Friday, February 17, 2017

উপনিবেশ বিরোধী চর্চা৫ - উনবিংশ এবং বিংশ শতে ঔপনিবেশিক রাষ্ট্র এবং দেশজ চিকিৎসা ব্যবস্থা ১৮০০-১৯৪৭

পুনম বালা

অথর্ব বেদে ২০টা পুঁথি জুড়ে ৭৩১টা স্তোত্র, জাদুমন্ত্র উল্লিখিত হয়েছে। এটি রচিত হয় ১২০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে। লিখিত চিকিতসাশাস্ত্র, যার নাম আয়ুর্বেদ, মূলসূত্র কিন্তু আহৃত হয়েছিল বেদ থেকেই। অনেকে মনে করেন অথর্ব বেদের সঙ্গে আয়ুর্বেদের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ সাযুজ্য রয়েছে। তবে এই ধারনায় বিতর্কও রয়েছে।
চরক এবং সুশ্রুত দুজনে মূল দুটি চিকিৎসা শাস্ত্র প্রণেতা। তারা বেদ এবং আয়ুর্বেদের এই সম্পর্ক নিয়ে দ্বিধাবিভক্ত। সুশ্রুত বলছেন, আয়ুর্বেদ হল অথর্ববেদের একটি উপাঙ্গ এবং বিশ্ব সৃষ্টি আগেই ব্রহ্মা এটি প্রণয়ণ করেন। কিন্তু দাশগুপ্ত এই ধারনাকে নস্যাৎ করে বলছেন অথর্ববেদের বহু স্তোত্র আয়ুর্বেদে দেখা যায়।

আয়ুর্বেদে ১০০০০ আর অথর্ববেদে ৬০০০ স্তোত্র রয়েছে। চরক এবং সুশ্রুত দুজনেই এটিকে ঐশ্বরিক দান রূপে গণ্য করেছেন। অথচ চরক আয়ুর্বেদের বিকাশ এবং সংকলনে দীর্ঘকাল লাগার কথা স্বীকার করে নিচ্ছেন। তিনি বলছেন নতুন চিকিৎসা ব্যবস্থা কোন একটি জাদুমন্ত্রে হঠাতই আবির্ভাব ঘটে নি, বরং এটি বিকাশে দীর্ঘদিন ধরে বৈজ্ঞানিক পরিমণ্ডলের প্রয়োজন হয়েছিল। এটি একটি শুরু ছিল, এবং প্রায়োগিক ব্যবস্থা হিসেবেই, শুরু হয়েছিল অথর্ববেদ লেখার পরের সময়ে। বাস্তবে, এর সঙ্গে অথর্ববেদের মিল একটা যায়গায় সেটি হল দুটি শাস্ত্রই অসুখ চিকিৎসার মাধ্যমে দীর্ঘজীবন লাভের কথা বলে, আয়ুর্বেদ বলে চিকিৎসার মাধ্যমে আর অথর্ববেদ বলে ঐন্দ্রজালিক ব্যবস্থার মাধ্যমে। তবুও অথর্ব বেদের সময়েও ওষুধ দিয়ে অসুখ সারানোয় নিদানশাস্ত্রের (ফার্মাকোপিয়া) বিস্তৃত ভুমিকা ছিল।

যদিও আয়ুর্বেদের উদ্ভবএর সঙ্গে পরাবস্তবতা এবং ধর্মতত্ত্ব জড়িয়ে রয়েছে, তবুও সাধারণভাবে স্বীকৃত যে১২, এটিতে বৈজ্ঞানিক চিন্তার স্ফূরণ ঘটেছে এবং এটি সে সময়ের মানুষের জীবন এবং স্বাস্থ্য বিষয়ে একটি দিশা দান করে১২। আয়ুর্বেদ শাস্ত্রের উদ্ভবের ইতিহাস আলোচনায় প্রতিভাত হয় যে চিকিৎসাশাস্ত্র অতীতের ঐন্দ্রজালিক এবং ধর্মতত্ত্বের পথ ছেড়ে এটি ক্রমশ যুক্তিগ্রাহ্য এবং বৈজ্ঞানিক পথ ধরেছিল।

পূর্বের বেদগুলির মতই আয়ুর্বেদ সম্পূর্ণতম শাস্ত্র। কিন্তু এটিতে যে চিকিৎসা বিদ্যার কথা বলা হয়েছে সেটি আলাদা চরিত্রের এবং স্তরের। নথিকরণের পরে এটি ব্রাহ্মণদের হাতে চলে যায়, কিন্তু সে বিষয়ে তারা কতটা ভূমিকা পেশ করেছে তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। বেদপরবর্তী সময়ের প্রথমদিকে আমরা দেখেছি ব্রাহ্মণেরা কিভাবে বাড়তে থাকা চিকিৎসা শাস্ত্রের জ্ঞান এবং চিকিতসাকে দমিয়ে রেখেছিল। পরের দিকে হয়ত চিকিৎসা জ্ঞানকে দমন করতে না পেরে এটিকে নথিবদ্ধ করে এবং চিকিৎসা ব্যবস্থার বিকাশ ঘটায়। এই জন্য ব্রাহ্মণেরা এটিকে উদ্ভবের ধর্মীয় মোড়ক দেয় এবং এবং রক্ষণশীলতায় ঢেকে রাখে।

আয়ুর্বেদের বৈজ্ঞানিকতার চরিত্র আমরা বিশ্লেষণ করতে পারি প্রাচীন চিকিৎসা শাস্ত্রগুলির ঔষধের জ্ঞানের বহরে। চরক সংহিতা, সুশ্রুত সংহিতা এবং অষ্টাঙ্গসংহিতাকে এক সঙ্গে বৃদ্ধত্রয়ী নামে অভিহত করা হয়। চরক সংহিতায় রয়েছে রোগের বিশদ নামকরণ, রোগের নিদানতত্ত্ব, রোগ নিরূপণ এবং রোগ চিকিৎসা। সুশ্রুত সংহিতায় রয়েছে শল্য চিকিৎসার বিবরণ। আর অষ্টাঙ্গ সংহিতা চিকিৎসার সারকোষ, এই দুই সংহিতা শাস্ত্রের সংহিতা বা সঙ্কলন। চরক এবং সুশ্রুত সংহিতা আমাদের বুঝতে সাহায্য করে অতীতের চিকিতাসাস্ত্রের তত্ত্ব এবং প্রয়োগের ইতিহাস এবং তার সঙ্গে চিকিতসকেদেরও। এই শাস্ত্র যে নীতিগুলির ওপর দাঁড়িয়ে রয়েছে - ১) প্রত্যেক রোগ সৃষ্টির পিছনে কারণ রয়েছে, ২) এগুলি যতটা না পারমার্থিক তার থেকে বেশি জাগতিক, ৩) সাধারণ রোগের যেমন চিকিৎসার পথ এবং পদ্ধতি রয়েছে, তেমনি জটিল এবং অনারোগ্য রোগেরও চিকিৎসার পদ্ধতি রয়েছে।

আয়ুর্বেদের ব্যবহারিক ঔষধ বিজ্ঞান(মেটিরিয়া মেডিকা)এ রয়েছে পরিপূর্ণ ব্যবহারিক এবং পরিবেশগত জ্ঞান। চরক সংহিতা আমাদের বিভিন্ন রোগের ছয়শ ওষুধের বিবরণ প্রদান এবং বিপুল সংখ্যার বিকারতাত্ত্বিক (প্যাথলজিক্যাল) অবস্থা বর্ণনা করে। অন্যদিকে সুশ্রুত সংহিতা প্রাথমিকভাবে চিকিৎসা শাস্ত্রে শল্যবিদ্যায় গুরুত্ব প্রদান করে।

দুটি শাস্ত্রতেই আয়ুর্বৈদিক বিজ্ঞান আটটি ভাগে বিভক্ত
১। সাধারণ চিকিতসা
২। শিশুরোগ চিকিৎসা
৩। শল্য চিকিৎসা
৪। বিষবিদ্যা
৫। মানসিক অসুস্থতা
৬। ভিরিলিফিক্স(?)
৭। শক্তি বাড়ানোর জন্য ওষুধ ও শক্তিবর্ধক
৮। কান, নাক, চোখ, ঠোঁট, জিভের চিকিৎসা

এছাড়াও এটি দুটিভাগে বিভক্ত একটি স্বাস্থ্য প্রচারের কাজ দ্বিতীয়টি সব ধরণের ওষুধ এবং খাদ্যের গুনাগুন, চরিত্র, স্বাদ এবং সর্বোচ্চ কার্যকারিতার ওপর নির্ভর করে বিভিন্ন রোগের চিকিৎসা।

চরক এবং সুশ্রুত সংহিতা পুরুষকে প্রকৃতির অংশ রূপে দেখে, এবং সারা বিশ্ব যে সব উপাদানে তৈরি পুরুষও সেই উপাদানগুলির সমন্বয়ে তৈরি। মানুষ, বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের ক্ষুদ্র প্রতিরূপ। প্রকৃতি এবং দেহ দুটিই ক্ষিতি অপ তেজ মরুত ব্যোম এই পঞ্চভূতেরর সমাহার। পঞ্চভূততত্ত্ব প্রাচিন চিকিৎসার মৌলিক তত্ত্ব১৭। প্রাচীন চিকিতসকেদের বক্তব্য, প্রত্যেকটা উপাদান প্রকৃতির স্বভাবে হাজারো জীব এবং জড়ের রূপে পরিবর্তিত হয়। এছাড়া প্রত্যেক বস্তুর স্বভাব আলাদা আলাদ, আগুন যেমন গরম তেমন জল ঠাণ্ডা ১৮। পঞ্চভূত ছাড়া দেহ তিনটি তত্ত্বে তৈরি ধাত, মন এবং আত্মা। শেষের দুটি জুড়ে আয়ুর্বেদ মনদৈহিক চরিত্র দিয়েছে। দেহের তিনটি ধাত বা দোষ - বাত, পিত্ত আর কফ। এইতত্ত্বগুলি সম্বল করে আয়ুর্বেদে রোগ নির্নয়, চিকিৎসা ও নিদান দেওয়া হয়। চিকিতসকের মানব দেহ আর প্রকৃতিকে আলাদ করে দেখেন না। যেহেতু মানুষ আর প্রকৃতি একীভূত, সেহেতু প্রকৃতির কোন কিছুই চিকিৎসার কাজে আবঞ্ছিত এবং অগুরুত্বপূর্ণ নয়।
(চলবে)

No comments: