Monday, January 30, 2017

উপনিবেশ বিরোধী চর্চা - যোগেন মণ্ডলের রাজনীতি বনাম শূদ্র-কারিগর-দার্শনিক, গ্রামভিত্তিক ব্যবস্থা


শূদ্ররা ভারতের গ্রাম ব্যবস্থার তাত্ত্বিক, দেশের আর্থব্যবস্থার, শ্রুতিভিত্তিক জ্ঞানচর্চা ব্যবস্থার অক্ষদণ্ড
উপনিবেশের চাপিয়ে দেওয়া বড়পুঁজির ছাপাখানাজাত কেন্দ্রনিয়ন্ত্রিত লেখাপড়া ভিত্তিক ভদ্রলোকিয় ব্যবস্থার পাল্টা দর্শনে জারিত

যোগেন মণ্ডল আর তার রাজনীতি নিয়ে Souvik প্রশ্ন তুলেছেন। পালটা প্রশ্ন তুলেছেন Dipankarদা। এ তর্ক-বিতর্কে মাথা ঢোকাতে না চাইলেও মনে হল তত্ত্বগতভাবে শূদ্র উতপাদনব্যবস্থার উতপাদক অভিকর শিল্পীদের সংগঠনের অবস্থান পরিষ্কার করে দেওয়া প্রয়োজন।
.
...ভারত আজও শূদ্র সভ্যতা। আজও। ভারত। ইন্ডিয়া নয়। সংখ্যালঘু উচ্চবর্ণের শাসনভুক্ত ইন্ডিয়া মূলত বড় পুঁজির, কেন্দ্রিয় শিক্ষা, উতপাদন ব্যবস্থার রক্ষক। সে গ্রাম-সংহার নীতির প্রচারক, যাদের প্রধান উদ্দেশ্য কেন্দ্রবিহীন গ্রাম ব্যবস্থাকে শহুরে একতান্ত্রিক ব্যবস্থা দিয়ে প্রতিস্থাপন করা।
যোগেন মণ্ডল বা আরও প্রখ্যাত শূদ্র নেতারা যে সংসদীয় রাজনীতি করেছেন সেটি বড় পুঁজি নিয়ন্ত্রিত ক্ষমতার ভদ্রলোকিয় রাজনীতি। অথচ ভারতের শূদ্ররা প্রাচীন কাল থেকেই ক্ষমতার রাজনীতির সরাসরি বিরোধী, তাদের জীবনের সঙ্গে সেই রাজনীতির একটা বিপ্রতীপ অবস্থান রয়েছে। সেই অবস্থা 'যোজন প্রমান দূরত্ব' শব্দবন্ধ দিয়ে বোঝানো যাবে না, এই ব্যবস্থা শূদ্রচর্যা বিরোধী। তাদের হাজার হাজার বছরের অকেন্দ্রিত গণতন্ত্রের চর্যার সঙ্গে বড়পুঁজির চাপিয়ে দেওয়া সংসদীয় গণতন্ত্রের, যা আসলে রকমফেরে বড়পুঁজিরইএকনায়কতন্ত্র, মিল নেই।
বড় পুঁজির, কেন্দ্রিভূত ক্ষমতার সেবাদাস রাষ্ট্রর নীতি বা উদ্দেশ্যর সঙ্গে শূদ্র জীবনধারণ পদ্ধতি, উদ্দেশ্য বিন্দুমাত্র খাপ খায় না। এই সমাজ থেকে যারাই সংসদীয় ক্ষমতার রাজনীতি করেছেন, বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছেন মূল সমাজ থেকে। উচ্চাসনে বসেছেন। ১১৫৭/১৭৬৩ সাল থেকেই শূদ্রদের স্বাধীনতার তেজ দমন করা ঔপনিবেশিতায় লেপ্টেলুপ্টে থাকা সান্ত্রী পরিবেষ্টিত পরিবেশে মন্ত্রী, চাকুরে হয়েছেন। তারপরে তাদের মনে হয়েছে, দেশিয় শূদ্র জ্ঞানচর্চা উতপাদন ব্যবস্থা ত্যাগ করে ঔপনিবেশিক জ্ঞানচর্চা, শিক্ষাব্যবস্থা বরণ করাই ভারতের শূদ্রদের ভবিতব্য - তারা চেষ্টা করেছেন শূদ্রদের নিদান দিয়ে সরকারি, কর্পোরেটে চাকরি করে 'নিজের পায়ে দাঁড়াতে' ভদ্রসভ্য হয়ে সংখ্যালঘু ভদ্রলোকীয় ব্যবস্থার জনসংখ্যা বাড়াতে - ঔপনিবেশিক ব্যবস্থা শূদ্রকে বড় পুঁজির সেবাদাস করবে তা তারা ঠারেঠোরে মেনেই নিয়েছেন, মেনে নিতেও বলেছেন।
ঠিক একই কথা বলা যায় শৌভিক যাদের যোগেন মণ্ডলের উত্তরাধিকারী বলছেন সেই মতুয়া সম্প্রদায়ের সম্পর্কেও। শূদ্রদের জীবনধারণ বিষয়ে ঠাকুর হরিচাঁদের নিদান অসাধারণ, শূদ্র সমাজ দর্শনের অনুসারী, আজও কোটি কোটি গ্রামীন শূদ্র মতুয়া সেই পথের অনুসারী। অথচ বর্তমান 'শিক্ষিত' মতুয়া তাত্ত্বিকদের নিদানে শূদ্র ‘পিছিয়েপড়া’ দারিদ্র, মুর্খতার জীবন-দর্শনের অস্বস্তি লক্ষ্যনীয়। শূদ্ররা কারিগর, দার্শনিক, গ্রামভিত্তিক ব্যবস্থার তাত্ত্বিক, দেশের আর্থব্যবস্থার অক্ষদণ্ড, শ্রুতি ব্যবস্থার অক্ষদণ্ড - চাপিয়ে দেওয়া ছাপাখানভিত্তিক লেখাপড়া ভিত্তিক ভদ্রলোকিয় ব্যবস্থার বাইরে দাঁড়িয়ে থাকেন। এই ক্ষমতার রাজনীতি তাকে সেই জ্ঞানচর্চা, সেই জীবনধারন, সেই দার্শনিকচর্যা থেকে বার করে নিয়ে এসে ভদ্রলোকিয় ঔপনিবেশিক বড় পুঁজির সেবাদাস চাকুরে হিসেবে, খুব বড় হলে কর্পোরেট উদ্যমী হিসেবে দেখতে চায় - যার জীবনের উদ্দেশ্য হবে শেষমেশ বড়পুঁজির আজ্ঞাবহ হওয়া।
ব্রিটিশপূর্ব ভারতে প্রচুর শূদ্র রাজা ছিল, শূদ্ররা জীবনের অভিমুখ বদল করেন নি, তারা তাদের শেকড়েই রয়ে গিয়েছেন দেশের ২০ শতাংশের জীবনে এই ঔপনিবেশিক ব্যবস্থা চাপিয়ে দেওয়ার পরেও। গত ৬০-৭০ বছর ধরে যারা ঔপনিবেশিক ক্ষমতার রাজনীতি করছেন, তারাও চাইছেন বড় পুঁজি যে গ্রাম উতপাদন-সংস্কৃতি-দর্শন-বিরোধী ব্যবস্থা তৈরি করেছে সেখানে শূদ্রদের টেনে নিয়ে আসার যাতে গ্রাম উতপাদন ব্যবস্থার ধ্বংসকর্মর উদ্দেশ্য পূর্ণ হয়।
---
অপেক্ষা করছি, ঔপনিবেশিক ব্যবস্থা শূদ্রদের জীবনে সহনীয় করে তুলতে চাষার ছেলে চাষা হবে কি, এই বৌদ্ধ দর্শন অনুসরণ করেছিলেন যে সব তাত্ত্বিক, শূদ্র গ্রাম ভিত্তিক উতপাদন তত্ত্ব বাতিলের কলমপাতে এগিয়ে আসেন কি না।

No comments: