Monday, February 20, 2017

উপনিবেশ বিরোধী চর্চা১৩ - উনবিংশ এবং বিংশ শতে ঔপনিবেশিক রাষ্ট্র এবং দেশজ চিকিৎসা ব্যবস্থা ১৮০০-১৯৪৭

পুনম বালা

এর আগে অনুবাদ এবং সংহিতাকরণ এবং য়ুনানি এবং আয়ুর্বেদিয় চিকিৎসার ইতিহাস নিয়ে যে আলোচনা করলাম তাতে পরিষ্কারব মধ্য যুগে চিকিৎসার জ্ঞান কিন্তু প্রণালীবদ্ধতার দিকে এগোচ্ছিল। সিদ্দিকি বলছেন, ভারতের বিভিন্ন অংশের হেকিমেরা আয়ুর্বেদিয় এবং য়ুনানি চিকিৎসা শাস্ত্র আর তাদের চিকিৎসার জ্ঞানের ওপর নির্ভর করে সেগুলির বিভিন্ন দিক নিয়ে প্রচুর প্রকাশনা করছেন। চিকিৎসা শাস্ত্রের গতিশীলতার আরেকটা প্রমান হল রস(পারদ) শাস্ত্রের বিকাশ৮৯। ষোড়শ শতকের শুরুর দিকে চিকিৎসা জ্ঞানে পারদ বিষয়ক শাস্ত্রের প্রবেশ এই শাস্ত্রটিকে অনেক দূর এগিয়ে দিতে সাহায্য করেছে। এই সময়ে নাড়ি পরীক্ষাও চিকিৎসা কর্মের অঙ্গাঙ্গী কর্ম হয়ে ওঠে।

হেকিম ইসকান্দার য়ুনানি এবং হেকিম শরিফ খানের মত দুজন লব্ধ প্রতিষ্ঠ চিকিৎসক, পরিকল্পিত ভাবে ভারতজুড়ে য়ুনানিকে ছড়িয়ে দেওয়ার কাজ করে গিয়েছেন। প্রথম জন উনিবিংশ শতে দাক্ষিণাত্যে যান। হায়দার আলি এবং টিপু সুলতান ব্যক্তিগতভাবে তাঁকে উতসাহিত করেন, যেহেতু তারা নিজেরা বিজ্ঞান, প্রযুক্তি এবং শিল্প সাহিত্যের অনুরাগী ছিলেন। সে সময়ে অনেকগুলি তামাদি হয়ে যাওয়া বা ভুলে যাওয়া বই পার্সিতে অনুদদিত হয়। গ্রিকো-আরব চিকিতসকেদের কাছে দাক্ষিণাত্য বরাবরের জন্য জানাশোনার এলাকা। শরিফ খানের দুটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ শারা-ই-হুমিয়ত-ই কানুন এবং ইলাজ অল-শরিফি। য়ুনানির প্রচারে তালিফ ই-শরিফি, ইসকান্দর য়ুনানির শেষ বৌদ্ধিক কাজ। প্র্যত্যেকটা শব্দের তিনি হিন্দিতে অনুবাদ করেন যাতে প্রত্যেক সাধারণ মানুষ পড়তে পারেন। শরিফ খান অন্যদিকে খানদান-ই-শরিফি নামক য়ুনানি চিকিতসকের পরিবারের প্রতিষ্ঠাতা। পরিবারের শেষ প্রখ্যাত চিকিৎসক ছিলেন হেকিম আজমল খান, যিনি তার পরিবারের পরম্পরার বয়ে নিয়ে সারা দেশে য়ুনানি চিকিতসা ব্যবস্থার প্রচার করেছেন।
ভারতের দক্ষিণ প্রান্তে দাক্ষিণাত্য য়ুনানি চর্চার বড় অঞ্চল ছিল। এই অঞ্চলে বিপুল পরিমান য়ুনানি চিকিৎসা এবং জ্ঞানচর্চা নিথিকরণ এবং প্রচারের কাজ করেছেন বিপুল সংখ্যায় লেখক-চিকিতসকেরা। আসিফ জা এবং সিকন্দর জাএর রাজত্ব চিকিৎসা সংক্রান্ত কাজকর্ম উতসাহ দেওয়ার জন্য বিখ্যাত ছিল। দাক্ষিণাত্যের ভেষজের যতদূর সম্ভব বিশদ বিবরণ য়াদগার-ই রাজাই এই সময়ে লিখিত। দস্তুরি আম সিকন্দর জাহি এবং মুজারিবাত-ই জামাল য়ুনানি পদ্ধতিতে রোগ নির্নয়, নাড়ি এবং মুত্র পরীক্ষা নিয়ে আলোচনা এবং সভাসদেদের চিকিতসাবিষয়ক গবেষণার উল্লেখ করেছে। ওয়ালাজাহির সময়ে দাক্ষিণাত্যে কিভাবে চিকিৎসা হত, তার জামালএ তার বিশদ বর্ননা রয়েছে৯১।

মনে হয় য়ুনানি আর আয়ুর্বেদ চিকিৎসা ব্যবস্থা একই পথ ভ্রমন করেছিল তার তাত্ত্বিক একতার আর রাজাদের যৌথ চিকিতসাব্যবস্থার পৃষ্ঠপোষকতার জন্য। হয়ত রাজাদের মনে হয়েছে এই দুই চিকিৎসা ব্যবস্থা তাদের স্থিতির পক্ষে হানিকারক নয় তাই তাদের পৃষ্ঠপোষকতা দিয়েছে। হাতে গোণা হেকিম ছাড়াও, মুঘল ভারত বিপুল সংখ্যায় বৈদ্যশাস্ত্রীকে পৃষ্ঠপোষকতা করেছে – বিশেষ করে মুঘল মধ্যবিত্ত মনসবদারেরা। বাহিনীতে বৈদ্যরা চাকরিও করেছেন৯২। মনসবদারদের বাহিনীতে শিফাখানায় চিকিতসকেরা চাকরি করতেন রাষ্ট্রীয় বেতনে। রাষ্ট্র এবং মনসবদারেরা তাদের বাহিনীতে বৈদ্যদের সেবাটাকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করত। তবে এটা হয়ত সত্যি যে আয়ুর্বেদের উন্নয়নের জন্য রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা খুব জরুরি শর্ত ছিল না। মনসবদারদের বাহিনীর সঙ্গে যে সব চিকিৎসক থাকতেন তাদের কাজ ছিল যুদ্ধে বা অসুস্থ সেনার চিকিৎসা। সাম্রাজ্যের সেনাবাহিনীর যুদ্ধের গতি বজায় রাখার জন্য তাদের সেবাটা জরুরি ছিল। কোন কোন সময় ছোট শহরে হাসপাতাল তৈরি করলে সেখানে কিছু হেকিম আর বৈদ্যর চাকরি হত। ছোট ছোট শহরে যে সব হাসপাতাল চলত সেগুলি চালানোর দায় যার নাম “আলতামঘা” ছিল অভিজাত এবং জায়গিরদারদের ওপর৯৬। খান বলছেন, যদিও বৈদ্যরা সরকারিভাবে মনসবদার বা সরকারি সেবাকেন্দ্রে চাকরি করতেন, - রাজ্য স্তরে হেকিমি আর বৈদ্যদের সংখ্যা ছিল বিপুল।

মধ্যযুগে দুধরণের চিকিৎসক ছিলেন, একদল রাজারাজড়া মনসবদার এবং অভিজাতদের সঙ্গে কাজ করতেন, অন্যদিকে গ্রামে গ্রামে বিপুল সংখ্যায় চিকিৎসক কোন রাষ্ট্রীয় সাহায্য ছাড়াই চিকিৎসা করতেন। রাজ দরবারে, রাজসভায় কাজ করতেন তারা থলিভরা সম্মানজনক মাইনে পেতেন, এদের অধিকাংশ পার্সি, মোটামুটি ধনবান এবং তাদের প্রভূত সামাজিক পদমর্যাদা ছিল। তাদের কেউ কেউ সত্যিকারের ধনী হয়েছেন, কেউ কেউ এত ধনী আর খ্যাতি পেয়েছেন যে কেউ কেউ অভিজাত পরিগণিত হয়েছেন, তবে মোট চিকিৎসক জনসংখ্যার খুবই ভগ্নাংশ এরা৯৮।

মুঘল ভারতের চিকিৎসা ব্যবস্থার উচ্চতম শৃঙ্গ বজায় ছিল সপ্তদশ শতক পর্যন্ত, যতক্ষণনা ভারতে রাজনৈতিক গোলযোগ সৃষ্টি হচ্ছে। মুঘল রাজত্বের অর্থনৈতিক দ্বন্দ্ব আমলাতন্ত্রের বিভিন্ন স্তরে আঘাত করতে থাকে। জয়গিরদারদের ওপর বিধিনিষেধ, কৃষকদের ওপর অত্যাচার, এবং জমিদারেরা কৃষকদের থেকে বেশি রাজস্ব তুলতে না পারায় সাম্রাজ্যের প্রশাসনে বিদ্রোহ দেখা দিল১০০। প্রচুর ফাটল এবং দ্বন্দ্বের উতপত্তি ঘটল। জমিদারেরা চাষীদের থেকে যেমন রাজস্ব তুলত, তেমনি তাকে সেনানী হিসেবে ব্যবহারও করত। না খেতে পাওয়া, গৃহহীন চাষীর সংখ্যা বাড়তে থাকল। একের পর এক তারা হাতে অস্ত্র তুলে নিয়ে সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে দাঁড়াল। মুঘল সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে বিভিন্ন স্তরের মানুষ একজোট হচ্ছিলেন। এই বিশৃঙ্খল অবস্থা এবং রাষ্ট্রের মারমুখী হয়ে ওঠার মধ্যের দ্বন্দ্ব সত্ত্বেও চিকিৎসকেরা কিন্তু মনসবদারদের পৃষ্ঠপোষকতার নিরাপত্তা পেয়ে এসেছে।
এটা মনে করা হয়ত সঠিক হবে, মধ্য যগের ভারতে বিভিন্ন স্তরের চিকিৎসক ছিলেন – কিছু রাজদরবারে বা অভিজাতদের সেবা দিতেন, কিছু মনসবদারদের অধীনে চাকরি করতেন এবং শেষে বিপুল সংখ্যক রাষ্ট্রের সাহায্য ব্যতিরেকে রাজ্যস্তরে জীবিকা নির্বাহ করতেন এবং সমাজে সেবা দিতেন। চাকরির সুযোগ খুবই সীমিত ছিল। এই তথ্য থেকে একটা সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারি যে স্থানীয় গ্রাম/ছোট শহরস্তরে চিকিতসকেদের চিকিৎসা শিক্ষা ব্যবস্থা বিপুল ক্ষেত্রে রাজসভা নির্ভর ছিল না। হয়ত তারা সেই এলাকাতেই প্রশিক্ষিত হতেন এবং সেখানেই তাদের সেবা দিতেন।

মধ্যযুগে বিদ্রোহী সামাজিক গোষ্ঠীর বিদ্রোহ জনিত ভারতীয় সমাজে বেড়েও চলা দ্বন্দ্বের জোরে ভারতে নতুন প্রশাসন এল। পৃষ্ঠপোষক মধ্যবিত্ত মনসবদারি এবং রাষ্ট্রটিও ব্রিটিশ রাজত্বে শাসনে ধুয়ে মুছে সাফ হয়ে যাওয়ায়, এই সময়ে দেশজ চিকিৎসা ব্যবস্থা কিছুটা পিছু হঠল১০০। বাংলায় মুসলমান পৃষ্ঠপোষণা চলে যাওয়ায় প্রচুর শহুরে চাকরি লোপ পেয়ে গেল, সেনা, কুশলী পরম্পরার কারিগর, করণিকদের কাজ গেল।

আয়ুর্বেদিয় চিকিতসকেরা পেশাদার ছিল কি না তা নিয়ে বিতর্ক রয়েইছে(বিশদে ৪র্থ অধ্যায়ে) – কিন্তু প্রাচীন এবং মধ্য যুগে ভারতীয় চিকিৎসা ব্যবস্থার যেদিকে পরিবর্তন আসছিল সেটা ইঙ্গিত করে পেশাদারিত্বের দিকেই যাওয়ার। চিকিৎসা শিক্ষা দীর্ঘমেয়াদী। জীবককে তক্ষশীলায় সাত বছর ধরে শিক্ষা নিতে হয়েছে। চিকিৎসা শাস্ত্রে উল্লিখত ধর্মীয় সূত্র/আচার অনুযায়ী চিকিৎসককে চিকিৎসার জন্য বৈধতা নিতে হয়। শেষতমভাবে দরবারে চাকরি চলে যাওয়ায় সামাজিকভাবে চিকিতসাবিদ্যার ওপরে গ্রহনের ছায়া পড়েছে। পরের অধ্যায়গুলিতে আমি আলোচনা করব, উনবিংশ শতকে, ভারতীয় চিকিৎসার এই উপাদানগুলি পেশাদারি চিকিৎসা ব্যবস্থার বিকাশে সাহায্য করবে, হয়ত সে অবস্থায় ছিল সেই স্তরে পৌঁছবে না।
(চলবে)

No comments: