খৃষ্টীয় ষোড়শ শতাব্দীর শেষ ভাগে ও সপ্তদশ শতাব্দীর
প্রারম্ভে বঙ্গভূমির অবস্থা চরমসীমায় উপনীত হয়। সেই সময়ে বাঙ্গালায় পাঠানরাজত্বের
অবসান হওয়ায়, বঙ্গভূমি বাঙালীগণেরই শাসনাধীনে আইসে। বিশেষতঃ পুর্ব্ব ও দক্ষিণ বঙ্গ
বারভূঁইয়ার অধীন থাকায় তৎপ্রদেশের অনেক উন্নতি সাধিত হইয়াছিল। বারভূঁইয়ার মধ্যে
হিন্দু ও মুসলমান এই দুই জাতিই ছিল। ইঁহাদের মধ্যে অনেক পরিমাণ সৌহার্দ্দও ছিল। এই
সময়ে রালফ ফিচ্ বঙ্গভূমিতে আগমন করেন, তিনি কোন কোন ভুঁইয়ার বিষয় উপস্থিত
করিয়াছেন। তাঁহার পর জেসুইট পাদ্রীগণ বঙ্গদেশে উপস্থিত হন। ফার্ণাণ্ডেজ, সোসা, ফন্সেকা
ও রাউস নামে চারিজন পাদরী ষোড়শ শতাব্দীর শেষভাগে উপস্থিত হইয়া সপ্তদশ শতাব্দীর
কয়েক বৎসর পর্য্যন্ত এতদ্দেশে অবস্থিতি করিয়াছিলেন। তাঁহারা ভুঁইয়াদিগের ও
বঙ্গদেশের অবস্থা বিশেষরূপে বর্ণনা করিয়া গিয়াছেন। তাহাদের বিবরণ লইয়া ডুজারিক
নামে একজন ফরাসী ঐতিহাসিক স্বীয় গ্রন্থে বাঙ্গালার বিবরণ বিস্তৃতভাবে লিপিবিদ্ধ
করিয়া গিয়াছেন। ডুজারিকের গ্রন্থ ১৬১০
খৃঃঅব্দে প্রকাশিত হয়। তাঁহার পর সামুয়েল পার্শা নামে ইংরেজ গ্রন্থকার স্বীয় গ্রন্থে
বাঙ্গালার সম্বন্ধে অনেক বিবরণ প্রদান করেন। পার্শা গ্রন্থ হইতে আমরা জানিতে পারি
যে, আমাদের সোনার বাঙ্গালায় তৎকালে ধান্য, গম, চিনি, আদা, লঙ্কা, তুলা, ও রেশম
অপর্য্যাপ্ত পরিমাণে জন্মিত এবং সন্দ্বীপ প্রভৃতি স্থান হইতে অনেক পরিমাণে লবনের
রপ্তানী হইত। পার্শার গ্রন্থ ১৬২৫ খৃঃ অব্দে প্রকাশিত হয়। এই সময় হইতে পর্টুগীজগণের অনুসরণ করিয়া
ওলান্দাজগণ বঙ্গদেশে বাণিজ্যার্থে আগত হয়। তাঁহারা চুঁচুড়া, বরাহনগর, কালিকাপুর,
ঢাকা প্রভৃতি স্থানে কুঠি স্থাপন করে। ইহাদের পর ইংরাজ ও ফরাসী বণিকগণ এতদ্দেশে
উপস্থিত হয়।
ইউরোপীয় বণিকগণ ক্রমে বঙ্গভুমিতে বণিজ্যব্যাপারে লিপ্ত
হইলে ইউরোপীয় পরিব্রাজক বঙ্গদেশে আগমন করেন। সপ্তদশ শতাব্দীর প্রথম ভাগে
ফ্রান্সিস পাইরার্ড নামে একজন ইউরোপীয় এতদ্দেশে আগমন করিয়াছিলেন। তিনি বঙ্গভূমিকে
স্বাস্থ্যকর ও নাতিশীতোষ্ণ বলিয়া বর্ণনা করিয়াছেন এবং তাঁহাকে অত্যন্ত উর্ব্বর
বলিয়াও উল্লেখ করিয়াছেন। ইহা হইতে অপর্য্যাপ্তপরিমাণে ধান্য ভারতবর্ষের সর্ব্বত্র
গয়া, মালাবার, সুমাত্রা ও মালাক্কা প্রভৃতি দ্বীপপুঞ্জে নীত হইত। বঙ্গভুমি মাতার
ন্যায় ঐ সমস্ত স্থানের অধিবাসীদিগকে অন্ন বিতরণ করিতেন। অসংখ্য জাহাজ ঐ সমস্ত
দ্রব্যবহনের জন্য প্রতিদিন বঙ্গভুমিতে আগমণ করিত। এই বঙ্গভূমিতে নানাপ্রকার পশু
জন্মগ্রহণ করিত, এবং তাহাদের মাংস সুলভ মুল্যে বিক্রীত হইত। কেবল দুগ্ধ ঘৃত
ব্যবহার করিয়া লোকে তথায় জীবন ধারন করিতে পারিত। বঙ্গবাসিগণ নানাপ্রকার সতরঞ্চ বয়ন
করিত। ইহাতে নানা প্রকার ফল জন্মিত, যথা – জামীর, লেবু, কমলা, দাড়িম, আনারস,
লঙ্কা। ইক্ষু অপর্য্যাপ্ত পরিমাণে জন্মিত। তাহা হইতে চিনি প্রস্তুত হইয়া নানা
স্থানে নীত হইত। এতদ্ভিন্ন নানাপ্রকার তৈল প্রস্তুত হইত। তুলা এত অধিক পরিমাণে
জন্মিত যে উহার অধিবাসিগণের পরিধেয়বস্ত্র প্রস্তুত হইয়া তাঁহার পর বহুল পরিমাণে
তুলা ও বস্ত্র নানা স্থানে নীত হইত। এতদ্ভিন্ন রেশম ও রেশমীবস্ত্র অনেক পরিমাণে
হইত। এই দেশের অধিবাসীগণের মধ্যে স্ত্রীপুরুষ উভয়েই সূতী ও রেশমী বস্ত্র প্রস্তুত
ও সূচীকার্য্য প্রভৃতি সুন্দররূপে সম্পাদন করিতে পারিত। এরূপ শিল্পকার্য অন্যত্র
দৃষ্ট হইত না। এই সমস্ত বস্ত্র এত সূক্ষ্ম হইত যে, কেহ তাহা পরিধান করিলে তাঁহাকে
নগ্ন বলিয়া বোধ হইত – বস্ত্র পরিহিত বলিয়া বুঝা যাইত না। বঙ্গবাসীগণ চিনবাসির
ন্যায় গৃহ সজ্জার উপকরণ ও বাসনাদি নির্ম্মাণ করিতে পারিত। রক্ত ও কৃষ্ণবর্ণের
মৃত্তিকানির্ম্মিত দ্রব্যাদি হইত। এই সমস্ত দ্রব্যের বাণিজ্যের বিষয়েও তিনি উল্লেখ
করিয়াছেন।
ইংলণ্ডেশ্বরী মহারাজ্ঞিই এলিজাবেথ বাদশাহ জাহাঙ্গীরের
দরবারে ‘সার টমাস রো’কে দূতস্বরূপ প্রেরণ করিয়াছিলেন। সপ্তদশ শতাব্দীর প্রারম্ভে
রো ভারতবর্ষে উপনীত হইয়াছিলেন। তিনিও বাঙ্গালার বিষয় বিবৃত করিয়াছেন, এবং তাঁহার
প্রধান নগর, রাজমহল ও ঢাকা ও পোর্ট গ্রান্ডি, পোর্ট পেকিনো, পিপলী ও সাতগাঁ
প্রভৃতি বন্দরের বাণিজ্যের কথা উল্লেখ করিয়াছেন।
No comments:
Post a Comment