Wednesday, February 1, 2017

বাংলা যখন বিশ্ব সেরা৭৪ - লাইফ অব মীর জুমলা, জেনারেল অব আওরঙ্গজেব

জগদীশ নারায়ণ সরকার

৪। অহোমদের রক্ষণাত্মক চোরাগোপ্তা(গেরিলা) হামলার রণনীতি
দুর্ভেদ্য সিমলাগড়ের পতন, সমধারা থেকে পালিয়ে যাওয়া আর শেষ পর্যন্ত বিপুল নৌবহর ধ্বংসে অহোমদের মনোবলে চিড় ধরিয়ে দিল। এখন আত্মরক্ষার ভার এসে পড়ল আতন বুড়াগোঁহাইয়ের কাঁধে। আজকের রণনীতিতে যাকে গেরিলা কায়দায় যুদ্ধ বলে, তিনি সেই পথ ধারণ করলেন অসাধারণ পরিকল্পনায়। বর্ষা আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করার জন্য অহোমেরা পাহাড়ে পালিয়ে গেল। সামনাসামনি লড়াই না করে তারা চোরাগপ্তা লড়ায়ের পরিকল্পনা করল। প্রাথমিকভাবে অনির্দিষ্ট দিক থেকে, কোন নর্দিষ্ট শিবির বাহিত না হয়ে রাতে ছোট ছোট দলে অতর্কিতে হানা দিতে শুরু করে। সেনা বাহিনী কয়েকটি ভাগে ভাগ হয়ে মুঘলদের এগোনো আর পিছোনোর সমস্ত রাস্তা ধরে আক্রমন শানাত। গোটা শিবিরে নয়, দল বেঁধে কিছু কাজ করতে বেরোনো যেমন আগুব জ্বালাবার কাঠ আনার দলকে হঠাত হঠাত আঘাত করত, খুন করত, ধরে নিয়ে গিয়ে তুর্কি ধরণের লোহার কুলুপের মত হাতিয়ার দিয়ে অত্যাচার করে ছেড়ে দিত, যাতে তারা শিবিরে ফিরে গিয়ে মারা যায়। দ্বিতীয়ত মুঘলদের বাহিনীর জন্য রসদের রাস্তা কেটে দেওয়া বা সেগুলি লুঠ করে লাখু, গড়গাঁও এবং মথুরাপুরের মুঘল শিবিরে প্রায় অনাহারের মত অবস্থা নেমে এল। মুঘল বাহিনীর জন্য সমস্ত খাবারের রসদএর সূত্র কেটে দেওয়া হল, জমা খাবারে আগুণ লাগিয়ে দেওয়া হল এবং গ্রাম থেকে কোন খাবার যাতে শহরে যেতে না পারে রাজার সে নির্দেশ সারা দেশে ছড়িয়ে দেওয়া হল। তৃতীয়ত আজকের পোড়ামাটির নীতি অনুসরণ করে মুঘল সেনার যতকিছু রসদ লাগতে পারে যেমন খাদ্য, নৌকো, স্থলযান, সোরার গুদাম সব কিছু মাটিতে মিশিয়ে, আগুণ ধরিয়ে নষ্ট করে ফেলা হল। উত্তর অসমে সমধরা ছেড়ে আসার আগে বারুদের গুদামে আগুণ ধরিয়ে আসা হল। পূর্ব দিকে আসার সময় তারা তিলান নদীর উত্তর পাড়ের সব মানুষকে গ্রাম ছাড়া করিয়ে মুঘলেরা কোন রসদ যাতে না পায় তার ব্যবস্থা করল। জানমুনগের দুর্গের বসতি জ্বালিয়ে দেওয়া হল। চতুর্থত সেগুলিকে হয়ত যুদ্ধ বলা যাবে না অথচ সামনা সামনি ছোটখাট হঠাত উদয় হয়ে লড়াই লাগিয়ে দিত। মীর জুমলা হয়ত যুদ্ধে জিতল, কিন্তু মানুষের হৃদয় জিততে পারল না, তার ক্ষমতার প্রয়োগ করতে পারল না। অহোমেরা মুঘলদের সামনাসামনি যুদ্ধে হয়ত হারাতে পারে নি, কিন্তু চোরাগোপ্তা লড়ায়ে মুঘলদের ধৈর্যের বাঁধ ভেঙ্গে দিতে পারল এবং এর ফলেই তাদের ফিরে আসতে হয়।

৫। লাখাউতে মীর জুমলার আগমন
অহোমদের চোরাগোপ্তা লড়ায়ের মধ্যেই মীর জুমলা ব্রহ্মপুত্রের দক্ষিণ পাড় ধরে তার মত করেই এগিয়ে চলছিলেন অসমের অক্ষ হৃদয়ের পানে। মুঘলদের আসমের আরও ভেতরে নিয়ে আসার রণনীতিতে অহোমদের ছেড়ে যাওয়া সোলাগড় দুর্গ দখল করার পরেই ফুকনেরা তাকে শান্তি বার্তা পাঠাল। কিন্তু আগের অভিজ্ঞতায় তিনি সেই বার্তা উপেক্ষা করলেন, কেননা এর আগের শান্তিবার্তায় তারা কোন উত্তর দেয় নি। তার মনে হয়েছিল এই শান্তিবার্তা শুধুই সময় কেনার আছিলা আর মুঘলদের সতর্ক প্রহরা এড়ানোর বাহানা।

রাজা, বরগোহাঁই ভিটারুয়াল ফুকন, দুয়ারিয়া গোষ্ঠীর দিহিঙ্গিয়া ফুকনকে লাখাউএর নদীর দুপাশের মুঘল বাহিনীর ওপর আক্রমন করতে নির্দেশ দিলেন, কিন্তু অহোম বাহিনী মীর জুমলার বাহিনীর হাতে গ্রেপ্তার হল। দিহিং এবং ব্রহ্মপুত্রের মিলনস্থল লাখাউতে ঢুকলেন মীর জুমলা। পেশকাশ দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে তার ব্রাহ্মণ গুরু আর তাম্বুলি ফুকনকে দিয়ে আবারও শান্তিবার্তা পাঠালেন রাজা। কিন্তু মীর জুমলা এই প্রস্তাবও প্রত্যাখ্যান করে বললেন তিনি শীঘ্রই গড়গাঁওতে পৌঁছবেন এবং তখন অবস্থা মত ব্যবস্থা নেবেন।

শ্বশুরের বিশ্বাসঘাতকতা এবং তার বাহিনীর বহু সেনানায়কেরা তাকে ছেড়ে চলে যাওয়ায় রাজা জয়ধ্বজ পশ্চাদপসণের সিদ্ধান্ত নিলেন – যতটা পারা যায় তার সম্পত্তি নিলেন – কেননা সব নিতে অন্তত ১০০০টি নৌকো লাগত – পেলেন না – যা পেলেন তাই নিয়ে চারাইদেও বা নাগা পাহাড়ের নিচের নামরূপের চারাই-খোরং এবং তার পরে তারাইসতএ গিয়ে তার মন্ত্রী এবং অনুরাগীদের সঙ্গে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত হল যে বিশাল মুঘল বাহিনীর সঙ্গে মুখোমুখি লড়াই করে যুদ্ধে জেতা যাবে না। শান্তি আলোচনা ব্যর্থ হওয়ায় কিছু অভিজাত, মহিষীদের নিয়ে আরও ভিতরে টিপামে গিয়ে বসতি করে ভবিষ্যতের জন্য ১ লক্ষ তীরান্দাজ সংগ্রহের পরিকল্পনা করলেন।

৬। গড়গাঁওএর পতন
বহু অহোম সেনাবাহিনী ত্যাগীকে নিয়ে মীর জুমলা লাখাউতে পদার্পন করলেন ১২ই মার্চ। বিপুল বাহিনীর অধিকাংশই বাইরেই থাকল। ছোট দিহিং নালা দিয়ে তারা আসতেই পারল না। প্রয়োজনীয় রসদ ছোট ছোট নৌকো করে নদীপথে সেনাবাহিনীর জন্য নিয়ে আসা হল। পদাতিক বাহিনী নিয়ে মীর জুমলা গড়গাঁওএর দিকে দেওলগাঁও(১৩-১৪ মার্চ), গাজপুর(১৫ মার্চ) এবং ত্রিমোহনী(১৬ মার্চ) হয়ে নালার পর নালা পেরিয়ে এগোতে থাকলেন। শেষ পর্যন্ত তিনি দিখু নালা পেরিয়ে গড়গাঁওতে ঢুকে রাজার প্রাসাদের পূর্ব পাশে শিবির গাড়লেন।
নাগা রাজা মুঘলদের কাছে বার্তা পাঠাল তারা মুঘলদের সাহায্য করতে চায়। মীর জুমলা প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করলেন, কিন্তু জানালেন তারা যদি অহোমদের সাহায্য না করে তাহলে তাদের মুঘলেরা সুরক্ষা দেবে।

নাগা পাহাড় পেরতে না পেরে নামরূপের নাগা ফৌজ শিবিরে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে দিন কাটাতে হচ্ছিল। রাজধানীর পূর্ব দিকে ১৪ দিনের দূরত্বে ভাগানিয়া রাজার ৪৯৮০ জন সঙ্গী বাহিনী বর্ষার আগমনের জন্য দিনগুণতে লাগল। বরগোহাঁই তিরুতে আর ফুকনেরা মাজুলির চরে আশ্রয় নিলেন। ঐতিহাসিক মহম্মদ মুনিমের পুত্র লিখছেন
খানইখানান সর্বোচ্চ সেনাপতি,
তার চেষ্টায় যুদ্ধ সমাপ্তির পথে,
তিনি যখন দুটি রাজধানী দখল করলেন আমরা দেখলাম,
সময় কিছু গোপনীয়তায় ছিদ্র বানায়।
এক বছরে অনেক কিছুই ঘটল,
(যেমন) কোচবিহার আর অসমের জয়।
(চলবে)

No comments: