Saturday, February 4, 2017

বাংলা যখন বিশ্ব সেরা৮০ - লাইফ অব মীর জুমলা, জেনারেল অব আওরঙ্গজেব

জগদীশ নারায়ণ সরকার

৩। মীর জুমলার অসম অভিযানের তাৎপর্য, অহোমদের বিরুদ্ধে তার বিজয়ের কারণ
জীবনের শেষতম অভিযানটি মীর জুমলার সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ ছিল। মুঘল সাম্রাজ্যের পক্ষে এটি তার প্রথম এবং শেষ অভিযান, যা মুঘল সাম্রাজ্যকে অসম সীমান্ত পর্যন্ত বাড়িয়ে দেবে। ইখতিয়ারুদ্দিন মহম্মদ ইবন বখতিয়ারের সময় থেকে মুসলমান শাসকেরা উত্তরপূর্বে মুঘলদের শাসন এলাকা বাড়াবার পরিকল্পনা করে চলেছিলেন, এটি সেই চেষ্টার ফলবতী রূপ। বাস্তবে রণনীতিগতভাবে এটি অসাধারণ এক যুদ্ধ অভিযান। দিল্লি মহম্মদ বিন তুঘলক এবং বাংলার হুসেন শাহ যেখানে চরম ব্যার্থ হয়েছেন সেখানে মীর জুমলা কিন্তু সফল হলেন। জাহাঙ্গীরের সময়ে মুঘল অভিযান প্রাথমিকভাবে সফল হলেও শেষ পর্যন্ত ব্যার্থই হয়েছিল। রাজার সঙ্গে শোলাগড়ের শান্তিচুক্তির দরকষাকষির সময় মীর জুমলা মন্তব্য করেছিলেন, রাজা যেন তাকে তার পূর্বের মুঘল বাহিনীর সেনানায়কদের মত না ভাবেন, তারা হেরে চলে গিয়েছিলেন, তিনি কিন্তু জিততেই এসেছেন। শিহাবুদ্দিন তালিশ লিখছেন, অতীতে কোন বিদেশি রাজা অসমের এত ভিতরে প্রবেশ করতে পারে নি, এবং কোন বিদেশি এই দেশ জিতিতেও পারে নি। মহম্মদ কাজিম লিখছেন, আসমের রাজারা আত্মসম্মান বিসর্জন দিয়ে তাদের মাথা নোয়ায় নি, দেশের সব চেয়ে শক্তিশালী শাসককেও তারা রাজস্ব দেয় নি, তারা দেশের সব থেকে বড় সাম্রাজ্যবাদী শক্তির মাথা হেঁট করে দিয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে যে সব বিশ্ববিজেতা জিততে এসেছিল তারা সেই দেশে ঢুকে জেতার পথ হারিয়ে ফেলেছে।

মীর জুমলা মাত্র একমাসের মধ্যে মুঘল কামরূপ, আর ভীতিপ্রদ, দুর্বোধ্য অসম জয় করে ফেলেছিলেন আড়াই মাসেই। কোচবিহার থেকে অহোম রাজধানীতে পৌঁছনোই বিজয় যাত্রা ছিল। অহোম রাজা তার বাহিনী সমাধায় জড়ো করেছিলেন, সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ সুরক্ষার গড়, এবং তার ধারণা ছিল অতীতে যে ঘটনা ঘটেছে, সেই ইতিহাস বর্তমান কালেও চক্রবত ঘুরবে একইভাবে। কিন্তু অতীতের অভিযাত্রীদের অসম জেতা স্বপ্নই থেকে গিয়েছিল, মীর জুমলা সেটিকে বাস্তবে রূপ দিয়েছিলেন। ডাচ শল্য চিকিৎসক জানাচ্ছেন, মীর জুমলার পরিকল্পনা এবং সৈন্য সাজানোর পরিকল্পনা এমন ছিল যে অসম জেতার পরে তিনি পেগু হয়ে চিনেও অভিযানের পরিকল্পনা করেফেলেছিলেন। সাম্রাজ্যের বাহিনী ছ মাসের জন্য বিচ্ছিন্ন হয়েছিল, তার জন্য তাকে চরম দুর্ভোগও পোয়াতে হয়েছে। মন্বন্তর, বন্যা বা মহামারী কোনটারই নিদান মীর জুমলার হাতে ছিল না। এটা বলা দরকার তার বাহিনী অহোমদের হাতে হারে নি। অহোম রাজারা এতই ভয় পেয়ে গিয়েছিল যে তারা দিল্লির শাসন মাথা পেতে নিয়েছিল, যা অতীতের কোন অসম রাজা করে নি। অসমের ইতিহাসে মীর জুমলার নাম বরাবরের জন্য লেখা থাকবে, বুরুঞ্জীতে তার পাকা স্থান তো হয়েই গিয়েছে।

তাদের পুরোনো সফলতায় অহোমেরা মনে করেছিল এবারেও তারা জিতবে। জমিদারদের থেকে মীর জুমলা দেশের সঠিক খবর পাবেন ভাবেন নি। অথচ প্রত্যেক যায়গায় অহমিয়াদের প্রতিরোধ তাসের ঘরের মত ভেঙ্গে পড়ে, পঞ্চতরন এবং সিমলাগড় ছাড়া তারা মুখোমুখি যুদ্ধে যায়ই নি, এবং যুদ্ধে তাদের বড় ক্ষয়ক্ষতিও হয় নি। যোগিগুপায় মহামারী ঘটে আর শ্রীঘাটে পিছনের সৈন্য আসায় দেরি হয়েগিয়েছিল বটে, কিন্তু অহোমেরা যদি বর্ষা আসার সময় পর্যন্ত কঠোরভাবে নিজেদের প্রতিরোধ বেঁধে রাখতে পারত তাহলে হয়ত তালিশ বলছেন মুঘলেরা একটাও দুর্গ দখল করতে পারত না।

অহোমদের প্রখ্যাতি তাদের শৌর্য আর রণকুশলতায়। তারা সারাক্ষণ নজরদারি করত। সেনানায়কদের মত তাদের দুর্গও কঠোর কঠিন পাথরে তৈরি। তাদের বিপুল বাহিনী ছিল, অর্থ ছিল এবং যুদ্ধ করার প্রচুর রসদও ছিল। সিমলাগড়ের মত কঠিন দুর্গও ছিল, অসম সাঁজোয়া বাহিনী আর তাদের বারুদের গুণমানও অত্যাশ্চর্য ছিল। তবে এগুলি সঠিক নেতৃত্ব ছাড়া একযোগ হলেও বাস্তবে কার্যকরী হয় না, যদি আদতে সেনানায়ক সেনানীদের মনে অতিরিক্ত জেদ চাপিয়ে দিতে পারেন। রাজা জয়ধ্বজের দোদুল্যমানতা, রাজধানীতে শত্রু আসার আগেই পালিয়ে যাওয়া, যার জন্য অসম বুরুঞ্জীতে তার (বদ)নামই হয়ে গেল ভাগানিয়া রাজা – কখনো মীর জুমলার মত নেতার প্রতিদ্বন্দ্বী হতে পারে না। প্রথম শিখ যুদ্ধ সম্বন্ধে কানিংহ্যাম যা বলেছেন, ঠিক সেই কথা ১৬৬১-৬২ সালের অহোমদের সম্বন্ধেও বলা যায়, বিদ্রোহীর হৃদয় ছিল, লড়াই করার হাজারো মানুষ ছিল, কিন্তু সবাইকে একসঙ্গে করে পথ দেখাবার মানুষটাই ছিল না।

কামরূপের বিভিন্ন শিবির থেকে পশ্চাদপসরণ কিন্তু অহোমদের উদ্দেশ্যপূর্ণ রণনীতি ছিল না। মানস থেকে গুয়াহাটি পর্যন্ত যেসব অহোম সেনানায়ক বিভিন্ন বাহিনীর দায়িত্বে ছিলেন, তাদের রাজার প্রতি অনাস্থা এবং শিবির বদলের জন্য রাজাকে বাধ্য হতে হয়েছিল পশ্চাদপসরনের সিদ্ধান্ত নিতে। মুঘল কামরূপে তাংচু সান্দিকৈওএর থেকে প্রচুর মালপত্র গুয়াহাটির মুঘল প্রশাসক দখল করেছে, এমন একটা খবর পেয়ে রাজা নিম্ন অসমের সেনা বাহিনীর জন্য একজন অনঅসমিয়া মনথির ভরালী বরুয়াকে অসম বাহিনীর সেনানায়ক এবং প্রশাসক নিযুক্ত করে। রাজার এই পদক্ষেপে অসমের প্রশাসন এবং সেনাবাহিনীর নেতৃত্বে ৪০০ বছরের অসমিয়া নেতৃত্ব দেওয়ার ঐতিহ্যের ছেদ ঘটল। এক দুর্গ থেকে অন্য দুর্গের অহমিয়া সেনাধ্যক্ষরা প্রায় নিষ্ক্রিয় হয়ে গেল বা কোন রকম প্রতিরোধ দিলই না, তারা নাকি মন্তব্য করেছিল, বেজদলইরা এবার থেকে যুদ্ধ করুক। রাজার নিজের শ্বশুর রাজশাহুর বরফুকনই রাজার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে মুঘল বাহিনী যাতে অপ্রতিরোধ্যভাবে নওগাঁয় ঢুকতে পারে তার সুযোগ করে দিয়েছিল। রাজাকে ছেড়ে যাওয়া সেনানায়কেরা একে একে মুঘল বাহিনীর সঙ্গে জুড়ে গিয়ে লাখাউ এবং গড়গাঁওএর দিকে পথ দেখিয়ে নিয়ে গিয়েছিল। এছাড়াও গ্রামগুলি দখল করার কাজে বা নির্দিষ্ট খবর দিয়ে নির্দিষ্ট কবর খুঁড়ে দামি ধনরত্ন উদ্ধারে সাহায্য করেছিল। অজানা ডাচ সেনানায়ক(এখন আমরা জানি তার নাম হেডেন - অনুবাদক) অহোমদের মানসিকভাবে ভেঙ্গে পড়ার তত্ত্বে খুব একটা গুরুত্ব দেন নি, তিনিও বলছেন, আমরা যখন শত্রুর রাজ্যে ঢুকলাম, অসাধারণ ত্রাস শত্রু পক্ষকে গ্রাস করল, এবং নবাবের ভাগ্য সুপ্রসন্ন করতে অহমিয়ারা আমাদের পাশে এসে দাঁড়াল। বলা দরকার তাদের রণনৈপুন্য আর ঐতিহ্যের সঙ্গে তাদের আত্মসমর্পন খাপ খায় না।

মীর জুমলা অসমের কৃষকদের ওপর সেনাবাহিনীর অত্যাচার না করতে দেওয়ার যে মানবিক অথচ রণনৈপুন্যের নীতি নিয়েছিলেন সেটি দুর্দান্ত কাজ দিয়েছিল, তিনি থানেদারদের স্থানীয় মানুষজনের সঙ্গে কথা বলে তাদের বিরোধিতা দূর করতে নির্দেশ দিয়েছিলেন। স্থানীয় প্রজারা বহু সময়ে অহমিয়া বিদ্রোহী সেনানায়কদের ধরিয়ে দিয়েছে। আর অহোমদের পোড়ামাটি নীতিতে যসে সব গ্রামবাসী গ্রাম থেকে পালিয়ে গিয়েছিলেন, তারা মুঘলদের প্রতিশ্রুতিতে ফিরে এসে ঘরদোর তৈরি করেছেন, নিজেদের জীবিকা ফিরে পেয়েছেন ফলে তারা মুঘলদের রসদ সংগ্রহে সহায়তা করেছেন। অসমের যুদ্ধ মানুষের যুদ্ধ হয়ে উঠতে পারে নি। গড়গাঁওএ থাকাকালীন মুসলমান প্রজাদের থেকে অহোমদের বহু গুপ্ত তথ্য পেয়েছেন মীর জুমলা।

দিলির খান দাউজাদির মত দৃঢবল বহু সেনানায়ক মীর জুমলার সেনা বাহিনীতে ছিলেন যারা জয় ছিনিয়ে নিয়ে এসেছিলেন প্রত্যেক যুদ্ধক্ষেত্র এবগ দুর্যোগ থেকে। ছিলেন ফারাদ খান, মহম্মদ বেগ, রশিদ খান, য়াগদার খান উজবেগ এবং তাদের বাহিনীর দৃঢ মনোভাবের সেনানীরা। মীর জুমলা তাদের ওপর যে প্রভাব বিস্তার করেছিলেন, তা অন্য কোন সেনানায়ক করে উঠতে পারেন নি। তার নেতৃত্ব, রণনীতি, শৃঙ্খলা, যুদ্ধের পরিকল্পনার সঙ্গে মন্বন্তর এবং মহামারী মোকাবিলা করার ক্ষমতা বাহিনীকে এক করে রেখেছিল। দুর্যোগের সময়ে ঠাণ্ডা মাথা, প্রজ্ঞা, প্রয়োজনের সময় প্রয়োজনীয় সাহায্য পাঠানো, ১৬৬২ সালের বর্ষার দুর্যোগে তার সেনা সংগঠনের উদ্যম তাকে এবং তার বাহিনীকে বহু দুর্যোগ থেকে বাঁচিয়েছিল এবং শেষে জয় দেখতে পেয়েছেন। তিনি অসম্ভবভাবে সুশৃঙ্খল – বর্ষায় যেমন তেমনি অসম ছেড়ে চলে আসার সময়েও। তার কঠোর মনোভাব বাদুলি ফুকনের মত অদম্য সেনা নায়ককে শিবির বদল করতে বাধ্য করেছিল।

বাদুলি ফুলন তার রাজাকে ছেড়ে এসে মীর জুমলার বাহিনীতে প্রবেশ করে ৩-৪ হাজার সেনা জোগাড় করে শোলাগুড়ি আর টিপামে মুঘলদের পথ দেখিয়ে নিয়ে গিয়েছেন। পূর্ব অসমের গড়গাঁও এবং নামরূপের মধ্যে এলাকার ডেকা-রাজা নামে অভিষিক্ত করেন মীর জুমলা। তিনি রাজা এবং অন্যান্য অমাত্যকে ধরে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন মীর জুমলাকে। এই পরিকল্পনাটা পথভ্রষ্ট হয়ে যায় অতন বরগোহাঁইর জন্য। বাদুলির নির্দেশে তার ভাই মাউপিয়া মেকুরিখোয়ায় নিজের দেশের বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই করেছিলেন। বাদুলির পথ ধরে জগন্নাথ ডেকা, রঘুনাথ মজুমদার এবং পুত্র মনোহর, উদ্ধব দুরিয়া এবং ডাংধরা বা অন্যান্যরা শিবির পালটে তার দেশকে মুঘলদের হাতে তুলে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেন বাদুলিকে নবাব বানানোর শর্তে। মীর জুমলা সরাসরি উত্তর না দিয়ে বলেছিলেন, আমি যা চইছি সেটা পাওয়ার যথেষ্ট তথ্য-প্রমান পেলে আপনারা যা চাইছেন পাবেন। এমনকি মন্থির ভরালি বরুয়া মীর জুমলার বাহিনীতে যোগ দেন জয়ধ্বজকে ধরিয়ে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে।

তবে অস্বীকার করা যাবে না, মীর জুমলাকে এই জেতার জন্য প্রচুর মূল্য দিতে হয়েছিল। তার বাহিনী অভূতপূর্ব দুর্যোগের মধ্যে পড়েছিল। ১৬৬২ সালে তার দুর্যোগের কথা স্মরণ করে তালিশ লিখছেন, লোহাকে গ্রেফতার করা সোজা, জল নয়। এবং মীর জুমলার মৃত্যুতে সম্রাটের নতুন দেশ বিজয় বিস্বাদ হয়েগিয়েছিল। যার জন্য তাকে দোষ দেওয়া যায় না, কিন্তু তার কাছের ওয়াকিয়ানবিশ কিন্তু এই বিজয়ে চোনা ফেলে লিখলেন ফাতিয়াইইব্রিয়া(বিজয় পুস্তক, যার নাম হুঁশিয়ারি) নামক বই।

(চলবে)

No comments: