Tuesday, February 7, 2017

বাংলা যখন বিশ্ব সেরা৮১ - লাইফ অব মীর জুমলা, জেনারেল অব আওরঙ্গজেব

জগদীশ নারায়ণ সরকার
আষ্টম অধ্যায়

চরিত্র এবং কৃতিত্ব

১। ইতিহাসে মীর জুমলার স্থান
সপ্তদশ শতকের ভারতে মীর মহম্মদ সৈয়দ মীর জুমলা অন্যতম অসাধারণ চরিত্র।কুতবনামাইআলমএর লেখক বলছেন, তিনি সময়ের পাতায় নিজের নাম লিখেছেন। উদ্যমী, উচ্চাকাঙ্ক্ষী এবং নিজেকে নিজের বলেই তৈরি করার মানুষ ছিলেন তিনি। তিনি যে চওড়া কপালের জন্য এই উপমহাদেশের রাজনৈতিক প্রতিযোগিতায় বিজয়প্রাপ্ত হয়েছেন, এবং কর্ণাটক থেকে দিল্লি, এবং খণ্ডেশ থেকে অসমের রাজনীতিকে প্রভাবিত করতে পেরেছিলেন, এছাড়াও ভারতের সমুদ্র বাণিজ্যে তার বড় অংশ ছিল। পারস্যের এক ভাগ্যান্বেষী অভিযাত্রীর সন্তান হয়ে গোলকুণ্ডায় ভাগ্যপরীক্ষায় এসেছিলেন, তার দক্ষতায় ধাপে ধাপে নথি রক্ষক থেকে মছলিপত্তনমের প্রশাসক এবং তার পরে গোলকুণ্ডার উজির পদের সাফল্যের সিঁড়িতে ওঠেন। সুলতান তাকে কর্ণাটক বিজয়ের দায়িত্ব দিলে তিনি বিজয়ের পরে সেখানে মুক্ত রাজতন্ত্রের স্বাদ অর্জন করে কার্যত কর্ণাটকের প্রথম নবাব হয়ে বসেন। তার পরে তিনি শাহাজানের অনুগত হলে তাকে মুঘল সাম্রাজ্য তাকে দেওয়ানিকুল পদে অভিষিক্ত করে। আওরঙ্গজেবের সময় তিনি কিছুকাল খণ্ডেশের প্রদেশের প্রশাসক হয়ে বাংলার মত গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চলের সুবাদার নিযুক্ত হন।

ভারতে মীর জুমলা বিজয়নগর রাজত্বের শেষ ৩০ বছর ধরে কর্মক্ষম ছিলেন। যদিও বিজয়নগর রাজত্ব ১৫৬৫ সালের তালিকোটার যুদ্ধের আঘাত সামলে নেয়, কিন্তু সপ্তদশ শতেই তার বিলয় নিশ্চিত হয়ে টুকরো টুকরো হয়ে যায়। কেন্দ্রিয় শাসনের রাশ ক্রমশ কমতে কমতে সিংহাসন দখলের লড়াই ছড়িয়ে পড়ে মূলত মাদুরা, জিঞ্জি, এবং তাঞ্জোরের নায়েকদের মধ্যে এবং তামিল এবং কানাডিদের মধ্যে বিবাদ বাড়ার সুযোগ নেয় মুসলমান সাম্রাজ্য। প্রচণ্ড লড়াই করা সত্ত্বেও রয়্যাল দেখতে পায় যে তার হাত থেকে ক্ষমতার রাশ বেরিয়ে যাচ্ছে একের পর এক। এই সব কটি এবং অন্যান্য নগন্য রাজনৈতিক শক্তি একসঙ্গে মিলেমিশে একটা গোলোযোগের অবস্থা তৈরি হয় দাক্ষিণাত্যে। রয়াল আর নায়েকদের মধ্যে যে জোট ছিল তা সেই মুহূর্তের চাহিদার দাবিতে চ্ছিন্নবিচ্ছিন্ন হয়ে দাক্ষিণাত্যের রাজনীতি আরও জটিল হয়ে পড়ে। তার সঙ্গে জোড়ে ইওরোপিয় কোম্পানিগুলির কার্যকৃতি।

মীর জুমলা বিজয়নগর রাজত্বের পতনকে আরও গতি দিয়েছিলেন। ১৬৩৬ সালের মে-জুন মাসে মুঘলদের সঙ্গে চুক্তির জন্য উত্তর দিকে অগ্রসর হওয়ার পথ বন্ধ হয়ে যায়। তখন দাক্ষিণাত্যের বিজাপুর আর গোলকুণ্ডার সুলতানেরা কৃষ্ণা, তুঙ্গভদ্রা নদীর অববাহিকায় দক্ষিণ-পূর্ব জেলাগুলিতে কৃষ্ণার কর্ণাটক থেকে তাঞ্জোরের কাবেরি পর্যন্ত বিস্তৃত ভেঙ্গে পড়া বিজয়নগর সাম্রাজ্যে, সাম্রাজ্য বিস্তারে মন দেয়। কুতুবশাহী সেনাপতি মীর জুমলা এই কাজে বিপুল ভূলিকা পালন করেন।

এই ভেঙ্গে পড়ার সময়ে দাক্ষিনাত্যের মোঘল সুবাদার আওরঙ্গজেব দূর থেকে মজা দেখার মানুষ ছিলেন না। কর্ণাটককে গিলে খাবার সময় খোঁজার অপেক্ষায় ছিলেন তিনি। তাঁরই উদ্যমে দিল্লি যোগাযোগে মীর জুমলা গোলকুণ্ডার সুলতানের প্রতি বিদ্রোহ ঘোষণা করেন।

মুঘল সাম্রাজ্যের দুই স্তম্ভ, শাহজাহান এবং আওরঙ্গজেব মীর জুমলার রণনৈতিক নেতৃত্ব এবং দক্ষিণী রাজনীতিতে তার অগাধ জ্ঞান সাম্রাজ্য বিস্তৃতিতে ব্যবহার করার পরিকল্পনা করেন। ১৬৪৯ সালে কান্দাহার হাতছাড়া হওয়া এবং পর পর তিন বছর ব্যর্থ কান্দাহার অভিযানে সামরিক বাহিনীতে হতাশার ছাপ ছড়িয়ে যায়। শাহজাহানের পরিকল্পনা ছিল মীর জুমলার নেতৃত্বে পারস্যে বাহিনী পাঠিয়ে তার সাম্রাজ্যের হৃতগৌরব পুনরুদ্ধার করা এবং পারস্যের সেনাবাহিনীর শৌর্য দমন করা। আওরঙ্গজেব, দারা বা সাদুল্লা খান যে যুদ্ধে ব্যর্থ হয়েছেন সেই যুদ্ধ মীর জুমলা জিতবেন এমন একটা ধারনা ছিল তার। কিন্তু মীর জুমলা শাহেনশাহের দৃষ্টি উত্তর-পশ্চিম থেকে সফলভাবে দাক্ষিণাত্যের পানে ঘুরিয়ে দেওয়ার কাজটি করতে পেরেছিলেন। শাহজাহান, কান্দাহার জেতার পরিকল্পনা ত্যাগ করে বিজাপুর জিততে মরিয়া হয়ে ওঠেন। মীর জুমলার পরামর্শটা খুব মনে ধরেছিল শাহজাহানের কেননা তিনি জানতেন মীর জুমলা দাক্ষিণাত্যের দরবারি রাজনীতিকে হাতের চেটোর মত চেনেন। ১৬৫৭-৫৮ সালের বিজাপুরী অভিযানের মূল প্ররোচক মীর জুমলাই। আওরঙ্গজেবের প্রধান পরামর্শদাতা এবং সেনানায়ক হওয়ায়, সুজার বিরুদ্ধে লড়াইতে মীর জুমলাই তাকে রাজসিংহাসনটির দখল নিশ্চিন্ত করান। এবং কোচবিহার আর অসম দখলের অভিযানে মীর জুমলার সাফল্য মুঘল সাম্রাজ্যের ভিত বহুদূর নিয়ে যেতে সাহায্য করে।

মুঘল সাম্রাজ্যের রণনীতি নির্ধারণে মীর জুমলার প্রভাব বেশ বড় যেমন ছিল, তেমনি, দরবারি রাজনীতি আর প্যাঁচকষাকষিতে সক্রিয় উপস্থিতিও আমরা দেখতে পাই। দিল্লির রাজনীতিতে দারা দাক্ষিনাত্যের শিয়া সুলতানির স্বাতন্ত্রের পক্ষেই ছিলেন। সম্রাটের স্নেহধন্য শাহজাদার বিপক্ষে গিয়ে, আওরঙ্গজেবের সাম্রাজ্যবিস্তারের পরিকল্পনায় দাক্ষিণাত্যে শিয়া সুলতানিকে গ্রাস করার রাজনীতিটির নীতি প্রভাবিত করতে পেরেছিলেন সফলভাবে। মুঘল সাম্রাজ্যের বড় সময় কেটেছে উদারপন্থী দারা আর ধর্মপালক সাম্রাজ্যবাদী আওরঙ্গজেবের পরস্পর বিরোধী নীতিতে সামঞ্জস্য আনতে গিয়ে। শাহজাহানের নীতি প্রায়শই দুই শিবিরের নীতিই প্রতিপালন করত। দাক্ষিণাত্যের শান্তি প্রস্তাবে দরবারে প্রাথমিকভাবে দারার নীতিটি মান্যতা পায়। অথচ সাদুল্লা খানের মৃত্যুর পর, উজির পদে বৃত হন আওরঙ্গজেব ঘনিষ্ঠ সামরিকবাদী মীর জুমলা। দরবারে আগ্রাসী আওরঙ্গজেবের সাম্রাজ্যবাদী নীতি সাফল্য পেল, দারার শান্তি নীতির বিপক্ষে। অথচ ১৬৫৭-৫৮ সালে শাহজাহানের অনুমোদনে যে দাক্ষিণাত্যের বিজাপুরী অভযান শুরু হয়, সেটি দারার হস্তক্ষেপে হঠাতই বন্ধ করে দিতে হয়।
মীর জুমলার জীবন শুধু যে রাজনীতি বা কূটনৈতিক ইতিহাসের ছাত্রদের পাঠযোগ্য তাই নয়, এটি ভারতের অর্থনৈতিক ইতিহাসের পাঠ্যক্রমে প্রবেশেরও দাবি রাখে। কর্ণাটকের খনির উদ্যম তাকে কুড়ি মন হিরের মালিক করেছিল। কর্ণাটক এবং বাংলায় তার ব্যবসার মূল ভিত্তিটাই ছিল দৈনন্দিনের খাদ্য বস্ত্রের একচেটিয়া উদ্যম। পশ্চিম এশিয়া এবং দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার সমুদ্র বাণিজ্যের অন্যতম উদ্যমী ছিলেন তিনি। সেই যুগের অর্থনীতির ইতিহাসে তার ব্যবসা বিষয়ে আলোচনা গুরুত্বপূর্ণ কেননা, তখন বিজয়নগর সাম্রাজ্য অস্তাচলে, পর্তুগিজ কোম্পানির উদ্যম ঢালের দিকে, আর এশিয় সমুদ্রগুলিতে ডাচ আর ব্রিটিশে কোম্পানি সবে ডানা মেলছে। দুই স্বজাতি, পর্তুগিজদের হাঠিয়ে দেওয়ার আগেই মীর জুমলা বিজয়নগরের সমুদ্র বাণিজ্যের বড় অংশ দখল করে প্রথমে ডাচেদের এবং পরে ব্রিটিশদের প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে ওঠেন। ইওরোপিয়রা তার ক্ষমতাকে ভয় পেত কিন্তু সাহায্য নিতে ভোলে নি। এদের সঙ্গে পূর্ব উপকূলের বাণিজ্য সম্বন্ধ তার শেষ দিন পর্যন্ত বজায় ছিল।
(চলবে)

No comments: