(লেখাটা বড় হবে, মাথা ধরানো হবে পড়ার দরকার নেই)
Debottom একটা অসামান্য ভূমিকা লিখেছেন নবজাগরণের চরিত্র বুঝতে। তাঁর সঙ্গেই নবজাগরণ বিষয়ে আরেক জ্ঞানচর্চক Debabrataদা এই সময়টার নানান তথ্য জানা বোঝা, বিশেষ করে বিদ্যাসাগরের ভূমিকা নিয়ে ইতিহাসের ভাবনা পালটে দেওয়ার কাজ করে চলেছেন।
অন্যদিকে Souvik ইওরোপিয় জ্ঞানচর্চা বিশেষ করে অষ্টাদশ শতকের জ্ঞান বিজ্ঞান চর্চা নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে সে সময়ের দেশিয় জ্ঞানচর্চা বুঝতে আমাদের ডেকেছিলেন। কেন নবজাগরণ বা কেন ইওরোপ এই নব্য বিজ্ঞানচর্চায় উপনীত হয়েছিল, এই দুটি অবস্থা বুঝতে ঐতিহাসিক প্রেক্ষিতটি আমাদের বুঝে নেওয়া দরকার।
তার পরে অন্য কথা।
---
বাংলার নবজাগরণ এবং নবজাগরিত পশ্চিমি জ্ঞানচর্চা আর প্রযুক্তি চর্চার সামগ্রিক আলোচনাকে পুঁজি, সওদাগরি উদ্যম আর উপনিবেশ বিচ্যুত করে দেখলে ভুল হবে।
সার্বিকভাবে পশ্চিমি রাষ্ট্র জ্ঞানচর্চা এবং প্রযুক্তির অন্তর্নিহিত শক্তিকে লুঠ, খুন অত্যাচার আর নজরদারির কাজে লাগিয়েছিল। কেন্দ্রিভূত পুঁজির মতই কেন্দ্রিভূত জ্ঞানচর্চার সমস্যা হল এটা বড় পুঁজিকে সংহত করে এবং অত্যাচার আর লুঠের কাজে লাগায়।
হাজার হাজার বছর ধরে এশিয়া আফ্রিকা আমেরিকার বিকেন্দ্রিত উতপাদন ব্যবস্থার সঙ্গে পাল্লা দিতে পশ্চিম ব্যর্থ হয়েছে, বিশেষ করে বাণিজ্যে। পলাশীর আগে কয়েক হাজার বছর সে এশিয়ার কাছে অধমর্ণ অর্থনীতি হিসেবেই গণ্য হয়েছে। সাতশ বছর আগে পশ্চিম এশিয় বাণিজ্যে দখল নিতে আরবের ওপরে যুদ্ধ চাপিয়ে দেয়, কিন্তু উজ্জীবিত ইসলাম তাদের পরিকল্পনা ব্যর্থ করে। সেই অভিজ্ঞতা থেকে ইওরোপ কয়েকটা যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত নেয়,
১) পুঁজি সংহত করা, লেভন্ট কোমপানি, মস্কোভি কোম্পানি ইত্যাদি যে সব ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিপূর্ব একচেটিয়া সনদী কোম্পানি ছিল সেগুলিকে বাতিল করে পুঁজি সংহত করে ইওরোপ জুড়ে ভেনিসিয় এবং আমস্টার্ডামের ব্যবসায়ীদের জড়ো করে পোপের অনুমতি নিয়ে(প্যাপান বুল) পাঁচটা ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি তৈরি করে। এদের সেনাবাহিনী নিয়ে ব্যবসার অনুমতি দেওয়া হয় - অর্থাৎ একচেটিয়া বাণিজ্য এবং সাম্রাজ্য বিস্তারের কাজের অনুঘটক হিসেবে তৈরি করা হল। রাষ্ট্র যে কাজ করতে পারে নি সেটাকে পুঁজি-রাষ্ট্রজোটের তৈরি করে করার উদ্যম নেওয়া হল। উপনিবেশের মুখড়া তৈরি হল। প্রথম ধাক্কা খেল আমেরিকা। তারপরে আফ্রিকা এবং এশিয়া
২) জ্ঞানচর্চায় এশিয়া/আফ্রিকা/আমেরিকা ইওরোপকে মাত করেদিয়েছিল। ইওরোপ এশিয় প্রযুক্তি নকল/চুরি করে তাদের উতপাদন ব্যবস্থা চালাবার চেষ্টা করেছে বহুকাল ধরে। কিন্তু তারা যা চাইছে - বিশ্ব বিজয় এবং কেন্দ্রিভূতভাবে উৎপাদন বাড়ানোর কাজ - এই জ্ঞানচর্চা আর প্রযুক্তি দিয়ে করতে পারছিল না।
তারা কেন্দ্রিভূত প্রযুক্তি তৈরি করার সিদ্ধান্ত নিল। ঠিক হল কারিগর পশুচারক উচ্ছেদ করে দেওয়া হবে, চাষীদের জমি দখল নেওয়া হবে কেন্দ্রিভূত উতপাদন ব্যবস্থা তৈরি করতে। লিভার টিভার তৈরির চেষ্টা এশিয়াতে বহু আগে হয়েছিল, লিভার তৈরি হয়েছে আরবে, চিনে ভারতে, আকবরের সময় ফাতাউল্লা সিরাজি্র কাজ প্রকৃষ্ট উদাহরণ, চিনের প্রযুক্তি নিয়ে ইওরোপমন্য নিডহ্যাম প্রচুর উদাহরণ দিয়েছেন। এশিয়া এগুলি পুঁজি কেন্দ্রিভবন এবং সাম্রাজ্য তৈরির কাজে লাগায় নি। ভস্কোর আগে জেং হি সারা বিশ্ব সমুদ্রে ঘুরে এসেছে কিন্তু পথ না হারিয়ে। অর্থাৎ সেই জ্ঞান তার ছিল, কিন্তু সে সেটা তারা সাম্রাজ্য বিস্তারে কাজে লাগায় নি।
ইওরোপ এশিয়া আফ্রিকা আমেরিকার বিকেন্দ্রিভূত জ্ঞান নিয়ে কেন্দ্রিভূত জ্ঞানচর্চা প্রকল্প তৈরি করল। একটা উদাহরণ দেওয়া যাক গ্যালিলিও বললেন তিনি লিভার দিয়ে পৃথিবী নড়িয়ে দিতে পারেন। গ্যালিলিওর কাজ ছিল কামানের গোলা ছোঁড়াত ট্রাযেকটেরি নিয়ে গবেষণা। তাঁর কাজটাই ছিল সাম্রাজ্যবাদী সামরিক উদ্যমকে সহায়তা করা। ইওরোপের বিপুল সংখ্যার বিদ্বান প্রযুক্তিবিদ সাম্রাজ্য বিস্তারের কাজে লাগে, শ্রম প্রতিস্থাপন করতে পারে এমন প্রযুক্তি তৈরি করল। কর্পোরেটদের বাণিজ্য উদ্বৃত্ত এই কাজগুলি চালিয়ে নিয়ে যেতে সাহায্য করেছে। এই বিদ্বানেদের অনেকেই নতুন কোম্পানিগুলির প্রোমোটার খাতক চাকুরে ছিল। যে জ্ঞানচর্চা চলছিল, তার মূল উদ্দেশ্য হল নজরদারি, বিকেন্দ্রিভূত উতপাদন ব্যবস্থাকে ধ্বংস করে কেন্দ্রিভূত উতপাদন ব্যবস্থা চালাবার মত করে প্রযুক্তি বিকাশ এবং শ্রম প্রতিস্থাপন প্রযুক্তি তৈরি। কোম্পানিগুলি ততদিনে যে ব্যবসা উদ্বৃত্ত নিয়ে আসছে সেগুলো দিয়ে এই গবেষণাগুলো হচ্ছে।তা ছাড়া আফ্রিকা আমেরিকা লুঠ উদ্বৃত্ত তো রইয়েইছে।
নজরদারি নির্ভর শ্রম প্রতিস্থাপন করার প্রযুক্তি না হয় তৈরি হচ্ছিল, যেমন ফ্লাইং শাটল কিন্তু এগুলো কাজে লাগাবে কোথায়? এই খরুচে যে এগুলো চালাতে ভর্তুকি প্রয়োজন, আসবে কোথা থেকে? খুলে গেল আমেরিকা আর আফ্রিকায় উপনিবেশের দরজা। এশিয়ায় পলাশী হল, তার ২৩ বছরের মাথায় তৈরি হল ইংলন্ডের প্রথম কেন্দ্রিভূত কাপড়ের মিল, বিপুল ভর্তুকি ঢুকতে থাকল।মিলগুলি রাষ্ট্রীয় সহায়তায় ছোটলোক চাষী পশুচারক কারিগরদের উচ্ছেদ করল এবং কারখানায় শ্রমিক হিসেবে নিযুক্ত করল। পেয়ে গেল শস্তাতম শ্রমিক।
অথচ ১৬০০ থেকে ১৬৮০র মধ্যে বাংলায় ১ লক্ষ কাজের পরিবেশ তৈরি হলেও আমরা কারখানা করি না, সেটাকে ব্যবহার করলাম কাজ দেওয়ার চাষ বাড়াবার কাজে। যাইহোক, পলাশীর চক্রান্ত এবং তারপরের লুঠ, ১ কোটি মানুষের গণহত্যা এবং আফ্রিকা থেকে বিপুল শ্রমের রপ্তানি এইগুলি না হলে ইওরোপ আজকেও অধমর্ণ থাকত। এই আলোচনাগুলিও করতে হত না।
এরপরে তৈরি হতে থাকল একের পর এক বিপুল নানান ধরণের কারখানা, উপনিবেশ থেকে লুঠ করা প্রযুক্তির বিনিয়োগে। তাই লুঠ চালিয়ে যেতে হয়, না হলে কারখানা চলে না। উপনিবেশে লুঠ চালাবার জন্যে তৈরি করা হল নবজাগরণ নামক একটি ইওরোপমন্য কাঠামো। তার চালক হলেন তথাকথিত বিখ্যতরা। নবজাগরণের অমুসলমান মাথাদের ওপরে ব্রিটিশ সাম্রাজ্য মৌলিক যে কটি কাজ সম্পাদনের দায়িত্ব দিয়েছিল ১)লুঠের পরিবেশ চালিয়ে যাওয়া এবং সাম্রাজ্যের লুঠের কাজের ওপর যতটা পারা যায় অবগুণ্ঠন চাপানো, ২) ভদ্রলোকামি এবং ব্রাহ্মণ্যবাদের গুরুত্ববৃদ্ধি, ৩) ইসলামোফোবিয়া তৈরি ৪) শহরের বাইরে চলা ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের থেকে বিচ্ছিন্নতা ৫) কেন্দ্রিভূত পড়াশোনার শেকড় গজানো, ৬) বেকনিয় তত্ত্বে গড়ে ওঠা লুঠেরা এবং খুনি প্রযুক্তির ওপর যতটা পারা যায় প্রগতিশীলতার কাপড় পরানো, ৭) ব্রিটিশ পূর্ব সময়কে কেয়টিক, লুঠেরা এবং হিন্দু বিরোধী প্রমান করা যাতে পলাশীর পরের লুঠের ওপর থেকে দৃষ্টি সরে যায় --- এবং আরও অনেক কিছু - নবজাগরণীয়রা সেগুলি নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করেছেন এবং তার যথেষ্ট প্রতিদান পেয়েছেন, আজও পেয়ে চলেছেন।
এগুলি সক্কলের জানা কথা, আবার আবৃত্তি করলাম।
ইতিহাস লেখার আগে এই প্রেক্ষিতটি তৈরি থাকা দরকার।
No comments:
Post a Comment