Tuesday, May 31, 2016

দ্য মুঘল এডমিনিস্ট্রেশন - যদুনাথ সরকার

চতুর্থ অধ্যায়
সুবাগুলির প্রশাসন৬
ফৌজদার এবং তাঁর দায় দায়িত্ব২
ফৌজদারদের দায়িত্ব পাওয়ার পর তাকে যে সনদ দেওয়া হয়, সেই সনদে বিশদে পরিষ্কার করে বলা হয়েছে-
‘দুর্বিনীত মানুষ আর গোষ্ঠীপতিদের দুর্গ ধ্বংস করা তাদের শাস্তি দেওয়ার উত্তম পদ্ধতি। রাস্তা পাহারা দেবে, রাজস্ব যারা দিতে চায় তাদের নিরাপত্তা বিধান করবে। জায়গিরদার এবং ক্রোরিদের গোমস্তাদের রাজস্ব আদায় করার সময় যতপ্রকার সাহায্য প্রয়োজন দেবে এবং সেনা সহায়তা দেবে।
‘কামারদের বন্দুক তৈরতে বাধা দেবে। থানাদারদের(ফৌজদারদের মহকুমার ছোট ছোট ভৌগোলিক এলাকার নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা আধিকারিক) নিয়োগ করে তাঁদের অবস্থা নিয়ন্ত্রণ করতে আদেশ দেবে, বলবে আইনি সম্পত্তি থেকে কেউ যেন কাউকে উচ্ছেদ না করতে পারে বা কোন নিষিদ্ধ শুল্ক যেন কেউ আদায় না করতে পারে।
‘যতক্ষণ না জায়গিরদার বা আমিল তোমায় লিখিতভাবে সেনা সাহায্য চাইবে, ততক্ষণ তোমার প্রশাসন এলাকার অধীনে কোন গ্রাম আক্রমন করবে না। এই ধরণের অনুরোধ পাওয়ার পর(অথবা কোন রাজস্ব না দেওয়া গ্রামের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক পদক্ষেপ নেওয়ার), সেই গ্রামের গণ্ডগোলের সূত্র যে সব মানুষ, তাদের এই কাজে বিরত থাকতে পরামর্শ দেবে এবং তাদের সেই পথ থেকে বের করে আনার চেষ্টা করবে, বলবে এই ধরণের হিংসার পথ থেকে তাঁরা যেন বিরত থাকে এবং শান্তিপূর্ণভাবে কৃষি কাজ করে রাজস্ব প্রদান করে। তাঁরা যদি নিজেদের পাল্টে নেয়, তাহলে আমিলের থেক তাদের নেওয়া একটা চুক্তিপত্রে স্বাক্ষর করাবে। আর যদি তাঁরা নিজেদের বদলাতে অনিচ্ছুক হয়, তাহলে এই কাজে উদ্যোগী গ্রামের প্রধান হিংসকদের শাস্তি দেবে, কিন্তু সাধারণ কৃষককে অনাদর কোর না। রাস্তা পাহারা দাও, জঙ্গল কেটে ফেল, এবং (বেআইনি)দুর্গ ধ্বংস করে দাও।
সংক্ষিপ্তাকারে বললে, ফৌজদারদের পদের নামের তাঁদের কাজ স্বপ্রকাশ, যে তারা সেনাবাহিনী নিয়ে যে কোন ছোট বিদ্রোহ, ডাকাত দল ছত্রভঙ্গ বা গ্রেফতার করা, যে কোন হিংসককর্মের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেওয়া, আর যারা রাজস্ব দপ্তর বা ফৌজদারি বিচারক বা নীতি প্রযুক্তকদের বিরোধিতাকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার দায়িত্বে থাকত।
(চলবে)

দ্য মুঘল এডমিনিস্ট্রেশন - যদুনাথ সরকার

চতুর্থ অধ্যায়

সুবাগুলির প্রশাসন৫
 
৪। ফৌজদার এবং তাঁর দায় দায়িত্ব
সাধারণ শান্তি বজায় রাখা এবং প্রশাসনিক কাজ সুষ্ঠুভাবে করার জন্য সুবাদারের সাহায্যকারী হিসেবে থাকতেন ফৌজদারেরা। এই আধিকারিকেরা সুবার বিভিন্ন মহকুমার(সাবডিভিশন) দায়িত্বপ্রাপ্ত ছিলেন, এঁরা খুব সভ্য হতেন, জমিদারদের হিসাবপত্র পরীক্ষায় চৌকস হতেন, এবং তাঁরা রাষ্ট্রের বিপুল সংখ্যক রাজস্ব জোগাড়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত হতেন, এবং তাঁরা শেষ পর্যন্ত কিন্তু শহরেই বাস করতেন।
যখন কোন নতুন ফৌজদার চাকরিতে বহাল হতেন, তিনি কি নীতি অনুসরণ করবেন এবং তাঁর ব্যবহার কি হবে সে সম্বন্ধে তাকে এই উপদেশগুলি দেওয়া হতঃ-
‘ফৌদারকে সাহসী হতে হবে এবং সেনাদের সঙ্গে মধুর ব্যবহার করতে হবে। তুমি এমন বাহিনী তৈরি করবে, যে বাহিনীতে একমাত্র যারা সাহসী বলে জ্ঞাত এবং ভাল পারিবারিক অবস্থা থেকে আসা সেনারা কাজ পায়।
‘যখন তুমি তোমার কাজের স্থানে পৌঁছবে, সবার আগে স্থানীয় প্রশাসনিক বিষয়ে অভিজ্ঞ এমন মানুষ খুঁজে বার করবে, যেমন স্থানীয় কানুনগো, যারা অন্যান্য প্রশাসনের আধিকারিকদের ভালভাবে জানেন এবং তাদের সঙ্গে ভাল ব্যবহার করে তাদের হৃদয় জিতে নেবে, তাদের থেকে জানবে, তোমার মহকুমায় যে সেনাদল আছে তাঁরা তোমার খামতির বা অসুবিধের সুযোগ নিতে পারে কি না, এবং আদৌ তাদের সঙ্গে কোন আইনভঙ্গকারী জমিদারের সুসম্পর্ক আছে কি না।
‘জানবে স্থানীয় জমিদারেরা নিয়মিত রাজস্ব প্রদান করে কি না, বা তোমার আগে যে আধিকারিক ছিল তার সঙ্গে জমিদারেরা লড়ুয়ে মনোভাব নিত কি না। যারা বশ্যতা মানবে না তাঁদের সঙ্গে প্রথমে সুব্যবহার করবে; তোমার সেই ব্যবহারে তারা যদি সদর্থক সাড়া না দেয় তাহলে তাঁদের শাস্তি প্রদান করবে। যখন মনে করবে তোমার হাতে যে পরিমান সেনা রয়েছে, তারা সেই জমিদারকে শাস্তি দিতে আপারগ, তখন তাঁর বিরোধী(জমিদার)দের তাঁর বিরুদ্ধে লেলিয়ে দেবে; সেই জমিদারের কিছুটা জমি কেড়ে নিয়ে তাঁর পাশের জমিদারকে অর্পণ করবে; এর ফলে যখন যুদ্ধ লাগার পরিস্থিতি হবে তখন সেই বন্ধু জমিদারের পক্ষে তোমার সেনা পাঠাবে।
‘রাজসভায় একজন বিশ্বাসী করণিককে তোমার চিঠিপত্র ব্যবস্থাপনা করতে দেবে; যারা তোমার পাঠানো চিঠির তথ্যানুসারে রাজসভায়(অবশ্যই প্রধান দেওয়ানকে) তা যথাযথভাবে পেশ করতে পারে।
‘স্থানীয় ওয়াকায়িনবিশ, সাওয়ানিনিগার এবং হরকরাদের(যারা তাকে নানান খবর দেবে এবং গুপ্ত খবরদার, গোযেন্দা) সঙ্গে ভাল ব্যবহার করবে, যাতে রাজদরবারে তাঁদের পাঠানো সমীক্ষা তোমার পক্ষে যায় এবং তোমার পদোন্নতি হয়।
‘সবসময় শস্ত্র নিয়ে ব্যায়ামাভ্যাস করবে, নিয়মিত শিকারে যাবে, নিরন্তর ঘোড়ায় চড়বে যাতে নিজেকে যে কোন জরুরি অবস্থার জন্য তৈরি রাখতে পার এবং প্রয়োজনে কোন সময় না নিয়েই লড়াইয়ের ময়দানে নেমে পড়তে পার। দুর্বলদের বিচার দেবে।
 
(চলবে)

গ্রামশিল্প উৎপাদন চর্চা - ল্যাপটপের থলে














পাওয়া যাচ্ছে হাওড়ার অবনী শপিং মল, দোকান পরম মাটি। বিনিময় মূল্য - ৪০০র কম-
আর্টিজান উইভার্স এন্ড ট্র্যাডিশনাল আর্টিস্টস গিল্ডের নানুরের সদস্য বরুণ দত্ত আর তাঁর স্ত্রী রুপা দুজনে অসাধারণ সব থলে তৈরি করেছেন, এবং করেচলেছেন ক্রমাগত এবং আমাদের শিল্প পিপাসা মিটিয়্র চলেছেন, আদাব।।
তার কাজের প্রতিশ্রুতিগুলি পেশ করা গিয়েছিল কয়েকদিন আগের ছবিতে - এবং খেস, কাপড় জোড়া, কাঁথা ফোঁড় ইত্যাদি দিয়ে যে থলে শিল্প তৈরি করা যায় তাঁর চলন্ত নিদর্শন তিনি।
আজ দেখাব পরম মাটিতে সম্প্রতি আসা কিছু ল্যাপটপের থলে। অসাধারণ সেই কাজ, ভাবনাটা আমাদের, কিন্তু রূপায়ন করেছেন এই দুই অসাধারণ দম্পতি।
শিল্প রসিকদের নিশ্চই সেই কাজ পছন্দ হবে, হবেই...মনে হয়...
আর যারা একটু অন্যধরণের ল্যাপটপ থলে চান, কিন্তু পান না, তাদের জন্য...

Sunday, May 29, 2016

খাদির পুনরুজ্জীবন - আমাদের কিছু ভাবনা

আমাদের খাদিকে জানা শুরু হয়েছিল খাদির দোকানগুলোয় গ্রাম উদ্যোগীদের তৈরি উতপা্দনকে খাদির দোকানে রাখার ভাবনা নিয়ে - হাওড়ার অবনী শপিং মলের দোকান শুরুর অন্তর এক বছর আগে থেকে।
তখন দিনাজপুর থেকে কলকাতা বহু দোকান ঘুরেছি, এনজিওদের সাথে কথা বলেছি - প্রখ্যাত এক খাদি ব্যক্তিত্বর সাথে ফোনে আলাপ করিয়ে দিয়েছেন এক প্রভাবশালী দাদা। যা দেখেছি, বুঝেছি, তা জানানো গেল। নতুন সরকার পুরোটা না হোক, কিছুটা রোগ সারাবার উদ্যোগ নিক এটাই কামনা।
ভারতের কথা জানি না, বাংলায় অন্তত খাদি সঙ্গঠনগুলির অবস্থা বেশ দুর্দশাগ্রস্ত - ব্যতিক্রমী হাতে গোণা কয়েকটি উদ্যমী সংগঠন বাদ দিলে। অথচ বাংলার জেলা জুড়ে রয়েছে বহু খাদি নামওয়ালা সংগঠনের দোকান, যাদের কয়েকটি বেশ ভাল চলে, কিন্তু অধিকাংশ নামকা ওয়াস্তে - আগে আমাদের ধারণা ছিল খাদির দোকান মানে সরকার নিয়ন্ত্রিত দোকান - তা হাতে গোনা - অধিকাংশ এনজিওদের অধীনে। সারা বছর এ সব এনজিওর বহু দোকান বন্ধ থাকে - অথচ সেগুলোর বিল ক্যাশমেমো কাটা হয়, সেই 'বিক্রি' দেখানোর টাকা নিয়মিত ব্যাঙ্কে জমা পড়ে - বছরের শেষে ভর্তুকির বিশাল অঙ্কের টাকা তোলার জন্য - সরকার বিক্রির ওপর ভর্তুকি দেয় এনজিও গুলিকে। সব লোক দেখানো, কাজের কাজ কিস্যু বলে তো মনে হয় না। আর শুধু শাড়ি বিক্রির টাকায় চলে বলে চালু দোকানগুলোয় রোজগারও কম হয়, ফলে নেওয়া ঋণ শোধ হয় না - এ এক বিষচক্র।
খাদির ঘরের আরও কথা জানাগেল চরকা কাটনি খোঁজার কাজ শুরু করায়। যে কটি সংগঠন কাজ করে খাদি কাপড় তৈরিতে, তাদের অধিকাংশ মিলের সুতোয় কাজ চালান - কে ঝামেলা করে চরকা কাটিনিদের কাজ দেয় - মিলই ভাল। আর চালু হয়েছে পলিয়েস্টার খাদি - মানে কি?
খাদিতে বাংলা বা কেন্দ্র সরকার বিপুল অর্থ বিনিয়োগ করেছে, কিন্তু কাজের কাজ কিছু হচ্ছে কি না বোঝা দায়। বিনিয়োগের গুড় খেয়ে যাচ্ছে আমলারা আর খাদি থেকে ঋণ নেওয়া কিছু এনজিও।
আমাদের ভাবনা ছিল এই দোকানগুলোয় যদি বাংলার কারুশিল্প আর আমাদের তাঁতিদের তৈরি নীলাম্বরীগুলি রাখা যায় - দিনাজপুর থেকে কলকাতা পর্যন্ত বাংলা এবং উত্তরপ্রদেশের একটি এনজিওর অনেকগুলি দোকান ঘুরলাম - কাজের কাজ কিস্যু হল না। সক্কলে উৎসাহ দেখায় - কিন্তু সে পাশ কাটানোর জন্য - অনেকের ভর্তুকির টাকা বাকি পড়েছে, সেগুলি কি আমরা বার করতে সাহায্য করব? উলটে প্রশ্ন আমাদের।
তাঁরা কাপড় ছাড়া তাঁরা গ্রাম উদ্যোগ নিয়ে আার যদি কিছু বিক্রি বোঝেন সেটি হল মধু আর বাজে থেকে বাজেতম ঘি। গান্ধীজীর কোথায় কানে হাত ছুঁয়ে আমাদে সাহায্য করার প্রতিশ্রুতি দেন কিন্তু সরকারকে মানানো দরকার। তাঁরা বলেন রোজগার হয়ত বেশি হবে, কিন্তু ঝামেলা নেবে কে?
বাংলায় এখন ৫৬টা চালু/আধাচালু দোকান রয়েছে, এই দোকানগুলি থেকে যদি ভিলেজ ইন্ডাস্ট্রির জিনিস থাকে তা হলে অনেকটা পাল্টে যাবে বাংলার গ্রাম উৎপাদনের বিক্রির চেহারা - খুব বেশি বিনিয়োগ না করেই। সেটা নতুন সরকার আর তাঁর সঙ্গে জুড়ে থাকা মানুষেরা ভাবুন। তাঁদের কাছে নিবেদন একটু উদ্যম নিয়ে ভাবুন - এই কাজ করতে অর্থ খুব বেশি লাগে না প্রয়োজন উদ্যম আর ভাবনা রূপায়ন করার।
সেই উল্লিখিত ভারত বিখ্যাত ব্যক্তিত্বর সাথে কথা বলার অভিজ্ঞতা দিয়ে এই লেখাটা শেষ করি - দূরাভাষে তিনি একটু অখুশি ভাবেই কথা শুরু করলেন - আমাদের ভাবনা বললাম - তিনি বললেন ধার নিতে চাইলে তিনি আমাকে সাহায্য করতে পারেন নয়ত... তাঁর পর আর কথা এগোয় নি।
বহু সংগঠন খাদিকে লক্ষ্য করে রোজগার বাড়াবার জন্য।
আমরা চাইছি বর্তমান খাদির পরিকাঠামো ব্যবহার করে চাইছে গ্রামের মানুষের রোজগার বাড়ানোর কাজ। ঋণ পাওয়া নয় - মানুষের কাজ খাদির মাধ্যমে বিক্রির।
আরও অনেক কিছু বলার রইল তবে বারান্তরে -
নতুন সরকার আমাদের ভাবনা শুনবেন নিশ্চই।

Thursday, May 26, 2016

দ্য মুঘল এডমিনিস্ট্রেশন - যদুনাথ সরকার

চতুর্থ অধ্যায়

সুবাগুলির প্রশাসন৪

৩। সুবায় নিযুক্ত দেওয়ানের দায়দায়িত্ব

সুবার দেওয়ান(নিযুক্ত হন, সম্রাটের হাসবুলহুকম এর অধীনে, উজিরের সনদএর পাঞ্জায় আর লেখনিতে) স্থানীয়ভাবে দ্বিতীয় পদাধিকারী এবং আমি প্রথম অধ্যায়ে যা বলেছি, সেটা আবার এখানে নতুন করে বলছি, দেওয়ান সুবাদারের সরাসরি প্রতিযোগী। পয়গম্বরের মৃত্যুর পর আরবি প্রশাসনের নীতিতে বিদেশ জয় করে দেশে দেশে যে নতুন ইসলামি সরকার তৈরি হয়, এবং প্রশাসনের নীতি এবং পরম্পরা গড়ে ওঠে, সেই পরম্পরা অনুযায়ী দুজন পদাধিকারী দুজনের ওপর কড়া নজর রাখতেন।

সুবার দেওয়ান নির্বাচন করতেন সাম্রাজ্যের প্রধান দেওয়ান, সরাসরি তাঁর নির্দেশ পালন করতেন এবং তার ওপর তিনি কাগজপত্রে সর্বদা যোগাযোগ রেখে চলতেন। তিনি যখন তার কাছ থেকে সুবায় যাওয়ার জন্য বিদায় নিচ্ছেন, তখন প্রধান দেওয়ান তাকে বলতেন যতটা সম্ভব কৃষিজমি বাড়ানোর চেষ্টা করা দরকার, এবং আমিন পদের জন্য খুব বিশ্বাস্ত কোন মানুষ বাছতে হবে। প্রধান দেওয়ানকে প্রতিমাসে খাজাঞ্চিখানার হিসাবনিকাশের প্রতিবেদন দুবার পাঠতে বলতেন। দেওয়ান, ক্রোরি আর তহশিলদার নিয়োগ করতেন, যাদের কাজ ছিল, বলপ্রয়োগ না করে রায়দের কাছে গিয়ে তাদের বকেয়াগুলি আদায় করা।

নিয়োগপত্র বা সনদে সুবার দেওয়ানের যে সব কাজ নির্দিষ্ট থাকত, সেগুলি হল,
‘গ্রামাঞ্চলে কৃষি ও বসত এলাকার বিস্তৃতিকরণ। আর খাজাঞ্চিখানা থেকে যাতে কেউ নির্দিষ্ট নির্দেশনামা ছাড়া টাকাপয়সা বার না করতে পারে, সে বিষয়ে নজর রাখা। ফোতেদারের সিন্দুক থেকে যখন খাজাঞ্চিখানায় অর্থর স্থান বদল হত, তখন তাদের প্রতিনিধিদের নির্দিষ্ট অভিজ্ঞানপত্র(কাবজুলওয়াসুল) দেওয়া হত। কোন আধিকারিক বা আমিল যেন নিষিদ্ধ শুল্ক না তুলতে পারে সেটাও দেখা তার কর্তব্য ছিল।

‘কৃষি মরশুম শেষে প্রথম নোট শিটে আমিলদের করা তছরূপ এবং বলপূর্বক আদায় করা এবং তাদের থেকে বকেয়াপ্রাপ্ত নানান কর আদায় করার কাজ করতেন তিনি। তিনি দুর্নীতিগ্রস্ত আমিনদের নাম প্রধান দেওয়ানের কাছে পাঠাতেন এবং সঠিক আমিন যাতে সেই পদে অভিষিক্ত হতে পারে।

‘যদি কোন আমিলের গাফিলতির জন্য কোন এলাকায় রাজস্ব বাকি পড়ে তাহলে সেই রাজস্ব ৫শতাংশ বার্ষিক সুদে এবং কয়েক কিস্তিতে আদায় করতে হত।

‘বিগত বছরের সরকারের পক্ষে থেকে দেয় তাকাভি ঋণ গ্রামীনদের থেকে এই বছরের প্রথম মরশুমেই আদায় করতে হবে। তাঁরা যদি শোধ করতে না পারে, বা দেরি করে, তাহলে সরকার দেওয়ান এবং আমিনকে সেই পরিমান শোধ করতে বাধ্য করবে।

‘নিয়ম অনুযায়ী নির্দিষ্ট সময়ে নির্দিষ্ট নথিপত্র মহাফেজখানায় পাঠাতে হবে।
(চলবে)

দ্য মুঘল এডমিনিস্ট্রেশন - যদুনাথ সরকার

চতুর্থ অধ্যায়

সুবাগুলির প্রশাসন৩

নতুন সুবাদারকে কাজ সম্বন্ধে এই উপদেশ দেওয়া হত-

‘পদে বসার সঙ্গে সঙ্গে তোমার বশবর্তী, অভিজ্ঞ, অনুগামী, উচ্চশ্রেণীর দেওয়ান নিযুক্ত করবে, এবং একই গুণ এবং অভিজ্ঞতাযুক্ত মুন্সি(সচিব) নিযুক্ত করবে। তোমায় একজন বিশ্বাসী বন্ধু বা মাধ্যমের(ওয়াসিলা) ওপর নির্ভর করতে হবে, যে নিয়মিত যে কোন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে তোমার চাহিদা/চিঠি শীঘ্র সঠিকভাবে সম্রাটের কাছে পৌছে দিতে পারে। তাকে তোমায় উপযুক্ত উপহার দিতে হবে কেননা সে তোমার হয়ে এই কাজটি সময় ব্যয় করে করে দিতে সম্মত হয়েছে। মানুষ পীরদের মাজারে যান তাঁদের সমাধিতে ফুল দিতে। ফলে একজন জীবিত ব্যক্তি তো উপহার পাওয়ার আশা করে থাকতেই পারেন।

‘সুবার রাজনীতি বিষয়ে অভিজ্ঞ ব্যক্তিদের কাছে শুনবে কতজন জমিদারের ওপর বল প্রয়োগ করতে হবে এবং প্রজাদের সামূহিক চরিত্রও জানবে, এবং প্রশাসন(রাবত এবং জাবত) নিয়ন্ত্রন এবং চালানোর জন্য জরুরি সেহবান্দি সেনার(রাজস্ব আদায়ের অনিয়মিত সেনা, অনেকটা শস্ত্রধারী পুলিশের মত) পরিমানটাও জানবে।যদি খোঁজ খবর নিয়ে বোঝ তোমার সেহবান্দি এবং নিয়মিত(তাবিনাম) সেনার পরিমান সেখানে অপ্রতুল, এবং এগুলি এবং অন্যান্য বিষয়ে যদি তোমার সম্রাটকে কিছু জানানোর এবং আবেদন থাকে, তাহলে রাজসভার তোমার মাধ্যমকে দিয়ে সেই আবেদন তার কাছে শীঘ্র পৌঁছে দেবে। যদি সুবা চালানোর জন্য সম্রাট তোমায় পরিমান মত সেনাবাহিনী মঞ্জুর করেন, তা হলে তো ঠিকই আছে। না হলে, ভাববে তুমি নিজ খরচে সুবা প্রতিপালন করতে পারবে কি না, এবং সেই খরচ তোমার চাকরির মেয়াদে বেতন এবং ভাতা দিয়ে তুমি তুলে নিতে পারবে কি না(তাহলে সেইভাবে এগোনোর কথা ভাববে)। আর কোনোটাই যদি না আদায় করতে পার তাহলে পদ নিতে অস্বীকার কোরো, কেননা একজনমাত্র সেনা নিয়ে কোন প্রশাসক কি আর করতে পারে(মানে তুমি একজনই মাত্র সেনা যাকে সম্রাট যথেষ্ট বাহিনী দেন নি)।

‘তুমি যখন রাজধানী থেকে সুবার দিকে যাবে, তখন একচতুর্থাংশ যুদ্ধ অভিজ্ঞ, ভাল পরিবারের এবং অনুগামী তাবিনান(শস্ত্রধারী অনুগামী) নিয়ে যাত্রা করবে। সুবা থেকে অর্ধেক দূরত্বে গিয়ে আরও একচতুর্থাংশ একই ধরণের সেনাবাহিনী যাতে নিয়োগ করতে পার সেটি নিশ্চিত করবে। অসামরিক প্রশাসন ঠিকমত চালাবার জন্য, উপযুক্ত অভিজ্ঞ অনুগামী নিয়ে যাবে, তাঁদের পরিষ্কার বলবে যে সুবার সীমায় পৌছোন থেকেই তাঁদের কাজ শুরু হয়ে যাবে। অর্ধেক আধিকারিককে নিজের কাছে রাখবে, এবং বাকি অর্ধেককে তোমার সঙ্গে থাকা তাবিনান নিয়ে তোমার আগেই সুবার সদরে পৌঁছে যেতে বলবে, এবং তাঁদের নির্দেশ দেবে, তাঁরা পৌঁছমাত্র অভিজ্ঞ মানুষদের জড়ো করে প্রত্যেক জমিদারের এবং জমাদারদের চরিত্র জানতে, এবং তাঁদের নিজেদের মধ্যে সম্পর্ক, আগের সুবাদারদের সঙ্গে তাঁদের রাজস্ব বিষয়ক সম্পর্ক, এবং কোন জমিদার নির্দিষ্ট রাজস্বের থেকে বেশি রাজস্ব অর্পন করে, তা বুঝে নিতে। আর যখন তুমি সদর থেকে এক চতুর্থাংশ পথ দূরত্বে থাকবে, তখন কিছু অভিজ্ঞ সেনা পাঠিয়ে জমিদারদের তোমার অভ্যর্থনা জানানোর জন্য অপেক্ষা করতে নির্দেশ দেবে(মতলিখিত স্টাডিজ ইন আওরঙ্গজেব’স রেইনএ ওডিসা সুবাদার নিয়ে এই কথা বলা হয়েছে।)

‘তুমি যখন সুবার সীমান্তে পৌছবে, সেই দিন থেকে কোন দপ্তরে কোন কোন আধিকারিক দায়িত্ব নেবে তার ভাবনা ভেবে নেবে, এবং তাঁদের সঙ্গে ভাল ব্যবহার করবে, কেননা ভবিষ্যতে তাদের সিদ্ধান্তই তোমার পথ চলার সহায়ক হবে।

‘দুর্বিনীত জমিদার এবং নেতাদের শাসন করবে, যাতে এই ধরণের মানুষেরা এই দৃষ্টান্তে সাবধান হয়ে যায়, এবং কোন বাধাছাড়াই রাজস্ব দেয়।

‘সদরে প্রবেশ করেই দুর্গে যাবে(দুর্গ সাধারণত সুবাদারদের সরকারি বাসস্থান। দারুণ উতসবের ঘণঘটা করে তিনি সেই দুর্গে প্রবেশ করতেন; তবে প্রবেশ করার আগে পরামর্শ করতেন তার ব্যক্তিগত জ্যোতিষীর সঙ্গে, সঠিক মুহূর্তের জন্য হয়ত তাকে শহরের কোন রম্য বাগানে বহু দিন বাস করতে হত)। যদি মনে হয় কোন বাহিনী অতিরিক্ত বোঝা, বিশদ সমীক্ষার পর তাদেরকে বরখাস্ত করবে। তোমার অধস্তন কর্মীদের বকেয়া বেতনদেওয়া খুব কঠিন। দেওয়ানকে নির্দেশ দেবে সুবার আয় অনুযায়ী যেন ব্যয়ের ব্যবস্থা করেন।

‘রায়তদের সঙ্গে ভাল ব্যবহার করবে, তাদের মন দিয়ে কৃষি চালিয়ে যাওয়ার জন্য অনুপ্রেরণা দেবে। তাদের সামনে কোন কিছু হাট করে বলতে যেও না, বা খারাপ ব্যবহার কোর না। মনে রেখো রায়তেরা চিরস্থায়ী(রাষ্ট্রের আয়ের একমাত্র নিয়মিত সূত্র)। উপহার নিয়ে আসা জমিদারদের ভাল ব্যবহার কোরো। তাদের সেনা দিয়ে শাসন করার থেকে ভাল ব্যবহার করা অনেক শস্তার।
‘খালসা মহলের গাঁইয়াদের সঙ্গে ঝগড়া করতে যেওনা, তাহলে খালসার দেওয়ান তোমার ওপর রুষ্ট হবেন, তিনি সম্রাটকে গিয়ে তোমার বিষয়ে অভিযোগ করবেন এবং এ জন্য সম্রাট তোমাকে ডেকে পাঠিয়ে তোমার ব্যবহারের কৈফিয়ত চাইতে পারেন।

‘শেখ এবং কাজিদের সঙ্গে ভালভাবে কথাবার্তা বলবে। বাড়ি বাড়ি ভিক্ষে না করা দরবারিদের কুশল প্রশ্ন করে তাদের সাহায্য করবে। ফকির এবং সাধারণ ভিক্ষুককে ভিক্ষে দেবে। দেখবে ক্ষমতাবানেরা যেন দুর্বলদের ওপর অত্যাচার না করে।’

তার অন্যতম দায়িত্ব হল, তার প্রশাসনিক এলাকার কাছাকাছি থাকা, জমির ওপর নির্ভরশীল(ভাসাল প্রিন্স) রাজাদের থেকে বাকি দেয় আদায় করা এবং রাজসভার বরাদ্দগুলি যাতে নির্বিঘ্নে রাজসভায় পৌছোতে পারে তার ব্যবস্থা করা।
(চলবে)

দ্য মুঘল এডমিনিস্ট্রেশন - যদুনাথ সরকার

চতুর্থ অধ্যায়
সুবাগুলির প্রশাসন২
২। সুবাদার আর তার কাজ
সুবাদার শব্দটা উতসারিত হয়েছে আরবি সুব থেকে যার অর্থ, চুম্বকের কোন এক দিকে নির্দেশনা। এত বড় দেশ শাসন করতে গিয়ে মুঘল শাসকেরা প্রথমের দিকে দেশটাকে প্রশাসনিকভাবে চারটে ভাগ করেছিল এবং সেই অঞ্চলগুলির প্রশাসনিক প্রধানের নাম দেওয়া হত কেন্দ্রিয় প্রধান প্রশাসনিক পদের উপসর্গে সেই অঞ্চলটির নাম জুড়ে যেমন পূর্ব, পশ্চিম, দক্ষিণ আর উত্তরের বড়লাট(ভাইরসয়)। পরে এই ভাগগুলিকে সুবায় বিভক্ত করা হয়। ঠিক এইভাবেই বহমানি সাম্রাজ্যের ভাগগুলিও তরফদার নামে চিহ্নিত ছিল, তরফ মানে দিক।
ভারত দেশটি বিভিন্ন ভৌগোলিক এককে বিভক্ত ছিল, এবং প্রত্যেকটি এককে রাজত্ব করতেন বহু আদিবাসী গোষ্ঠী এবং তাঁরা প্রায়শই এক স্থান থেকে অন্য স্থানে মাইগ্রেট করতেন। ফলে শুধু এক অঞ্চলের নাম একটি আদিবাসী গোষ্ঠীর নামে করা খুব একটা বুদ্ধিমানের কাজ ছিল না, এবং এই এলাকায় বহু আদিবাসী গোষ্ঠীকে একত্রে বাস করতেন এবং সামাজিকভাবে তাঁদের পরস্পরের সঙ্গে খুব একটা ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিলও না। ফলে থিক হয় চার অঞ্চলে যদি সম্রাটের প্রতিনিধি পাঠানো যায়, তা হলে ব্যাপারটা সহনীয় হয় – এবং এই যুক্তিতে সুবাদার বা তরফদার শব্দের উদ্ভব।
সুবাদারের সরকারিভাবে নাম ছিল নাজিম বা এলাকার নিয়ামক। তার মূল কাজ ছিল শান্তি বজায় রাখা, রাজস্ব আদায় করা আর যে সব ফর্মান সম্রাট তাকে পাঠাতেন সেগুলি কার্যকর করা।
যখন কোন নবনির্বাচিত সুবাদার প্রধান দেওয়ানের সামনে গিয়ে সুবায় যাওয়ার অনুমতি চাইতেন, তখন দেওয়ান তাকে নিম্নলিখিত দায়িত্ব দিতেনঃ
‘অভিজ্ঞ মানুষেরা বলে গিয়েছেন, সুবাদারদের প্রধান কাজ হল, তার সুমধুর ব্যবহারে সব শ্রেণীর মানুষকে খুশি রাখা, ক্ষমতাবানেরা যাতে দুর্বলের ওপর অত্যাচার না করতে পারে তা দেখা এবং অত্যাচারীদের দাবিয়ে রাখতে হবে,
‘সম্রাটের নির্দেশ পূরণ করতে, সুবাদারেরা, তাঁদের অধস্তন হিসেবে কাজ করা মনসবদার নিয়োগ খুব বেছে বেছে করতে হবে, যাতে তাঁরা যোগ্য আধিকারিকরূপে প্রতিপন্ন হয়। তাকে বিদ্রোহী জমিদার এবং আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়া মানুষদের দমন করতে হবে, এবং প্রত্যেক মাসে তার সুবায় কি ঘটছে তার দুটি সমীক্ষা ডাক চৌকি মার্ফত রাজসভায় পাঠাতে হবে,
‘তুমি ঘুষ নিয়ে কোন ডাকাতকে মুক্তি দেবে না, কেননা তোমার এই ধরণের কর্মকাণ্ড সুবায় দুর্ণিতির বীজ বপন করব্র এবং অন্যান্য অভিজাতরা হয়ত মনে করতে পারে তাঁরা ঘুষ দিয়ে ছাড় পেয়ে যাবে, এবং অরাজক অবস্থার সৃষ্টি হবে যা তোমার পক্ষে নিয়ন্ত্রণ করা অসম্ভব হয়ে যাবে।’
সুবাদারের সাধারণত চল্লিশজন উপদেষ্টা থাকতেন, এবং তার কি করণীয় আর কি করণীয় নয়, তা আকবরের ফর্মানে রয়েছে(বার্ড, হস্টোরি অব গুজরাট)।
(চলবে)

দ্য মুঘল এডমিনিস্ট্রেশন - যদুনাথ সরকার



চতুর্থ অধ্যায়
সুবাগুলির প্রশাসন
১। আধিকারিকরা গ্রামের জীবন অপছন্দ করে ফলে গ্রামের স্বার্থে তাঁরা বিরূপ ছিলেন
সুবা’র প্রশাসনিক কাঠামো মূলিত কেন্দ্রিয় কাঠামোর ক্ষুদ্র প্রতিরূপ। প্রশাসনের প্রধান ছিলেন নাজিম, মানুষের লব্জে সুবাদার, আর ছিলেন দেওয়ান, বক্সী, কাজি, সদর, বুয়ুতাত এবং একজন নীতিবাগীশ, কিন্তু কোন খানইসামান পদ ছিল না। (জেলার বক্সীরা সাধারণত দপ্তরে না কাটিয়ে সুবাদারদের সঙ্গে জুড়ে থাকতেন।?)
সুবার সদরে প্রশাসনের মূল কেন্দ্র ছিল। গ্রিক ভাষ্যে যেভাবে আমরা শহুরে সরকারের নিদর্শন পাই সেটি ঠিক সে ধরণের প্রশাসন নয়, এটি একটি প্রশাসন যেটি শহরে থাকে এবং শহর এবং তার আশেপাশের বসবাসকারী অধিবাসীদের বিষয়ে বেশি চিন্তিত ছিল। মুঘলেরা শিকার করতে। বাগানে বেড়াতে এবং মাঝে মাঝে দূরে যেতে ভাল বাসলেও – আদতে কিন্তু তাঁরা অনপনেয় নাগরিক ঘরানার মানুষ ছিল – তাঁদের দেখাদেখি তাঁদের সভাসদ, আধিকারিক এবং সাধারণভাবে বললে মুসলমান সমাজের মধ্যবিত্ত এবং উচ্চবিত্তরা সকলেই নগরের অধিবাসী ছিলেন। গ্রাম সাধারণভাবে অবজ্ঞার বস্তু ছিল, এবং গ্রামজীবনকে শাস্তি হিসেবে ধরে নেওয়া হত।
অথচ গ্রাম থেকে তাঁদের খাদ্য আসত; সেটাই হয়ত তাঁদের গ্রামের সঙ্গে শেষ যোগাযোগ-সূত্র। রোমে সম্রাটের পাশে বসে যেভাবে কবিরা গ্রামকে দেখতেন, প্রায় সেই তত্ত্বেই মুঘল কবি, অভিজাতরা প্রভাবিত ছিলেন। এ সংক্রান্ত একটা পার্সি কবিতা শোনা যাকঃ জঘ দুম সুইশহর ওয়া সর সুইদেহ/দুমইআন জঘ আঝ সরইয়ু বেহ। যার অর্থ – বায়সের লেজ শহরের পানে, মাথা গ্রামের দিকে/সত্যিকারের লেজ মাথার থেকে উত্তরম।(হামিদুদ্দিনের আহকমইয়ালামগিরি থেকে – অনুবাদ গ্রন্থকারের)
সুবার প্রশাসন গ্রামের সঙ্গে যোগাযোগ রাখত ১) ফৌদারদের মাধ্যমে, যদিও সে প্রায়শই শহরে অতিবাহিত করত, ২) প্রশাসনের নিচের দিককার আধিকারিকেরা রাজস্ব আদায় করার জন্য গ্রামে থাকতেন, ৩) সুবাদারদের সভায় মাঝেমধ্যে জমিদারদের আসার মাধ্যমে, ৪) সুবাদার যদি কোন দিন গ্রামে যেতেন। এবং স্বাভাবিকভাবেই গ্রামের সঙ্গে এই যোগাযোগ খুব যে কিছু ঘনিষ্ঠ তা বলা যাবেই না, এবং প্রথম অধ্যায়ে আমি যা বলেছি, তা নতুন করে এখানে বলি, গ্রামকে নিজের মত করে বিকাশ হতে দেওয়া হয়েছিল, এবং যতদিন তাঁরা অবিচ্ছিন্নভাবে সাম্রাজ্যকে কর দিয়ে গিয়েছে, ততদিন শহরের আধিকারিকরা কেউ গ্রামের দিকে মুখ ঘুরিয়েও তাকান নি।

Wednesday, May 25, 2016

দ্য মুঘল এডমিনিস্ট্রেশন - যদুনাথ সরকার

 তৃতীয় অধ্যায়
অর্থ ও ঘরগেরস্তি(হাউসহোল্ড) দপ্তর১০
বুয়ুতাত(buyutat)এর দায়দায়িত্বঃ
বুয়ুতাত আরবি দ্বৈত-বহুবচন, মূল বাইত(bait) মানে বাড়ি। মুঘল ভারতে দেওয়ানইবুয়ুতাত বা জনগণেশের লব্জে বুয়ুতাত হল একটি পদ যার দায়িত্ব রাষ্ট্রের কাছে ঋণী কোন মৃত ব্যক্তির সম্পত্তি যেমন দখল করেন তেমনি মৃতদের সম্পত্তি যাতে তার উত্তরাধিকারীরা পায় তারও ব্যবস্থা করেন। তিনি খানইসামানের কিছুটা অধস্তন কর্মীরূপে কাজ করার দায়িত্বপ্রাপ্ত।তার কাজে এক্তেয়ারগুলি হলঃ
১) খাজাঞ্চিখানার তহবিল থেকে বিভিন্ন খরচ এবং কারখানার কাজের জন্য বরাদ্দ করেন,
২) খানইসামানের সহযোগিতায় তিনি মৃত অভিজাতের সম্পত্তি ক্রোক করতেন,
৩) কারখানার ব্যবস্থা(সরঞ্জাম) করা,
৪) বিভিন্ন দ্রব্যের দাম ঠিক করা,
৫) কারখানার তহবিলের ওপর নজর রাখা, দেওয়ানের দপ্তরে মাসিক আয়ব্যয়ের হিসেব পাঠানো,
৬) সম্রাট রাজধানীর বাইরে গেলে তাঁর সঙ্গে থাকা কারখানার দৈনিক হিসেব রাখা,
৭) প্রাপ্তি স্বীকার করা(কাবুজ),
8) বিভিন্ন দ্রব্যের বিশদ বর্ণনার ওপর তিনি তারিখ লিখবেন,
৯) গরুদের দাগানোর জন্য আনা হলে, তিনি লিখে দিতেন দাগানোর জন্য আনা হয়েছে
১০) বিভিন্ন কারখানার প্রস্তাবে, তাঁদের পুরোনো জিনিসপত্র বিক্রি করা বা না করার সিদ্ধান্ত,
১১) হল্টিং ডেজ ফর ক্যাটল ঠিক করেন,
১২) সাধারণ ভৃত্য, বরকন্দাজ এবং পশুবিষয়ক খাজাঞ্চিখানার অগ্রিম দেওয়া হয় তার উপস্থিতিতে
১৩) বিভিন্ন মঞ্জুরীপ্রাপ্ত পণ্যের(জিনসওয়া আজনান) চিঠি(স্লিপ) থাকত তার দপ্তরে,
১৪) কারখানার ঘরগুলি তার পাঞ্জার ছাপে বন্ধ করা হত,
১৫) খাদ্য রাখার মালখানা(যাখিরা)র সাধারণ দপ্তরীকে অগ্রিম দিতেন তিনি,
১৬) অন্য দপ্তরের জন্য কেনা জিনিসপত্রের দামের মান্যতা দিতেন তিনি,
১৭) কারখানার জন্য লিখিত অনুরোধে প্রথমে তার স্বাক্ষর থাকত, তার পর থাকত খানইসামানের,
১৮) পশু খাদ্যের খরচের সিহার এবং সামারি গ্রান্ট(সারাসারি তনখা) বুয়ুতাতের দপ্তরে যেতে হবে, তার পর স্বাক্ষর করবেন খানইসামান।
(চলবে)

দ্য মুঘল এডমিনিস্ট্রেশন যদুনাথ সরকার

তৃতীয় অধ্যায়
অর্থ ও ঘরগেরস্তি(হাউসহোল্ড) দপ্তর৯

প্রধান দেওয়ানের(হাই স্টুয়ার্ট) দায়িত্ব

দেওয়ানের তলায় থাকতেন সাম্রাজ্যের আমলাতন্ত্রের দ্বিতীয় প্রধানতম আধিকারিক দেওয়ান বা খানইসামান। তিনি আদতে খরচের আসল দেওয়ান।

\তার কাজকর্মগুলির প্রতি নির্দেশ

খানইসামানের অবর্তমানে এবং তার স্বাক্ষরে নগদ তহবিল(ক্যাশ ব্যালেন্স) এবং সংগৃহীত দ্রব্যগুলি, মুশরফ এবং তহবিলদারের পাঞ্জাগুলি মিলিয়ে দেখে নেবেন যে তালিকার সঙ্গে মজুদ ভাণ্ডার মিলছে কি না, না হলে তাঁদের ডেকে কম পড়া দ্রব্যগুলি ভর্তুকির ব্যবস্থা করবেন;

বিভিন্ন কারখানা এবং মালখানার বছরের ব্যায়ের হিসেব নিজের কাছে রাখবেন। খোঁজ করুণ কতগুলি খেলাত(পোষাক) খিলাতখানা এবং প্রত্যেক কারখানায় রয়েছে। মালখানার যদি আরও প্রয়োজন হয় তাহলে চাহিদা অনুযায়ী ব্যয়বরাদ্দ(সরনজাম) তৈরি করুণ(মাঝখানের ৪৯ পাতা নেই। তারপর...) ...নাহলে প্রয়োজনে পাওয়া যাবে না।

স্বর্ণকার, কলাইকার(এনামেলার), মুদ্রার ছাঁচ তৈরি কারক, জাল বুনক, ধাতুবিদ(অনেকটা স্বর্ণকারদের স্তরের – ‘সাধা কর’) ইত্যাদিদের সঙ্গে মিশে যান এবং ভাল ব্যবহার করুণ।

দস্তরএ খানইসামানের কাজকর্ম সম্বন্ধে যা দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে তা হল,
১) শ্রমিকদের রোজের শ্রমিকদের মাসিক, বাৎসরিক, এবং দৈনন্দিন হাজিরা এবং যারা নতুন ঢুকছে, তাঁদের বেতন এবং পুরাতনদের বেতনবৃদ্ধির কাগজে স্বাক্ষর
২) নানান কারখানার দারোগা, আমিন, মুশরিফ, এবং তহভিলদারদের নতুন নিয়োগ, পদচ্যুতি, বা বদলি
৩) কারখানার কাজের নিয়মনীতি এবং ঘরগেরস্তির খাজাঞ্চিখানার নীতি তৈরি
৪) শ্রমিকদের নিয়োগ এবং বেতনের চিটা(স্লিপ) তৈরি করা
৫) কারখানার ব্যবস্থাপকেদের বিভিন্ন দাবিদাওয়া নিয়ে প্রত্যুত্তর
৬) বিভিন্ন দাওয়াতখানা বা বিশ্রামগৃহে অভিজাতদের থাকার ব্যবস্থা
৭) নিমগোস্ত এবং পাওগোস্ত পরিদর্শন
৮) কারখানার শ্রমিকদের থেকে একরারানামা নেওয়া
৯) বিভিন্ন কারখানা এবং মালখানার দরখাস্ত বিচার বিবেচনা করা
১০) নজর, দান দক্ষিণার খরচ এবং উপহারের বিষয়ে নিজরদারি
১১) গৃহপালিত পশুদের খাদ্য বরাদ্দ
১২) কারখানা থেকে কোন কিছু ধার নেওয়া বিষয়ে অনুমতিপত্র
১৩) প্রাসাদের বিভিন্ন রান্নাঘরে খাদ্য বিতরণ করা, সেগুলি বাড়ানো বা কমানো, জেনানা মহল ছাড়া বিভিন্ন মহলের নির্দেশপত্রে প্রথমে খানইসামান এবং তার পত্র বুয়ুতাতের স্বাক্ষর প্রয়োজন।
১৪) মুতালিবাত বা রাষ্ট্রীয় আগ্রিম উদ্ধার বিষয়ে হিসাব-নিকাশ(মুহাসিবাত) উপস্থাপনায় স্বাক্ষর
১৫) কোন সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা। আর নজরদারিতে থাকা কোন আধিকারিকের সম্পত্তি বা বেতন নতুন করে ফিরিয়ে দেওয়ার নির্দেশ পাওয়ার সেই নকলটি স্বাক্ষর করে দেওয়ানের দপ্তর থেকে তার তনখা যাতে দেওয়া হয় তা নিশ্চিত করা।
১৬) জেলায় যাওয়া সম্রাটের যে কোন ফর্মায়েশ পূরণ করা।
১৭) বাগানের রোজগার গ্রহণ, এবং দোকান এবং বাড়ি থেকে ভাড়া নেওয়া
১৮) কারখানার বড় চিঠি রাখা,
১৯) সুবার ডায়েরি আর আওয়ারিজা এবং সম্রাটের আওয়ারিজা কোন পরিবর্তন ছাড়া বন্ধ(সিল) করে রাখা
২০) শহরে নতুন এসে থাকার জন্য আধিকারিকদের অগ্রিমের দরখাস্ত বিষয়ে স্বাক্ষর,
২১) কারখানার দারোগা, আমিন, মুশরিফ এবং তহবিলদারদের উপস্থিতির নথি প্রত্যায়িত করা
২২) পেশকাশ(উপহার এবং উপঢৌকন) বা কোন মৃত মনসবদার থেকে বরামত করা সম্পত্তির(আমনুল) নানা বিষয়ের তালিকায় স্বাক্ষর,
২৩) বিভিন্ন রিশালার প্রধান(সাহেবইরিশালা)দের আর্থিক উপহারে প্রতিস্বাক্ষর
২৪) বিভিন্ন কারখানায় মালবাহকদের বিতরণ
২৫) রাজকুমার/রাজকুমারীদের বিবাহের ব্যবস্থাপনা,
২৬) হিসাব-কিতাবের(মুহাসিবত) পর যে নগদ উদ্ধার হল, তার তুমার (রেজিস্টার) পরীক্ষক খানইসামানের দপ্তরে পাঠাবেন, এবং বুয়ুতাতএর দপ্তরে তার নকল পাঠাতে হবে।
২৭) বিভিন্ন বাড়ি আর গৃহ সম্বন্ধে পরিকল্পনা(বিকল্প পাঠে, হিসাব-কিতাব)।
(চলবে)

দ্য মুঘল এডমিনিস্ট্রেশন - যদুনাথ সরকার

তৃতীয় অধ্যায়
অর্থ ও ঘরগেরস্তি(হাউসহোল্ড) দপ্তর৭

ফলে আমরা খালসার দেওয়ান, রাজস্ব বিভাগের আমলা, আমিন, ক্রোরি, কর সংগ্রাহক, সায়ের মহালের কর সংগ্রাহক, খাজাঞ্চিখানার করণিকদের মত বিভিন্ন দপ্তর, বিভিন্ন আমলার থেকে যে বিভিন্ন তথ্য উপাত্ত এবং নথিপত্র সংগ্রহ করতেন, সেই তালিকা পেলাম।

৫। তনখার দেওয়ানের দায়িত্ব

দেওয়ানিতন নিম্নলিখিত বিষয়গুলি দেখতঃ

ক) সম্রাটের সামনে জমা দেওয়ার
জায়গির সংক্রান্ত সম্পর্কযুক্ত এবং নগদী তনখা
জমিদারি সংক্রান্ত নানান বিষয়
জায়গির আর সুবাদারদের দাউল
বকেয়া বিষয়ক নানান তথ্য
পরগণার আওয়ারিজা(Awarija)
জায়গিরের তাউজিয়া(Taujih)
মনসবদারদের পদবিষয়ক

খ) বিভিন্ন পরওয়ানা(নির্দেশ) – জায়গিরের মঞ্জুরি(তনখা), নগদী বেতন, তহবিলের নির্দিষ্ট বেতনের কর্মচারী এবং অন্যান্যরা, নিউজলেটারে উল্লিখিত বিভিন্ন অভিযোগ বিষয়ে, পরগণা থেকে বদলি হওয়া আমলার জায়গির বিষয়ক নির্দেশ, মনসবদারদের অগ্রিমের উদ্ধার।

গ) যে সব নথিতে স্বাক্ষর করতে হয় – জায়গিরের সিয়াহা(Siaha), দান বিষয়ক – মুসাইদাত, বিভিন্ন অগ্রিমের ক্ষতিপূরণ বিষয়ক

ঘ) বিভিন্ন নগদী এবং দানের(গ্রান্ট ইন এইড) বরাদ্দ(তনখা)র অনুমতিপত্র(দস্তক)

ঙ) সম্রাট আধিকারিকদের কাছে বরাদ্দ এবং বাকি(তলবদর – talbdar)র তালিকা(তুমার)য় স্বাক্ষর করে দেওয়ার পরে, প্রধান দেওয়ান তার নকলে প্রতি-স্বাক্ষর করবেন। পাদশাহী নির্দেশ(আহকাম – ahkam) শীঘ্রই বকশী এবং অন্যান্য আধিকারিকদের নজরে আনা হবে। স্বাক্ষরিত হিসাব-নিকাশের নথিপত্র জায়গিরদারদের মুস্তাফি, iyuz-i-jagir এবং দেওয়ানের কাছে নিয়ে আসতে হবে স্বাক্ষরের জন্য।
নগদের দাউলএর জন্য দিওয়ানিতনের স্বাক্ষর প্রয়োজন। ছাপদেওয়া(ব্রান্ডিং, ঘোড়ায়?) এবং রিসালা(অশ্বারোহী সৈন্য)পরীক্ষার কাগজে তিনি অনুমতি দেওয়া হল লিখে দেবেন।
শ্রমিকদের বেতনের তালিকার সংক্ষিপ্তসারে তিনি স্বাক্ষর করে লিখে দেবেন, অমুক তারিখ থেকে অমুক তারিখ পর্যন্ত নগদ বরাদ্দ
মনসবদার এবং অন্যান্য দপ্তরীদের বক্তব্যর(মেমো) নকল দ্বিতীয়বারের জন্য সম্রাটের সামনে উপস্থিত করা হলে দেওয়ান তাতে স্বাক্ষর করে লিখবেন, ঠিকঠাকভাবে মিলিয়ে দেখা হল।

চ) আইমা এবং অন্যান্য বিষয় – বিভিন্ন দানপত্রের জন্য ফর্মান, মেমো, এবং নির্দেশে। এগুলি সুবার নিউজলেটার দপ্তরে রাখা হত।

ছ) করণ – সম্রাটের নির্দেশ অনুসারে ফর্মান, পরওয়ানা(হাসবুলহুকুম)
(চলবে)