{এটা কয়েকটা কিস্তির ধারাবাহিক। Somnath Roy, Rouhin Banerjee চেয়েছিলেন এই ধরণের লেখা। এবং যারা মনে করছেন এই উৎপাদন ব্যবস্থা সম্বন্ধে জানা দরকার তাদের জন্য।
বনেদিয়ানার ঢঙেই বলি, এটা তাত্ত্বিক তাথ্যিক লেখা হবে। সবার জন্য নয়। সুখপাঠ্য তো নয়ই। দাবিটি আপাদমস্তক রাজনৈতিক। বর্তমান রাজনৈতিক অবস্থার ছাপ অনপনেয়ভাবেই পড়েছে। যাদের এই রাজনৈতিক বক্তব্য অস্বস্তির এবং এই বিশাল লেখাটি ঝামেলাদার মনে হবে স্বচ্ছন্দে এড়িয়ে যেতে পারেন।
এর আগে কয়েকবার এই নিয়ে আলোচনা করেছিলাম - কিন্তু সাঁটে। এবারে বিশদে প্রেক্ষাপট এবং তার ঐতিহাসিক ভূমিকা তৈরি করে দেওয়া গেল।}
এর আগে কয়েকবার এই নিয়ে আলোচনা করেছিলাম - কিন্তু সাঁটে। এবারে বিশদে প্রেক্ষাপট এবং তার ঐতিহাসিক ভূমিকা তৈরি করে দেওয়া গেল।}
---
গাঁইয়া বৈশ্য-শূদ্র-মুসলমানেদের মত ছোটলোকেদের সংগঠন বঙ্গীয় পারম্পরিক কারু ও বস্ত্র শিল্পী সংঘ বা উইভার্স আর্টিজান এন্ড পার্ফর্মিং আর্টিস্টস গিল্ডের(ওয়াপাগ) কাছে, ২০১৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনটা খুব অদ্ভুত ঢাপুয়া বাতাস। সদস্যরা চোখ ফেড়ে ফেড়ে দেখছিলাম বাংলায় পুঁজির তাত্ত্বিক আর অনুগামীদের তাত্ত্বিক হেঁটমুণ্ডউর্ধপদীকরণ। সে এক মজার কান্ড। যে রাজনৈতিক দলের চোখের পাতা না ফেলে বড় পুঁজির ব্যবসার দালালি করার কথা – তারা গ্রামের মূলতঃ শূদ্র-বৈশ্য-মুসলমান এবং অন্যান্য পরপম্পরার ছোট উদ্যমী বা পথের ব্যবসায়ীদের পাশে দাঁড়াচ্ছে – তেলেভাজা শিল্পকে মদত দেওয়ার কথা বলছে আদতে ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর উদ্যম তৈরি এবং পৃষ্ঠপোষকতা করার কথা বলছে। খুব সাধারণ গ্রামীন শূদ্র-বৈশ্য-মুসলমান এবং অন্যান্য স্বউদ্যমী উতপাদক বিতরক, যাদের নিজের বাজারে দাঁড়িয়ে থাকার দক্ষতা, ধার পাওয়া বা ব্যাঙ্কেবিলিটি বা পুঁজি বিনিয়োগ বা প্রযুক্তি কেনা নয়, বরং পরম্পরা, জ্ঞান, দক্ষতা, প্রজ্ঞা এবং স্থানীয় বাজার নির্ভরতা এবং নতুন সময়ে সেই পরম্পরাকে নতুন করে ব্যবহারের উদ্যমে গ্রামীন অর্থনীতিকে জোরদার এবং শহরের টাকা গ্রামে আনার রাজনীতি করেন - তাদের পাশে দাঁড়াচ্ছেন - ঘোমটা পরে নয়, সরাসরি - ভদ্র শিক্ষিত বামপন্থী পুঁজিবাদী কুতসা সত্ত্বেও।
গাঁইয়া বৈশ্য-শূদ্র-মুসলমানেদের মত ছোটলোকেদের সংগঠন বঙ্গীয় পারম্পরিক কারু ও বস্ত্র শিল্পী সংঘ বা উইভার্স আর্টিজান এন্ড পার্ফর্মিং আর্টিস্টস গিল্ডের(ওয়াপাগ) কাছে, ২০১৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনটা খুব অদ্ভুত ঢাপুয়া বাতাস। সদস্যরা চোখ ফেড়ে ফেড়ে দেখছিলাম বাংলায় পুঁজির তাত্ত্বিক আর অনুগামীদের তাত্ত্বিক হেঁটমুণ্ডউর্ধপদীকরণ। সে এক মজার কান্ড। যে রাজনৈতিক দলের চোখের পাতা না ফেলে বড় পুঁজির ব্যবসার দালালি করার কথা – তারা গ্রামের মূলতঃ শূদ্র-বৈশ্য-মুসলমান এবং অন্যান্য পরপম্পরার ছোট উদ্যমী বা পথের ব্যবসায়ীদের পাশে দাঁড়াচ্ছে – তেলেভাজা শিল্পকে মদত দেওয়ার কথা বলছে আদতে ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর উদ্যম তৈরি এবং পৃষ্ঠপোষকতা করার কথা বলছে। খুব সাধারণ গ্রামীন শূদ্র-বৈশ্য-মুসলমান এবং অন্যান্য স্বউদ্যমী উতপাদক বিতরক, যাদের নিজের বাজারে দাঁড়িয়ে থাকার দক্ষতা, ধার পাওয়া বা ব্যাঙ্কেবিলিটি বা পুঁজি বিনিয়োগ বা প্রযুক্তি কেনা নয়, বরং পরম্পরা, জ্ঞান, দক্ষতা, প্রজ্ঞা এবং স্থানীয় বাজার নির্ভরতা এবং নতুন সময়ে সেই পরম্পরাকে নতুন করে ব্যবহারের উদ্যমে গ্রামীন অর্থনীতিকে জোরদার এবং শহরের টাকা গ্রামে আনার রাজনীতি করেন - তাদের পাশে দাঁড়াচ্ছেন - ঘোমটা পরে নয়, সরাসরি - ভদ্র শিক্ষিত বামপন্থী পুঁজিবাদী কুতসা সত্ত্বেও।
আর যাদের তাত্ত্বিকভাবে বড় পুঁজির পাশে দাঁড়াবার কথা নয়, বড় পুঁজির তৈরি শৃঙ্খল ভেঙ্গে যারা সমাজে সাম্য আনার ব্রতী - তারা বড় পুঁজির পাশে দাঁড়াবার কাজ খুব সফলভাবে করে চলেছেন – কোন নেতা উদ্বাহু হয়ে কৃষি থেকে শিল্পায়ন(বড় পুঁজির)এর ‘উত্তীর্ণ’ হওয়ার তত্ত্বের তরফদারি করছেন, কেউ আবার চাষার ছেলে চাষা হবে নাকি এই অশ্লীল বিতর্কে ভোট জমাবার চেষ্টা করছেন, কেউ আবার বড় পুঁজির বাজারে বাতিল চার চাকা চড়ে সেই প্রকল্প থেকে মুখ ঘুরিয়ে নেওয়া অঞ্চলে ভোট প্রচারে ব্রতী - সেই পরিচয় বদলের কম্মটা দেখে শুনে, বোধহয় নতুন সময়ে, নতুন করে শিক্ষা নেওয়ার সময় এসেছে। সময় এসেছে শূদ্র-বৈশ্য-মুসলমান এবং অন্যান্য পরম্পরার সমাজের স্বউদ্যমী, জ্ঞানী, প্রজ্ঞাবান, দক্ষ, প্রযুক্তিবিদ এবং নিজের বাজারে নিজে দাঁড়িয়ে নিজের কাঁচামাল নিয়ে বড় পুঁজির সঙ্গে লড়াই করে চলা মানুষদের জন্য আলাদা মন্ত্রক দাবি করা আর ঔপনিবেশিক হস্তশিল্পী তকমা ঝেড়ে ফেলার নতুন করে দেশিয় উতপাদন ব্যবস্থার দিকে নজর দেওয়ার।
আজ সেই দাবির যৌক্তিক বিস্তৃতিতে ঢোকার আগে সময় এসেছে গাঁয়ের অর্থনীতির কুড়টি ধরে বসে থাকা এই মানুষগুলি ব্রিটিশ সময়ের পূর্বে কি ছিল তা বোঝা।
***
***
পলাশী চক্রান্তের আগে কয়েক হাজার বছর ধরে বাংলা তথা এশিয়ার নানান কৃষি আর শিল্প দ্রব্যই ছিল সমগ্র এশিয়া/আফ্রিকা/ইওরোপের ভোগ্য। ১৮০০র আগের চার শতকে, বংলা/ভারত থেকে রপ্তানি হওয়া নানান পণ্য ব্রিটেন তথা ইওরোপিয় জীবনযাত্রার মান নতুন এক উচ্চতায় পৌঁছে দিয়েছে – যা আমরা এই বিশ্বায়নের সময়ে ভুলতে বসেছি। বিগত দুশ বছর ধরে একটি উলট পুরাণ অভিনীত হয়ে চলেছে ‘ফোরেন গুডস’এর প্রতি ভারতের ভদ্র উচ্চমধ্যবিত্তের আদেখলেপনার দেখনদারিতে – বড় পুঁজির লুঠেরাভূমি ভারতবর্ষের মাটিতে। পলাশির আগে লন্ডনসহ ইওরোপে বাংলার চা, মসলিন ইত্যাদি মূলত বাঙলার ভোগ্যপণ্য ভোগের উচ্চ-মধ্যবিত্তের অসম্ভব আদিখ্যেতার বর্ণনা, জেন অস্টিনের উপন্যাসেরমত রিজেন্সি যুগের নানান সাহিত্যে ফুটে রয়েছে।
বছরের পর বছর ধরে রপ্তানিমুখী আর বিপুল আভ্যন্তরীণ দেশিয় বাণিজ্যের হাত ধরে কারিগরির যন্ত্রের বিকাশ, ভারতে আর বিশ্বে নতুন নতুন বাজার তৈরি, নতুন নতুন পণ্যদ্রব্যের উদ্ভাবনী দক্ষতায় বাংলার গ্রাম উতপাদকেরা ছিলেন মাহির। মনে রাখতে হবে ভারতের উৎপাদনের মাত্র ১০ শতাংশ ইওরোপে যেত রপ্তানির জন্য – বাকিটা কিন্তু দেশে/এশিয়ার আভ্যন্তরীণ বাজারে বিক্রি হত। শুধু বস্ত্র উত্পাদনে অসাধারণ দক্ষতাই নয়, নানান ধরণের ধাতুজ সংকর দ্রব্য(ক্রুসিবল স্টিল – প্রখ্যাত দামাস্কাস তরোয়ালের পিন্ডটি তৈরি করতেন বাংলা/ভারতের ডোকরা কামারেরা। আজও তাঁরা যে লোহার দ্রব্য তৈরি করেন, তাতে মাথা খারাপকরা জং ঢাকতে, বিন্দুমাত্র রংএর প্রয়োজন হয় না – যে প্রযুক্তি আজও প্রযুক্তিগর্বী ইওরোপের অধরা – দিল্লির লৌহ স্তম্ভ অথবা বিষ্ণুপুরের মদনমোহন কামান মাথায় ছাতা ছাড়াই শয়ে শয়ে বছর খোলা আকাশের তলায় পড়ে থাকে মাথা উঁচু করে, কোণার্কের ৮০ ফুটের শোয়ানো বিম আজও বিষ্ময় জাগায়, এখোনো বাংলার যে কোনও পুরোনো পরিবারের ঠাকুর ঘরের কাঁসা-পিতলের তৈরি দেবতা কোনও বিশেষ প্রসাধন ছাড়াই বিরাজমান রয়েছেন কয়েকশ বছর অক্লেশে), খাবারদাবার (পান, সুপুরি, গুড়, চা, নুন, মশলা, চাল, মিষ্টি, ফল, আচার, সাদা চাটনি, চিনি, মদ্য (গৌড়ি বা রাম), মধু, চিনি, গুড় ইত্যাদি), পরিধেয় (চামড়া, সুতো, সিল্ক, তসর, মুগা, এন্ডি, পাট), রং(নীল অর্থাত ইন্ডিগোসহ হাজারো প্রাকৃতিক রং), শিল্প-শিল্পী(মুর্শিদাবাদের হাতির দাঁতের কারুশিল্পী, হাতির দাঁতের তৈরি নানান আসবাব তৈজস রপ্তানি হত পারস্যে ইওরোপে, মস্করী বা পটুয়ারা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার নানান বৌদ্ধ গুম্ফায় ছবি এঁকেছেন, মগধের (পাটনা – সে সময়ের বাংলার সীমানার মধ্যেই ছিল) বঙ্গের পাথর শিল্পীরা অজন্তা ইলোরা বরবুদর, চম্পা (কাম্পুচিয়ায়)মন্দির খোদাই করেছেন, আরব সহ বিশ্বের দামিতম ভারি জাহাজগুলি তৈরি হত সন্দ্বীপ আর হুগলীর বলাগড়ে, বাংলা থেকে তাঁত শিল্পী বস্ত্র শিল্প শেখাতে গিয়েছেন পারস্যে- আজকের বড় পুঁজির প্রয়োজনে ভেঙে দুমড়ে মুচড়ে ধ্বংস হয়ে যাওয়া ইরাকে), মাটির বাড়ি তৈরির (পোড়া মাটির মন্দির অন্ততঃ তিনশো বছর ধরে রোদ, জল, ঝঞ্ঝায় দাঁড়িয়ে থেকেছে বাংলার প্রযুক্তির অনন্য বিজ্ঞাপন হয়ে, আজও বিলাসবাহুল বাড়ির ব্রিটিশ নাম কিন্তু বাংলা আঙ্গিকের বাড়ি যার পোশাকি নাম বাংলো) প্রযুক্তি আর পণ্য সরবরাহ করত নিজের জ্ঞান, প্রযুক্তি, দক্ষতা, প্রজ্ঞা, কাঁচামাল আর বাজার নির্ভর বাংলার গ্রাম শিল্পীরা। অকলঙ্ক খ্যাতি ছিল নানান ধরনের বস্ত্র উত্পাদনে, লৌহ দ্রব্য তৈরিতে, শিল্পীর গুণমানে আর কারিগরীর চূড়ান্ত দক্ষতায়।
(এরপরে দ্বিতীয় পর্ব)
(এরপরে দ্বিতীয় পর্ব)