Wednesday, February 1, 2017

বাংলা যখন বিশ্ব সেরা৭৫ - লাইফ অব মীর জুমলা, জেনারেল অব আওরঙ্গজেব

জগদীশ নারায়ণ সরকার

গ। কামরূপ অসমে মীর জুমলার প্রশাসনিক ব্যবস্থা

১। সেনা শাসন
বাঙলার সঙ্গে যোগাযোগের সুবন্দোবস্ত করতে, জিতে আসা দেশটিকে শাসনে রাখতে, অহোম বিদ্রোহীদের বশে রাখতে, স্থানীয় রায়তদের শান্ত রাখতে যত তিনি এগিয়েছেন, প্রত্যেক জায়গায় সেনা শিবির তৈরি করেছেন। প্রত্যেকটিতে একজন সেনা আধিকারিক আর তার নেতৃত্বে একটি বাহিনী রাখা ছিল। গৌহাটির ফৌজদারির জন্য মহম্মদ বেগ আর কালিয়াবরের জন্য নাসিরুদ্দিন খানকে নিয়োগ করলেন। আর আতাউল্লা হুসেন বেগ, সৈয়দ আলি মির্জা, আলি রাজা বেগ, আনওয়ার বেগ, মীর নুরুল্লা এবং মহম্মদ মুকিমকে যথাক্রমে যোগীগুপা, কাজলি, সমধারা, দেওলগাঁও, গাজপুর, ত্রিমোহনী এবং রামডাঙ্গের থানাদার নিযুক্ত করা হল। ইবন হুসেনের নেতৃত্বে ৩২৩টা নৌবহর রাখা হল। তাকে সাহায্যের জন্য দেওয়া হল জামাল খান, আলি বেগ, অন্যান্য আধিকারিক এবং মুনাবর খান এবং অন্যান্য বাংলার জমিদারকে, অহোমদের মাজুলির জবাবে লাখাউ হল মুঘলদের নৌঘাঁটি। সাধারণের হাতের বাইরে রাখার জন্য গড়গাঁওএর প্রাসাদে পাহারা বসানো হল। সেখানে একটা টাঁকশাল তৈরি হল সম্রাটের নামে টাকা আর খুচরো তৈরির উদ্দেশ্যে। কিন্তু স্থায়ী প্রশাসনের কোন সম্ভাবনাই দেখা যাচ্ছিল না।

মীর জুমলার সঠিক তথ্য পাওয়া খুব জরুরি ছিল। এক মুসলমান চর যে কালিয়াবরে ভুল খবর দিয়েছিল তার জিভ কেটে নেওয়া হয় এবং চাকু চালাবার মত তার পিঠে চাবুক চালানো হয়।

অহোম রাজধানী দখলের অর্থ কিন্তু অহোম বিদ্রোহ শেষ হওয়ার ইঙ্গিত নয়। বিভিন্ন এলাকায় থানা বা চৌকি তৈরি করা হলেও সেগুলোর ওপরে রাজার অনুগত অহোমি সেনা বাহিনীর হঠাত আক্রমণের বিরাম ছিল না। মীর জুমলা যখন গড়গাঁওতে পৌঁছন, তার কিছু দিন পরে গড়গাঁওয়ের উদ্দেশ্যে সোনারুপায় ভর্তি ছটা নৌকো অহোমিরা দখল করে নাবিক-সেনাদের হত্যা করে। রাজার প্রাক্তন আমলা আর গুপ্তঘাতকদের দল মুঘল বাহিনীকে অতিষ্ঠ করে তুলছিল যাতে বর্ষা আসা পর্যন্ত তাদের শিবিরে রসদ পৌঁছতে না পারে।

আশ্চর্যের, সেই বছরের অনেক আগেই বর্ষা এসে গেল। মীর জুমলার পরিকল্পনা ছিল গোটা বর্ষাকালটা তিনি লাখাউতে কাটাবেন যাতে রসদের অভাব না হয়। কিন্তু গতায়াতের অসুবিধেয় জন্য দখল করা মালপত্র পাঠানো সমস্যা হয়ে দাঁড়াল। তিনি গড়গাঁওয়ের ৭ মাইল দক্ষিণপূর্বে মুথুরাপুরে তার মূল বাহিনীর ছাউনি ফেললেন(৩১ মার্চ)। এটি উচ্চ এবং সৌন্দর্যময় জমিতে অবস্থিত ছিল, আর এটি জুড়ে প্রচুর ফলএর গাছ আর ধান চাষের জমি ছিল ফলে নিত্য খাবারের সমস্যা ছিল না। অহোমিয়াদের হঠাই চোরাগোপ্তা আক্রমণের রুখতে জরুরি সতর্কতা নিলেন।

গড়গাঁওতে গোলান্দাজ ভাণ্ডার, হাতিশাল রসদের ভাণ্ডার আর সেনাবাহিনীর সম্পত্তি রক্ষার ভার দেওয়া ছিল মীর মুর্তাজা, রাজা অমর সিং এবং ৫০জন রিসালাদার আর কিছু বন্দুকবাজকে। কিছু প্রয়োজনীয় অস্ত্রশস্ত্র রেখে বাকিগুলি ঢাকায় পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল। দেওয়ানিতন মীর সৈয়দ মহম্মদকে স্থানীয় রায়তদের শান্ত করার ভার দেওয়া হয়েছিল। মহম্মদ আবিদ, বাজেয়াপ্ত মালের দাম নিরূপক, রাজার প্রাসাদের সম্পত্তির খতিয়ান, সেনা বাহিনীর বেতন দেওয়া এবং বাকি অর্থ ঢাকায় পাঠাবার ব্যবস্থা করছিলেন। মহম্মদফ খলিল আমিনি পদে এবং সপত্তি দেখাশোনার কাজে মহম্মদ আশরফ নিযুক্ত হলেন।

গড়গাঁও আর মথুরাপুরের চারপাশ পুলিশি চৌকি দিয়ে সুরক্ষিত ছিল। অহোম সেনাবাহিনী ছেড়ে আসা সেনাদের সাহায্যে মীর জুমলা প্রধাণত মোটামুটি ১০০টা গ্রাম সাইরিং, শিলঘাট, টাউকাক, ছররা, রাওখাম, সিনাতোলি দখল করেন। দক্ষিণের পাহাড়ের সালপানি মিয়ানা খানের প্রশাসনে দেওয়া হল যাতে তিনি বড় গোঁহাইদের আক্রমন আটকাতে পারেন। গড়গাঁও আর সালপানির মধ্যের দেওপানির কর্তৃত্ব দেওয়া হল গাজি খানকে, গড়গাঁওয়ের উত্তরপূর্বের দিহিংএর তীরের দায়িত্ব দেওয়া হল জালাল খানকে। অহোমদের নিয়মিত আক্রমন সত্ত্বেও মুঘল ছাউনিগুলি দাঁড়িয়ে থাকল।

২। অসম যুদ্ধে অধিকৃত জিনিসপত্রের ব্যবস্থা
যুদ্ধে অধিকৃত দ্রব্য গুলি যেহেতু সাম্রাজ্যের, তাই সেগুলির নিরাপত্তার দায়িত্ব মীর জুমলা নিজের বলে মেনে নিয়েছিলেন। সিমলাগড় বা কালিয়াবরে হাতি বা কামান, জাম্বুরক, বন্দুক, বারুদ অহোমিয়ারা ছেড়ে গিয়েছিল, সেগুলি মীর জুমলা দখল নিয়ে তালিকাভুক্ত করিয়েছিলেন বিশেষ এক আধিকারিককে দিয়ে। দেওলগাঁওতে মীর জুমলা কয়েকজন মুসলমান রায়তের থেকে শুনলেন হাতি সহ বেশ কিছু শনাক্ত না করা দ্রব্য রাজা সঙ্গে নিয়ে যেতে পারেন নি, ফেলে রেখে গিয়েছেন। দিওয়ানিতন মীর সৈয়দ মহম্মদ এবং ফরহাদ খানকে সেই দ্রব্যগুলি আনতে পাঠালেন। উতসাহী সেনাপতি ভাগানিয়া রাজা আর ফুকনদের পদ্ম পুকুরিতে ছুঁড়ে ফেলা প্রচুর এ ধরণের অস্ত্রশস্ত্র নিজে উদ্ধার করিয়েছেন। মথুরাপুরেও তিনি মীর মুরতাজাকে দিয়ে যুদ্ধাস্ত্র সংগ্রহ করেছেন।

অসমে যুদ্ধ অধিকৃত সংগ্রহগুলি পরিমানে বিশাল, ৮২টি হাতি, সব থেকে দামি ৩ লাখ টাকা নগদ, আর রাজার ফেলে যাওয়া নানান ধরণের মালপত্র। অভিযানের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত উদ্ধার হয়েছে ৬৭৫টা কামান – তার মধ্যে একটা বড়, লোহার ৩ মন গোলা ছুঁড়তে পারে, ১৩৪৩টা উটের সুইভেল, ১২০০ রামছাঙ্গি, ৬৫৭০টা গাদা বন্দুক(ম্যাচলক), ৩৪০ মন বারুদ, ১৯৬০ সিন্দুক সোরা – এক একটার ওজন দুই থেকে আড়াই মন, ৭৮২৮টা লোহার ঢাল, ওজন করা হয় নি লোহা, সোরা আর গন্ধক, ১৭৩টা ধানের গোলা – প্রত্যেকটায় ১০ থেকে ১০০০ মন ধান, বহু বছরের রাজা আর ফুকনদের জন্য সঞ্চিত খাদ্য, যা তারা পোড়াতে ভুলে গিয়েছিল – যার অভাবে মীর জুমলার বাহিনীকে হয়ত অভুক্ত মরতে হত।
কালিয়াবরের ওপরে অহোম নৌবাহিনী পর্যুদস্ত হওয়ায় মনে করার কারণ নেই যে রাজার সব জাহাজ নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। যুদ্ধে অংশগ্রহণ করা নৌ বহর বাদ দিলে রাজার নৌশালে প্রচুর নৌকো রাখা ছিল। একটি নৌশাল লাখাউএর দূরে আর একটি ত্রিমোহনীতে মীর জুমলা ঘুরে দেখেন। লাখাউতে১০০টা বাছারি ছপ্পর(ঘাসের ছাদ)ওয়ালা জাহাজ, ৭০, ৮০, ১০০, ১২০ হাত(কিউবিটস) লম্বা, পোক্ত এবং দারুণ সাজসজ্জাওয়ালা। যদিও অসমিয়ারা গড়গাঁও নৌশালায় ১২০টা সমুদ্রে যাওয়া সাজসজ্জাওয়ালা বাছারি জাহাজ ডুবিয়ে চলে গিয়েছিল, তবুও ৬০, ৭০, ৮০ নাবিক বহনক্ষম সমুদ্রগামী ১০০০ জাহাজ মীর জুমলা উদ্ধার করেন।
অসমিয়া বন্দুক এবং বারুদ তৈরির প্রযুক্তিবিদদেরকে ঢাকায় নিয়ে যাওয়ার নির্দেশ জারি করেন। হাতি প্রশিক্ষণের মাহুত নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হন।
কর্নাটকের মত অসমেও মীর জুমলা মন্দির লুঠ করে প্রচুর অর্থ লাভ করেন। কাজলি দখল করার পর তিনি কামাখ্যা, লুনা চামরি এবং ইসমাইল যোগী মন্দিরগুলি নিজের আওতায় নিয়ে আসেন।

উত্তরী অসমে থাকার সময় মীর জুমলা জানতে পারলেন যে ময়দামের কবরগুলিতে প্রচুর সোনাদান থাকে। নির্দিষ্ট একটা কবর থেকে তিনি ৮০ বছর আগের এক রাণীর ৯০০০০ টাকার পানবাটা লুঠ করে তার হাড় গোড় ছড়িয়ে ফেলে দেন। অহোম রাজা দুঃখে মন্তব্য করেন যে তিনি তারে পূর্বজদের হাড়টাও বাঁচাতে পারলেন না। এক অজানা ডাচ নাবিক লিখছেন, ধনীদের কবর (লুঠ করতে)পেলে আর তাদের কে চায়? মানুচি ঢাকায় দেখেন গড়গাঁও এবং অন্যান্য এলাকা থেকে জাহাজ বোঝাই করে লুঠের মাল আসছে।

৩। অসমিয়াদের প্রতি মীর জুমলার ব্যবহার
যারা বিদ্রোহ কররেছে তাদের চরম সাজা হয়েছে। তিনি সেনাদের নির্দেশ দিয়ে বলেছিলেন অবাধ্য অসমিয়াদের খুন করতে। একজন ডাচ নাবিক বলছেন প্রত্যেক কাটা মাথার জন্য ৫০ টাকা আর জীবিত ধরে নিয়ে এলে ১০০টাকা পারিতোষিক দেওয়া হত। মুঘলদের হাতে যে সব অসমিয়া ধরা পড়েছে তাদের প্রচণ্ড অত্যাচার করে মাথা কেটে মারা হয়েছে। এর কারণ ছিল তারা যাতে ভয় পেয়ে মুঘলদের বাহিনীতে যোগদান করে।

অন্যদিকে যারা মুঘলদের সাহায্য করেছে, তাদের অসম্ভব ভাল ব্যবহার করা হয়েছে। তবে যে সব মানুষ যুদ্ধে যুক্ত ছিল না, তাদের উন্নতির জম্য মীর জুমলা ব্যবস্থা করেছেন। তিনি কৃষকদের মন জেতার চেষ্টা করেছেন যাতে তারা বিদ্রোহীদের দলে যোগ না দেয়। সেনা বাহিনীতে লুঠ, ধর্ষণ কঠোরভাবে নিষিদ্ধ করে দিয়েছিলেন। এতে নারীলোলুপ সেনারা হতাশ হয়েছিল। সেনাবাহিনী অসম থেকে ফেরা পর্যন্ত এই নির্দেশ জারি ছিল – বাহিনীর কোন আমীর, সেনা, তাঁবেদার কোন মহিলার বা তার পরিবারের সম্পত্তির দিকে লাস্যভরা চোখ তুলে তাকাবে না। আর যদি কোন উচ্চাবচ এই কাজটি করে তাহলে তাকে সারা শহর ঘোরানো হবে এবং শাস্তি দেওয়া হবে।

একবার ফারহাদ খান পালয়ে যাওয়া এক গ্রামবাসী ফিরে এসে মুঘলদের রাস্তায় বাধা দান করেছে এই অভিযোগে মহম্মদ মুকিম বেগকে নির্দেশ দেন গ্রামে গিয়ে সেই ধরা পড়া মানুষটিকে খুন করতে, তার সম্পত্তি লুঠ করতে এবং তার স্ত্রী আর সন্তানদের ওপর অত্যাচার করতে। মীর জুমলা এই নির্দেশ খারিজ করে সেই গ্রেপ্তার হওয়া মানুষটিকে ছেড়ে দিতে আর অন্যান্য গ্রামীনদের সুরক্ষা দিতে আদেশ দেন। যারা অহোমদের অত্যাচারে দেশ ছেড়ে চলে গিয়েছিল, তাদের বিভিন্ন শহরে ফিরিয়ে এনে পুনর্বাসনের দায়িত্ব নেন মীর জুমলা। সিমলাগড়ে অনেক কামরূপী মুসলমান বন্দী ছিল তাদের ছেড়ে দেন মীর জুমলা।

গড়গাঁওতে পৌঁছে তিনি ঘরছাড়া রায়তদের ফিরিয়ে এনে, পুনর্বাসনের নির্দেশ জারি করেন এবং কামরূপের অধিবাসীদের বাড়ি তৈরি বা চাষে তাদের একবছরের জন্য সব রকম রাজস্ব ছাড় দেওয়ার নির্দেশ দেন। আরও একটি নির্দেশে হিন্দু মসলমান নির্বিশেষে রাজা বা অহোম অভিজাতদের কাছে যারা দাসের মত থাকতেন, এবং মুক্তির আশা ছেড়ে দিয়েছিলেন, তাদের মুক্তির নির্দেশ দিয়ে খাসা নৌকো করে তাদের বাড়ি পৌঁছে দেওয়ার এবং জীবিকার বন্দোবস্ত করেন।

এই সবেও প্রজাদের মন জয়ের বিষয়টি সহজ হয় নি। তালিশ দুঃখ করে লিখছেন, মীর জুমলার মহানুভবতা বা রাজার অত্যাচারেও অসমিয়ারা ইসলাম ধর্ম বরণ করে নিল না। হয়ত মীর জুমলার মন্দির ধ্বংস-লুঠ বা কবর লুঠে মানুষের মনে এমন ঘৃণা জেগেছিল যে তারা ইসলামে পরিবর্তিত হওয়ার কথাই ভাবে নি। তবে বিদ্রোহীদের প্রতি কঠোরতা আর জনগণের প্রতি তার মহানুভবতায় মানুষেরা বুঝতে পারল যে মুঘল থানাগুলি আক্রমন করে লাভ নেই। দুখিনকোলের গ্রামের মানুষেরা মুঘলদের প্রতি বশ্যতা স্বীকার করে নিল, এবং উত্তরকোলের গ্রামের মানুষ আস্তে আস্তে বুঝতে পারল যে তাদেরও মুঘলদের কাছে অবনত হতে হবে যখন প্রাকৃতিক দুর্যোগ বর্ষার আকারে নেমে এল।
(চলবে)

No comments: