জগদীশ নারায়ণ সরকার
১৬৫৬ সালের শেষের দিকে আওরঙ্গজেব সরাসরি কুতুব শাহকে হুঁশিয়ারি দিলেন যে তিনি যদি জমিদারদের উস্কানি দেওয়া বন্ধ না করেন, এবং যে সব সাম্রাজ্য-নিয়ন্ত্রিত মহাল তারা দখল করেছেন, সেখান থেকে তাঁর সেনা তুলে না নেন, এবং এই কাজে দায়িত্বপ্রাপ্ত কামগার বেগের হাতে (প্রশাসনের ভার) তুলে না দেন তাহলে তিনি তাঁর রাজ্য দখলের অভিযান শুরু করবেন। মহালগুলির যত রাজস্ব সুলতান তুলেছেন সেগুলি নিয়ে কামগারের সঙ্গে আলোচনা শুরু করতেও নির্দেশ দিলেন তিনি।
বীজাপুরের বিষয়ে ২১ জুন ১৬৫৬ তারিখে মীর জুমলার সুলতানের কাজকর্ম বিষয়ে উল্লেখ করে চিঠিটি পাওয়ার আগে মালুজি - যার ভাই জিঞ্জি দখলে কিলাদারের সঙ্গে যুদ্ধ করেছিল, তাঁর জন্য মীর জুমলা সাম্রাজ্যের কাজে নিয়োগ করারও সুপারিশ করেছিলেন, তাঁর ভাইকে নিজের দেহরক্ষী হতে বললেন। বুঝলেন দিল্লির সভায় বীজাপুরের বিরুদ্ধে আনা কোন আভিযোগ টিঁকবে না, তিনি মীর জুমলাকে তাঁর সাংকেতিক ভাষায় চিঠি লিখতে বললেন এবং সুলতানকে বীজাপুরের মুঘল হাজিব মার্ফতও হুমকি দিলেন।
যদিও আওরঙ্গজেব মীর জুমলা আধিকৃত কর্ণাটকে বিভিন্ন দাক্ষিণাত্যের ক্ষমতাবানদের আভিযানের উৎসাহ নানাভাবে বিশেষ করে হুমকি চিঠি দিয়ে আটকাচ্ছিলেন, কিন্তু তার পাশাপাশি কূটনীতিও প্রয়োগ করতে তিনি ভুল করেন নি। মীর জুমলার নির্দেশে শাহজী ভোঁসলার সঙ্গে বহু চিঠিচাপাটি আদান প্রদান করে তাঁকে আলাপালোচনার গতিপ্রকৃতি জানিয়ে রাখছিলেন। মীর জুমলার কর্ণাটক রক্ষায় শাহজীর সাহায্য তিনি নিয়েছিলেন সুলতানের সঙ্গে দারার চক্রান্ত রুখতে, তার বদলে তিনি তাঁকে বিশেষ কিছু সুবিধেও দিয়েছিলেন। ভবিষ্যতে পুরস্কারের প্রতিশ্রুতি দিয়ে, হিন্দু বিদ্রোহ রুখতে শাহজীকে চিঠি লেখেন আওরঙ্গজেব, প্রয়োজনে মীর জুমলাকেও চিঠি লিখতে অনুরোধ করে বললেন সম্রাটের কাছে শাহজী বিষয়ে যে আবেদনটি পড়ে রয়েছে – যিটি ছিল আদিল শাহের বাহিনীর ওপর শাহজীকে আক্রমণের ছক - সেই পরিকল্পনার ভবিষ্যত দাঁড়াল তা তাঁকে জানানো হোক। তাঁর চিঠিটি শেষ করছেন এই বলে, ‘আদিল শাহের মত অবিশ্বাসী মানুষের ওপর আঘাত করলে কি হতে পারে, সে বিষয়ে আমার বিন্দুমাত্র মাথা ব্যথা নেই, বরং এটি অতীব প্রয়োজনীয় কর্ম বলে আমি মনে করি। (কবিতা) তোমার যা ভাল, তা আমারও ভাল।’।
৬। আওরঙ্গজেবের প্রতি মীর জুমলার যুক্তিহীন অবিশ্বাস
মীর জুমলার কর্ণাটক বাঁচাতে আওরঙ্গজেব কি কি ভূমিকা নিয়েছিলেন, সে সম্বন্ধে মুন্সি কাবিল খানের যে অসাধারণ বর্ণনা রয়েছে, তাতে প্রমান দাক্ষিণাত্য জয়ের প্রশংসা তাঁর প্রাপ্য। নানান তথ্যের সমাহারে আমরা দেখতে পাচ্ছি, আওরঙ্গজেব কর্ণাটক বাঁচাতে কিছু নিজের বিচারবুদ্ধিমত উদ্যোগ নিয়েছিলেন আর কিছু মীর জুমলার পরামর্শক্রমে নিয়েছিলেন, এবং প্রত্যেকটি পদক্ষেপের যুক্তি বর্ণনা করে মৃদুভাষায় যে সব চিঠি আওরঙ্গজেব আর তাঁর মুন্সি, মীর জুমলাকে লিখেছিলেন, তাতে প্রমান হয় যে মীর জুমলার দখল করা ভূখণ্ডটি রক্ষায় আওরঙ্গজেব যথেষ্ট আন্তরিক ছিলেন; তাই তাঁর প্রতি মীর জুমলার সন্দেহ শুধু ভিত্তিহীন ছিল তাই নয়, আওরঙ্গজেব ভীষণ দুরবস্থার মধ্যে যে সেই কাজটি করেছেন, সেই সম্মানটুকু তাঁর প্রাপ্য ছিল। দূরে বসে খবর পাওয়ার দেরিতে মীর জুমলার মনে ক্ষোভ জমেছে এই অভিযোগ করাই যায়, বিশেষ করে যেভাবে ডাকচৌকিগুলির ওপরে আক্রমণ নেমে আসছিল, সেই সংবাদে মাথা ঠাণ্ডা রাখা খুব কঠিন ঠিকই – কিন্তু আওরঙ্গজেবের ওপর অবিশ্বাস যে খুব একটা ন্যয় সঙ্গত এ কথা মোটেই বলা যাবে না। সে ঘটনাগুলি ঘটেছিল, তা কিন্তু সম্রাট আর তাঁর উজিরের কাজকর্মের নীতিতেই হচ্ছিল। দুজনেই চেয়েছিলেন এলাকায় থাকা আওরঙ্গজেব কর্ণাটকের নিরাপত্তায় দায়িত্ব নিন। কিন্তু অকুস্থলে দাঁড়িয়ে থেকে তিনি যে রণনীতি আর কূটনীতি অনুসরণ করেছিলেন, তা ছিল তাতক্ষণিক সিদ্ধান্তের ফল। সেগুলি ক্ষতস্থনা হয়ত উপশম করে কিন্তু আরোগ্য করে না। তাঁর হাতে প্রয়োজনীয় সেনাবাহিনীর জোর ছিল না, যথেষ্ট সেনা রাখার অনুমতিই ছিল না। একটা বিষয় পরিষ্কার, যে মীর জুমলা কর্ণাটক থেকে প্রস্থানের পরে সেখানকার বাহিনীর পরিমান কমিয়ে দেওয়া হয়। এছাড়াও বহু ঘটনা তাঁর নিয়ন্ত্রণের বাইরে থেকে গিয়েছিল। যেমন এর আগে আমরা দেখেছি, দারার উচ্চাশা পুরণের গোপন চক্রান্ত কুতুব শাহের গোঁ বাড়তে এবং আওরঙ্গজেবের বারংবার হুমকিকে উপেক্ষা করতে সাহায্য করেছিল। দারার উতসাহে দুজন দক্ষিণী সুলতানই আওরঙ্গজেবের হুঁশিয়ারি প্রকাশ্যে অমান্য করার সাহস পেয়েছিল এবং তারা বুঝতে পারছিল আওরঙ্গজেবের ওপর শাহেনশার পুরোপুরি বিশ্বাস নেই, এবং সম্রাট তাঁর থেকে বার বার জবাবদিহি চেয়ে পাঠাচ্ছেন, এমন গুজবও কৌশলে ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছিল। আওরঙ্গজেব প্রকাশ্যেই মীর জুমলাকে বলেছিলেন আমার বক্তব্য বা লেখার কোন প্রভাব পড়ছে না। তিনি উজিরকে বলেন যে ডাকচৌকিগুলি ঠিকঠাক কাজ করা মুশকিল কেননা, ইন্দোর আর বুরহানপুরের জায়গিরের মধ্যেকার ডাকচৌকিগুলিতে থাকা মানুষেরা মন দিয়ে কাজ করছে না।
৭। গোলকুণ্ডা আক্রমণের দ্বিতীয় পরিকল্পনায় বাধ সাধলেন মীর জুমলা
১৬৫৬র মাঝের দিকে মীর জুমলার মনে কর্ণাটক এবং তাঁকে নিয়ে যে সব রটনা ছিল সেগুলি দূর করার চেষ্টা করলেন আওরঙ্গজেব। তাঁর বক্তব্য ছিল সমস্যা সমাধানের সূত্র আসতে হবে দিল্লি থেকেই। দাক্ষিণাত্যের সুবাদারের ইচ্ছে ছিল যে এই বিষয়ে মীর জুমলা সম্রাটের সামনে তাঁর রাজনীতি সঠিকভাবে প্রয়োগ করুক, যাতে তিনি দুই সুলতানকেই চিঠি লিখে তাদের শয়তানি কাজকর্মে দাঁড়ি টানতে সক্ষম হন। কিন্তু ক্রমশঃ তিনি বুঝছিলেন দাক্ষিণাত্যের অবস্থা শুধু আর হুমকি দিয়ে সামলানো যাচ্ছিল না, প্রয়োজন ছিল সরাসরি মেঠো রণনীতি বিশেষ করে আক্রমণের রাস্তা অবলম্বন করার। দারার চক্রান্ত আর উস্কানি রুখতে তিনি সুলতানি রাজ্য দুটিকে আক্রমন করার প্রস্তাব মীর জুমলাকে দিলেন। ‘’তুমি যদি মনে কর যে আমি তোমার কাজে অবহেলা করছি, তাহলে আমি বলব তোমারও মনে রাখা উচিত এই দুর্বিসহ অবস্থাকে সামলানোর একটা দায় সম্রাটের ওপরও বর্তায়, যাতে কর্ণাটক বিষয়ে(নীতি গ্রহণে) কোন ত্রুটি না থেকে যায়’। তিনি আবারও বললেন, ‘তুমি গোলকুণ্ডার অবস্থা ভালভাবেই জান। এই বিষয়ের তদ্বির নির্ভর করছে সম্রাটের সুখ-ইচ্ছার ওপর, এবং আশাকরব, তুমি বিষয়টি তাঁর সামনে এমনভাবে উপস্থিত করবে যাতে কর্ণাটক বিষয়ে যারা লোভ করছে তাদের বিচ্ছিন্ন ও নির্বিষ করে দেওয়া যায়।’ হিন্দু বিদ্রোহ দমন করতে আওরঙ্গজেব চেয়েছিলেন দিল্লির বাহিনী এসে যেন ‘আমাদের কাজ’ কর্ণাটকের সামনে চোখ রাঙিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা আবদুল জব্বারের নেতৃত্বে কুতিব শাহী বাহিনীকে হঠিয়ে দিক, কেননা এখন আর শুধু চোখ রাঙ্গানিতে কাজ হচ্ছে না। ঘটনা যখন পেকে উঠল, মুঘল দূত হাজি শফি কোন রকমে প্রাণ বাঁচিয়ে কর্ণাটক থেকে বহু কষ্টে ফিরে এলেন, সে সময় আওরঙ্গজেব সরাসরি মীর জুমলাকে প্রস্তাব দিয়ে বললেন অন্তত একবারও যেন খুব দেরি হয়ে যাওয়ার আগে তিনি সম্রাটের অনুমতি নিয়ে দাক্ষিনাত্যে আসেন। দিনের পর দিন অবস্থা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে, তুমি যা ভাল মনে কর, কর। তুমি যদি একে সামলাতে চাও তাহলে তাড়াতাড়ি চলে এস, যাতে আমরা দুজন হাতে হাত মিলিয়ে কাজ করতে পারি। ভবিষ্যতে কিন্তু কোন উদ্যমই যথেষ্ট বলে প্রমাণিত হবে না। আমি জানি তুমি কত বড় সেবার কার্যে আছ, তোমার জ্ঞান প্রজ্ঞা দূরদৃষ্টি অতুলনীয়; তাই তাড়াতাড়ি বিষয়টাকে নিয়ন্ত্রণে আনতে পরিকল্পনা প্রস্তুত কর, অমনযোগী হয়ো না।
আওরঙ্গজেব শেষ পর্যন্ত কুতুব শাহী রাজত্ব উচ্ছেদ এবং তাঁর জন্য একটি বাহিনীর নেতৃত্ব দিয়ে তিনি যেন দিল্লি থেকে চলে আসেন এমনও প্রস্তাবটা দিয়ে ফেললেন মীর জুমলাকে। ‘সুলতানের মনোভাব আর অদূরদৃষ্টি সম্পন্ন মানুষদের চক্রান্তের কথা অবিদিত নেই তোমার কাছে। এই জন্য আমি কুতুবউলমুলককে উচ্ছেদ করতে চাই এবং তাঁকে ক্ষমতায় রাখার প্রস্তাব আমাকে কেউ দিক চাই না। কর্ণাটকের ভবিষ্যতের জন্য এবং সময় সারণী দেখে আমার মনে হয়েছে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এই কাজটা সমাধা করতে ফেলতে হবে। এই বিষয়টা সুলতানকে পাঠানো চিঠিতে বিশদে বলা হয়েছে, এবং চিঠিটির বিষয়টি নিয়ে তুমি নিশ্চই সম্রাটকে বোঝাবে এবং দেখবে এটিকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব যাতে বাস্তবে রূপায়িত করা যায়, এবং তাঁর জন্য দেরি না করে ফর্মান জারি করার ব্যবস্থা করবে।’ ততক্ষণ দাক্ষিনাত্যে তিনি তাঁর বাহিনী বাড়াবার প্রস্তাব দিলেন, বললেন প্রয়োজনে কাজি মহম্মদ হাসানের নেতৃত্বে একটি বাহিনী যত তাড়াতাড়ি সম্ভব কর্ণাটক আসার ব্যবস্থা নিতে।
এটা পরিষ্কার যে আওরঙ্গজেব সরাসরি মীর জুমলাকে দাক্ষিনাত্য অভিযানে নেতৃত্ব দিতে বলছেন। ঘটনাগুলি পরিষ্কার করে তাঁর সামনে পেশ করলেন – সুলতানেরা সাম্রাজ্যের নির্দেশিকা, সুবাদারি নিশান এবং হুঁশিয়ারি অমান্য উপেক্ষা করেছেন, সুলতান হিন্দু রাজা জমিদারদের উষ্কানি দিয়েছেন যাতে তারা বিদ্রোহ করে, এবং বীজাপুরের সহায়তায় একটা বড় ধরণের সামরিক অভিযানের পরিকল্পনা করছে সুলতান, এবং এই ছোট বাহিনী নিয়ে তাঁর পক্ষে মীর জুমলার জায়গির বাঁচানো মুশকিল – মীর জুমলাকে তিনি স্পষ্ট জানিয়ে দিলেন, হয় তিনি সম্রাটকে রাজি করিয়ে আওরঙ্গজেবের সামরিক অভিযানের অনুমতি নিন, না হয় তাঁর ১২ বছরের শ্রমের ফল দখল রাখার কথা মন থেকে মুছে ফেলুন। দাক্ষিনাত্যের অবস্থা এবং তাঁর সমাধান সম্পর্কে এক মত হয়েও দুজন পরিকল্পক এক মত হতে পারলেন না। আওরঙ্গজেব চাইলেন মীর জুমলা কর্ণাটকের রাজনীতির মাধ্যমে দাক্ষিনাত্যের সমস্যার সমাধান করুণ, আর মীর জুমলা চাইলেন যে এই কাজটা শুরু হোক বীজাপুর দিয়ে। এই বিষয়ে দুজনের মধ্যে ছোটখাট বিরোধ দেখা দিল। উজির দিল্লিতে বসে বুঝতে পারছিলেন না কেন আওরঙ্গজেব তাঁর প্রস্তাবে দ্বিধান্বিত হচ্ছেন এবং সাড়া দিচ্ছেন না। আওরঙ্গজেব জানালেন তিনি অতীতে বারংবার উজিরের প্রস্তাবে কাজ করেছেন - কেন তুমি এখানে আমার অবহেলা দেখছ, যার মূল্য অঙ্কের খাতায় ধরে না? আর এই দেশটার নিয়ন্ত্রণ আমাদের হাতের বাইরে বেরিয়ে যাক, এবং আমাদের শত্রুরা উৎসাহিত হয়ে আমাদের নিয়ে মৃত্যুমিছিল করুক সেই পরিকল্পনায় আমি কি করে সায় দেব? সর্বশক্তিমান না চান, এই চিন্তা আমার মন কুরে কুরে খাচ্ছে। অবাক হয়ে যাচ্ছি তুমি একে বাধ্যতা ধরে নিলে।
কর্ণাটকের নিয়ন্ত্রণ কার হাতে থাকবে, এই প্রশ্নে এবং এবং সম্ভাব্য সামরিক অভিযানে যখন সারা দাক্ষিনাত্য উত্তাল, বীজাপুরি সুলতানের হঠাত মৃত্যু দাক্ষিণাত্যের রাজনীতিতে নতুন বাঁকের সৃষ্টি করল এবং বীজাপুরের দিকে সবার নজর ঘুরে গেল।
(চলবে)