Tuesday, January 24, 2017

বাংলা যখন বিশ্ব সেরা৬৬ - লাইফ অব মীর জুমলা, জেনারেল অব আওরঙ্গজেব

জগদীশ নারায়ণ সরকার

মীর জুমলা খুব কঠিন ধাতের মানুষ ছিলেন, তিনি মন রাখা প্রতিশ্রুতিতে বিন্দুমাত্রও প্রভাবিত হতেন না। তিনি বহু সময় অপেক্ষা করলেন, কুঠিয়ালদের প্রতি সভ্যতা এবং শালীনতা প্রদর্শন করলেন। ক্রমে তাঁর দীর্ঘ অপেক্ষা রাগে রূপান্তরিত হল। আর কোন সমঝোতা নয়, অবিলম্বে নগদে টাকা ছাড়া অন্য কোন কিছুতে সন্তুষ্ট হবেন না জানিয়ে দিলেন। বালেশ্বরের সুবাদারকে বললেন সব ধরণের ব্রিটিশ রপ্তানির ওপর ৪% রপ্তানি শুল্ক প্রয়োগ করতে এবং বন্দরে জাহাজ ভেড়ানোর জন্য একটা শুল্ক চাপিয়ে দিতে এবং ত্রেভিসাকে হুগলীতে পাঠিয়ে দিতে। নভেম্বরে দেখা গেল ব্রিটিশদের সমস্ত ব্যবসাই প্রায় বন্ধের মুখে দাঁড়িয়ে পড়েছে। স্থানীয় বেনিয়াদের থেকে উচ্চ সুদে টাকা ধার করে যে সব বিপুল পণ্যের দাদন দেওয়া হয়েছে, তাকে সন্তষ্ট না করলে সে সবগুলি তিনি দখল নেবেন। হুগলী কুঠিয়ালের সামনে বিপুল দুর্যোগের ঘনঘটা। বিপুল বিনিয়োগে সে বছরের জন্য যে সব পণ্য তারা কিনেছেন, হয়ত মীর জুমলা তাদের সব জাহাজকে বন্দর ছাড়তে নিষেধাজ্ঞা জারি করতে পারেন, সে সবের ভবিষ্যৎ নিয়ে কি হবে তাই তাঁর মাথা ব্যথা থেকেই গেল। সারা ভারতের সরতাজ বাঙলার ব্রিটিশ ব্যবসা হাত ছাড়া হতে বসেছে দেখে ব্রিটিশদের টড়নক নড়ল যে জাহাজ কাণ্ডকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সমাধা করে ফেলা অত্যন্ত জরুরি।

পাটনায় সোরা ব্যবসার নিষেধাজ্ঞায় উদ্বিগ্ন সুরাটের কুঠিয়াল মাদ্রাজের আধিকারিকদের কঠোরভাবে নির্দেশ দিয়ে জাহাজ কাণ্ডকে যততাড়াতাড়ি সম্ভব মিটিয়ে নিতে এবং মীর জুমলার ক্ষতিপূরণ দিতে নির্দেশ দিলেন(৩ জুন ১৬৫৯)। একই সঙ্গে সেই নির্দেশের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে ১২ অক্টোবর এক নির্দেশে গ্রিনহিল এস্টেট থেকে মীর জুমলাকে ক্ষতিপূরণ দিতে নির্দেশনামা জারি করলেন। নভেম্বরের শুরুতে মাদ্রাজের কুঠিয়াল, বাঙলার কুঠিয়ালকে পরামর্শ দিলেন যাতে তারা নবাবের চাহিদা মত যত বেশি সম্ভব ক্ষতিপূরণ দিয়ে ব্যাপারটার একটা স্থায়ী মিটমাট করে নেওয়ার কথা ভাবেন। কিন্তু হঠাতই তাঁর কানে মীর জুমলার যুদ্ধে হারের উড়ো খবর পৌ্ঁছনোয় তিনি বাংলার কুঠিয়ালদের জোর দিয়ে বললেন যে তারা যেন মীর জুমলাকে বুঝিয়ে দেন, মীর জুমলার কাজে যদি তাঁদের কোম্পানির ক্ষতি হয় তাহলে তাদের প্রত্যাঘাত করার যথেষ্ট ক্ষমতা রয়েছে। খবরটা যে সত্যি উড়ো এবং ভিত্তিহীন সেটা বাঙলার কুঠিয়ালেরা জানত এবং তারা জানত জাহাজ কাণ্ডে ক্ষতিগ্রস্ত মীর জুমলার প্রকৃত ক্ষমতার ব্যপ্তি এবং মাদ্রাজের কুঠিয়ালের এ ধরণের পরামর্শ হাস্যকর ছাড়া আর কিছু নয়।

শেষে ১ ডিসেম্বর ত্রেভিসা কেনের সঙ্গে হুগলি ত্যাগ করে মীর জুমলার শিবিরের দিকে রওনা হল মীর জুমলার সঙ্গে জাহাজ কাণ্ডটির দরাদরি করে স্থায়ী সমাধানের উদ্দেশ্যে। নবাবের সঙ্গে তার যে সব শর্তে চুক্তি হয় সেগুলি হল- ১) সমস্ত দখল নেওয়া পণ্য সহ জাহাজটি তাকে অবিলম্বে ফিরিয়ে দিতে হবে। ২) ক্ষতিপূরণের অর্থের বিষয়টি নিয়ে তাঁর পক্ষ থেকে তাবাতাবাই এবং ব্রিটিশদের পক্ষ থেকে সর্বশ্রী ঊম আ কোর্ট এবং জার্সি যৌথভাবে দেখাশোনা করবেন এবং এটি আগামী চার মাসের এই হিসেব মধ্যে শেষ করতে হবে। মীর জুমলার ভাবভঙ্গী দেখে ত্রেভিসার মনে হল তাকে সন্তুষ্ট না করতে পারলে নবাব ব্রিটিশদের খোলা হাতে ব্যবসা করার ছাড়পত্র দেবেন না। কিন্তু ৭ জুমাদা ১০৭০, ৯ ফেব্রুয়ারি ১৬৬০ সালে শাহজাহানের ফার্মানের অনুসরণে তিনি ত্রেভিসার সমস্ত আশঙ্কা উপেক্ষা করে বাস্তবতা অনুসরণ করে ব্রিটিশেরা যাতে ব্যবসা করতে পারেন, সে উদ্দেশ্যে যথাবিহিত দস্তক এবং পরওয়ানা জারি করেন।

ষষ্ঠ অধ্যায়
বাঙলার সুবাদার মীর জুমলা
১। বাঙলার সুবাদারি প্রাপ্তি
সুজার আরাকানে পলায়ন এবং মীর জুমলার ঢাকা প্রবেশের খবরে দশ দিনের উতসবের নির্দেশ দিলেন আওরঙ্গজেব(২৪মে)। শেষ ষোল মাস মীর জুমলা নানান বিপদ সামলে যেভাবে সাম্রাজ্যকে সেবা করেছেন, সেই কাজের পুরস্কার স্বরূপ তাকে বাঙলার সুবাদার পদে নিয়োগ করা হল।

জারি করা ফরমানে পাদশাহ স্পষ্টভাবে তাঁর পদপ্রাপ্তির কারণ উল্লেখ করেছেন। যে বিজয় তিনি অর্জন করেছেন, তাতে একজন মহান ক্ষমতাশালী চক্রবর্তী রাজাও গর্বিত হতেন, এবং যে আনুগত্যে, যে সাহসিকতায়, যে দক্ষতায়, যে প্রজ্ঞায় তিনি যুদ্ধ পরিচালনা করে সাফল্য অর্জন করেছেন, তাঁর পদপ্রাপ্তি সেই সব গুণেরই প্রতিফলন মাত্র। মীর জুমলা তাঁর পুত্রকে লিখছেন, যে বাংলায় সঠিক প্রশাসনিক ব্যবস্থার অভাব রয়েছে। তাই এই প্রদেশে যোগ্য সুবাদারের পদপ্রাপ্তিটা মুঘল সাম্রাজ্যের পক্ষে খুব জরুরি পদক্ষেপ ছিল। আওরঙ্গজেব তাকে লিখলেন, ‘সামগ্রিকভাবে, বহু বছর ধরে, বাঙলার প্রশাসনে গাছাড়া মনোভাব এবং শৈথিল্য, আনুগত্যের অভাব, এবং বিদ্রোহ রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঢুকে রয়েছে, এবং সে তথ্য তোমার অজানা নয়... প্রত্যেক জেলায় স্থানীয় ক্ষমতাশালীদের মদতে দাঙ্গা আর বিদ্রোহের আগুণ জ্বলছে।’ এর আগে মীর জুমলা বাঙলার সুবাদারির পদ প্রত্যাখ্যান করেছিলেন এই যুক্তিতে, যে এই স্বার্থপর পদক্ষেপে তাঁর অনুগামীরা তাকে ভুল বুঝে তাঁর থেকে দূরে সরে যাবে। কিন্তু পাদশাহের যুক্তি ছিল বাঙলার মত গুরুত্বপূর্ণ সুবার দায়িত্ব তিনি মীর জুমলা ছাড়া অন্য কারোর হাতে দিতে বিন্দুমাত্র উতসাহী নন, কেননা মীর জুমলার আনুগত্য, দক্ষতা সততা, বিচারের পদ্ধতি এবং নৈতিকতাই তাকে এই পদে যোগ্য করে তুলেছে।

তাঁর আগের মনসব ছাড়াও তাকে হপ্ত হাজারহফত হাজার সওয়ারএর মধ্যে ৩০০০ সওয়ার হবে শেহ আসপা দু আসপা। এক কোটি দাম বেতন ছাড়াও তনখা হিসেবে আগের সুবাদারদের জন্য বরাদ্দ মহালগুলি থেকে বেছে বেছে সব থেকে ভাল জাগিরগুলি দেওয়া হল। একটি অপূর্ব খিলাত, কন্সতান্তিনোপলের তুর্কি সম্রাটের আস্তাবলে থেকে শাহজাহানের ৩১তম জালুসে(বছরে)র উপলক্ষ্যে উপহার দেওয়া থেকে সব থেকে ভাল, বিশেষ এবং দ্রুততম ইরাকি এবং আরবি ১০টি ঘোড়ার সঙ্গে সম্রাটের নিজের আস্তাবলের আরও ৪০টি তাতারি(তুর্কি, ইংরেজদের ভুলভাল উচ্চারণে টাট্টু ঘোড়া) ঘোড়া, একটি মদ্দা হাতি সহ কয়েকটি হাতি দেওয়া হল। এর পরেও বলা হল, কোন মহালকে তিনি যদি খারাপ মনে করেন, এবং সেটি বদলে যদি অন্য কোন ভাল পরগণা মহাল হিসেবে চান, তাহলে তার ইচ্ছে পাদসাহকে জানিয়ে সেটি বদল করে দেওয়া হবে। এ ছাড়াও একটি রত্ন খচিত কোমর বন্ধনী তাঁর সঙ্গে রত্ন খচিত তরবারি, যেটির হাতল আকীক(agate) রত্নদ্বারা তৈরি উপহার দেওয়া হয়।

আওরঙ্গজেব তাঁকে নির্দেশ দিলেন বিক্ষুব্ধদের শান্ত করতে, আইনভঙ্গকারীদের শাস্তি দিতে, গোলান্দাজ এবং বন্দুকবাজদের আয়ত্ত্বে আনতে – বিশেষ করে নোবাহিনীর যুদ্ধ জাহাজগুলিকে, রাস্তা, রাজপথের আবাধ গতায়াতের বন্দোবস্ত করতে এবং এই কাজ করার জন্য প্রয়োজনীয় নির্দেশাবলী জারি করতে। সম্রাট তাকে লিখলেন, ‘অশক্তের ওপর ক্ষমতাশালীর হাত, শোষকের ওপর শোষিতের হাত বলপূর্বক সরিয়ে দিতে হবে। জীবনের সব ক্ষেত্রে শারিয়তের আইন প্রযুক্ত এবং বিচার সুনিশ্চিত করবে। সর্বশক্তিমানের সৃষ্টি সব জীবের বিশেষ করে গৃহী এবং বিদেশি ভ্রমণকারীদের শান্তি দেওয়া তাদের উন্নতি ঘটানো দরকার, এবং সীমান্তের ওপর সদা সতর্ক তোমার নজরদারি থাকুক। অত্যাচারীদের অত্যাচার থেকে মুক্ত হয়ে যাতে কৃষকেরা যাতে চাষের কাজ অবাধে করতে পারে সেই দিকে তোমার মনযোগ ধাবিত হোক।’

পরগনার বিভিন্ন বিদ্রোহী জমিদার বিশেষ করে অসমীয়া এবং মগেদের শাস্তি দেওয়ার কাজে মীর জুমলাকে নির্দেশ দেন, কেননা এরা মুসলমানদের ওপর অত্যাচার এবং দুর্ব্যবহার করত। ইসলামের সৌভাতৃত্ব এবং ধর্মাচার অবাধ করার জন্য তিনি মীর জুমলাকে নির্দেশ দিয়েছিলেন। আওরঙ্গজেব কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ সেনানীকে অন্তত এক বছর বাংলায় থাকার নির্দেশ দিয়ে কয়েকজনকে দিল্লিতে ডেকে নিয়েছিলেন। এবং যদি মীর জুমলা তাদের মধ্যে থেকে কাউকে যোগ্য মনে করে রেখে দেওয়ার প্রস্তাব সম্রাটকে দেন তাহলে তাঁর অনুরোধ পালন করা হবে।

আওরঙ্গজেবের ৪৪তম জন্মদিবসে(১৫ জুলাই, ১৬৬০) মীর জুমলার সুজার বিরুদ্ধে জয় স্মরণে রাখতে তাকে নতুন করে সম্মান জানানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। বাঙলা জয়ের জন্য তিনি খানইখানান এবং সিপাহসালার উপাধি অর্জন করলেন, ৭০০০ মনসবদার করা হয় তাকে, পাশাপাশি তাঁর পদকে আরও ২০০০ দু আসপা শেহ আসপা বাড়ানো হয়। তাঁর ব্যক্তিগত অনুগামীর মধ্যে ২০০০কে দু আসপা শেহ আসপা করা হয়। এই উপলক্ষ্যে তাকে একটি বিশেষ খেলাত এবং একটি সোনার তরোয়ালও দেওয়া হয়।
(চলবে)

No comments: