বাংলা সাহিত্যে শাঁখ, শাঁখা
হাতে শাঁখা পরে কোজাগরী লক্ষ্মীপুজোয় বাঙালি মেয়েরা শাঁখ বাজিয়ে স্মরণ করেন সম্পদের দেবী লক্ষ্মী দেবীকে - শঙ্খ বাজিয়ে তোমায় ঘরে এনেছি; সুগন্ধি ধূপ জ্বেলে আসন পেতেছি৷ প্রদীপ জ্বেলে নিলাম তোমায় বরণ করে, জনম জনম থাকো আমার এঘরে, এসো মা লক্ষ্মী বোসো ঘরে৷
বাংলার শহুরে বা লৌকিক সাহিত্যে বার বার উঠে এসেছে শাঁখ আর শাঁখা অনুষঙ্গ, স্বয়ং রবীন্দ্রনাথও তার গ্রাম্য ছড়া সংগ্রহে উল্লেখ করেছেন পার্বতী আর মহাদেবের শাঁখা আর শাঁখারির এক কৌতুকতর সাংসারিক কোন্দল৷ শত বছর আগে রবীন্দ্রনাথ গ্রাম্যছড়া সংগ্রহের মাধ্যমে বাংলার লোকসম্পদ সংগ্রহের এক আন্দোলনের সূচনা করে এই নাম জানা-অজানা শিল্পীদের, সম্প্রদায়ের প্রতি সম্মাননা জানান, রবীন্দ্র জন্ম সার্ধশতবছরে লৌকিক শিল্পীদের পক্ষথেকে গঙ্গা জলে গঙ্গাপুজোর আদলে ঠাকুর রবীন্দ্রনাথকে প্রণাম জানানো হল রবীন্দ্রনাথের এই লেখাটি ছাপিয়ে-
যে ছড়ার আলোচনায় প্রবৃত্ত হইতেছি তাহাতে দেবদেবীর একটি গোপন ঘরের কথা বর্ণিত আছে৷
শিব সঙ্গে রসরঙ্গে বসিয়ে ভবানী৷ কুতূহলে উমা বলেন ত্রিশূল শূলপাণি৷৷ তুমি প্রভু, তুমি প্রভু ত্রৈলোক্যের সার৷
ইন্দ্র চন্দ্র কুবের বরুণ তোমারি কিংকর৷৷ তোমার নারী হয়ে আমার সাধ নাহি পোরে৷ যেন বেন্যা পতির কপালে প’ড়ে রমণী ঝোরে৷৷ দিব্য সোনার অলংকার না পরিলাম গায়৷ শামের বরন দুই শঙ্খ পরতে সাধ যায়৷৷ দেবের কাছে মরি লাজে হাত বাড়াতে নারি৷ বারেক মোরে দাও শঙ্খ, তোমার ঘরে পরি৷৷
ভোলানাথ ভাবিলেন, একটা কৌতুক করা যাক, প্রথমেই একটু কোন্দল বাধাইয়া তুলিলেন৷
ভেবে ভোলা হেসে কন শুন হে পার্বতী , আমি তো কড়ার ভিখারি ত্রিপুরারি শঙ্খ পাব কথি৷৷ হাতের শিঙাটা বেচলে পরে হবে না, একখানা শঙ্খের কড়ি৷ বলদটা মূল করিলে হবে কাহনটেক কড়ি৷৷ এটি ওটি ঠাক ঠিকাটি চাও হে গৌরী, থাকলে দিতে পারি৷ তোমার পিতা আছে বটে অর্থের অধিকারী৷ সে কি দিতে পারে না দুমুটো শঙ্খের মুজুরি৷৷
এই-যে ধনহীনতার ভড়ং এটা মহাদেবের নিতান্ত বাড়াবাড়ি,….স্ত্রী যখন ব্রেস্লেট প্রার্থনা করে কেরানিবাবু তখন আয়ব্যয়ের সুদীর্ঘ হিসাব বিশ্লেষণ করিয়া আপন দারিদ্র্য প্রমাণ করিতে বসিলে কোন্ ধর্মপত্নী তাহা অবিচলিত রসনায় সহ্য করিতে পারে৷ বিশেষত শিবের দারিদ্র্য ওটা নিতান্তই পোশাকি দারিদ্র্য, তাহা কেবল ইন্দ্র চন্দ্র বরুণ সকলের উপরে টেক্কা দিবার জন্য, কেবল লক্ষ্মীর জননী অন্নপূর্ণার সহিত একটা অপরূপ কৌতুক করিবার অভিপ্রায়ে৷ কালিদাস শংকরের অট্টহাস্যকে কৈলাসশিখরের ভীষণ তুহিনপুঞ্জের সহিত তুলনা করিয়াছেন৷ মহেশ্বরের শুভ্র দারিদ্র্যও তাঁহার এক নিঃশব্দ অট্টহাস্য৷ কিন্তু দেবতার পক্ষেও কৌতুকের একটা সীমা আছে৷ মহাদেবী এ সম্বন্ধে নিজের মনের ভাব যেরূপে ব্যক্ত করিলেন তাহা অত্যন্ত স্পষ্ট৷ তাহাতে কোনো কথাই ইঙ্গিতের অপেক্ষায় রহিল না৷
গৌরী গর্জিয়ে কন ঠাকুর শিবাই, আমি গৌরী তোমার হাতে শঙ্খ পরতে চাই৷৷আপনি যেমন যুব্-যুবতী অমনি যুবক পতি হয়, তবে সে বৈরস রস, নইলে কিছুই নয়৷৷ আপনি বুড়ো আধবয়সী ভাঙধুতুরায় মত্ত, আপনার মতো পরকে বলে মন্দ৷৷
এইখানে শেষ হয় নাই–ইহার পরে দেবী মনের ক্ষোভে আরো দুই-চারটি যে কথা বলিয়াছেন তাহা মহাদেবের ব্যক্তিগত চরিত্র সম্বন্ধে, তাহা সাধারণ্যে প্রকাশযোগ্য নহে৷ সুতরাং আমরা উদ্ধৃত করিতে ক্ষান্ত হইলাম৷ ব্যাপারটা কেবল এইখানেই শেষ হইল না; স্ত্রীর রাগ যতদূর পর্যন্ত যাইতে পারে, অর্থাৎ বাপের বাড়ি পর্যন্ত, তাহা গেল৷
কোলে করি কার্তিক হাঁটায়ে লম্বোদরে, ক্রোধ করি হরের গৌরী গেলা বাপের ঘরে৷৷
এ দিকে শিব তাঁহার সংকল্পিত দাম্পত্য-প্রহসনের নেপথ্যবিধান শুরু করিলেন–
বিশ্বকর্মা এনে করান শঙ্খের গঠন৷ শঙ্খ লইয়া শাঁখারি সাজিয়া বাহির হইলেন-, দুইবাহু শঙ্খ নিলেন নাম শ্রীরাম লক্ষ্মণ৷ কপটভাবে হিমালয়ে তলাসে ফেরেন৷৷ হাতে শূলী কাঁখে থলি শম্ভু ফেরে গলি গলি৷ শঙ্খ নিবি শঙ্খ নিবি এই কথাটি ব’লে৷৷ সখীসঙ্গে বসে গৌরী আছে কুতূহলে৷ শঙ্খ দেখি শঙ্খ দেখি এই কথাটি বলে৷৷ গৌরীকে দেখায়ে শাঁখারি শঙ্খ বার ক’ল্ল৷ শঙ্খের উপরে যেন চন্দ্রের উদয় হল৷৷ মণি মুকুতা-প্রবাল-গাঁথা মাণিক্যের ঝুরি৷ নব ঝলকে ঝলছে যেন ইন্দ্রের বিজুলি৷৷
দেবী খুশি হইয়া জিজ্ঞাসা করিলেন–
শাঁখারি ভালো এনেছ শঙ্খ৷ শঙ্খের কত নিবে তঙ্ক৷৷
দেবীর লুব্ধভাব দেখিয়া চতুর শাঁখারি প্রথমে দর-দামের কথা কিছুই আলোচনা করিল না; কহিল-
গৌরী, ব্রহ্মলোক, বৈকুণ্ঠ, হরের কৈলাস, এ তো সবাই কয়৷ বুঝে দিলেই হয়৷হস্ত ধুয়ে পরো শঙ্খ, দেরি উচিত নয়৷৷
শাঁখারি মুখে মুখে হরের স্থাবর সম্পত্তির যেরূপ ফর্দ দিল তাহাতে শাঁখাজোরা বিশেষ সস্তায় যাইবে মহাদেবীর এমন মনে করা উচিত ছিল না৷
গৌরী আর মহাদেবে কথা হল দড়৷ সকল সখী বলে দুর্গা শঙ্খ চেয়ে পরো৷৷ কেউ দিলেন তেল গামছা কেউ জলের বাটি৷ দেবের ঊরুতে হস্ত থুয়ে বসলেন পার্বতী৷৷ দয়াল শিব বলেন, শঙ্খ আমার কথাটি ধরো–
দুর্গার হাতে গিয়ে শঙ্খ বজ্র হয়ে থাকো৷৷ শিলে নাহি ভেঙো শঙ্খ, খড়েগ নাহি ভাঙো৷ দুর্গার সহিত করেন বাক্যের তরঙ্গ৷৷ এ কথা শুনিয়া মাতা মনে মনে হাসে৷ শঙ্খ পরান জগৎপিতা মনের হরষে৷৷ শাঁখারি ভালো দিলে শঙ্খ মানায়ে৷ ভাণ্ডার ভেঙে দেইগে তঙ্ক, লওগে গনিয়ে৷৷
এতক্ষণে শাঁখারি সময় বুঝিয়া কহিল–
আমি যদি তোমার শঙ্খের লব তঙ্ক৷ জ্ঞেয়াত-মাঝারে মোর রহিবে কলঙ্ক৷৷
ইহারা যে বংশের শাঁখারি তাঁহাদের কুলাচার স্বতন্ত্র; তাঁহাদের বিষয়বুদ্ধি কিছুমাত্র নাই; টাকাকড়ি সম্বন্ধে বড়ো নিস্পৃহ; ইঁহারা যাঁহাকে শাঁখা পরান তাঁহাকে পাইলেই মূল্যের আর কোনোপ্রকার দাবি রাখেন না৷ ব্যবসায়টি অতি উত্তম৷
কেমন কথা কও শাঁখারি কেমন কথা কও৷ মানুষ বুঝিয়া শাঁখারি এ-সব কথা কও৷৷
শাঁখারি কহিল–
না করো বড়াই দুর্গা না করো বড়াই৷ সকল তত্ত্ব জানি আমি এই বালকের ঠাঁই৷৷ তোমার পতি ভাঙড় শিব তা তো আমি জানি৷ নিতি নিতি প্রতি ঘরে ভিক্ষা মাগেন তিনি৷৷ ভস্মমাখা তায় ভুজঙ্গ মাথে অঙ্গে৷ নিরবধি ফেরেন তিনি ভূত-পেরেতের সঙ্গে৷৷
ইহাকেই বলে শোধ তোলা! নিজের সম্বন্ধে যে-সকল স্পষ্ট ভাষা মহাদেব সহধর্মিণীরই মুখ হইতে মধ্যে মধ্যে শুনিয়া আসিয়াছেন, অদ্য সুযোগমত সেই সত্য কথাগুলিই গৌরীর কানে তুলিলেন৷
এই কথা শুনিয়া মায়ের রোদন বিপরীত৷ বাহির করতে চান শঙ্খ না হয় বাহির৷৷ পাষাণ আনিল চণ্ডী, শঙ্খ না ভাঙিল৷ শঙ্খেতে ঠেকিয়া পাষাণ খণ্ড খণ্ড হল৷৷ কোনোরূপে শঙ্খ যখন না হয় কর্তন৷ খড়গ দিয়ে হাত কাটিতে দেবীর গেল মন৷৷ হস্ত কাটিলে শঙ্খে ভরিবে রুধিরে৷ রুধির লাগিলে শঙ্খ নাহি লব ফিরে৷৷ মেনকা গো মা,
কী কুক্ষণে বাড়াছিলাম পা৷৷ মরিব মরিব মা গো হব আত্মঘাতী৷ আপনার গলে দিব নরসিংহ কাতি৷৷
অবশেষে অন্য উপায় না দেখিয়া দুর্গা ধূপদীপনৈবেদ্য লইয়া ধ্যানে বসিলেন৷
ধ্যানে পেলেন মহাদেবের চরণ দুখান৷
তখন ব্যাপারটা বুঝা গেল, দেবতার কৌতুকের পরিসমাপ্তি হইল৷
কোথা বা কন্যা, কোথা বা জামাতা৷ সকলই দেখি যেন আপন দেবতা৷৷
এ যেন ঠিক স্বপ্নেরমতো হইল৷ নিমেষের মধ্যে-
দুর্গা গেলেন কৈলাসে, শিব গেলেন শ্মশানে৷ ভাঙ ধুতুরা বেঁটে দুর্গা বসলেন আসনে৷ সন্ধ্যা হলে দুইজনে হলেন একখানে৷৷
কিন্তু কড়া জবাব দিয়া কার্যোদ্ধার হয় নাই৷ বরং তর্কে পরাস্ত হইলে গায়ের জোর আরো বাড়িয়া উঠে৷ সেই বুঝিয়া দুর্গা তখন-
গুটি পাঁচ-ছয় সিদ্ধির লাড়ু যত্ন ক’রে দিলেন৷
দাম্পত্যযুদ্ধে এই ছয়টি সিদ্ধির লাড়ু কামানের ছয়টা গোলার মতো কাজ করিল; ভোলানাথ এক-দমে পরাভূত হইয়া গেলেন৷ সহসা পিতা কন্যা জামাতার ঘনিষ্ঠ মিলন হইয়া গেল৷ বাক্যহীন নন্দী সকৌতুক ভক্তিভরে দ্বারপার্শ্বে দাঁড়াইয়া মনে মনে হাসিতে লাগিল-
সম্ভ্রমে সম্ভাষণ করি বসলেন তিন জন৷ দুগা, মর্তে যেয়ে কী আনিবে আমার কারণ৷৷ প্রতিবারে কেবলমাত্র বিল্বপত্র পাই৷ দেবী বললেন, প্রভু ছাড়া কোন্ দ্রব্য খাই৷৷ সিঁদুর-ফোঁটা অলকছটা মুক্তা গাঁথা কেশে৷ সোনার ঝাঁপা কনকচাঁপা, শিব ভুলেছেন যে বেশে৷৷ রত্নহার গলে তার দুলছে সোনার পাটা৷ চাঁদনি রাত্রিতে যেন বিদ্যুৎ দিচ্ছে ছটা৷৷ তাড় কঙ্কণ সোন্ পৈঁছি শঙ্খ বাহুমূলে৷ বাঁক-পরা মল সোনার নূপুর, আঁচল হেলে দোলে৷৷ সিংহাসন, পট্টবসন পরছে ভগবতী৷ কার্তিক গণেশ চললেন লক্ষ্মী সরস্বতী৷৷ জয়া বিজয়া দাসী চললেন দুইজন৷ গুপ্তভাবে চললেন শেষে দেব পঞ্চানন৷৷ গিরিসঙ্গে পরম রঙ্গে চললেন পরম সুখে৷ ষষ্ঠী তিথিতে উপনীত হলেন মর্তলোকে৷৷ সারি সারি ঘটবারি আর গঙ্গাজল৷ সাবধানে নিজমনে গাচ্ছেন মঙ্গল৷৷
অথবা সাধারণ গ্রামীণ ছড়ায় বারবার উঠে আসছে শাঁখের কথা
মাসি পিসি বনকাপাসি, বনের মধ্যে টিয়ে৷ মাসি গিয়েছে বৃন্দাবন দেখে আসি গিয়ে৷৷ কিসের মাসি, কিসের পিসি, কিসের বৃন্দাবন৷ আজ হতে জানলাম মা বড়ো ধন৷৷ মাকে দিলাম শাঁখা শাড়ি, বাপকে দিলাম নীলে ঘোড়া৷ ভাইয়ের দিলাম বিয়ে৷৷ আবার মায়ে দিল সরু শাঁখা, বাপে দিল শাড়ি৷ ঝপ্ ক’রে মা বিদেয় কর্-, রথ আসছে বাড়ি৷৷ আগে আয় রে চৌপল-, পিছে যায় রে ডুলি৷
গীতায় পাচ্ছি কুরু পাঞ্চালের নানান বীরের হাতে ধৃত শঙ্খের নাম-
তস্য সঞ্জনয়ন্ হর্ষ্ কুরু-বৃদ্ধঃ পিতামহঃ ৷ সিংহ নাদম্ বিনদ্য উচ্চৈঃ শঙ্খম্ দধ্মৌ প্রতাপবান ৷১২৷ ততঃ শঙ্খাঃ চ ভের্যাঃ চ পনব আনক গোমুখাঃ ৷ সহসা এব অভ্যহন্ন্ত সঃ শব্দঃ তুমুলঃ অভবত্ ৷১৩৷ ততঃ শ্বেতৈঃ হয়ৈঃ যুক্তে মহতি স্যন্দনে স্থিতৌ ৷ মাধবঃ পান্ডবঃ চ এব দিব্যৌ শঙ্খৌ প্রদধ্মতুঃ ৷১৪৷ পাঞ্চজন্যম্ হৃষীক-ঈশঃ দেবদত্তম্ ধনঞ্জয়ঃ ৷ পৌন্ড্রম্ দধ্মৌ মহাশঙ্খম্ ভীমকর্মা বৃক-উদর ৷১৫৷ অনন্ত বিজয়ম্ রাজা কুন্তীপুত্রঃ যুধিষ্ঠিরঃ ৷ নকুলঃ সহদেবঃ চ সুঘোষ-মনিপুস্পকৌ ৷১৬৷ কাশ্যঃ চ পরম-ইষু-আসঃ শিখন্ডী চ মহারথঃ ৷ ধৃষ্টদ্যুম্নঃ বিরাটঃ চ সাত্যকি চ অপরাজিতঃ ৷১৭৷ দ্রুপদঃ দ্রৌপদেয়াঃ চ সর্বশঃ পৃথিবী পতে ৷ সৌভদ্রঃ চ মহা বাহু শঙ্খান দধ্মুঃ পৃথক্ পৃথ্ক ৷১৮৷সঃ ঘোষঃ ধার্তরাষ্ট্রাণাম্ হৃদয়ানি ব্যদারয়াত্ ৷ নভঃ চ পৃথিবীম্ চ এব তুমুলঃ অভ্যনুনাদয়ন ৷১৯৷
বঙ্গার্থ- তখন কুরু বংশের বৃদ্ধ পিতামহ ভীষ্ম দুর্যোধনের হর্ষ উত্পাদনের জন্য সিংহের গর্জ্জনের মত অতি উচ্চনাদে তার শঙ্খ বাজালেন৷ তারপর শঙ্খ ভেরী পনক আনক ঢাক এবং গোমুখ সিংঙ্গা সমুহ হঠাত্ একত্রে ধ্বনিত হয়ে এক তুমুল শব্দের সৃষ্টি হল৷ অন্যদিকে শ্বেত অশ্বসমুহ যুক্ত একদিব্য রথে স্থিত শ্রীকৃষ্ণ এবং অর্জুন উভয়ে তাদের দিব্য শঙ্খ বাজালেন৷ তখন শ্রীকৃষ্ণের পাঞ্চজন্য নামক শঙ্খ বাজালেন৷এবং অর্জুন বাজালেন তার দেবদত্তক নামক শঙ্খ এবং বিপুল ভোজন প্রীয় ভীমকর্মা সেন বাজালেন পৌন্ড্র নামক তার ভয়ঙ্কর শঙ্খ৷ কুন্তীপুত্র মহারাজ যুধিষ্ঠির অনন্ত বিজয় নামক শঙ্খ বাজালেন, এবং নকুল এবং সহদেব বাজালেন সুঘোষ এবং মনিপুস্পক নামক শঙ্খ৷ হে মহারাজ তখন মহান ধনুর্ধর কাশিরাজ, প্রবল যোদ্ধা শিখন্ডি,ধৃষ্টদ্যুম্ন, বিরাট এবং অপরাজিত সাত্যকি, দ্রুপদ দ্রৌপদীর পুত্রগন, সুভদ্রার মহা বলবান পুত্র এবং অন্য সকলে তাদের নিজ নিজ পৃথক শঙ্খ বাজালেন৷ শঙ্খ নিনাদের সেই শব্দে আকাশ বিদীর্ন হল৷ পৃথিবী কম্পিত হল এবং তার ফলে ধৃতরাষ্টের হৃদয় প্রবল ভয়ে বিধ্বস্ত হল৷
সাধারণ তুসু গানেতেও লৌকিক জীবনে শঙ্খ ব্যবহারের উল্লেখ পাই - আমার তুষু সিনানে গেছে কালীদহের পুকুরে, কোথায় এক ব্রাহ্মাণ এসে শঙ্খ পরায় তুষুরে, শঙ্খ যে পরলি মাগো মূল্য লিব কার কাছে, ঘরে আছে অবৈ দেবরাজ মূল্য নাও গা তার কাছে, ওহে ওঠে অবৈ দেবরাজ মূল্য দাও হে আমারে, তোমার কন্যা শঙ্খ পরিল কালীদহের পুকুরে, শঙ্খ যে পরলি মাগো হাতে কেমন সেজেছে, অথবা, কি আনন্দ লাগলো মনে, আদিবাসী পাবনে, শাঁখ বাজালো ও দিদিরা, দে উলু দে সকলে, নিয়ে আয় তোরা বরনডালা, টুসুর মায়ের ঘর সাজা, পদ্ম ফুলটা পাতে দিব, হলুদ ফুলের বিছানা, সুগন্ধর ধূপ জ্বেলে দেব, দেব জ্বেলে দীপ বাতি, সারা রাতি থাকব বসে, টুসুর মায়ের পাশে, কি আনন্দ লাগলো মনে, আদিবাসী পাবনে৷
আবার শ্রীশ্রী রামকৃষ্ণ কথামৃতর প্রথম পরিচ্ছেদে পূর্ণ, ছোট নরেন, গোপালের মা শীর্ষক কথায় পাই শাঁখা পরা হাত আর শাঁখারীর কথা- “রণজিত রায় ওখানকার জমিদার ছিল৷ তপস্যার জোরে তাঁকে কন্যারূপে পেয়েছিল৷ মেয়েটিকে বড়ই স্নেহ করে৷ সেই স্নেহের গুণে তিনি আটকে ছিলেন, বাপের কাছ ছাড়া প্রায় হতেন না৷ একদিন সে জমিদারির কাজ করছে, ভারী ব্যস্ত; মেয়েটি ছেলের স্বভাবে কেবল বলছে, ‘বাবা, এটা কি; ওটা কি৷’ বাপ অনেক মিষ্টি করে বললে -- ‘মা, এখন যাও, বড় কাজ পড়েছে৷’ মেয়ে কোনমতে যায় না৷ শেষে বাপ অন্যমনস্ক হয়ে বললে, ‘তুই এখান থেকে দূর হ’৷ মা তখন এই ছুতো করে বাড়ি থেকে চলে গেলেন৷ সেই সময় একজন শাঁখারী রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিল৷ তাকে ডেকে শাঁখা পরা হল৷ দাম দেবার কথায় বললেন, ঘরের অমুক কুলুঙ্গিতে টাকা আছে, লবে৷ এই বলে সেখান থেকে চলে গেলেন, আর দেখা গেল না৷ এদিকে শাঁখারী টাকার জন্য ডাকাডাকি করছে৷ তখন মেয়ে বাড়িতে নাই দেখে সকলে ছুটে এল৷ রণজিত রায় নানাস্থানে লোক পাঠালে সন্ধান করবার জন্য৷ শাঁখারীর টাকা সেই কুলুঙ্গিতে পাওয়া গেল৷ রণজিত রায় কেঁদে কেঁদে বেড়াচ্ছেন, এমন সময় লোকজন এসে বললে, যে, দীঘিতে কি দেখা যাচ্ছে৷ সকলে দীঘির ধারে গিয়ে দেখে যে শাঁখাপরা হাতটি জলের উপর তুলেছেন৷ তারপর আর দেখা গেল না৷ এখনও ভগবতীর পূজা ওই মেলার সময় হয় -- বারুণীর দিনে৷
অরু দত্ত তরু দত্ত দুই বোন শাঁখা পরা হাতের কিংবদন্তী বর্ধমানের যোগাদ্যার কাহিনী লিখেছিলেন ইংরেজি পদ্যয়, গত শতাব্দে, যার কুড় কিন্তু সারা বাংলার গ্রামেগঞ্জের লৌকিক কাহিনীতে ছড়িয়ে রয়েছে৷ ঠিক একই কাহিনি আমরা পাই হাওড়ার রাজবল্লভী দেবীর প্রতিষ্ঠার কিংবদন্তীতেও
আর বাংলার মেয়েদের কথা, বাংলার পরিবেশের কথা জীবনানন্দ ছাড়া আর কেইবা তার তুলতুলে পলিমাটিময় কলমে বলেছেন, রূপসী বাংলায় বারবার লিখেছেন-
১)দেখিব মেয়েলি হাত সকরুণ- শাদা শাঁখা ধূসর বাতাসে, শঙ্খের মতো কাঁদে : সন্ধ্যায় দাঁড়াল সে পুকুরের ধারে,
২)চারিদিকে বাংলার ধানী শাড়ি- শাদা শাঁখা- বাংলার ঘাস, আকন্দ বাসকলতা ঘেরা এক নীল মঠ-আপনার মনে, ভাঙিতেছে ধীরে ধীরে;- চারিদিকে এইসব আশ্চর্য উচ্ছ্বাস-
৩)ঘুমায়ে পড়িব আমি একদিন তোমাদের নক্ষত্রের রাতে, শিয়রে বৈশাখ মেঘ-শাদা-শাদা যেন কড়ি-শঙ্খের পাহাড়, নদীর ওপার থেকে চেয়ে রবে- কোনো এক শঙ্খবালিকার, ধূসর রূপের কথা মনে হবে-এই আম জামের ছায়াতে
৪)সে কত শতাব্দী আগে তাহাদের করুণ শঙ্খের মতো স্তন, তাহাদের হলুদ শাড়ি — ক্ষীর দেহ — তাহাদের অপরূপ মন
৫)চলে গেছে বহু দূরে; — দেখোনিকো, বোঝানিকো, করোনিকো মানা, রূপসী শঙ্খের কৌটা তুমি যে গো প্রাণহীন — পানের বাটায়৷
Lokfolk লোকফোক forum of folk লোক tribal আদিবাসী culture সংস্কৃতি of West Bengal পশ্চিমবঙ্গ, বাংলা. LOKFOLK is Bengal বাংলা India's ভারতের traditional পারম্পরিক knowledge system জ্ঞানভাণ্ডার, history ইতিহাস, Indigenous technology প্রযুক্তি. We have two mass bodies গনসংগঠন Bongiyo Paromporik Kaaru O ও Bastro Shilpi Sangho; Bongiyo Paromporik Aavikaar Shilpi Sangho. Journal পত্রিকা, PARAM, পরম. Picture - KaaliKaach কালিকাচ, Dinajpur দিনাজপুর, Madhumangal মধুমঙ্গল Malakar মালাকার
Sunday, September 12, 2010
শাঁখ শাখার বারোমাস্যা - চারুমণ্ডল
লেবেলসমূহ:
Bengal,
Conch Shell Carving,
ConchBangles,
ConchShell,
FolkCommunity,
FolkCraft,
শাঁখ,
শাখা,
শাঁখারি
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
No comments:
Post a Comment