে এই দুই নায়ক তাঁর বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছে। ফলে তিনি কুতুব শাহের প্রতি বিদ্বিষ্ট হয়ে উঠে মুজফফরাউদ্দিন খান মহম্মদ, খানইখানানকে রাজসভায় ডেকে গোলকুণ্ডা রাজ্য লুঠ আর দুর্গকে মাটিতে মিশিয়ে দেওয়ার নির্দেশ দিলেন। কিন্তু তাঁর এই আভিযান করতে কিছুটা দেরি করতে হল। শাহজাহানের দূত হামিম মহম্মদ হুসেইন আদিল শাহের রাজসভায় বললেন কুতুব শাহের নির্দেশে মীর জুমলা এই কাজটি করেছেন, এবং তিনি(দূত) দেখবেন যাতে আদিল শাহ যথেষ্ট ক্ষতিপূরণ পান। তারপর আদিল শাহ শাহজাহানকে অনুরোধ করেন এই এক তৃতীয়াংশ দুই তৃতীয়াংশ আহদনামার ভাগাভাগির বখরার, এবং এই পেশকাশ যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তাকে পাঠিয়ে দেওয়া হোক।

কিন্তু ১০ জানুয়ারি ১৬৪৮এ দেখা গেল এই ভাগাভাগিতে আদিল শাহ খুশি হননি। তিনি কুলবর্গার মুস্তাফা খানকে নির্দেশ দিলেন তুরুমালার নায়ককে নিয়ে জিঞ্জি দখল করার। তাঁর শেষ এবং সব থেকে বড় সৈন্য সজ্জা – ১৭০০০ ঘোড়া, ২০-৩০ হাজার পদাতিক সৈন্য তাঁর সঙ্গে ৩০ হাজার তিরুমালার সৈন্য(সঠিক যুদ্ধাস্ত্র বিহীন অনিয়মিত সেনা দল) যোগ করে মুস্তাফা খান এগিয়ে চললেন। হয়ত ঘটনার এই অগ্রগতি দেখে মীর জুমলা মার্চের ১৬৪৮এর বর্ষায় কাঞ্জিভরমের দিকে এগোলেন। দূরদৃষ্টিতে তিনি বুঝলেন ব্যপ্ত মাদুরা এবং মহিশূরের যৌথ বাহিনী নিয়ে আদিল শাহ ওয়ান্ডিওয়াশের দিকে এগোচ্ছেন। ভেলুগতির মত হিন্দু সেনানায়ক আর তাঁর গোলান্দাজ বাহিনী নিয়ে মীর জুমলা মুস্তাফার আগেই জিঞ্জি পৌঁছবার চেষ্টা করলেন, যাতে জিঞ্জি বীজাপুরের হাতে না পড়ে। বীজাপুরী ঐতিহাসিক জহুরি লিখছেন স্বাভাবিকভাবে মীর জুমলা ‘কিছুটা গণ্ডগোল পাকাতে চাইছিলেন’। জিঞ্জি রাজা এগিয়ে এসে মীর জুমলাকে স্বাগত জানিয়ে তিনি যে চুক্তি পালন করবেন, এবং বিশ্বাসঘাতকতা করবেন না, জানালেন। তখন দুটিই সুলতানি বাহিনী মাত্র ১০ মাইল দূরত্বে অবস্থান করছে। রাজা তখন মীর জুমলার বাহিনীর ২ মাইল আগে শিবির ফেলেছেন। মীর জুমলা খুব তাড়াতাড়ি রাজার সঙ্গে যোগ দিলেন। দুটি বাহিনীর মধ্যে এখন তফাত মাত্র আট মাইলের। মুস্তাফা বুঝলেন এই যৌথ বাহিনীর বিরুদ্ধে তাঁর আক্রমন কার্যকারী হবে না। তিনি আদিল শাহকে খুব তাড়াতাড়ি আরও বাহিনী পাঠাতে অনুরোধ করলেন। আদিল শাহ, ৭-৮০০০ সেনা বাহিনীর নায়ক সেনাপতি ইখলাস খান, রুস্তমইজামান, আফজল খাঁকে মুস্তাফা খাঁয়ের সাহায্যের জন্য পাঠাবেন ঠিক হল। অন্যদিকে কুতুব শাহ মনে করছিলেন আদিল শা রুস্তমকে পাঠিয়েছেন তাঁর হাত থেকে জিঞ্জি আর তাঞ্জোর দখল করার জন্য, তিনি শাহজাহানকে বিজাপুরের এই চুক্তি ভাঙ্গার ঘটনা বিবৃত করে পাঠালেন এবং মীর জুমলাকে কিছু দিন অপেক্ষা করতে নির্দেশ দিলেন। কেননা তাঁর বিশ্বসা পাদশাহ তাঁর পক্ষেই রায় দেবেন।

দুটি সেনা বাহিনী কোন ঘটনা ছাড়াই পরস্পরের বিরুদ্ধে মুখোমুখি বসে রইল। জিঞ্জি কার দখলে থাকবে, এই সিদ্ধান্ত কয়েক দিনের মধ্যেই দুপক্ষের বিরোধে পরিষ্কার হয়ে যাবে। কিন্তু বিজাপুর থেকে বাহিনী আসাতে দেরি হওয়ায় এবং আদিল শাহী সেনা বাহিনীতে সেনাপতিদের মধ্যে মতভেদ বাড়তে থাকায় মুস্তাফার ধারণা হল যে আপাতত কিছু দিনের জন্য দুপক্ষের মধ্যে যুদ্ধ বিরতির চুক্তি হোক। মীর জুমলা মুস্তাফার নেতৃত্বে বিক্ষুব্ধ সেনাপতিদের সঙ্গে তলে তলে যোগাযোগ করতে শুরু করে দিলেন। তাদের ইচ্ছে কুতুব শাহী বাহিনীর সঙ্গে চুক্তি বদ্ধ হওয়া।

যত দিন যেতে থাকে জিঞ্জির ভাগ্য কি হবে তা নিয়ে কিন্তু ভেতরে ভেতরে বিরোধ বাড়তেই থাকল। চুক্তিতে ঠিক হল জিঞ্জি জয়ের পরে মুস্তাফা খান জিঞ্জিতে থাকবে আর মীর জুমলা ফিরে যাবেন গোলকুণ্ডায়। দুজনই প্রকাশ্যে পরস্পরকে সাহায্যের কথা জানাতে থাকলেন। খানইখানান কিছুটা পিছিয়ে রায়চূরে শিবির গাড়লেন। অন্যদিকে মুস্তাফা জিঞ্জির দিকে আগ্রসর হয়ে ত্রিণোমালে চঙ্গম দুর্গ দখল করে রাখলেন। মীর জুমলা জিঞ্জির ৩০ মাইল দূরে তাঁর ভেলোরের আশ্রিত রাজ্য স্বারিগুন্টার শিবিরে ফিরে গেলেন, যেখান থেকে তিনি কুতুব শাহের পক্ষ থেকে প্রশাসন চালাচ্ছিলেন।

৩ জিকাদ ১০৫৮/৯ নভেম্বর ১৬৪৮ সালে মুস্তাফা খান মারা যাওয়ায় সীমান্ত চুক্তিতে ধাক্কা লাগার আশংকা দেখা দিল। প্রতিস্থাপিত সেনাপতিত্বের যায়গায় খান মহম্মদ আসার আগেই জিঞ্জির আবরোধ মালিক রাইহানের নেতৃত্বে হতে শুরু করল। খান মহম্মদ তখন নান্দিয়ালে তাদপার্তি দুর্গ দখলের লড়াই করছিলেন। রাইহান সেনাদের ২৫০০ হুন মাইনে দিয়ে অবরোধ আরও জোরদার করলেন। এই সুযোগ নিয়ে মীর জুমলা একাই জিঞ্জি দখল করার পরিকল্পনা করলেন। তাঁর ধারণা ছিল মুস্তাফা এবং খারিয়িত খান মারা গিয়েছে, তাদের সেনা বাহিনী ছন্নছাড়া হয়ে রয়েছে, সাহজী নিজে মানসিকভাবে দুমড়ে মুচড়ে রয়েছেন, মালিক রাইহান জিঞ্জি দখলের আগেই তিনি জিঞ্জি দখল নেবেন। মীর জুমলার অভিযানের পরিকল্পনার খবর পেয়ে মালিক রাইহান একটা কড়া বার্তা পাঠালেন, ‘আপনি দুর্গের এত কাছে আছেন, তাই আপনার এই কাজ আমাদের স্বার্থের বিরোধী। দুর্গের আধিবাসীরা আপনার সাহায্য চায়। আমার মনে হয় আপনি একটু দূরে গিয়েই অপেক্ষা করুণ। আদিল শাহী সেনার নিয়ন্ত্রণ আমার হাতে নেই। যদি কিছু ঘটে যায় তাহলে তাঁর দায়িত্ব আমি নেব না। মুস্তাফা খান হয়ত মারা গিয়েছেন, কিন্তু আমি এখনও জীবিত রয়েছি। আমি শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে লড়াই করে যাব।’ মীর জুমলাকে স্তব্ধ হতে হল। তিনি ভেলোরের ৪২ মাইল দূরে আরও উত্তরে কুডাপ্পা জয় করতে গেলেন। খান মহম্মদ সরকারি নির্দেশে তাদপার্তি থেকে অবরোধ জোরদার করতে এলেন।

কিন্তু মীর জুমলা জিঞ্জি দখলের সিদ্ধন্ত থেকে সরলেন না। শুরুর দিকে নায়কেদের সঙ্গে বন্ধুত্ব করে তিনি ১৬৪৬এর সীমান্ত চুক্তি এবং ১৬৪৮এর মুস্তাফার সঙ্গে চুক্তি সত্ত্বেও তাদের বিজাপুরের বিরুদ্ধে উস্কাতে শুরু করলেন। বিজাপুরের রাজকীয় ঐতিহাসিক ঝাউরিইবনঝাউরি লিখছেন, ‘বিশ্বাসঘাতক, দুর্মতি আবদাল্লা, যাকে রয়াল যুদ্ধে হারিয়ে দিয়েছিল, যে বিজাপুরের সমর্থন ছাড়া এক ইঞ্চিও কর্ণাটকের জমিও দখল করতে পারত না, সে অবিশ্বাসীর(রয়াল) সঙ্গে গোপন চুক্তি করে তাঁর সেনাপতি মীর জুমলাকে পাঠিয়ে হিন্দুর সহায়তায় হিন্দু রাজাদের খেপিয়ে জিঞ্জির সুরক্ষা করতে গেল।’ অনেক দূর থেকে মীর জুমলা খুব দেরি করে এসে পৌছলেন, ততক্ষণে একদিনেই খানইখানান জিঞ্জি দখল করে নিয়েছেন। তাঁর চুক্তি পালন না করে তিনি গোলকুণ্ডার দিকে পালিয়ে গেলেন।
জিঞ্জির পতনের পরেই বিজাপুরী সেনা হাতে তাঞ্জোর আর মাদুরার নায়কেরও পতন হল এবং তেগনাপত্তনমের মত সমুদ্রের আশেপাশের এলাকাগুলো লুঠ, খুনের অত্যাচার চলল। হিন্দু রাজারা রাজস্ব দিতে প্রতিশ্রুত হলেন। ডাচ নথি অবলম্বন করে ফস্টার লিখছেন, ‘ভারতের পূর্বাংশে... মুসলমান শক্তি কানাড়িদের জীবন অতিষ্ঠ করে তুলল। বিজাপুরী সেনা, প্রখ্যাত দুর্গ জিঞ্জিকে কেন্দ্রকরে সমগ্র জেলা দখল করল। তেগনাপত্তনমের প্রশাসক করা হল মলয়াকে’। অখুশি রয়াল মহীশূরের মায়কের আশ্রয়ে থাকতে থাকতে বিজাপুরের সঙ্গে যুদ্ধ প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতে থাকলেন। জেসুইট ধর্মপ্রচারকেদের বক্তব্য, ‘আদিল শাহী সেনা দুটি ক্ষমতাশালী রাজাকে হারিয়ে, অভূতপূর্ব পরিমানে সম্পদ দখল করে, একটাও যুদ্ধ না করে, একটাও সৈন্য না খুইয়ে বিপুল দেশটি জয় করে বিজাপুরে ফিরে যায়’।

কুতুব শাহ আদিল শাহকে অভিবাদন জানিয়ে চিঠি লেখে, সঙ্গে ৪ লাখ হুণ এবং জিঞ্জি পতনের সময় মুঘলদের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য চারটি রত্ন উপহারস্বরূপ পাঠায়। তাঁর প্রস্তাব ছিল কর্ণাট আর মুলুন্দএর জঙ্গলটি কারোর অধিকারে নেই, সেটি কুতিব শাহ নিজের অধিকারে নিতে চান, যাতে শত্রুর হাত থেকে রক্ষা পাওয়া যায়। আদিল শাহ এতে রাজি হন, গোন্ডিকোটা দুর্গ এবং গোটা কোক্কানুর কুতুব শাহকে দখলের জন্য দিলেন। যাইহোক, সামগ্রিকভাবে দেখা গেল, চুক্তি ভঙ্গ হতে হতে শেষ পর্যন্ত সীমান্ত চুক্তি সেই সময়ের জন্য পালিত হল।
(চলবে)

বাংলা যখন বিশ্ব সেরা১৪ - লাইফ অব মীর জুমলা, জেনারেল অব আওরঙ্গজেব

জগদীশ নারায়ণ সরকার

৫। বীজাপুর গোলকুণ্ডার কর্ণাটক ভাগাভাগি চুক্তি
কর্ণাটক দখলের দুই দক্ষিণী সুলতানি রাজ্যের প্রতিদ্বন্দ্বিতার আবহে, আহমদনগর দখলের পর প্রায় পঁচিশ বছর ধরে মুঘল পাদসাহ শাহজাহান দাক্ষিণাত্য বিজয়ের দীর্ঘস্থায়ী একটা অশুভ খেলা খেলতে থাকেন। এই বিজয় মুঘল সাম্রাজ্যের সামরিক বলে করতে হয় নি, বরং দুই সুলতানি রাজ্যের মধ্যে যে কূটনৈতিক লড়াই চলছিল, তাকে ব্যবহার করে মুঘলেরা চতুরতায় কাজটি হাসিল করে। এটি ঘটতে পেরেছিল অনেকটা ইনকিয়াদনামা(আত্মসমর্পণের ইচ্ছে) বা আহদনামা বা তা’হাহুদনামা(চুক্তি)র জন্য আর ১৬৩৬ সালের এপ্রিল-মে মাসের মধ্যে হওয়া সীমান্ত চুক্তি এবং মুঘল সাম্রাজ্যের ভয় দেখানোর রণনীতি আর দুই সুলতানি রাজ্যের মোঘল সাম্রাজ্য সম্বন্ধে অযথা ভয়ের পরিবেশ তেরি হয়ে যাওয়ার জন্য। দুটি রাজ্যের বৈদেশিক নীতি তৈরি হয়েছিল সাম্রাজ্যবাদী নীতি অনুসরণে এবং ঠিক সেই জন্যই দুটি রাজত্বের স্বাধীনতা পরাধীনতায় পরিণত হল। অন্য ভাষায় বলতে গেলে, সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্রীয় নীতির মদতে তারা আরও বড় রাজ্য জয়ের পথে যেতে পারল না বলেই তাঁদের স্বাধীনতার সূর্য অস্তমিত হল। কর্ণাটকে সীমান্ত নীতির ফলে তারা উত্তরের দিকে রাজত্ব জয়ের অভিযানে যেতে পারল না, তাঁদের অভিযানগুলি দক্ষিণের দিকে নিয়ে যেতে বাধ্য হল, যার জন্য তাঁদের রয়াল আর তাঁর নায়কদের লড়াইয়ের মাঝে পড়ে বিজয়নগর দখল করতে হল।

গোলকুণ্ডা এবং বীজাপুরকে পুর্ব এবং পশ্চিম কর্ণাটক দখলের নীতি প্রণয়নে মুঘলেরা যে প্ররোচনা দিয়েছিল, তার হাজারো পরোক্ষ সূত্র ছড়িয়ে রয়েছে সে সময়ের মুঘল ইতিহাস আর নথিতে। যদিও সরাসরি মুঘল সূত্র এই তত্ত্ব স্বীকার করে না। কর্ণাটকীয় আগ্রাসন সংক্রান্ত বিভিন্ন তেলুগু নথিতে মুঘল সম্রাট বলতে শাহজাহানকে না তাঁর প্রতিনিধি হিসেবে দাক্ষিণাত্যে মুঘল সুবাদার আলমগিরকে বোঝানো হয়েছে কি না তা নিয়ে যথেষ্ট বিভ্রান্তি রয়েছে। কিন্তু গাণ্ডিকোটা কৈফিয়িত নামক নথিতে পাচ্ছি, মুঘল সম্রাটের সরাসরি প্ররোচনায় গোলকুণ্ডা কর্ণাটক জয়ে উৎসাহিত হয়ে, ‘পাদশার উজির মীর জুমলা, আলমগীরের পক্ষে দক্ষিণে আসেন...’। মুঘল হস্তক্ষেপের একটা লেখর প্রমান রয়েছে। গুটি তালুকে উদ্ধার হওয়া তাম্র প্রশস্তিতে পাওয়া যাচ্ছে, পাদশা(পাচ্চায়ি)র হয়ে গোলকুণ্ডা কর্ণাটক এবং গুটি দখল করে।

কুতুবশাহী আক্রমন সংক্রান্ত নথিপত্রেও একই তত্ত্ব সমর্থনের তথ্য পাচ্ছি অর্থাৎ নীতি নির্ধারণে মুঘল সাম্রাজ্যের লুকোনো হাতের অস্তিত্ব, যাদের প্ররোচনায় সুলতান তাঁর সৈন্য নিয়ে কর্ণাটক আক্রমন করেন। পাদশাহ শাহজাহানকে লেখা আবদুল্লা কুতুব শাহ এক চক্রান্ত-পত্রেও এ ধরণের ধারনার প্রমান পাওয়া যায়,

১) কর্ণাটক রাজ্য থেকে লুঠ করা সম্পদের দুই তৃতীয়াংশ সম্রাটকে দেওয়ার অঙ্গীকার করা হয়;

২) রয়াল এবং তাঁর নায়কদের মধ্যে বিভেদ ঘটিয়ে যে চুক্তিপত্র স্বাক্ষরিত হবে, সে সময়ে পাদশাহের একজন আধিকারিক থাকবেন ঠিক হয়;

এরই সঙ্গে শাহজাদা দারার কাছে কুতুব শাহ, নিজেকে তাঁর আজন্ম শিষ্য(মুরিদ) হিসেবে উল্লেখ করে আর্জি পেশ করে (আর্জদস্ত) অনুরোধ করেন দাক্ষিণাত্যের গণ্ডগোলে তিনি যেন মধ্যস্থতার ভূমিকা পালন করেন।

অন্য দিকে এই তত্ত্বের পক্ষে সরাসরি সমর্থন পাওয়া যাচ্ছে ডাচেদের পক্ষ থেকে; ডাচ সূত্রে জানা যাচ্ছে, কর্ণাটক ‘আক্রমন করে, সেটিকে নিজেদের মধ্যে ভাগবাঁটোয়ারা’ করে নেওয়ার ‘নির্দেশ’ দুই সুলতানকে দিয়েছিল মুঘলেরা।
যখন সাম্রাজ্যবাদী নিয়ন্ত্রণে, দুই সুলতানের একের পর এক আক্রমনে ব্যতিব্যস্ত হয়ে উঠেছে কর্ণাটকের রয়াল রাজ্য, সে সময় পরস্পর সুলতানের বিরুদ্ধতা কাজে লাগাতে চেষ্টা করেন রয়াল। এক সুলতানের সেনার পক্ষ নিয়ে অন্য সুলতানের বিরুদ্ধে যুদ্ধের কাজে লাগাতে রয়াল একজনকে অর্থ, হাতি আর অন্যান্য উপঢৌকন দিয়ে বশ করে। এটা খুব কঠিন কাজ ছিল না, কেননা সেই দুই সুলতানের পরস্পরের মধ্যে গভীর ঈর্ষা আর অবিশ্বাসের বাতাবরণকে কাজে লাগানো হয়েছিলমাত্র। ফলে ইসলামিক আগ্রাসনের প্রাবল্যের গতি কিছুটা হলেও কমে গিয়েছিল সেই পদক্ষেপে।

শনৈ শনৈ দুই সুলতানের কাছে এই তথ্য পরিষ্কার হয়ে গেল যে দুজনের মিলিত আক্রমনের উদ্যোগ ছাড়া কর্ণাটক বিজয় সম্পন্ন হবে না, এবং অবিশ্বাসীর গাছটি(ট্রি অব দ্য ইনফিদেল)র শেকড় উপড়ে ফেলা যাবে না। আদিল শাহ বুঝতে পারলেন, ‘কুতুব শাহের সাহায্য ছাড়া রয়াল বিরুদ্ধে সফলভাবে যুদ্ধ করে জেতা যাবে না; ফলে তিনি কর্ণাটক দ্বিখণ্ডী করণের কুতুব শাহী প্রস্তাব মেনে নিয়ে রয়াল এবং অন্যান্য জমিদারের বিরুদ্ধে ধ্বংসক্রিয়ায় তাকে সামিল করে নিলেন’। ১৬৪৬ সালের মার্চ-এপ্রিলে দুই সুলতান ঠিক করলেন হিন্দু কর্ণাটকের রাজা শ্রী রঙ্গ’র রয়ালের রাজ্য, যুদ্ধের সামগ্রী, পণ্য, সোনাদানারত্নরাজি এবং নগদ অর্থ আলোচয়া সাপেক্ষে বিজাপুর আর গোলকুণ্ডার মধ্যে ভাগ হয়ে যাবে, যার মধ্যে দুই তৃতীয়াংশ পাবেন আদিল শাহ আর এক তৃতীয়াংশ পাবেন কুতুব শাহ।

সেই সময়ে এই সীমান্ত এবং রাজ্যভাগ চুক্তি দুই সুলতানি রাজ্যের পক্ষে খুবই সুখকর ঠেকল। বিজিত আদিল শাহী উজির নবাব মুস্তাফা খান কানাড়ি দেশ এবং কুতুব শাহী উজির মীর জুমলা পূর্ব কর্ণাটকের দিকে এগোতে থাকলেন। ১৬৬৪এর জুন মাসে বিজাপুরী সেনাধ্যক্ষ, মুলুন্দের দিকে এগোলেন। ব্যাঙ্গালোর জেলায় তাঁর সঙ্গে যোগ দেওয়ার প্রস্তাব দেওয়া হল মাদুরা, তাঞ্জোর আর জিঞ্জি ইত্যাদির নায়েক, দেশাই এবং আরও অন্যান্যদের। সেখান থেকে তারা রয়াল রাজধানী ভেলোরের দিকে এগোবেন। একই সঙ্গে কুর্নুলে থাকা খান মহম্মদকেও মূল বাহিনী অনুসরণ করতে নির্দেশ দিলেন। চলতি অবস্থা শ্রী রঙ্গর পক্ষে খুব মাথা ব্যথার কারণ হয়ে উঠল। যে মানিওয়ারেরা(নায়েক) এক সময় তাঁর অধীন ছিল আজ তাঁর বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে, এবং তাঁদের উকিল আর অন্যান্য পেশাদারদেরকে মুস্তাফা খানের কাছে পাঠিয়েছে আদিল শাহী সুলতানির পক্ষে আইনি আধীনতার জন্য কাগজপত্র তেরি করতে। চিন্তিত হয়ে রয়াল ১০ হাজার থেকে ১২ হাজার ঘোড়সওয়ার, এক লাখ পদাতিক এবং ১০০ হাতি পাঠালেন নায়কদের ভয় দেখাতে। জিঞ্জির রূপ নায়েক ভয় পেয়ে সরে দাঁড়ালেন। তাঞ্জোরের নায়েক বিজয়ার্গভ আর মাদুরার নায়েক তিরুমালা খালপত্তনমে(কয়ালপত্তনম)হাজারো রত্নখণি নিয়ন্ত্রণ করতেন; তারা রয়ালের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার পরিকল্পনায় এড়ে রইলেন। রয়াল বুঝলেন তারা মুস্তাফার সঙ্গে যোগ দিয়ে তার রাজত্ব দখল করবেই। রয়াল শান্তি প্রস্তাব দিয়ে ভেলোরের কাছে কানোয়ি পাসে তাঁর ব্রাহ্মণ গুরু ভেঙ্কান্না সোমাইয়াজী(সোমাজী)কে নবাব মুস্তাফার সঙ্গে সাক্ষাত করতে পাঠালেন। নবাবের শান্তি শর্ত(নায়েকদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ পরিকল্পনা থেকে রয়ালকে সরে আসতে হবে, এবং পিছিয়ে ভেলোরে চলে যেতে হবে) শুনে ফিরে এসে রয়ালকে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হতে পরামর্শ দিলেন, গুরু। মুস্তাফা খান তখন জগদেব দেশ জয় করতে গেলেন।

একই সময়ে নবাব মীর জুমলা উদয়গিরি দখল করে গোটা পূর্ব উপকূল, নেলোরের দক্ষিণ এবং সেন্ট জর্জ দুর্গের আশেপাশের অঞ্চল দখল করতে উঠেপড়ে লাগলেন। উত্তর আর্কোটের টোন্ডামানাদ, তিরুপ্তি এবং চন্দ্রগিরি ১৬৪৬এর এপ্রিল মাসের আগেই দখল হয়ে গিয়েছে। ১১ ডিসেম্বর পুলিকটের আশেপাশে থাকার সময় ডাচেরা অগ্রগামী গোলকুণ্ডা বাহিনীর আলোচনা সুরু করে বশ্যতা স্বীকার করল। তিনি ডাচ দুর্গের সুরক্ষার ব্যবস্থা দেখে খুবই প্রভাবিত হলেন। যুদ্ধের আবহেই প্রচুর আলোচনার টানাপোড়েনের পর তিনি ডাচেদের এলাকায় কাসিম মাজানদারিনিকে থানাদার নিয়োগ করেন। তিনি শুধু পুলিকটই নয়, স্যান থোমেরও প্রশাসন হাতে নিয়ে রাজ্যজুড়ে শান্তি বজায় রাখায় ব্যবস্থা করে হিন্দু শক্তি দমনের দিকে এগোলেন। মীর জুমলা পুলিকট থেকে এগোবার পথে সমস্ত রাস্তা জুড়ে বাড়ি ঘরদোর পুড়িয়ে মানুষ খুন করে, বিপুল ধ্বংসলীলা চালাতে থাকেন। স্থানীয় অভিজাতরা তাঁর সঙ্গে যোগ দেয়। এলাকার পর এলাকা জনশূন্য হয়ে পড়ে। তাঁর পৌঁছবার আগেই পোন্নারি, পূনামালি, কাঞ্চি(কাঞ্চিভরম), এবং চিঙ্গিলপুট(যেটি সপ্তম স্বর্গের সঙ্গে তুলনীয়)র পতন হতে থাকল একের পর এক, জনশূন্য এলাকা দখল করতে করতে এগোতে লাগলেন। ৪ জানুয়ারি ১৬৪৭এ জানা গেল রাজার সকাশে(ভেলোর) পৌঁছবার জন্য মাত্র দু দিন হাতে রয়েছে। দেশজুড়ে বিপুল মন্বন্তর নেমে এল, কেউ মীর জুমলার বিরোধিতা করতে এগিয়ে এলেন না।

বিজাপুরী আর কুতুব শাহী সেনার হাতে ভেলোরে হিন্দু সেনাপতি ভাইলুয়ারের চরম বিপর্যয়ের পর রয়াল আত্মসমর্পনের অঙ্গীকার করেন এবং যুদ্ধের ক্ষতিপূরণ হিসেবে ৫০ লক্ষ হুণ আর ১৫০টি হাতি দিতে বাধ্য হন(এপ্রিল, ১৬৪৭)। বিজাপুরের আত্মসমর্পণের শর্ত কুতুব শাহ মেনে নেন না। যদিও নায়কেরা নতুন করে রয়ালের পাশে দাঁড়াবার অঙ্গীকার করতে থাকেন, এবং দেশের স্বাধীনতার পতাকা উর্ধ্বে তুলে ধরার নিশ্চয়তা দিতে থাকেন, কিন্তু ততদিনে বহু দেরি হয়ে গিয়েছে। নায়কদের মধ্য কলহ তাদের পতনের কারণ হল। তাঞ্জোর আর জিঞ্জির সামরিক ক্ষমতা এতই সীমিত ছিল যে তারা আক্রমণকারীদের বিরুদ্ধে কোনই প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারে নি। মহীশূর আর মাদুরার যৌথ সেনা দল বিজাপুরের মুস্তাফা খানের সাহায্যে ওয়ান্ডিওয়াসে মীর জুমলার বিরুদ্ধে দাঁড়ালেও, মীর জুমলা কয়েকজন হিন্দু সেনাপতি যেমন ভেলুগতির প্রধানকে সঙ্গে নিয়ে তাদের সমস্ত প্রতিরোধ উপড়ে ফেলেন।

১৬৪৭ সালে মাদ্রাজে ব্রিটিশদের সঙ্গে সন্ধি করায় মীর জুমলা পিতলের বন্দুক পেলেন। তাঁর বদলে বাণিজ্য সুবিধা দিলেন। অক্টোবরে ব্রিটিশ কুঠিয়ালেরা সমীক্ষা পত্র পাঠিয়ে জানাল যে গোলকুণ্ডার রাজা মোটামুটি সমগ্র রাজত্ব জয় করে নিয়েছেন, এবং আনাবব(নবাব) উপাধিতে দেশ শাসন করছেন।
(চলবে)

বাংলা যখন বিশ্ব সেরা১৩ - লাইফ অব মীর জুমলা, জেনারেল অব আওরঙ্গজেব

জগদীশ নারায়ণ সরকার

৪। কর্ণাটকে নীর জুমলার দ্বিতীয়বার অভিযান
পূর্ব কর্ণাটক জয়ের সুলতানি গোলকুণ্ডার প্রচেষ্টা এক ধাক্কায় ধুলিতে মিশে গেল। মীর মহম্মদের অনুপস্থিতিতে গাজি আলির অযোগ্য নেতৃত্ব যে গোলকুণ্ডা বাহিনীর সাময়িক পশ্চাদপসরণ হয় সেটা নিশ্চিত। সেই মুহূর্তে গোলকুণ্ডার বাহিনী এতই হতচকিত হয়ে পড়ে যে ঘুরে দাঁড়িয়ে নতুন করে আক্রমন শানাবার কথা তাঁদের মনে আসে নি।
একদিকে কুতব শাহকে চেষ্টা করতে হচ্ছিল তাঁদের পশ্চাদপসরেণের সুযোগে যেন বিজাপুর কোন জমি দখল না নিতে পারে, অন্য দিকে কর্ণাটকের যতটুকু জমি তাঁদের দখলে রয়েছে, তা ধরে রাখতে নিজের বাহিনীর জন্য সম্পদ আর অতিরিক্ত বাহিনী পাঠানোর ব্যবস্থা করা। ১৬৪৪এর শেষে এবং ১৬৪৫এর প্রথম পাদে গোলকুণ্ডাকে, ছোট ছোট রাজা নিয়ে জোট করা রয়্যালের সঙ্গে যুদ্ধ সাময়িকভাবে থামিয়ে দিয়ে শান্তি চুক্তি করতে হয়। কুতুব শাহী কূটনীতি পিছু হঠলমাত্র। কিন্তু নায়কেরা দুই সুলতানের সাহায্য চেয়ে বসায় তাঁর পররাজ্য আক্রমনের বাসনা আবার জেগে উঠল। সুলতান নতুন করে মীর মহম্মদ, বর্তমানের মীর জুমলার জয়ের আস্বাদ মিটে যেতে না যেতেই দ্বিতীয়বার রাজ্য জয়ে পাঠালেন।

সময়টা যেন মীর জুমলার নতুন অভিযানের জন্যই যেন অপেক্ষা করছিল। কর্ণাটক যুদ্ধে যুদ্ধে আর দুর্ভাগ্যের ভারে ক্ষতবিক্ষত। রয়্যালও সমস্যার ভারে বিপর্যস্ত। গোলকুণ্ডার চাপে ডাচেরা তাঁর বিরুদ্ধে যুদ্ধে নেমেছে, ১২ আগস্ট ১৬৪৫ থেকে সুরক্ষিত পুলিকট ডাচ কুঠি তাঁর হাতে রুদ্ধ। অন্য দিকে গৃহযুদ্ধ লেগেছে - তাঞ্জোর, মাদুরা এবং সিনসিদার(জিঞ্জি)এর নায়কদের সঙ্গেও লড়াই চলছে সমানতালে। ১৬৪৫ সালের ডিসেম্বরে নায়কদের যৌথ বাহিনী রয়্যালের সেনাবাহিনীকে হারিয়ে দেয়। ফলে পুলিকটের অবরোধকে জোরদার করতে রয়্যাল চাহিদার ভগ্নাংশ মাত্র ৪০০০ পদাতিক আর কিছু খাবারদাবার আর গোলাবারুদ পাঠাতে পেরেছে। বিজাপুরের রয়্যাল রাজ্য আক্রমণের খবর গোলকুণ্ডার হর্ষ বৃদ্ধি করল। ১৬৪৬ সালের শুরুতে আদিল শাহি সেনাপতি মুজফফরউদ্দিন খান মহম্মদ, খানইখানান, কুর্নুলের নান্দিয়ালসহ অঞ্চলের আটটি দুর্গ দখল করে সেই বছরের বসন্তে পশ্চিম দিক থেকে অগ্রসর হয়ে কর্ণাটক বালাঘাট দখল করেন। ব্রিটিশেরা অবস্থা বুঝে তাঁদের নথিতে মন্তব্য করল, ‘মুসলমানের নতুন করে ছেড়ে যাওয়া এলাকা দখল করতে শুরু করেছে’।

এই সব একসঙ্গে ঘটে যাওয়া চলচ্চিত্রসম ঘটনার সুযোগে সুসজ্জিত এবং চরম দক্ষ ইওরোপিয় গোলান্দাজ এবং বন্দুকচি বাহিনী নিয়ে মীর জুমলা উত্তর আর পূর্ব দিক থেকে রয়্যালের এলাকা আক্রমন করে। দামরালার সিংহাসনে মাল্লাইয়া (চিন্নানা)কে বসান রয়্যাল। তাঁর ছিল ৫০ হাজার সেনা। তিনি চেষ্টা করছিলেন আক্রমনকারী মুসলমান বাহিনীকে তাঁর রাজ্য থেকে দূরে রাখার। গোলকুণ্ডার আক্রমনের সামনে পড়ে ডাচেদের অবরোধ থেকে বিপুল সংখ্যক বাহিনী তুলে নেওয়া হয়। মাত্র হাজার খানেক সেনার অবরোধ ভাঙতে ডাচেরা নতুন করে আক্রমন শানায় কিন্তু রয়্যালের খুব কম ক্ষতি হয়। অবরোধ চলতে থাকে। রাজা ডাচেদের থেকে বিপুল অঙ্কের ক্ষতিপূরণ চেয়ে বসে; না পেলে অবরোধ তুলতে রাজি নন জানিয়ে দিলেন।

কিন্তু ডাচেদের বিরুদ্ধে রয়্যালের সাফল্য মীর জুমলার আক্রমণে ছিন্নভন্ন হয়ে গেল। পাঁচ মাসের মধ্যে কৃষ্ণা নদী পেরিয়ে কুর্নুল জেলার কাম্বামে পৌঁছে এরাগোন্দাপালেমের প্রায় অজেয় দুর্গ দাদ্দানালা দখল করলেন। নায়ক নিহত হলেও এখানে আবার মীর জুমলা তাঁর ফলিত কূটনীতি অবলম্বন করে নিহত নায়েকের পুত্রকে নগদ ৫০ লক্ষ প্যাগোডা আর বছরে এক লক্ষ প্যাগোডার বিনিময়ে দুর্গটির স্বত্ব অর্পণ করে যান। রয়্যাল রাজত্বের পূর্বাঞ্চলের মুকুট রাজধানী উদয়গিরি মীর দখল করলেন। ব্রিটিশ সূত্রে জানতে পারছি ২১ জানুয়ারি আর ১০ ফেব্রুয়ারির মধ্যে মুসলমান সেনানায়ক রয়্যালের রক্ষণের তিনটে গুরুত্বপূর্ণ দুর্গ দখল করলেন। উদয়গিরি দখল হল বিশ্বাসঘাতকতায়। ডাচেদের বিরুদ্ধে লড়াই করে প্রায় জিততে বসা রয়্যালের সেনানায়ক মাল্লাইয়ার দুর্গ ঘিরে রাখে মীর জুমলা। ৫০ হাজার সেনা থাকা সত্ত্বেও সে মীর জুমলার সঙ্গে বোঝাপড়া করে, নিজে আর তাঁর সৈন্যের স্বাধীনতার আশ্বাস নিয়ে দুর্গটা তুলে দেয় গোলকুণ্ডার দখলে।

উদয়গিরি দখল করে মীর জুমলা পশ্চিমের পানে যেতে যেতে কুডাপ্পা জেলার চিট্টিভেলির ছটা দুর্গ দখল করেন। মালটি সমাজে প্রধান দ্বিতীয় অনন্ত শুধু যে তাঁর রাজ্য হারালেন তাই নয়, তাকে বিপুল অর্থ ক্ষতিপূরণ দিতে হল।
(চলবে)

বাংলা যখন বিশ্ব সেরা১২ - লাইফ অব মীর জুমলা, জেনারেল অব আওরঙ্গজেব

জগদীশ নারায়ণ সরকার

গাজি আলির সেনাপতিত্বে কুতুব শাহি বিপর্যয়
মীর জুমলা কর্ণাটক থেকে গোলকুণ্ডা রাজসভায় যাওয়ার পর্বে সেনাবাহিনীর দায়িত্ব পেলেন গাজি আল বেগ। নেতৃত্ব আরও জোরদার করতে সুলতান তাঁকে পাঠালেন সৈয়দ মুজফফর, শাহ গজনফর খান, বিজাপুরের রুস্তমইজামানের জামাই এবং অন্যান্য সেনা আধিকারিককে। কিন্তু সেনাবাহিনীর নেতৃত্বের পরিবর্তন গোলকুণ্ডার রাজ্যজয়ের পক্ষে শুভ হল না।

শ্রী রঙ্গ প্রাণপনে চেষ্টা করছিলেন গোলকুণ্ডার বিরুদ্ধে রণনীতির গুটিগুলি সাজানোর। বিজয় নগরের শেষ প্রভাবশালী নরপতি শ্রী রঙ্গ’র ছিল অসাধারণ ব্যক্তিত্ব। তিনি ক্রমশঃ মীর জুমলার আক্রমণের প্রাবল্য থেকে সেরে উঠছিলেন। যুবরাজ থাকাকালীন তিনি নিজের ঘনিষ্ঠ আত্মীয়ের বিরুদ্ধে বিজাপুরী হানাদারদের সঙ্গে হাত মিলিয়েছিলেন। কিন্তু ক্ষমতা হাতে পেয়ে তিনি তাঁর পূর্বের অবস্থান থেকে সম্পূর্ণ ঘুরে গিয়ে মুসলমান আক্রমনকারীর বিরুদ্ধে দক্ষিণের হিন্দু রাজাদের একজোট করতে সচেষ্ট হলেন, এমনকি ডাচেদের সাহায্যও প্রার্থনা করলেন। প্রাথমিকভাবে শ্রী রঙ্গ তাঁর সভার ষড়যন্ত্রীদের খতম করলেন। তারপর তাঁর কাছাকাছি মাদুরার তিরুমালা নায়েককে ধ্বংস করতে উদ্যমী হলেন। কিন্তু তিরুমালার নায়েক তাঞ্জোর আর জিঞ্জির নায়েকদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে তাঁদের যৌথ শত্রুর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুললেন। শ্রী রঙ্গ জিঞ্জির নায়কের বিরুদ্ধে বিপুল সেনাবাহিনী নিয়ে লড়তে গেলেন। তিরুমালার নায়েক বৃহত্তর দেশভক্তিকে চুলোয় দিয়ে শ্রী রঙ্গর বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নিতে গোপনে গোলকুণ্ডার সঙ্গে যোগাযোগ করতে শুরু করেন, উত্তর দিক থেকে সুলতানকে, শ্রী রঙ্গর রাজধানী ভেলোর আক্রমণ করতে প্ররোচিত করে। এই সংবাদের শ্রী রঙ্গ জিঞ্জি থেকে তাঁর রাজ্যে ফিরে যেতে বাধ্য হন এবং তাঁর সঙ্গে হাত মেলায় পশ্চিম উপকূলের ইক্কেরির নায়ক। কিন্তু শ্রী রঙ্গ তাঁর রাজধানীতে ঢুকে লুঠেরা গোলকুণ্ডার সেনা (১৬৪৩-৪৪)কে রাজধানী ছাড়া করে। দামরালা ভেঙ্কটাপ্পাকে গোলকুণ্ডার সঙ্গে হাত মেলাবার আগেই তিনি গ্রেপ্তার করেন। মীর জুমলা, বিজাপুরী সেনাপতিদের ১৫ লক্ষ প্যাগোডা এবং ১৫টি হাতি দিয়ে কিনে নিয়ে অভেদ্য উদয়গিরি দখল করার কাণ্ডে মানসিকভাবে ক্ষতবিক্ষত আদিল সাহের ঈর্ষা আরও বেশি জ্বালিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করলেন শ্রী রঙ্গ। কর্ণাটকের বালাঘাটে তখন ছিল বিজাপুরী ৬০০০ গোলান্দাজ আর ২০০০০ পদাতিক সেনা। রয়্যাল তাঁদের আক্রমন করে সেখান থেকে কুতুবশাহী সেনাকে উতখাত করলেন(জানুয়ারি ১৬৪৪)। তিনি এবারে তাঁর অভিজাতদের বিরুদ্ধে কড়া পদক্ষেপ নিতে শুরু করলেন – জিঞ্জি, তাঞ্জোর আর মাদুরার নায়েকদের পাশে দাঁড়ানোর জন্য বিপুল অর্থ দাবি করে বিজাপুরকে সেই অর্থ দিয়ে পাশে দাঁড়ানোর ঋণ শোধ করলেন আর জিঞ্জির হাত থেকে আর্নি দখল নেওয়ার ইচ্ছে প্রকাশ করলেন।

কিন্তু শ্রী রঙ্গর পক্ষে একই সঙ্গে তাঁর রাজ্যের ভেতর আর বাইরের, দু ধরণের শত্রু বিরুদ্ধে লড়া খুব সহজ হল না। নিজের রাজ্যে ক্ষমতায় থাকা তাঁর আত্মীয় আয়াপ্পা দারমালার আক্রমনের ধাক্কায় দারমালা ভেঙ্কটাপ্পাকে মুক্তি দিতে হল এবং তাঁদের ক্ষমতা ফিরিয়ে দিতে হল। অন্যদিকে যে কোন মুহূর্তে ভেঙ্কটগিরি দখল করে রাখা গোলকুণ্ডা সেনা বাহিনীর আক্রমনের আশংকাও তিনি করছিলেন।

৬৪৪এর ১৪জুলালাইএর মাঝামাঝি কুতুব শাহী সেনাবাহিনী কাসি আলি(গাজি আলি)র নেতৃত্বে কোন বাধা ছাড়াই পুলিকটের কাছাকাছির শহরগুলি শহর দখল করে। এবং আরও অগ্রসর হয়ে ডাচেদের বাণিজ্য সুবিধা রেখেই তাঁদের আত্মসমর্পণ করতে নির্দেশ দেয়। ব্রিটিশেরা আশঙ্কা করছিল সেন্ট জর্জেও গোলকুণ্ডার আক্রমন আসতে পারে। কিন্তু আক্রমণকারীরা ডাচ সেনাপতি হিউসেনের জবরদস্ত প্রতিরোধ ভেঙ্গে গড়টি দখল করতে পারল না। উল্টোদিকে জিঞ্জির বিদ্রোহী নায়েক, গাজি আলির আক্রমনের আগেই রয়্যালকে আক্রমনের পরিকল্পনা করছিল পিছন থেকে। খবর পেয়ে রয়্যাল জিঞ্জির সঙ্গে চুক্তি করে হিন্দু সেনাপতি কিস্টাপ্পা নায়েককে তুলে নেন এবং চিন্নানা(মালাইয়া)কে আবার ক্ষমতায় বসান। কিস্টাপ্পা এবং ভেলুগতি শিঙ্গা হঠাৎ করে মুসলমান বাহিনীকে ভেঙ্গাল্লু হ্রদের সামনে(২১ আগস্ট ১৬৪৪) আক্রমন করে। গোলকুণ্ডার সেনাবাহিনীর প্রভূত ক্ষতি হয়। যৌথ বাহিনী তাদের আরমাগাঁও থেকে উদয়গিরি ছাড়িয়ে তাড়িয়ে দিয়ে আসে। মীর জুমলার বীরত্বপূর্ণ কাজ ধুলিতে মিশে গেল।
(চলবে)

বাংলা যখন বিশ্ব সেরা১১ - লাইফ অব মীর জুমলা, জেনারেল অব আওরঙ্গজেব

জগদীশ নারায়ণ সরকার

খ) গোলকুণ্ডা
১৬৪৫এর আগেই বিজাপুর যত তাড়াতাড়ি পশ্চিম কর্ণাটক দখল করতে পেরেছিল, ঠিক সেই দ্রুততায় গোলকুণ্ডা পূর্ব কর্ণাটকের উচ্চ এলাকা(বালাঘাট) দখল করতে পারে নি। ১৬৪২ সাল পর্যন্ত কুডাপ্পার জেলার উত্তর-পূর্ব দিকের শুধু কাম্বমই দখল করতে পেরেছিল গোলকুণ্ডা। দক্ষিণ-পূর্ব দিকে যেতে বেশ সময় লেগেছিল।

কর্ণাটক দখলের লড়াইতে পেছনে পড়ে থাকতে ইচ্ছুক ছিলেন না সুলতান আবদুল্লা কুতুব শা, তিনি এই কাজে তার সরইকাহিল মীর মহম্মদকে অবস্থা বদলাবার দায়িত্ব দিলেন। মীর মহম্মদ বললেন তিনি সম্পূর্ণ অবস্থার পরিবর্তন করে দেখিয়ে দেবেন। ওয়ারিস জানাচ্ছেন, ‘কুতুবউলমুল্কের একজন নায়েকও এক একর জমি দখল করতে না পারলেও মীর জুমলা বিশাল বিশাল দুর্গ দখল করতে সক্ষম হয়েছিলেন’।

২। মীর জুমলার প্রথম যুদ্ধযাত্রা
বিজয়নগরের অবস্থা এওই দুর্দশাগ্রস্ত হয়ে পড়েছিল যে সুলতানের স্বপ্ন শুধু সাকার হওয়া সময়ের অপেক্ষা ছিল মাত্র। এর রাজা ভেঙ্কটপতি বা তৃতীয় ভেঙ্কট(১৬৩০-৪২) তার প্রথম পাঁচ বছরের রাজত্ব কালে তার রাজ্যের মধ্যেই বিদ্রোহের আঁচ পাচ্ছিলেন। জিঞ্জির নায়কের সঙ্গে তাঁর চুক্তির প্রভাবে অসস্তুষ্ট হয়ে তাঞ্জোর আর মাদুরার নায়েক ১৬৩৭ সালে তাঁর বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেলেন। এর আগে উপর্যুপরি বীজাপুরী আক্রমনে রয়্যালদের সম্পদ আর আত্মরক্ষার দক্ষতা ভেতর থেকে ক্ষয়ে গিয়েছিল। এর পর মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা হয়ে দেখা দিল নিজের পরিবারের মধ্যে দ্বন্দ্ব। তাঁর ভাইপো শ্রী রঙ্গ কাকার সঙ্গ ছেড়ে বীজাপুরের পক্ষে যোগ দেয়। ফলে তৃতীয় ভেঙ্কট মাদ্রাজপত্তম আর পুনামাল্লির (৪০০০০ সেনা বাহিনীর) প্রধান ভেলুগতি তিম্মা, দামরালা ভেঙ্কটার সাহায্য সত্ত্বেও খুব বেশি লড়াই দিতে পারেন নি।

১৫০২/১৬৪২এর এপ্রিলে ৪০০০০ পদাতিক, ৪০০০ ঘোড়সওয়ার আর গোলান্দাজ, আলি রাজা খাঁ(কোন্ডাভিডুর সরইলস্কর, রাজাকীয় বাহিনীর প্রধান), গাজি আলি বেগ(মারাঠা অশ্বারোহী বাহিনীর প্রধান), আলম খাঁ পাঠান, আইনুল মুল্ক, সুজাউলমুল্ক, দাদাজী কান্তিয়া এবং আসির রাও, ভেঙ্কটা রেড্ডি এবং অন্যান্য নাইকোয়ারের মত বেশ কিছু হিন্দু এবং মুসলমান সেনাপতি নিয়ে এগিয়ে চললেন। বাজার দরে খাবার কেনা হল, খবর চালাচালির জন্য রাজসভার সঙ্গে বিভিন্ন একালায়(ডাকচৌকি)পায়রার ডাকের ব্যবস্থা করা হল।

উপকূলের সেনা শিবির কোণ্ডাইভু থেকে থেকে সৈন্য নিয়ে মীর মহম্মদ নেল্লোরের সমতলে কোন বড় প্রতিরোধ ছাড়াই পৌঁছলেন এবং স্থানীয় দুর্গের সেনাদের আক্রমণ রুখে আটটা বড় দুর্গ দখল করতে সক্ষম হলেন। এর পরে আরও দক্ষিণের দিকে আসবেন মনস্থ করলেন। কিন্তু তাঁর জন্য চাই রাজধানী থেকে দক্ষ সুড়ঙ্গ খোঁড়ার কর্মী। বিশেষ করে যদি সেই অঞ্চলের সুরক্ষিততম দুর্গ ডুম্বুরু(বা দান্দারুলু) দখল করতে হয়। ২০-১-১০৫২/১১ এপ্রিল ১৬৪২ সালে দুর্গের ট্রেঞ্চ খোঁড়া শুরু হল। তারপরে তিনি আরমাগাঁও আর পুলিকটের মধ্যের শ্রীহরিকোটা দ্বীপ এবং ২১ এপ্রিল ১৬৪২ সালে আরও কিছু দুর্গ দখল করলেন রয়্যাল, টিম্মা আর দামারলা ভেঙ্কটের যৌথ বাহিনীর প্রতিরোধ ভেঙ্গে। ভেঙ্গে পড়ে রয়্যাল চিত্তোরের পাহাড়ে আশ্রয় নিলেন এবং ছ মাসের মধ্যে, ১০ অক্টোবর ১৬৪২ সালে মারা গেলেন। তাঁর উত্তরাধিকারী হিওসেবে শ্রী রঙ্গ সিংহাসনে আরোহন করলেন তৃতীয় শ্রী রঙ্গ রূপে ২৯ অক্টোবর ১৬৪২-১৬৮১।

শ্রীহরিকোটা দখল আসলে মীর জুমলার রণনীতর চাতুর্য প্রমান করে। শ্রীহরিকোটা উত্তরে আরমাগাঁও এবং দক্ষিণে পুলিকটের মধ্যে গোঁজ হয়ে রইল। ফলে খুব তাড়াতাড়ি তিনি আরমাগাঁওএর আশেপাশের এলাকা দখল করতে পারলেন। যদিও একটা বড় অংশ তখনও শ্রীরঙ্গ’র আয়ত্তে ছিল – তিনি বিপুল পরিমান সৈন্যদল ভেঙ্কটগিরি আর আরমাগাঁওতে তেরি রেখেছিলেন। ব্রিটিশ কুঠিয়ালদের নথির মন্তব্য সূত্রে পাচ্ছি, আরমাগাঁও এলাকার নায়েকদের ‘দেশ থেকে তাড়া খেয়ে বেড়াতে হচ্ছে, একদিকে রয়্যাল অন্য দিকে সুলতানি সেনার চাপে তারা ব্যতিব্যস্ত। মুসলমানেরা চাওলা গেলডানকেতে মূল শিবির তৈরি করেছে’। তাঁদের বিশ্বাস হচ্ছিল যে খুব কম সময়ের মধ্যে এলাকাটি মুসলমান শাসনের আওতায় চলে আসবে। তারা রঙ্গ করে লিখল, ‘একদিকে গোলকুণ্ডার রাজা, অন্যদিকে বিজাপুরের রাজার শাঁড়াশি আক্রমন, অথচ দেশিয়রা(জেন্টুজ) নিজেদের মধ্যে বিভেদের খেলায় মত্ত। ফলে তারা আর তাঁদের দেশের শাসন ধরে রাখতে পারবে না।’

নেল্লোরকে মূল ঘাঁটি করে বর্ষার পরপরই গোলকুণ্ডার সেনা বাহিনী ঝটিতি আক্রমণ করে নাকবাত, রাপুর (১৯.১০.১০৫২/৩১ ডিসেম্বর ১৬৪২) কাল্লুর(২৪.১০.১০৫২/৪.১.১৬৪৩) দুর্গ দখল করে ফেলল। প্রথম দুর্গটির সেনাবাহিনী আক্রমনকারীদের কথা শুনে পালিয়ে গেল। আর দ্বিতীয় দুর্গের লড়াইতে গোলকুণ্ডা ১০-১২ হাজার ঘোড়সয়ারওয়ালা আদিবাদী সাংগ্রেজরাজকে বিশাল জঙ্গলের মাঝে ফেলে হারাল। জঙ্গল পরিষ্কার করে আক্রমণকারীরা সেখানে মীর মহম্মদের নেতৃত্বে দুটো ছোট দূর্গ তৈরি করল। মুসলমান সেনা নেতার অধীনে ছিলেন যেমন দুজন মুসলমান নেতা খাইরাত খাঁ এবং সৈয়দ মহম্মদ মাজানদারানি ছিলেন, তেমনি ছিলেন দুজন রেড্ডি ভাই ভেঙ্কট আর তিম্মা আর রাওয়াজী কান্তিয়া। কুল্লুরের দুর্গ দখলের যুদ্ধ প্রায় একমাস স্থায়ী হয়(২৪-১০-৫২/৪-১-৪৩ শেষ শাওয়াল ১০৫২ জানুয়ারি ১৬৪৩)। রয়্যাল বিশাল সেনা বাহিনী নিয়ে তিরুপতিতে অপেক্ষা করছিলেন(মার্চ এপ্রিল ১৬৪৩)।কিন্তু তাঁর বাহিনীর বিপক্ষের জোরদার যুদ্ধের এবং অস্ত্রশস্ত্রের খবর আর বাহনীর মধ্যেই অসন্তোষ যেমন কালাহস্তির দামারালা ভেঙ্কটা এবং টুপাক্কি কৃষ্ণাপ্পা, কুতুবশাহীদের মনোবল বাড়িয়ে ভেল্লোরে চলে গেলেন। অন্যদিকে মীর মহম্মদ তাঁকে জোরজার না করে উদয়গিরিতে পৌঁছে গেলেন। উদয়গিরি তখন দুই শক্তির মধ্যে নিষ্পেষিত হচ্ছে। এটি ভালিকোণ্ডা পাহাড়ে অবস্থিত এবং এটি প্রায় অগম্য, শুধু একটি ঢোকার রাস্তাওয়ালা দুর্গ। মীর মহম্মদ মাল্লাইয়া নামক হিন্দু সেনাপতিকে প্রচুর সোনা ঘুষ দিয়ে, তাঁর থেকে গুপ্ত প্রবেশ পথ জেনে নেন(জুনের মাঝামাঝি, ১৬৪৩)। একের পর এক দুর্গের পতনের খবরের সঙ্গে প্রায় অজেয় দুর্গ উদয়গিরি পতনের খবর এল সুলতানের কাছে, ১০.৪.১০৫৩/১৮ জুনে ১৬৪৩, তিনি বিজয়ী সরইখাহিলকে মীর জুমলা পদের অভিষিক্ত করেন। তিনি রাজসভায় গিয়ে বিজয় উপহার দেন সুলতানকে এবং বেশ কিছু কাল তিনি সেই সভায় থাকেন।

১৬৪২ আর ১৬৪৩ সালে মীর জুমলার বীরত্বে পুলিকটের উত্তরের উপকূল এলাকার অধিকাংশই দখলে নিয়ে আসতে পারলেন সুলতান কুতুব শাহ। যে অসম্ভবকে সম্ভব করলেন মীর, তা হতে পারল তাঁর সামরিক বীরত্ব আর কূটনৈতিক চাতুর্যের দ্বারা, এবং বিজয়নগরের রাজপরিবারে দুটি অদক্ষ রাজা তৃতীয় ভেঙ্কট আর তৃতীয় রঙ্গ’র মধ্যে বিভেদ বীজে। ভেঙ্কটের অসুবিধেগুলো আগেই আলোচনা করা হয়েছে, আর শ্রী রঙ্গর সঙ্গে ভেঙ্কটের বিপুল ঝগড়ার জন্র শ্রী রঙ্গের সিংহাসনে আরোহন উনিশ দিন পিছিয়ে যায়। এই অবস্থা ব্যবহার করে গোলকুণ্ডা। নতুন রাজাকে অভিজাতদের অধিকাংশরই পছন্দ হয় নি বিশেষ করে কালাহস্তির ভেলুগতি ভায়েদের(দামারালা ভেঙ্কটাদ্রি বা ভেঙ্কটা এবং আয়াপ্পা)। এরা দুইভাই আগের রাজত্বে মোটামুটি রাজ্য পরিচালনা করত। এই বিক্ষুদ্ধরা জুটল গিয়ে গোলকুণ্ডার দলে। তাঁর ভেঙ্গে পড়া রাজত্বে শ্রী রঙ্গা কখোনো গোপনে কখোনো সরাসরি গিরগিটির মত মত, রঙ, আনুগত্য বদল করা অভিজাতদের মুখোমুখি হলেন। এর পাসাপাশি তাকে দু’দিকে চেপে ধরল বিদেশি সেনাবাহিনী, কখোনো যৌথভাবে কখোনো একা।
(চলবে)