Tuesday, January 24, 2017

বাংলা যখন বিশ্ব সেরা৬৫ - লাইফ অব মীর জুমলা, জেনারেল অব আওরঙ্গজেব

জগদীশ নারায়ণ সরকার
ষষ্ঠ পর্ব
ইওরোপিয়দের সঙ্গে মীর জুমলার সম্পর্ক(১৬৫৮-৬০)

১। জাহাজ পর্ব তখনও সমাধা হয় নি
১৬৫৮র চুক্তিতে গ্রীনহিলের কুঠিয়ালির সময় মীর জুমলার যে জাহাজটি ব্রিটিশেরা দখল করেছিল, সেই পর্ব তখনও সমাধানের পথে হাঁটে নি। গ্রিনহিল সেটি এডোয়ার্ড উইন্টারকে বিক্রি করে দিয়েছিলেন, উইন্টার সেটি ব্যক্তিগত কাজে ব্যবহার করছিলেন। মুঘল সাম্রাজ্যে মীর জুমলার বাড়তে থাকা প্রভাবে শঙ্কিত হয়ে সুরাটের আধিকারিকরা মাদ্রাজ দপ্তরকে জানাল(২৭ নভেম্বর ১৬৫৮) উইন্টারের থেকে জাহাজটির দাম উসুল করা হোক। মীর জুমলাকে শান্ত করা না গেলে মছলিপত্তনম এবং অন্যান্য এলাকার ব্যবসা সঙ্কটে পড়তে পারে এমন কি বন্ধও হয়ে যেতে পারে। কমিটি অব নিউ জেনারেল স্টক(১৩ সেপ্টেম্বর ১৬৫৮) এই বিষয়ে কোন দায় নিতে অস্বীকার করে এবং কুঠিয়ালদের হুঁশিয়ারি দিয়ে আগামী দিনে স্থানীয় রাজনীতিতে মাথা ঢোকালে কি হাল হতে পারে তা এই ঘটনাটা থেকে শিক্ষা নিতে।

মীর জুমলার জাহাজ উদ্ধারে সম্রাট আওরঙ্গজেবের ফরমানের উত্তরে মীর জুমলার ব্যবসায়িক আধিকারিক মীর মহম্মদ হুসেইন টাপা টাপা(তাবাতাবাই) উইন্টারের কবল থেকে জাহাজটি উদ্ধারের দাবি জানালেন। মছলিপত্তনপমের কুঠিয়াল এই বিষয়ে মাথা গলাতে আস্বীকার করাতে টাপা টাপা(তাবাতাবাই) ব্রিটিশদের হাতে বন্দী মীর জুমলার সেনানী কাজি (মহম্মদ হাশিম)র মুক্তির দাবি জানালেন। এই সব হুঁশিয়ারিতে কোম্পানি এবং আধিকারিকেরা আশংকা করছিলেন যে তাদের ব্যবসার ওপরে আঘাত আসতে চলেছে।
ভারতের কোম্পানি এখন দুটি মতদ্বৈধতায় পড়েছে – একদিকে মীর জুমলার জাহাজ ফেরতের জোরালো দাবি কোম্পানির ইংলন্ডের কর্মকর্তা, বিশেষ করে গ্রিনহিলের উত্তরসূরী এজেন্ট চেম্বার, তার স্ত্রীর পক্ষ নিয়ে কোন দায় নিতে অস্বীকার করছে, অন্যদিকে কোম্পানির নির্দেশে উইন্টার সেটি মীর জুমলার ব্যবসায়িক আধিকারিকের কাছে ফেরত দিয়েও পরে সেটি কেড়ে নেন, সে বিষয়ে কি সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।

২। বিহার আর বাংলায় মীর জুমলার দায়িত্ব
জাহাজ পর্বের আরও জটিলতা বাড়ল বাংলা-বিহারে জুড়ে সুজার বিরুদ্ধে লড়তে মীর জুমলাকে আওরঙ্গজেব সম্পূর্ণ দায়িত্ব দেওয়ায়। যদিও ব্রিটিশ কুঠিয়ালেরা মীর জুমলাকে যমের মত ভয় করত, কিন্তু জাহাজ কাণ্ড সমাধানে তাদের উদ্দেশ্যটা অনেকটা ঘটনা প্রবাহের গতি এবং সিংহাসনের দখলের লড়াতে মীর জুমলার জড়িয়ে থাকা এবং তাঁর ভাগ্য পরিবর্তনের ওপর বহুলভাবে ছেড়ে দিয়েছিল। যদিও বাঙলার কুঠিয়ালেরা এই ঘটনাকে দেখছিল করমণ্ডল কুঠির দায়িত্ব হিসেবে, মীর জুমলা জাহাজ কাণ্ডকে দেখতেন সামগ্রিকভাবে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে জড়িয়েই, এবং তিনি স্পষ্টতই মনে করতেন জাহাজ কাণ্ডে বাঙলার কুঠিয়ালেরা তাদের দায় এড়িয়ে যেতে পারে না। ফলে তার প্রথম কাজটাই হল এই ঘটনার শাস্তি স্বরূপ ব্রিটিশেরা যাতে বিহার থেকে সোরা কিনতে না পারে তার ব্যবস্থা করা। তাঁর সঙ্গে দু’দুবার দেখা করেন পাটনা কুঠির কুঠিয়াল চেম্বারলিন। দ্বিতীয় আলোচনায়(২১ ফেব্রুয়ারি ১৬৫৯) মীর জুমলা ৬০০টাকার উপঢৌকন পেয়ে প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ হন, ব্রিটিশ কুঠিয়ালকে জলদস্যু বা ছিঁচকে চোরের থেকে বেশি মর্যাদা দেন নি। এর প্রতিক্রিয়ায় তিনি ব্রিটিশদের মাল পরিবহনে গাড়ি, নৌকোগুলি দখল হলে তাঁর সাপেক্ষে অগ্রিম ক্ষতিপূরণ পাওয়ার দস্তক দিতে অস্বীকার করেন এবং একই সঙ্গে বলেন চেম্বারলিনকে গ্রেফতার এবং তাঁর কুঠিকে দখল না করে তাদের প্রতি তিনি যথেষ্টই দয়া দেখিয়েছেন। চেম্বারলিন যেন এটা মনে রাখেন।

সুজার বিরুদ্ধে যুদ্ধে মীর জুমলার জয় ব্রিটিশদের বাধ্য করল যতদূর সম্ভব মীর জুমলারকে শান্ত রাখার নীতি গ্রহণ করতে। জাহাজটি হয় ফেরত পাওয়া যাবে নয়ত ক্ষতিপূরণ, এবং এই বিষয়টি তিনি বালেশ্বরের কুঠিয়ালের মাধ্যমে সেন্ট জর্জের কুঠিয়ালকে সাড়ে চারমাসের মধ্যে সমাধান করতে অনুরোধ করেছেন, চেম্বারলিনের এই আশ্বাসে পাটনায় ব্রিটিশদের ব্যবসার আনুমতি দিলেন মীর জুমলা এবভং বললেন তাঁর কর্মচারী সংশ্লিষ্ট কাগজপত্র হাতে পেয়ে সন্তুষ্ট হলে জাহাজ কাণ্ডের সমাধান হয়েছে বলে তিনি মেনে নেবেন।

গোলাগুলি এবং অন্যান্য রসদের সরবরাহ বিষয়ে ডাচেদের সাহায্য চাইতে কাশিমবাজারের কুঠিয়ালকে তাঁর শিবিরে ডেকে পাঠান মীর জুমলা। যেহেতু তাঁর জন্য ব্রিটিশেরা অপেক্ষা করে নি বলে ব্রিটিশদের কাশিমবাজার কুঠি বন্ধে নির্দেশ দেন তিনি। এই নিষেধাজ্ঞা তুলতে কুঠিয়াল কেনকে মে মাসে মীর জুমলার সঙ্গে দু’দুবার দেখা করতে হয়। মীর জুমলা উপঢৌকন নিতে আস্বীকার করেন এবং তাঁর জাহাজটিকে ফেরত এবং ৪০০০০টাকা ক্ষতিপূরণ দাবি করেন। তিনি এর জন্য দুমাসের বেশি অপেক্ষা করতে পারবেন না জানিয়ে দেন, এবং এই কাজের ক্ষতিপূরণের মঞ্জুরিপত্র কেন যাতে বালেশ্বর এবং হুগলী থেকে আনিয়ে নিতে পারেন তাঁর জন্য তাকে বেশ কিছু দিন সময় দেন এবং এটি না করতে পারলে তাদের সব ব্যবসা বন্ধ করিয়ে দেওয়ার এবং সবধরণের অগ্রিম ক্ষতিপূরণের দস্তক না দেওয়ার এবং ক্ষতিপূরণ হিসেবে তাদের মজুদ সোরাও দখল করার হুমকি দেন। মে মাসের শেষের দিকে হুগলীর স্থানীয় কুঠিয়ালদের থেকে চিঠি নিয়ে ম্যাথিয়াস হলস্টেড মীর জুমলার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে আসেন এবং সেই চিঠির প্রেক্ষিতে মীর জুমলা ব্রিটিশদের দাবি কিছুটা মেনে নেন। বালেশ্বর এবং হুগলীর কুঠিয়ালেরা নবাবের ক্ষতিপূরণ হিসেবে ২৫০০০টাকা ধার্য করার সিদ্ধান্ত নেন। জুনের প্রথম দিকে হলস্টেড আর কেন মীর জুমলার সঙ্গে দেখা করেন এবং এক মাসের মধ্যে তাঁর দখল করা পণ্যের দাম মিটিয়ে দিলে ব্রিটিশদের দস্তক দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিলেন।

ডাচ কুঠিয়াল ম্যাথায়াস ভ্যান ডেন ব্রোক মীর জুমলার সঙ্গে দেখা করতে চললেন, ডচেরা হুগলী নদী নৌকো এবং কামান নিয়ে পাহারা দেওয়ার কাজ নিজেদের কাঁধে তুলে নেওয়ায় তাদের ব্যবসার পথ রোধ হয় নি। সে সময় কানাঘুষোয় শোনা যাচ্ছিল যে বিপুল অর্থের বিনিময়ে ডাচেরা হুগলীর প্রশাসনিক ক্ষমতা অর্জন করতে পারে। জুনের মাঝখানে শাহজাদা মহম্মদ সুলতান মীর জুমলার শিবির ছেড়ে সুজার বাহিনীতে যোগ দেওয়ায়, ব্রিটিশেরা সেই সুযোগে জাহাজ নিয়ে দরকষাকষির ব্যাপারটা একটু ঢিলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। আগের চুক্তি অনুযায়ী, সেপ্টেম্বরের শুরুতে কেন মুর্শিদাবাদে এসে মীর জুমলা এবং বালেশ্বরের কুঠিয়াল ত্রেভিসার জন্য অপেক্ষা করতে থাকে। যুদ্ধের অনিশ্চিতির বাহানা দেখিয়ে বালেশ্বরের কুঠিয়াল ক্ষতিপূরণের অর্থ দেওয়া আপাতত স্থগিত রাখা হয়েছে এবং যুদ্ধের গতি কোন দিকে গড়ায় দেখে তা সিদ্ধন্ত নেওয়া হবে কেনকে বলে জানায়। ত্রেভিসা নবাবের সঙ্গে দেখা করতে চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়ে সুরাটের প্রেসিডেন্ট এন্ড্রু এবং মছলিপত্তনমের মীর জুমলার আধিকারিকের চিঠি মীর জুমলার উদ্দেশ্যে পাঠিয়ে দেন।
(চলবে)

No comments: