Monday, February 13, 2017

উপনিবেশ বিরোধী চর্চা - উনবিংশ এবং বিংশ শতে রাষ্ট্র এবং দেশজ চিকিৎসা ব্যবস্থা ১৮০০-১৯৪৭

পুনম বালা
(পুনম বালার এই গবেষণাটি ১৯৮৭ সালের। তিরিশ বছর পরে সংঘর পক্ষে সেটি অনুবাদ করছি। এই মুহূর্তে আমরা গ্রামীন পরম্পরার স্বাস্থ্য ব্যবস্থার রক্ষক যাদের আমরা বলি পরম্পরার স্বাস্থ্য বিধায়ক - তাদের নিয়ে একটা নতুন সংঘ বানাতে চলেছি - যদিও সলতে পাকানোর কাজ চলছিল গত কয়েক বছর ধরেই।
অবশ্য পুনম বালা এখানে আয়ুর্বেদ আর য়ুনানি নিয়ে আলোচনা করেছেন - আমরা করছি পরম্পরার গ্রামীন চিকিতসকেদের নিয়ে। এর সঙ্গে আয়ুর্বেদিয় ব্যবস্থার পার্থক্য খুব সামান্য নয় আবার খুব দূরাগতও নয়। মূল পার্থক্য হল এটি কেন্দ্রিয় নিদান বহির্ভূত ব্যবস্থা। স্থানীয় আবহাওয়া, খাদ্য ব্যবস্থা, জল, মাটি, গাছপালা, মানুষ ও তার রোগভোগকে নিয়েই সামগ্রিক এই ব্যবস্থা। এবং আমাদের মনে হয়েছে এটা অন্যরকম, স্থানিক এবং তাই ভারতের সাধারণ মানুষ এতে আস্থা আজও রেখেছেন। পরে কোন দিন হয়ত আরও কিছু আলোচনা করব। শুরুতে শুধুই সারাংশ। তার পরে মূল গবেষণার অনুবাদ।)
সারাংশ
এই গবেষণায় আমি ব্রিটিশ ভারতের ১৮০০ থেকে ১৯৪৭ পর্যন্ত সময়ে স্বাস্থ্য শিক্ষা এবং স্বাস্থ্য নীতি নিয়ে আলোচনা করব। যে তথ্যাবলী আমি এখানে ব্যবহার করেছি, তার পেয়েছি এডিনবরা, লন্ডন, কলকাতা এবং দিল্লির বিভিন্ন গ্রন্থাগার সূত্রে।
শুরুতে প্রাচীন এবং মধ্যযুগীয় ভারতের চিকিৎসা ব্যবস্থার একটি সাধারণ ধারণা উপস্থাপন করা গিয়েছে। এছাড়াও এই গবেষণা বিশ্লেষণ করতে চেয়েছে আয়ুর্বেদিয় এবং য়ুনানি চিকিৎসা ব্যবস্থার বিকাশের সঙ্গে শাসক শ্রেনীর সম্পর্কটি। ব্রিটিশ ভারতে দেশিয় চিকিতসাবিদ্যা মোটামুটি কয়েকটি পুঁথিভিত্তিক শাস্ত্রীয় নিদান (স্ট্যাটিক রুল) এবং সেগুলি বিচারহীনভাবে অনুসরণ করে যাওয়ার থোড় বড়ি খাড়া নিতি ছিলমাত্র। অথচ ভারতের চিকিৎসা ব্যবস্থার ইতিহাস বহুকাল ধরে আত্তীকরণ এবং পরিবর্তনের সাক্ষী এবং সেই চরিত্রটি সে অর্জন করেছিল বৈদেশিক আক্রমনকারী এবং শাসক শ্রেণীর পরিবর্তনের জন্যে।
বাকি অংশে আমরা দেখতে চেষ্টা করব ভারতীয় চিকিৎসা ব্যবস্থার ওপর ব্রিটিশ শাসন এবং ব্রিটিশ চিকিৎসা ব্যবস্থা কি প্রভাব ফেলেছিল তারে রূপরেখাটি। এই পর্বে পশ্চিমি চিকিতসাবিদ্যা, বিশেষ করে ব্রিটেনে চিকিৎসা ব্যবস্থার রূপ পরিবর্তন হচ্ছিল এবং সেটি চরম পেশাদারি রূপ গ্রহণ করছিল। ফলে এই গবেষণায় আমি দেখাতে চেষ্টা করব কিভাবে ব্রিটিশ শাসন ব্যবস্থা কিভাবে বিভিন্ন চিকিৎসা ব্যবস্থার মধ্যের প্রতিযোগিতায় ভারতীয় চিকিতসাবিদ্যাকে পেশাদারি রূপ প্রদান করল, সেই চিত্রটিও।
প্রাথমিকভাবে দেখা গেল যে ভারতে দুটি চিকিৎসা ব্যবস্থাই পাশাপাশি শান্তিপূর্ণভাবে পারস্পরিক দেওয়া নেওয়ার মধ্যে দিয়ে সহাবস্থান করছে, কিন্তু ব্রিটেনের পেশাদারদের প্রবল চাপে, রাষ্ট্রীয় উদ্যমে চিকিৎসা সেবা ক্ষেত্র উন্মুক্ত হওয়ায় ক্রমশ বৈদেশি চিকিৎসাবিদ্যাটি জাঁকিয়ে বসতে শুরু করল প্রথমের সারিতে, দেশিয় চিকিতসাবিদ্যাকে পিছনে সরিয়ে দিয়ে। উনবিংশ শতের শেষের দিকে দুই চিকিতসাবিদ্যার তাত্ত্বিক এবং প্রায়গিকতার মধ্যে যে দেওয়া নেওয়ার ভাবনার দ্বার উন্মুক্ত হয়েছিল, পশ্চিমি চিকিৎসাবিদ্যার বিপুল অগ্রগতির ফলে সেই সুযোগটি অচিরেই উতপাটিত হল।
পশ্চিমি চিকিতসাবিদ্যা, ভারতের অন্যান্য পেশাদারি শিক্ষার মতই ইংরেজি ভাষা বাহিত হয়ে এল। এই পেশাকে বাঙালি উচ্চশ্রেণীর(এলিট) ভদ্রলোকেরা আপন করে নিলেন। ইংরেজি বলতে পারা, ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের নানান সুযোগ নেওয়া, সম্পর্ক তৈরি করা পরম-শিক্ষিত(বেস্ট এজুকেটেড) শ্রেণীটি কিন্তু উনবিংশ শতকের শেষ থেকেই জাতিয়তাবাদী আন্দোলনের মুখ হয়ে উঠলেন। সুবিধাভোগী মানুষেরাই চিকিতসাবিদ্যা শিক্ষাঙ্গনে মূল ভুমিকা পালন করেছেন, এরাই আবার দেশিয় চিকিতসাবিদ্যাকে পুনর্নবীকরণ করতে এবং তাকে প্রায়োগিক ভূমিকায় নিয়ে যেতে উতসাহী হয়ে উঠলেন। এমত অবস্থায় এই সময় পর্যন্ত পশ্চিমি চিকিতসাবিদ্যা কিন্তু সারা দেশে মূলতম চিকিতসাবিদ্যা হয়ে উঠতে পারে নি, চিকিৎসা শিক্ষায় দুটি ব্যবস্থাই কিন্তু পাশাপাশি রয়ে গিয়েছিল।
ভারতের সামাজিক এবং ধার্মিক অবস্থা ব্রিটেনের সামাজিক অবস্থা থেকে শত শত যোজন দূরে। তাই ব্রিটেনে যেভাবে এই চিকিতসাবিদ্যা প্রভাব ফেলেছিল, ভারতে সেই প্রভাবটি না পড়াটি কি খুব আশ্চর্যের? রাষ্ট্রীয় নীতিগুলি ব্যবসায়িক এবং প্রশাসনিক ব্যবস্থাকে জোরদার করতে লাগানো হয়েছিল, তাতে কিন্তু দেশিয় চিকিতসাবিদ্যা বা দেশিয় চিকিতসাবিদ বা দেশের মানুষ কোউই বিন্দুমাত্র উপকৃত হয় নি। ফলে এই সময়ের চিকিতসাবিদ্যাকে আমাদের দেখতে হবে প্রতিযোগিতা এবং আত্তীকরণের দৃষ্টিতেই।
(চলবে)

No comments: