(এই লেখাটি তৈরির পথে লোকফোক-এর বিশ্বেন্দু বহু মানুষের, বহু ওয়েবসাইটের, বহু সংবাদপত্রের পরামর্শ, সহায়তা, অকৃপণ ও অযাচিত আনুকূল্য নাভ করেছে৷ এই ক্ষুদ্র পরিসরে সকলের নাম বলা না গেলেও, এই লেখাটি দেখে অনেকই বুঝবেন তাদের হস্তবলেপনের তথ্য৷ সব্বাইকে ব্লগ আর কলাবতী মুদ্রার পক্ষথেকে প্রণাম, ভালবাসা আর শুভেচ্ছা)
প্রতিদিন সন্ধ্যা নামার সঙ্গে সঙ্গে শাঁখা-সিঁদুর পরা একটা মেয়ে ঘরে জ্বালিয়ে দেয় সন্ধ্যাপ্রদীপ৷ উলুধ্বনি দিয়ে বাজায় শঙ্খ, প্রদীপ দেয় তুলসিমঞ্চে৷ পরিবারের প্রতি, স্বামীর প্রতি, স্বজনের প্রতি, নানান সম্পর্কের প্রতি মঙ্গল কামনায় প্রণাম করে এবং তার পরিবেশের প্রতি ভালবাসা আর শ্রদ্ধায় শাঁখা ছোঁয়ায় কপালে৷ প্রান্ত বাংলার গ্রামে গ্রামে লাখো লাখো বিবাহিত মেয়ে আজও তুলসি তলায় শাঁখা হাতে পরে প্রণাম দেয়৷ আমাদের বিবাহিত মেয়েটাও হাজার বছরের বাংলার সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ধরে রেখে দিতে চায় তার শাঁখা পরা হাতে তুলসি তলায় সান্ধ্য প্রণামের রোজকার আচারের মধ্যে৷
আগেরদিনই পুকুরঘাটে তার হাতের শাঁখা ভেঙেছে৷ পরিবার, স্বজনের অমঙ্গলের আশঙ্কায় দুরুদুরু করে ওঠে তার অন্তর৷ হাজার হাজার বছরের সংস্কারেরর বেড়ায় জুড়ে থাকা বিবাহিত স্ত্রীটিধনকে বেঁধে রাখা যায়নি৷ পরের দিনই সক্কাল সক্কাল আপিস যাবার পথে বরকে তাড়া দিয়েই সে নিয়ে গিয়েছে শহরের শাঁখারি বাজারে৷ সেখান থেকে সে প্রায় মনেরমত শাঁখা পরে এসেছে৷ দাম বেড়েছে, মন খারাপ৷ মনেরমত মকরমুখী শাঁখাটি পেতে তাকে গুণতে হয়েছে বেশ কয়েকশ টাকা৷ তবুও আগের ভেঙে যাওয়া শাঁখাটির ওপর করা কাজেরমত হয়নি৷ তবুও সন্তুষ্ট সে৷ বাড়িতে ফিরে নতুন মকরমুখী শাঁখাটিতে একটু সিঁদুর ছুঁইয়েই তার শান্তি৷ সেই সন্ধ্যায় তুলসিতলার পুজোটা আরও একটু গাঢ় হয়ে ওঠে তার৷
সকালে শাঁখারিবাজারের শাঁখা পরার উপাচারের পর সন্ধ্যায়ও মেয়েটার হাত তাই রীতিমতো লাল৷ দু বেলা চলে গিয়েছে, তবু তখনও প্রচণ্ড জ্বলছে হাতখানা৷ তার পরও তার মুখে হাসি৷ পরিবারের মঙ্গল কামনায় তার যত কষ্টই হোক, সে তা সইবে৷ সে জানে তার মা দিদিমা শ্বাশুড়িরাও এই ঐতিহ্যকে বুকে করে বেঁচেছেন, কৃষ্টি সজল চোখে তাদের দেখানো পথে সেও হাঁটতে চায়৷
বাংলার মফস্বলের শহরে শহরে শাঁখারীবাজারে গিয়ে চোখে জল আনা এমন নানান ঐতিহ্যবরণ চিত্র আজও এই শপিংমল সংস্কৃতির ভাঙাহাটে আদুরি সরারমত পরতে পরতে আনন্দে নীরবে খেলা করে চলে৷ বাংলার চিরাচরিত লৌকিক কৃষ্টির ঐতিহ্য মরেও যেন মরে না৷ শতাব্দের পর শতাব্দ মন্বন্তর, লুঠপাট, মারী, রাষ্ট্র বিপ্লব, ঝড়-জল-বণ্যা সয়ে সে তার রেশ টুকু ছড়িয়ে দিয়ে যায় প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে, যুগ থেকে যুগান্তরে, গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে৷ শুধু লৌকিক ধর্ম বিশ্বাসই নয, এই পশ্চিমি সংস্কৃতির পালতোলা সময়েও হাজার হাজার বছরের মাটির গন্ধ ভরা বাঙলিত্বের আঘ্রাণে মাখোমাখো বর্ণময় ভিন্ন ভিন্ন কৃতির সামাজিক-সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ধরে রাখতে পেরেছেন বাংলার মেয়ে বউরা৷ বাংলার শহরে শহরে পুরনত্বতে ভরদিয়ে শাঁখারীবাজারের দোকানগুলো বাংলার মিষ্টি মিষ্টি এই ঐতিহ্যকে বিশ্বায়নের নানান ব্যবসায়িক টানা পোড়েনের মধ্যেও ধরে রেখে দিয়েছেন আগলে৷ পেটে প্রায় কিল মেরে শাঁখারিরা আজও নানান আনুষঙ্গিক ব্যবসার মুনাফার হাতছানি উপেক্ষা করে বাংলার এই অমর ঐতিহ্যকে শুধু বাপদাদার ব্যবসারূপেই নয়, বাংলার সংস্কৃতির অঙ্গ রূপেই বহন করে আসছেন৷ তাদের দোকানে বিবাহিত হিন্দু মেয়েরাই মূলত এই শাঁখা কিনতে আসেন৷ শাঁখা পরার অধিকার একমাত্র সধবা বিবাহিত মেয়েরাই৷ ভাঙাগড়ার দিনেও গ্রামের মেয়েদের হাতে শাঁখা আর মাথার সিঁদুরের ঐতিহ্যকে অজর অমর করে রেখেছেন এই শাঁখারিরা তাদের অপার লৌকিক ভালবাসায়৷
যে শাঁখা পরে বাঙালি বিবাহিত মেয়েরা তাদের দেশের ঐতিহ্য বহন করে চলেন, বিশেষজ্ঞরা বলেন, সেই শাঁখার রমরমা ব্যবসার শুরু নাকি ঢাকার শাঁখারি বাজার থেকে৷ মনেরাখতে হবে, বাংলার উপকূলে কিন্তু শাঁখা পাওয়া যায় না৷বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শাঁখারিরা নাকি এসেছিলেন বাংলার বাইরে থেকে – মাত্র কয়েক শতাব্দ আগে৷ অথচ শহরে-গ্রামের নানান লেখায়, কথকতায়, সাহিত্যে অমর হয়ে রয়েছে বাঙালি মেয়েদের শাঁখ আর শাখা৷
বুড়িগঙ্গার উত্তর পাড় থেকে তিনশ গজ দূরে দশ ফুট প্রশস্ত একটি গলিই ঢাকার প্রখ্যাত শাঁখারিবাজার৷ এপার বাংলায় আবার বিষ্ণুপুরের শাঁখার কদর দেশের প্রান্ত ছাড়িয়ে পৌঁছেছে বিদেশের বাজারে, তবুও পশ্চিম বাংলার জেলা শহরগুলো জুড়েই শাঁখারিপাড়ার মাদকতাময় সোঁদা গন্ধ৷ দুই বাংলারই নানান শহরের শাঁখারিবাজারের, শাঁখারিপাড়ার নানান গলির পুরোনো পুরোনা বাড়িঘরের কাঠামোর সঙ্গে শহরের অন্য অঞ্চলগুলোর কোনো মিল নেই৷ একই বাড়িতে বসত, কর্মগৃহ এবং দোকান৷ বাজারের ভেতর সারিবদ্ধভাবে অনেক বাড়িঘর এবং তার সামনে সাজিয়ে রাখা শাঁখারি দোকানের পসরা৷ রোদের আলো দোকানের ভেতরে প্রবেশ করে না৷ স্যাঁতস্যাঁতে ঘর, তার ভেতর শাঁখারিরা বসে শঙ্খের গহনা তৈরি করেন৷ শঙ্খ কাটার জন্য শাঁখের করাত লাগে৷ শঙ্খের মাঝামাঝি চিকন জলের ধারা পড়লে ইস্পাতের সঙ্গে ঘর্ষণ লেগে পুরো ঘর বাষ্পের আকার ধারণ করে৷ ফলে কাটায় শ্রমিকরা স্যাঁতসেঁতে ঘরে বসে কাজ করে৷ এ কারণে পুরুষ শিল্পীরা অনেক সময় গুল ও নেশা জাতীয় দ্রব্য গ্রহণ করে৷ পুরুষদের সঙ্গে নারী শ্রমিকরাও রয়েছেন৷ নারীরা সাধারণত শঙ্খ কাটার পর নকশা ও পলিশ করার কাজের সঙ্গে জড়িত থাকেন৷
সাধারণত আরো অনেক লোকশিল্প ও লোকশিল্পকেন্দ্রিক পেশাদার মানুষের বসবাস কিন্তু শাঁখারি এলাকায়৷ শাঁখারিদের পাশাপাশি মহল্লায় বাস তাঁতব্যবসায়ী, কাঁসারী, কাঠমিস্ত্রি, স্বর্ণকার, কুমারটুলী ইত্যাদি৷ এ বাংলার নানান শহরের শাঁখারি পাড়াগুলোর চেহারাও কিন্তু খুব একটা পার্থক্য নেই, শহরের অন্যান্য পাড়াগুলো যখন বেড়ে চলছে পশ্চিমি ঢংএ তখন এধরনের ঐতিহ্যমণ্ডিত পুরোনো লৌকিক শিল্পীঅধ্যুষিত পাড়াই যেন উন্নয়ণের সঙ্গে তাল মেলাতে না পেরে নিজস্বতা আঁকড়ে বিদ্রোহীরমত মাথাতুলে দাঁড়িয়ে৷
তবে শাঁখা এখন ফ্যাশনও৷ সব সম্প্রদায়ের মেয়েরাই ব্যবহার করে শাঁখা৷ শহরে শহরে শাঁখারীবাজারে বেশ কয়েকটা দোকান আছে শাঁখার৷ তাই বেশ ঘুরে ঘুরে, যাচাই-বাছাই করে শাঁখা কিনতে পারেন ক্রেতারা৷ বাংলার অন্যান্য ব্যবসায়ীদেরমতই আজও শুধু ঢাকার শাঁখারিবাজারের দোকানিরা নয়, এ বাংলার শহরগুলোর প্রায সব শাঁখারিবাজারের শিল্পীরা ক্রেতাকে দেবতা মনে করেন৷ ফলে সমাদরটা একটু বেশিই পান ক্রেতারা৷
Lokfolk লোকফোক forum of folk লোক tribal আদিবাসী culture সংস্কৃতি of West Bengal পশ্চিমবঙ্গ, বাংলা. LOKFOLK is Bengal বাংলা India's ভারতের traditional পারম্পরিক knowledge system জ্ঞানভাণ্ডার, history ইতিহাস, Indigenous technology প্রযুক্তি. We have two mass bodies গনসংগঠন Bongiyo Paromporik Kaaru O ও Bastro Shilpi Sangho; Bongiyo Paromporik Aavikaar Shilpi Sangho. Journal পত্রিকা, PARAM, পরম. Picture - KaaliKaach কালিকাচ, Dinajpur দিনাজপুর, Madhumangal মধুমঙ্গল Malakar মালাকার
Friday, September 10, 2010
শাঁখ শাখার বারোমাস্যা - নাম্দীমুখ
লেবেলসমূহ:
Bengal,
Conch Shell Carving,
ConchBangles,
ConchShell,
FolkCommunity,
FolkCraft,
শাঁখ,
শাখা,
শাঁখারি
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
No comments:
Post a Comment