Monday, August 21, 2017

উপনিবেশ বিরোধী চর্চা ৪ শূদ্র-বৈশ্য-মুসলমান এবং অন্যান্য পরম্পরার সমাজের উদ্যোগী(ওয়াপাগ)দের দাবি- এমএসএমই নয় আলাদা পারম্পরিক বিশ্ববাংলা মন্ত্রক চাই

{এটা কয়েকটা কিস্তির ধারাবাহিক - এবারে চতুর্থ কিস্তি। Somnath Roy, Rouhin Banerjee চেয়েছিলেন এই ধরণের লেখা। এবং যারা মনে করছেন এই উৎপাদন ব্যবস্থা সম্বন্ধে জানা দরকার তাদের জন্য।
বনেদিয়ানার ঢঙেই বলি, এটা তাত্ত্বিক তাথ্যিক লেখা হবে। সবার জন্য নয়। সুখপাঠ্য তো নয়ই। দাবিটি আপাদমস্তক রাজনৈতিক। বর্তমান রাজনৈতিক অবস্থার ছাপ অনপনেয়ভাবেই পড়েছে। যাদের এই রাজনৈতিক বক্তব্য অস্বস্তির এবং এই বিশাল লেখাটি ঝামেলাদার মনে হবে স্বচ্ছন্দে এড়িয়ে যেতে পারেন।
এর আগে কয়েকবার এই নিয়ে আলোচনা করেছিলাম - কিন্তু সাঁটে। এবারে বিশদে প্রেক্ষাপট এবং তার ঐতিহাসিক ভূমিকা তৈরি করে দেওয়া গেল।}
---
***
বড় পুঁজি নির্ভর লুঠেরা শিল্পবিপ্লবের প্রাথমিক দর্শন হল উৎপাদনের কেন্দ্রিকতা এবং এই কেন্দ্রিকতা সফল হয় না যদি না শ্রমকে বৃহৎভাবে প্রতিস্থাপন করা যায় বিপুল যন্ত্র ব্যবহার এবং বিশ্বজোড়া প্রাকৃতিক সম্পদ লুঠ করে। ফলে শ্রম প্রতিস্থাপনকারী প্রযুক্তি বিকাশ ঘটতে শুরু করে বিদ্যুৎবাহী স্বতঃচল মাকু চালানোর মাধ্যমে। তাতেও কাপড়ের মিলের লাভ দেখা যায় নি, যতদিন না পলাশী উত্তর সময়ে বাংলা লুঠের সম্পদ লন্ডনে যায় নি আর ভারতের আড়ং নির্ভর বস্ত্রশিল্পকে গায়ের জোরে উচ্ছেদ আর দেশিয় বাজার দখল করে লুঠের সম্পদের ভর্তুকি নির্ভর মিলগুলির খুব খারাপ উৎপাদন এই বাজার গুলোতে বিক্রির ব্যবস্থা করা যায় নি এবং লন্ডনে বাঙলা তথা ভারতীয় বস্ত্র পণ্যের ওপর ৮৫%এর ওপরে শুল্ক লাগু হয় নি।
বড় পুঁজির এই দখলদারির কাজে সরাসরি সাহায্য করেছে ঔপনিবেশিক প্রযুক্তি আর শিক্ষায় শিক্ষিত ভদ্র মধ্যবিত্ত এবং তাঁদের উচ্চমধ্যবিত্ত হয়ে ওঠার প্রণোদনা। সে পলাশির পর থেকেই বাংলার সম্পদ লুঠ আর শ্রম প্রতিস্থাপনের কাজে বড় পুঁজিকে নিঃশর্ত সাহায্য করে গিয়েছে। সিঙ্গুর আন্দোলনে দেখা গিয়েছিল, ১৫০০ কোটি টাকার কোম্পানিতে সরাসরি কাজ হওয়ার কথা মেরে কেটে ১০০০-১৫০০ পশ্চিমি প্রযুক্তিতে দক্ষতা অর্জন করা শ্রমিকের। সেটা সরাসরি আসত শহরের আশেপাশে বা অধিকাংশ বাঙলার বাইরের ভদ্র পরিবার থেকেই। বড় পুঁজির বিকাশের সঙ্গে ভদ্র-মধ্যবিত্তের স্বার্থ আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িত - ফলে বড় পুঁজির দখলদারির স্বার্থ তারা দেখবে এটা আর আশ্চর্যের কি?
আমরা যারা ছোট গ্রামীন উতপাদকেদের রাজনীতিতে জড়িয়ে রয়েছি, তারা মনে করি বাংলা/ভারত/এশিয়ার গ্রামীন উৎপাদন ব্যবস্থা, বিশ্ব উতপাদন ব্যবস্থার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দর্শন। এই ক্ষেত্রে হাজারো বিক্রেতা, হাজারো উৎপাদক বিরাজ করে - পুঁজির, লাভের মালিকানা একজন বা কয়েকজনের হাতে জড়ো হয় না, সারা সমাজে ছড়িয়ে যায়। সামাজিক সাম্য বজায় থাকে।
বড় পুঁজি প্রণোদিত হোস্টাইল টেকওভারের মত শুধুই গায়ের জোরে, বড় পুঁজির তৈরি প্রশাসনের আইনের লাঠি দেখিয়ে অনিচ্ছুক উতপাদকের উৎপাদন পরিকাঠামো কিনে নেওয়ারও সুযোগ নেই গ্রামীণ উৎপাদন ব্যবস্থায়। এই উৎপাদন ব্যবস্থা অনেক বেশি গণতান্ত্রিক, অনেক বেশি পরিবেশ বান্ধব, কম অপচয়ী, প্রযোজনভিত্তিক, স্থানীয় অর্থনীতিকে জোরদার করে, স্থানীয়ভাবে কর্ম সৃষ্টি করে, স্থানীয় জ্ঞান, দক্ষতা আর বাজারভিত্তিক - লাভ দূর দেশে বসে থাকা একজন বা কয়েকজনের হাতে গিয়ে সে লাভ জড়ো হয় না। ফলে আমরা সরাসরি শ্রম প্রতিস্থাপন দর্শনের বিরোধী, বড় পুঁজির গায়ের জোরে দখলদারির বিরোধী, শ্রমের, জ্ঞানের, দক্ষতার অবমাননার বিরোধী।
অবশ্যই এই দক্ষতা জ্ঞান প্রজ্ঞা আর গ্রামীন নিজস্ব বাজার, কাঁচামাল নির্ভর উতপাদন ব্যবস্থায় বড় পুঁজির মূল ব্যবস্থাপক মধ্যবিত্তের পুনর্বাসনের জায়গা নেই। স্বাভাবিকভাবেই এই বিকেন্দ্রিভূত দর্শনটি মধ্যবিত্ত ভদ্রলোক তাঁদের স্বার্থেই অপছন্দ করবেন এবং করছেনও। তাই তাদের জগতে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের তেলেভাজা শিল্প তৈরির ডাকে ব্যঙ্গের মিচকি হাসির হররা। অথচ গত কয়েক দশক ধরে বাংলার উন্নয়ন মানচিত্রে সিঙ্গুর, নন্দীগ্রাম, হরিপুর ইত্যাদি আন্দোলনের প্রেক্ষিতে বড় পুঁজি, জমি, মালিকানা, উৎপাদন পদ্ধতি বিষয়ে যে বিতর্ক জমে উঠেছে তা মনের জানালা খুলে দেয়। নতুন করে ভাবতে শেখায় – কিন্তু ইংরেজী শিক্ষিত ভদ্র বাঙালি কলার তোলা কর্পোরেট তল্পিবাহকই থেকে যায়।
***
মূল বিতর্কে ঢোকার আগে দেখে নেওয়া যাক গ্রাম উতপাদকেদের বাংলা বাজার কতটুকু। বাংলায় অন্তত ৫০ লক্ষ ছোট উদ্যমী, ৭ লক্ষর বেশি তাঁতি এবং অন্তত ৩ লক্ষ পরম্পরার অভিকর শিল্পী রয়েছেন – মোট সংখ্যা ৬০ লক্ষ। এবারে বোঝা যাক – যদি প্রত্যেককে মাসে দুহাজার টাকা রোজগার করতে হয়, তাহলে নিশ্চই বছরে ন্যুনতম ১ লাখ টাকার উতপাদন এবং ব্যবসা করতে হবে। তাহলে ৬০ লক্ষ গুণ ১ লক্ষ – অর্থাৎ ন্যুনতম ৬০ হাজার কোটির ব্যবসা দেয়। এর সঙ্গে প্রায় ১০ কোটির বাংলায় অপরম্পরাগত ছোট গ্রামীন ব্যবসা, কৃষি ইত্যাদির যোগ করলে সেটি আকাশ ছোঁবে।
বাংলার ক্ষেত্রফল এবং জনসংখ্যা ভারতের গড় জনসংখ্যার কাছাকাছি – এই অঙ্কের সঙ্গে যদি আমরা রাজ্যগুলির গুণিতক করে ফেলি তাহলে যে অঙ্কটা দাঁড়াবে তা চোখ কপালে তোলার মতই। কর্পোরেট ব্যবসার উচ্চতার শ্রেষ্ঠতার ফানুষ চুপসে যায়। তাই এই বিশাল বিপুল অর্থনীতির জোরে ২০০৮এর ইওরোপ আমেরিকার বিষকে নীলকণ্ঠের মত ধারণ করে গ্রাম ভারত, কর্পোরেট ভারতকে উদ্ধার করে আর সেই বেল আউটের জেরে কর্পোরেট অর্থিনীতির ফাণ্ডামেন্টাল কত জোরদার সেই ফানুসে বাতাস ভরে বড় পুঁজি পোষিত ফেউয়েরা।
ফিরি আমাদের বিতর্কে – জ্ঞান, প্রজ্ঞা, দক্ষতা, নিজের বাজার, নিজস্ব প্রযুক্তি, নিজের কাঁচামাল, আর নিজের এলাকায় শ্রম বাজারের ব্যবস্থাপনা নিজের হাতে রাখার বৈশ্য শূদ্র মুসলমান এবং অন্যান্য পরম্পরার সমাজের গ্রাম উদ্যমের জন্য কেন এমএসএমই মন্ত্রকের বাইরে আমরা একটা আস্ত মন্ত্রকএর দাবি জানাচ্ছি সেই যুক্তি-প্রতিযুক্তিতে। আমাদের প্রতীতি প্রমান করতে আমরা একটা পথ নিয়েছি – দুটি বিষয়ের তুলনা।
বিতর্কে ঢোকার আগে, আগেই যেটা বলেছি, সেটা নতুন করে বলে নেওয়া দরকার, এমএসএমই উদ্যোগীরা আমাদের ভাই। সেই উদ্যোগীদের সঙ্গে পরম্পরার গ্রামীন উদ্যোগের কোন বিরোধ নেই। কিন্তু দুটি উদ্যম আলাদা। তাদের মধ্যে শুধু উৎপাদন করা ছাড়া কোন কিছুতেই যে মিল নেই তা আমরা এবারে দেখাব।
(চতুর্থ কিস্তির সমাপ্তি)

No comments: