নীল, নীল চাষ এবং বাংলার নবজাগরণের অগ্রদূতেরা
স্যামুএল বর্ণের তোলা বাংলার গ্রামের ছবি, ১৮৫৮
নীল গাছ থেকে ত্রিহুতে নীল রংএর মণ্ড তৈরি হচ্ছে
নীল তৈরির বিভিন্ন পদ্ধতি
নীল চাষ
আমেরিকার লুইজ়িয়ানায় নীল চাষ
বাংলার অন্যান্য বিশ্বজয়ী কৃষি দ্রব্যের তালিকায় নীলের স্থান ছিল হয়ত সবার ওপরে। বিশেষ করে গ্রিস, রোমসহ ইওরোপ এবং মিশরের মত আফ্রিকা মহাদেশে নিলের চাহিদা উত্তুংগ ছিল। কাপড় ছোপানোর জন্য নীলের মণ্ড এই সব দেশে বিলাসিত দ্রব্য রূপে পরিগনিত হত।
নীলের সঙ্গে ভারতের সম্বন্ধ সুপ্রাচীন। ভারতের অন্যতম ভৌগোলিক নাম, ইন্ডিয়া থেকে নীলের বানিজ্যিক নাম, ইন্ডিগোর উতপত্তি। অবশ্য, নীল ভারত ছাড়াও নানান দেশে, মহাদেশে চাষ এবং তৈরি হত। তবুও যে নীল লাতিন আমেরিকায় বা অন্যান্য দেশে তৈরি হয়ে ইয়োরোপে বাণিজ্যের জন্য আসত, তারও নাম ছিল ইন্ডিগো। এশিয়ার বিভিন্ন দেশ, চিন, জাপানেও নীলের চাষও হত, ভারত থেকে নীলও রপ্তানি হত।
রোমের উতপাদকেরা এক সময় ভারত থেকে আমদানি করা মসলিন এবং নীলের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে। নীলের ওপর কর চাপান হয়। তবুও ভারতের নীলের চাহিদা কমে না।
এখানে অন্য একটি বিষয় তুলে ধরা প্রয়োজন। ভারতের চাষি এবং বনিকেরা, ভারতের নীলকে বিশ্বের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি বাণিজ্যিক দ্রব্যে রূপান্তরিত করেছিল। ব্রিটিশরা ভারতে পা দেওয়ার অনেক আগেই ভারত তথা বাঙলায়
নীল উত্পন্ন হয়ে বিশ্ব বাজারে গিয়েও তার নিজস্বতার পরিচয় তৈরি করতে পেরেছিল, এবং
ভারত সেই বিশ্ব বাণিজ্য থেকে যথেষ্ট লাভও ঘরে তুলে নিয়ে আসত। এত লাভ, একচেটিয়া ব্যবসারমতইপ্রায় নীল বেচার বিশ্ব
বাজারে ভারতের পকড়। অথচ ভারত ব্রিটিশদের
নীতিরমত করে প্রকৃতি বিরোধী উত্পাদন করার দিকে ঝোঁকে নি। বিশ্বের অন্যান্য দেশে তথাকথিত বাজার বাড়াবার দিকেতো
নজর দেয়ই নি, আর দেশেও নীল চাষীর ওপর চাপ দিয়ে অতিরিক্ত উতপাদন করতেও ঝোঁকেনি। যতটুকু উতপাদন করলে তার সমাজ এবং বিশ্ব বাজারের চলে
যায়, সেই পরিমানের বেশি উত্পাদন করে সে অতিরিক্ত লোভি হতে চায় নি অথবা প্রকৃতির
নিজস্ব উত্পাদনকর্মর ওপর অপরিমেয় চাপ সৃষ্টি করতে চায়নি।
নীল আর বাংলার নবজাগরণের অগ্রদূতেরা
কেন এই প্রবন্ধে বাংলার নীল স্বাধীনতা সংগ্রাম(আজও বিদ্রোহ বলব?) নিয়ে আলোচনা করছি না, তা নিয়ে অনেকেই প্রশ্ন করতে পারেন। নীল স্বাধীনতা সংগ্রাম নিয়ে বহু সুষ্ঠু, বিশদ, পরিপক্ক আলোচনা হয়েছে(জমিদার গোলোকনাথ রায়ের লড়াইএ কথা ময়মনসিংহের
ইতিহাসএ কেদারনাথ মদুমদার লিখছেন, ...১৮৪৩
খ্রীষ্টাব্দে ময়মনসিংহ জেলার কাগমারীর ঘটনা। কাগমারীর নীলকুঠীর
কিং সাহেব কয়েকজন প্রজাকে গুদামে আবদ্ধ করেন ও তাহাদের নীলের দাদন লইতে বাধ্য
করিবার চেষ্টা করেন। প্রজারা নীল বুনিতে
অস্বীকার করায় একজন প্রজার মাথা মুড়াইয়া তাহাতে কাদা মাখিয়া নীলের বীজ বুনিয়ে
দেওয়া হয় ও অপর একজনকে একটি বৃহত সিন্দুকে আবদ্ধ করিয়া রজনীকালে বেলকুচির কুঠিতে
পাঠাইবার চেষ্টা করা হয়। ...যথাসময়ে প্রজারা (জমিদার) গোলকনাথ রায়ের নিকট কিং সাহেবের অমানুষিক অত্যাচারের কথা
অবগত করাইলে গোলকনাথ কৃষকগণকে লইয়া কিং সাহেবের কুঠি আক্রমণ করেন এবং কিং সাহেবকে
ধরিয়া লইয়া গোপন করিয়া রাখেন। উভয়পক্ষই জেলা-ম্যাজিস্ট্রেটের নিকট বিচার প্রার্থী হয়। এদিকে গোলকনাথ ও কিং সাহেব কাহারও সংবাদ পাওয়া যায় না। জেলা-ম্যাজিস্ট্রেট গোলকনাথকে গ্রেপ্তার করার জন্য
পাবনার জয়েন্ট-ম্যাজিস্ট্রেট, রাজসাহির ম্যাজিস্ট্রেট ও মালদহের
জয়েন্ট-ম্যাজিস্ট্রেটকে লিখিয়া পাঠাইলেন। কিন্তু গোলকনাথকে কোথাও খুঁজিয়া পাওয়াগেল না। বহুদিন পর পাকুল্যা থানার দারোগার সাহায্যে কিং সাহেব
পরিত্রাণ লাভ করেন।)। কিন্তু বাংলার নীল চাষে প্রখ্যাত বাঙ্গালীদের অংশগ্রহন বিষয়ে অনেকেই নিশ্চুপ আজও।
আক্ষরিক অর্থে গ্রামীণদের ওপর উত্পাতের
পুরস্কারস্বরূপ ধনে জমিদারি কিনে বাঙালি মধ্যবিত্তরা রায়তদের শুধুই জোর করে আফিম
বা নীল চাষ করতে বাধ্য করেন নি, আফিম আর নীল বিদ্রাহীদের সরাসরি বিরোধিতা করেছেন,
স্বাধীণতা সংগ্রামীদের ঠেলে দিয়েছেন বাঙলা জুড়ে তাণ্ডবলীলা চালানো ব্রিটিশ সেনার
সামনে, লবন প্রস্তুতকারক, মালঙ্গীদের স্বাধীণতা সংগ্রামের বিরোধিতা করে, সরকারের
লবন নীতির সমর্থনে বুক ফুলিয়ে লবন ব্যবসা করেছেন, ভারতে ব্রিটিশদের জমি কেনার জন্য
এবং দিল্লিশ্বরের জন্য কোম্পানির মাসবরাদ্দ অর্থ বাড়াতে মহারাণীর সামনে নতজানু
হয়ে লণ্ডনে দরবার করেছেন, চিনের সঙ্গে অনৈতিক আফিম ব্যবসায়ে সরাসরি জড়িত থেকেছেন,
ভাইবেরাদারদের নিয়ে ব্যাঙ্ক খুলে জনগণের অর্থে কার টেগোর নামক কোম্পানি তৈরি করে
নীল আর আফিম ব্যবসায় টাকা নিয়োগ করছেন, আবার ঠিক সময়ে ব্যাঙ্কটি যাতে উঠে যায়
তারও ব্যবস্থা করে রেখে গিয়েছেন সযত্নে, চীনকে আফিম খাওয়ানোর ব্রিটিশ সাম্রাজ্যর
চক্রান্তের অন্যতম তুচ্ছ অংশিদার হয়েছেন সাগ্রহে, নীল চাষীদের গাঢ় লাল রক্তে বোনা
নীল রং(ইন্ডিগো)এর ব্রিটিশ বণিক সাম্রাজ্যের সঙ্গে ব্যবসায়ে বাঙলায় বড়তম
উদ্যোক্তা হয়ে পরবর্তী কালে উদ্যোগপতি আখ্যা পেয়েছেন, মহামান্য কোম্পানি
বাহাদুরের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সরাসরি ভারতীয় সভ্যতার নামে ঘৃণা ছড়িয়ে অজস্র আস্থা
অর্জন করেছেন, গ্রামীণ বাঙলার সমাজিক বনিয়াদ ধ্বংস করে তার চরিত্র পাল্টে দেওয়ার
কাজে সরাসরি যুদ্ধ করা ব্রিটিশ সেনারা যখন বিদ্রাহীদের রক্তে হোলি খেলছে, মেকলে,
ট্রেভলিয়নেরমত জাতিবিদ্বেষী ব্রিটিশ সরকারি আমলারা যখন কলকাতায়
উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে হাজার হাজার বছরের ভারতীয় সভ্যতার মুখে কালি ছেটাচ্ছেন, তখন
ইংরেজি শিক্ষিত ভারতসমাজবিদ্বেষী বর্ণকুলীন নবজাগরণের বাঙালি কর্ণধার আর ভারত
ভাঙার আর অগ্রদূতেরা দ্বারকানাথের নেতৃত্বে চূড়ান্ত অমিতব্যয়ের সূতিকা ঘর,
বেলগাছিয়ার বাগানবাড়িতে অশ্লীল নাচের আসর বসিয়ে কোম্পানির আমলাদের অভ্যর্থনা
জানাচ্ছেন মদের ফোয়ারা ছুটিয়ে, অজস্র অর্থ ব্যয় আর সম্পদ নষ্ট করেছেন অপচয়ের চরমে
উঠে। ছাপার ব্যবসা বাঁচানোর জন্য বিদ্যাসাগর বরাবরই চুপ
থেকেছেন। এ দেশে দ্বারকানাথ আর তার অস্বস্তির
অপৌত্তলিকগুরু রামমোহনের যত জীবনী প্রকাশ হয়েছে, তাতে প্রায় প্রত্যেক লেখক
উদ্দেশ্যপূর্ণভাবে তাঁর বেনিয়ানি করে ঘুষ গ্রহণ, নুন আর আফিম বোর্ডে দেওয়ানি করে
বামহস্তক্রিয়ায় বাস্তবে পাওয়া মাইনে থেকে অত্যন্ত বেশি আয় করা, ভারতে অত্যাচারী
ব্রিটিশ নীলকরদের পক্ষ নেওয়া এবং নীলকরচরিত্র, ইওরোপিয়দের ভারতে জমিকেনার পক্ষে
সফল সওয়াল, নুন ব্যবসায় তাদের বিরুদ্ধে মালঙ্গীদের আন্দোলন নিয়ে সাধারণেই নীরব
থেকেছেন, না হয় অস্বস্তিকরভাবে সেগুলি নানান অজুহাত আর দর্শণ দেখিয়ে সমর্থন করতে
বাধ্য হয়েছেন।
নীলচাষ আর নীল জমিদারিঃ বাঙালির সামাজিক ইতিহাসে
রামমোহন-দ্বারকানাথ
মহামহিম
ইংলন্ডেশ্বরের অতি বশংবদ প্রজা
জমিদার প্যারীসুন্দরী-গোলোকনাথের অসামান্য নীল আন্দোলনের গড়ে তোলার
বিপরীতেই রামমোহন-দ্বারকানাথের ভূমিকা। আমরা আলোচনা
করব বাঙলার তথা কলকাতায় দুই মহাতেজ বাঙালি রামমোহন আর দ্বারকানাথের ইংরেজ নীলকরদের
আর বাঙলায় ইংরেজদের জমি কেনার আন্দোলনের প্রতি এই দুই নবজাগরণের অগ্রদূতের সদর্থক
সমর্থনের প্রায়অব্যক্ত ইতিহাস। দুই মহাতেজ কলকাতায় নানান সভাসমিতিতে অথবা সংবাদপত্রকে প্রভাবিত করেছেন। রামমোহন রায় ব্রিটেনে গিয়ে সমর্থন জোগাড় করার ইতিহাস রচনা করেছেন। এই আন্দোলনের ইংরেজি নাম কলোনাইজেশন। সুসভ্য
ইংরেজদের এই পোড়া বাঙলা দেশে জমি কিনে বাস করার, অবাধে ব্যবসা করতে দেওয়ার
তথাকথিত প্রগতিশীল আন্দোলনে এই দুই বাঙালি অগ্রণী ভূমিকায় আজও ভারতীয় ঐতিহাসিকদের
নীরবতা আশ্চর্যজনকতো বটেই, সন্দেহজনকও। ঐতিহাসিকেরা
দ্বারকানাথের জীবনীকার ব্লেয়ার বি ক্লিংএর দাবি, রামমোহন কলোনাইজেশনের আন্দোলনের
সামাজিক ভূমিকা তৈরি করেছেন, আর দ্বারকানাথ দিয়েছেন আন্দোলনের আর্থিক ভিত্তি। প্যারীসুন্দরী, গোলকনাথ বা বিশ্বনাথের নীলকর বিরোধী লড়াই আজও পরিচিতি লাভ
করেনি। প্রিন্স পিতার কুকর্মকে কোনও তত্বতেই
ঢাকা না দিয়ে, দেবেন্দ্রনাথ তত্ববোধিনীতে সরাসরি নীলকর বিরোধী লেখা ছেপেছেন। ঠাকুর জমিদারিতে রায়তদের ওপর অমিত অত্যাচারের সংবাদ পাওয়া গেলেও, দেবেন্দ্রনাথ
বাঙালির ইংরেজ তোষণের বিরুদ্ধেও দাঁড়িয়েছেন। দেবেন্দ্রনাথের আধ্যাত্মিকতা যতটা প্রচার পেয়েছে, তাঁর নীলকর বিরোধী ভূমিকা
প্রচার পায়নি।
কলোনাইজেশনের জোড়া-তাত্বিক
ব্রিটিশ সাম্রাজ্যে গড়ে ওঠা এজেন্সি হাউসগুলো ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির পক্ষ
নিয়ে ইংরেজবাণিজ্যবিশ্বে ব্যবসা চালাত। এদের ব্যবসার
কর্মকান্ড নির্ভর করত এদেশে ব্যবসায়ী ইংরেজদের লাভের বিনিয়োগের ওপর। নীল ব্যবসাকালে এজেন্সি হাউসগুলো নীলকরদের ১০ শতাংশ হারে টাকা ধার দিত। ১৮২৩এর সরকার নতুন ধারনীতি প্রণয়ন করায় নীলকরদের ধার পেতে বেশি সুবিধে হয়। এই নীতি বাঙলার নীলচাষকে আরও কয়েক দফা এগিয়ে দেয়। ১৮২৪এর ইঙ্গ-বর্মা যুদ্ধে সরকারের কোষাগারে টান ধরল। ইংলন্ডে বাঙলার কাঁচামালের দাম দারুণভাবে পড়তে শুরু করায় দেশিয় নীল
(ইংরেজদের)ব্যবসার ওপর চরম আঘাত নেমে আসে। ব্যবসায় মন্দা
শুরু হয়। এজেন্সি হাউসের একটি বড় অংশ অর্থ
নীলচাষে খাটছিল ১০ শতাংশ বাত্সরিক সুদে। ফলে এজেন্সিদের অনেকেই বিনিয়োজিত অর্থ ফেরত দিতে পারছিল না। একের পর এক এজেন্সি হাউসে তালা ঝুলতে শুরু করে। নীলকরেরা বিপদ অনুভব করে। নীলকরেরা সরকারকে দাবি জানায়, দাদন নিয়ে যেসব চাষী নীল সরবরাহ করার শর্ত
পূরণ করছেনা তাদের বিরুদ্ধে সরকারকে আইনি ব্যবস্থা নিতে হবে। নীলকরদের দাবি মানে নিল সরকার। আর্মহার্স্টএর
ষষ্ঠ নিয়মে নীলকরদের আসল সুদ সমেত ফেরত পেতে আইনের দ্বারস্থ হওয়ার অনুমতি মিলল। এতেও অত্যাচারী নীলকরদের মন ওঠেনা। তাদের চাই আরও
কড়া নতুন আইন। তারা আর দাদন দিতে চায় না। ভারতে জমি কিনতে চায়। এই দাবিতে
বহুদিন ধরেই আন্দোলন করছিল ব্রিটিশাররা। ১৮৩৩এর সনদে ব্রিটিশ নাগরিকদের ভারতে জমিকেনার অধিকার দেওয়ার অনেক আগে
থেকেই রামমোহন রায়, প্রসন্ন কুমার ঠাকুর, দ্বারকানাথ ঠাকুর প্রভৃতি জমিদারদের
একাংশ এই আন্দোলনের পক্ষে সওয়াল করছিলেন। যুক্তি ছিল,
অবোধ, অসভ্য ভারতীয়রা সুসভ্য ইংরেজদের সংস্পর্শে এসে সভ্য হয়ে ওঠার সুযোগ পাবে, আর
ব্যবসায়ী ইংরেজদের ব্যবসার দক্ষতার মাধ্যমে দেশের সম্পদ বৃদ্ধি হবে। অথচ ভারতীয় জমিদারদের সংখ্যাগুরু অংশ এই দাবির বিরোধী।
নেপলিয়নের পতনের পর ইওরোপের বাইরে থাকা প্রায় প্রত্যকটি
মহাদেশের বড় অংশ ইংরেজদের পদতলে। ১৭৮০তেই ইউনিটেরিয়ানদের
এডাম স্মিথ ওয়েল্থ অব নেশনএ মুক্ত
বাণিজ্যে ডাক দিচ্ছেন। ইংরেজদের অবাধ বাণিজ্যের অর্থ অন্তঃত
বাঙালিরা জেনে গিয়েছে পলাশির উত্তর ক্লাইভ-হেস্টিংসএর স্বেচ্ছাচারী লুঠেরা যুগলবন্দীতে। পুরেনো অভিজ্ঞতা নয়, মাত্র সাত দশকও পেরোয়নি। অথচ ইউনিটেরিয়ান রামমোহন-দ্বারকানাথ এদেশে ব্রিটিশারদের বাণিজ্যর জন্য
প্রয়োজনীয় জমি কেনার অধিকার দাবির পাশে দাঁড়ালেন। ইংলন্ডে ইউনিটেরিয়ানদের প্রভাব যথেষ্ট ছিল। নতুন শিল্পমালিকদের সামনে ভারতীয় উপনিবেশের ধংস হওয়া বাজারের হাতছানিই
মুক্ত বাণিজ্য। ১৮৩২র নতুন সংস্কার আইন আর ১৮৩৩র সনদ
কোম্পানির একচেটিয়া বাণিজ্যের বিরুদ্ধে ইউনিটেরিয়ানদের সবথেকে বড় জয়।
১৮২৮এর ফেব্রুয়ারিতে সংবাদ কৌমুদীতে নীলকরদের চাষের জমি
দখলের বিরুদ্ধে সংবাদ প্রকাশ হয়। সে সময়ে ভারতে
ধান উত্পাদনের হার কমছিল। ২৬ ফেব্রুয়ারিতে দ্বারকানাথ
সংবাদকৈমুদীর সম্পাদককে এই সংবাদের বিরুদ্ধে কড়া চিঠি লেখেন। দাবি নীলকরেরা বাঙলার পতিত জমি উদ্ধার করে সাধারণ রায়তদের(লোয়ার ক্লাস
শব্দটি সচেতন ভাবে ব্যবহার করবেন দ্বারকানাথ, যা পরে, এমনকি স্বাধীনতার পরেও
গ্রামবাংলার খেটেখাওয়া মানুষ বোঝাতে ইংরেজি শিক্ষিতদের কলমে অহরহ ব্যবহৃত হবে)
অর্থ সরবরাহ করে তাদের সুন্দর জীবনযাপন করার সুযোগ করে দিচ্ছে। আরও দাবি এই উন্নয়ণের কাজকর্মকে আরও এগিয়ে নিয়ে যেতে ইংরেজদের আরও বেশি
করে জমি কেনার সুযোগ করে দিতে হবে। তিনি দেশের
মানুষকে হুমকি দিয়ে রাখলেন এই বলে যে, তার এই প্রস্তাবে যে বিরুদ্ধাচরণ করবে সে
আদতে দেশের মানুষেরই শত্রুতা করবে। দ্বারকানাথের
গলায় এ যুগের বিশ্বায়ণের রাজনীতির কারবারিদের সুর। অথবা উল্টোটাও বলা যায়। আজকের বিশ্বায়ণের প্রবক্তারা, সে বামপন্থী হোক, দক্ষিণপন্থী অথবা
মধ্যপন্থী সরকার অথবা বিশ্বব্যাঙ্কই হোক, তারা দ্বারকানাথের দেওয়া হুমকির
সফলতমপথটি অনুসরণ করছেন। দ্বারকানাথ বেঙ্গল
হরকরাতেও নতুন একটি পত্রাঘাত করেন। যদিও সেখানে
নতুন তথ্য নেই। সংবাদ কৌমুদীতে প্রকাশিত চিঠিরই প্রায়
প্রতিলিপি। নীলকরেরা ১৮২৮এর জুন আর ১৮২৯এর জুনে
একত্রিত হয়ে কোম্পানি সরকারের কাছে ভারতে অবাধে জমিকেনা আর বসবাসের সুযোগ করে
দেওয়ার দাবি জানান। এ প্রতিবেদন ৩০মে ১৮২৯এর বেঙ্গল
হরকরায় প্রকাশ হয়।
No comments:
Post a Comment