Monday, February 13, 2017

উপনিবেশ বিরোধী চর্চা১ - উনবিংশ এবং বিংশ শতে রাষ্ট্র এবং দেশজ চিকিৎসা ব্যবস্থা ১৮০০-১৯৪৭

পুনম বালা

প্রথম অধ্যায়
মুখবন্ধ
এই গবেষণা ভারতীয় চিকিতসাবিদ্যায় উনবিংশ এবং বিংশ শতকে রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপের প্রভাব নিয়ে আলোচনা করবে। এই সম্পর্কেটি বিশ্লেষণ করার আগে বলে নেওয়া যাক আমরা এই আলোচনাটিকে মূলত বাংলার প্রেক্ষিতে ধরার চেষ্টা করব।

ভারতের অন্যান্য অঞ্চলে এই বিষয়ে বেশ কিছু কাজ হলেও বাংলায় সেই কাজ খুব বেশি এগোয় নি (উদাহরণস্বরূপ পাঞ্জাবঃ হিউম, ১৯৭৭)১ যদিও শুরুতে সেখানে রাষ্ট্র কিছুটা হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল। এখানে দেখতে পাব দুপক্ষের মধ্যে কিছুটা হলেও আলোচনা চলেছিল বিভিন্ন নীতি প্রয়োগ নিয়ে। বাংলার সমাজে, সামাজিক পিরামিডের ওপরের তলায় স্থিত ব্রাহ্মণ, কায়স্থ এবং বৈদ্য প্রভাব অপরিসীম। এদের যৌথভাবে ভদ্রলোক বলা যেতে পারে। অন্যান্য ক্ষেত্রের মত ব্রিটিশ বাংলায় চিকিৎসা ব্যবস্থাতেও এরা গুরুত্বপূর্ণ এবং প্রভাবশালী ভূমিকা পালন করেছে।

মাদ্রাজ এবং বম্বে বাদ দিলে কলকাতা ব্রিটিশ ভারতের ব্যবসা ও বানিজ্যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। এই তিনটি কেন্দ্র ভারত জুড়ে পশ্চিমি প্রভাব এবং সাংস্কৃতিক লেনদেন বাড়িয়েছে অনতিক্রম্যভাবে। ১৭৫৭র পলাশি চক্রান্তের পর ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ক্লাইভকে বাংলার শাসন ব্যবস্থা সামলানোর ভার দিল। ১৭৬৫ সালে কোম্পানি দায়িত্ব পেল মুঘল সম্রাটের থেকে বাঙলা বিহার এবং ওডিসার দেওয়ানি, রাজস্ব আদায়ের। রাজস্ব আদায়ের ঘোমটায় এই রাজ্যগুলির প্রশাসনিক কর্তৃত্বভার নিজেদের কাঁধে তুলে নিল কোম্পানি। ১৭৭৩ সালের পিটের আইনে কলকাতাকে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের রাজধানী হিসেবে গণ্য করা হল। এই বাংলাতেই জেলাওয়ারি প্রশাসনিক ব্যবস্থার সূত্রপাত এবং প্রয়োগ হল। এই কারণে ভারতীয় শহরগুলির মধ্যে কলকাতাই প্রথম প্রভাবিত হয় ইওরোপিয় ভাবনা এবং সঙ্গঠনগুলিদ্বারা।

ব্রিটিশ রাষ্ট্রের ভারতীয় সমাজের ওপর প্রভাব – কিছু দৃষ্টিভঙ্গী
সাম্প্রতিক কাল পর্যন্ত ব্রিটিশদের বিজয়ে ভারতীয় সমাজ ও সংস্কৃতিতে কি কি বিরূপ প্রভাব পড়েছে তাই নিয়ে মূলত আলোচনা নিবদ্ধ থেকেছে। ভারতের সমাজ বিকাশের অভাবকে ব্রিটিশদের নানান বিরূপ নীতির প্রভাব হিসেবে দেখা হয়। ভারত বিকাশের সব দায় গিয়ে পড়েছে মূলত ব্রিটিশ নীতিগুলির ওপরে। বহু মানুষের ধারণা, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের শুরুর আগে ব্রিটিশেরা ভারতীয় জনগণের চাহিদা নিয়ে ভাবনা চিন্তাই করে উঠতে পারে নি। এই সময় জাতীয়তাবাদীরা মূলত পরিবর্তনের দাবি তুললেন৪। তারা একবাক্যে বললেন, ঐতিহ্যময় সংস্কৃতি, বিজ্ঞান এবং ধর্মের পতন এবং বিনাশ ঘটেছে বৈদেশিক শাসনের ফলেই। তারা দেশজ ঐতিহ্যকে পুনরুদ্ধারের কাজে ব্রতী হলেন৫। জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে জুড়েগেলেন বিভিন্ন শ্রেণীর মানুষজনও৬।

দেশজ চিকিৎসা শাস্ত্রের জ্ঞান যদি হয় অতীতের সংস্কৃতির ঝলক, ঠিক সেই দিক থেকেই আয়ুর্বেদ আর য়ুনানির নবজাগরনকে দেখা হতে শুরু করল জাতীয় ঐক্যমত্যরূপে। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতার প্রতিবাদে পেশাদার সংগঠন তৈরি হল৭। বিংশ শতের প্রথম দু দশকে ভারতের জাতীয় কংগ্রেস এই আন্দোলনে যুক্ত হয়ে ভারতীয় চিকিৎসাবিদ্যা প্রসারে বেশ কিছু সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে৮।

উপনিবেশের পক্ষে আজকাল খুব বেশি বলার লোক নেই। এই ধারনাগুলির বিপরীতে বলা হতে থাকল, ব্রিটিশদের আসার পূর্বে ভারত ছিল অচল-বদ্ধ সমাজ। ব্রিটিশেরা উপনিবেশ স্থাপন করে ভারতীয় সমাজে পরিবর্তনের সূচনা করেছে৯। এই যুক্তির প্রথম অংশটা খুবই ওপর ওপর বলা হয়ে থাকে। সমাজের অচলতা বা বদ্ধতার উদাহরণ খুব বেশি পাওয়া গেল না। বরং এর বিরুদ্ধে বলা যেতে পারে একটা বিদেশি অচেনা সংস্কৃতি ভারতের ওপর চাপিয়ে দেওয়ার জন্যই ভারতের সমাজে বদ্ধতা এসেছে। ফলে বদ্ধতার মত শব্দটি ব্রিটিশ নয়, ব্রিটিশপূর্ব সমাজকে বিচার করতে ব্যবহার হতে শুরু করল। পরিবর্তন তো এসেছেই, কিন্তু সেটি বদ্ধ সমাজে সদর্থক না বিপরীতাত্মক আঘাত করেছে সেটা পরিষ্কার হল না।

কুমার১০ শিল্প স্থাপন এবং রেলপথের বিকাশ ভারতে সদর্থক পরিবর্তন হিসেবে দেখেছেন। এছাড়াও ব্রিটিশদের তৈরি পূর্ত দপ্তরের উদ্যোগে অসামরিক বাড়ি বানানো, রাস্তা তৈরি করা, খাল কাটা, সেচ ব্যবস্থার বিকাশকে কিছুটা ব্রিটিশ ভারতে সমাজ বিকাশের সদর্থক পদক্ষেপ রূপে দেখা হতে শুরু করল।
ব্রিটিশ রুল এন্ড ইন্ডিয়ান ইকনমি বইতে চার্লসওয়ার্থ১১ ভারতের সঙ্গে ব্রিটিশ শাসকদের বাণিজ্যিক এবং আর্থিক সম্পর্ক নিয়ে বিশদে আলোচনা করেছেন। ভারতীয় অর্থনীতির ইতিহাসে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের প্রভাব নিয়ে তার কাজ। তার বক্তব্য, দত্ত১২ এবং ডিগবি১৩ ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের কুফলগুলি নিয়ে বেশিই আলোচনা করেছেন – ব্রিটিশ অর্থনীতির চাহিদায় ভারতের লুঠ ঘটেছিল রাজস্বের হার বৃদ্ধি এবং তার ফলে কৃষির সঙ্কোচনে। ঠিক এর বিপরীতে গ্রিফিথ১৪ মার্ক্স১৫এর তত্ত্ব সাম্রাজ্যবাদের সুফলের যৌক্তিকতা অনুসরণ করে দাবি করেছেন, ব্রিটিশদের শিল্পায়ন এবং আধুনিকীকরণ ভারতের অর্থনীতির পক্ষে মঙ্গলময় হয়েছিল।

দেশজ চিকিৎসা ব্যবস্থা ধর্মীয় এবং সামাজিক আচারের সঙ্গে জড়িত ছিল। বহু ঔপনিবেশিক চিকিৎসক এবং প্রশাসক একে বদ্ধ এবং অকার্যকর হিসেবে দাগিয়ে দিয়েছেন। অথচ ব্রিটিশ শাসনের প্রথম দিকে ব্রিটিশ বিজ্ঞানী এবং চিকিৎসক দল এই ব্যবস্থার পক্ষে দাঁড়িয়েছিল। উনবিংশ শতকের শেষ পাদ পর্যন্ত দুটি চিকিৎসাবিদ্যার তাত্ত্বিক পার্থক্যই করা হত না, এবং অনেকেই বিশ্বাস করতেন এবং বলতেনও পশ্চিমি চিকিৎসাবিদ্যার চিকিতসকেরা সম্মান এবং সুবেতন পাচ্ছেন শুধুমাত্র রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষণার জেরে, তার বেশি কিছু নয়।
কেশোয়ানি১৬ এবং মজুমদার১৭ বলছেন, উনবিংশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধ থেকে দেশিয় চিকিৎসাবিদ্যার বিনাশ ঘটতে থাকে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষণার অভাবে, যেটা পশ্চিমি চিকিৎসাবিদ্যার কপালে জোটে নি। মজুমদার লিখছেন, ভারতীয় চিকিৎসাবিদ্যার পতন ঘটে, ব্রিটিশ শাসনে পশ্চিমি চিকিৎসাবিদ্যায় অত্যধিক জোর দেওয়ার জন্য। অতীতের মতই, ভারতীয় চিকিৎসাবিদ্যা জনগণের পৃষ্ঠপোষণায় বেঁচে থাকে। ব্যানার্জী বলছেন, শুধুই উপনিবেশের উপেক্ষার তত্ত্ব দিয়ে ঔপনিবেশিক প্রভাব বিচার করা যাবে না। তিনি লিখছেন, জনগনকে পশ্চিমি চিকিৎসা বিজ্ঞানের সুফল থেকে বঞ্চিতই করা হল না, তাদের বহুকালের দেশজ স্বাস্থ্য ব্যবস্থা থেকেও আলাদা করে ফেলা হল। তিনি বলছেন ভারতীয় সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্য বিনাশের সঙ্গে ভারতীয় চিকিৎসাবিদ্যার পতনের ইতিহাস জুড়ে রয়েছে।

গুপ্ত এবং আর্নল্ড দুজনেই এর জন্য সরকারি পৃষ্ঠপোষণাকে দায়ি করছেন। গুপ্ত২০ বলছেন, ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ নীতিসমূহ প্রাথমিকভাবে দুটি চিকিৎসাবিদ্যার পাশাপাশি বেড়ে ওঠার দিকে নজর দিয়েছিল। কিন্তু ক্রমশই দেশিয় চিকিৎসাবিদ্যার ওপর ব্রিটিশেরা খড়গহস্ত হয়ে ওঠে এবং যদিও চিকিতসাবিদ্যা শিক্ষণ এবং প্রয়োগে (ব্যবসায়ে) তাকে অঙ্গীভূত করে নেওয়া হয়, কিন্তু তার স্থান হয় পিছনের সারিতে।

১৮২২ সালে দেশিয় চিকিৎসাবিদ্যা শিক্ষণ কেন্দ্র গড়ে উঠলে পশ্চিমি চিকিৎসাবিদ্যা শিক্ষণের পাশাপাশি দেশিয় ভাষায় দেশিয় চিকিৎসাবিদ্যা শিক্ষণের সুযোগ করে দেওয়া হল। এই প্রথম ব্রিটিশ রাষ্ট্র দেশিয়দের মধ্যে দেশিয় চিকিৎসাবিদ্যা প্রসারের উদ্যোগ নিল২১। বিতর্ক পিছু ছাড়ল না, দীর্ঘ বিতর্কের পরে ১৮৩৫ সালে দেশিয় ভাষায় চিকিৎসাবিদ্যা শিক্ষা দানের সুযোগ বন্ধ করে দিয়ে শুধুই ইংরেজিতে শিক্ষার ব্যবস্থা করা হল। এই নির্দেশনায় দেশিয় ভাষায় চিকিৎসাবিদ্যা শিক্ষণের প্রচেষ্টার শুধু যে বিনাশ ঘটল তাই নয়, আগামী দিনে পদে পদে নানান বিরুদ্ধ নীতি প্রণয়ন করে তাকে বাধা দেওয়ার উদ্যমেরও পথ উন্মুক্ত হল।

আর্নল্ড২২ আবার দেশিয় ভাষায় চিকিৎসাবিদ্যা দানের বিরুদ্ধতার যুক্তি ছাড়িয়ে বলছেন, ব্রিটিশেরা এক নতুন নীতি প্রণয়ন করল। তারা ভারতীয়দের নিয়ন্ত্রণ করতে, দেশজ চিকিৎসাবিদ্যাকে ধর্মীয়তার মোড়কে মুড়ে জনগন থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেওয়ার চেষ্টা চালাল২৩।
(চলবে)

No comments: