শঙ্খাসুরের রক্ত থেকে শঙ্খ
বাঙালী ঐতিহ্যের একটি নির্দিষ্ট স্থান দখল করে আছে শাঁখা৷ শাঁখা ছাড়া হিন্দু সম্প্রদায়ের কোন ধর্মীয় আচারভিত্তিক কর্মকান্ডই সুসম্পন্ন হয় না৷ হিন্দু নারীদের সধবা হওয়ার প্রতীকই হলো শাঁখা৷ পৌরানিক কাহিনীতে শাঁখার উত্পত্তি সম্পর্কে বলা হয়েছে- শঙ্খাসুরের স্ত্রী তুলসী দেবী ছিল ঈশ্বর নারায়ণে বিশ্বাসী খুবই সতীসাধ্বী নারী৷ কিন্তু শঙ্খাসুর ছিল ঈশ্বরবিমুখ অত্যাচারী৷ তার পাপের শাস্তিস্বরূপ তাকে ঈশ্বরের আদেশে হত্যা করে ভারত মহাসাগরে ভাসিয়ে দেয়া হয়৷ পতিব্রতা তুলসী তা সইতে না পেরে স্বামী এবং নিজের অমরত্বের জন্য ঈশ্বরের কাছে বিনীত প্রার্থনা করে৷ ঈশ্বর তার প্রার্থনা মঞ্জুর করে তার দেহভস্ম থেকে তুলসী গাছ এবং সমুদ্রে হত্যা করা স্বামীর রক্ত থেকে শঙ্খ বা শাঁখা উত্পত্তি করেন৷ এখানেই শেষ নয়, তুলসী দেবীর ধর্মপরায়ণতায় সন্তুষ্ট হয়ে ঈশ্বর তুলসী ও শাঁখাকে তাদের সম্প্রদায়ের ধর্মীয় কাজে ব্যবহারের আবশ্যকতা নির্ধারণ করে দেন৷ সেই থেকে পতিব্রতা তুলসীকে চিরস্মরণীয় করে রাখতে হিন্দু সম্প্রদায় তুলসী ও শাঁখার ব্যবহারের প্রচলন করে৷ এ কাহিনী সূত্রে বলা যায় খ্রীষ্টপূর্ব পাঁচ হাজার বছর আগে (মহাভারতের যুগে) শাঁখার ব্যবহার শুরম্ন হয়৷ হিন্দু সমাজে শান্তির প্রতীক, মঙ্গলের প্রতীক শাঁখার ব্যবহার বহুল প্রচলিত৷ তবে শাঁখা দিয়ে গড়া গহনা ও বাদ্যশঙ্খের ব্যবহার ছাড়া তাদের সামাজিকতা ও ধর্মীয় কার্যাদি অচল বলা চলে৷ বিবাহিত নারীদের তো বরের দেয়া শাঁখার বালা ধারণ করতেই হবে৷ আর পূজা-অর্চনা, সামাজিক, মাঙ্গলিক বা যেকোন শুভ অনুষ্ঠানে বাদ্য শঙ্খের ধ্বনি ছাড়া তা অসম্ভব বলেই ধরে নেয়া যায়৷
শাঁখের প্রকারভেদ
সাধারণত শাঁখা হয় বামাবর্তী, কিন্তু হাতে গোণা যে সব শঙ্খ দক্ষিণদিকে মুখ করা তাদের দক্ষিণাবর্তী শঙ্খ বলাহয়৷ সনাতন ব্রাহ্মণ্যধর্মে কিন্তু দক্ষিণাবর্তী শঙ্খের চাহিদা আর তার গুরুত্ব বেশ বেশি, এ ধরণের শঙ্খ খুব বেশি পাওয়া যায়না বলেই হয়ত৷ দক্ষিণাবর্তী শঙ্খ দেবী লক্ষ্মীর প্রতীক৷ আমরা যেন মনেরাখি ব্রাহ্মণ্য সাহিত্যে দক্ষিণ দিকটি সম্পদের দেবতা কুবেবের দিক, সে জন্যও হয়ত দক্ষিণবর্ত শঙ্খের দাম৷ সুপুরি থেকে বড় নারকেলের পরিমানমত হয়ে থাকে দক্ষিণাবর্তী শঙ্খ৷ আজকের বাজারে একটি সাধারণ দক্ষিণাবর্তী শঙ্খের দাম দেড় হাজার টাকা থেকে দুহাজার টাকা প্রতি গ্রাম, আবার দক্ষিণাবর্তী শঙ্খের দুধেলা প্রকারের দাম হয় গ্রাম প্রতি দু হাজার টাকাও৷ কখোনো আবার লক্ষণ, রং আর নানান উপাদানের উপর নির্ভর করে দাম ওঠে গ্রাম প্রতি দশহাজার টাকা পর্যন্তও৷ মাঝারি পরিমানের একটি দক্ষিণাবর্তী শঙ্খের দাম ওঠে প্রায় দশ থেকে পনের লাখ টাকা৷
ভারতে যেসব শঙ্খ ব্যবহার করা হয়, তার মধ্যে শঙ্খের ব্যবহার হয় দুভাবে ৷ আস্ত শঙ্খ আর কাটা শঙ্খ, যেখানথেকে তৈরি হয় শাঁখা, নানান শঙ্খজাত দ্রব্য৷ আস্ত শঙ্খ আবার ব্যবহার করা হয় দুভাবে৷ তার একটি বাদ্যশঙ্খ অন্যটি জলশঙ্খ৷ আর কাটা শঙ্খ দিয়ে হয় শাঁখা, আংটি, চুনসহ নানা উপকরণ৷
বাদ্যশঙ্খ : শ্রীলঙ্কা থেকে আসা শঙ্খ পরিষ্কার করে পেছনের অংশ কেটে বাদ্যশঙ্খ তৈরি করা হয়৷ এ শঙ্খ বিশেষ কায়দায় ধরে কাটা অংশ মুখে লাগিয়ে ফুঁ দিয়ে শব্দের সৃষ্টি করা হয়৷ এ শব্দকে বলা হয় মঙ্গলধ্বনি৷ পূজার আগে বা বিশেষ ক্ষণে বাদ্যশঙ্খ বাজিয়ে মঙ্গলধ্বনি দেওয়া হয়৷ প্রতিটি মন্দির অথবা হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের ঘরে বাদ্যশঙ্খ একটি প্রয়োজনীয় উপকরণ৷
জলশঙ্খ : জলশঙ্খ অনেকটা বাদ্যশঙ্খের মতোই৷ তবে এতে জলশঙ্খের মতো পেছনের অংশ কাটা হয় না৷ আস্ত শঙ্খটিকে চিত করে রেখে তার মধ্যে জল রাখা হয়৷ জল রাখা হয় বলেই এর নাম জলশঙ্খ৷ জলশঙ্খের জল পূজার কাজে ব্যবহৃত হয়৷ হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা জলশঙ্খে রাখা জল গঙ্গার জলের মতোই পবিত্র মনে করেন৷ জলশঙ্খ মন্দিরে বা ঘরে একটি ত্রিপদের ওপর রাখা হয়৷
বাদ্যশঙ্খ ও জলশঙ্খ উভয়ের গায়ে নকশা করা থাকে৷ নকশা ছাড়া শঙ্খও ব্যবহার কম নয়৷
সাধারণত প্রতিটি শঙ্খে গায়ে দেখা যায় ফুল, লতাপাতার নকশা৷ বিশেষ কিছু শঙ্খের ওপর মা কালী, রাধা-কৃষ্ণ, দুর্গা প্রতিমার নকশাও দেখা যায়৷ দিনের পর দিন কাটাকাটি করে একটি শঙ্খের ওপর নকশা ফুটিয়ে তোলা হয়৷ নকশা করা প্রতিটি শঙ্খ বাংলার লোকশিল্পের অন্যতম উপাদান৷ শখের হাঁড়ি, কাঠের পুতুল, মনসার মঞ্জুষ, পাথরের তৈজস, শোলার কদম, লক্ষ্মী সরার মতোই নকশা করা শঙ্খ লোকশিল্পের উপাদান৷ ঐতিহাসিক কেদারনাথ মজুমদারের 'ঢাকার বিবরণ' (১৯১০) গ্রন্থে উল্লেখ হয়েছে সে সময় ঢাকার কারখানার জন্য শ্রীলঙ্কা ও আফ্রিকা থেকে তিন-চার লাখ টাকার শঙ্খ আমদানি করা হতো৷ শঙ্খগুলোর ছিল তিতকৌড়ি শঙ্খ (লঙ্কা দ্বীপ), পটী শঙ্খ (সেতুবন্ধ রামেশ্বর), ধলা শঙ্খ (সেতুবন্ধ রামেশ্বর), জাহাজী শঙ্খ (সেতুবন্ধ রামেশ্বর), গুড়বাকী (মাদ্রাজ), সরতী, দুয়ানী পটী (মাদ্রাজ), আলাবিলা শঙ্খ, জলী শঙ্খ (মাদ্রাজ)৷ শাঁখারিদের অর্থনৈতিক অবকাঠামো দাঁড়িয়ে আছে শঙ্খশিল্পের ওপর৷ শাঁখারিরা শঙ্খের অলঙ্কার তৈরির জন্য বেশ কয়েক প্রকারের শঙ্খ ব্যবহার করে৷ এগুলোর নাম আজকাল আর উল্লেখ পাওয়া য়ায না – আগেকার পুস্তক থেকে য়া পাওয়া গেল দিলাম - তিতপুটি, রামেশ্বরী, জামাইপাটি, পাঁজি, দোয়ানি, মতি ছালামত, পাটী, গায়বেশী, কাব্বাম্বী, ধনা, জাডকি, কলকো, নারাখাদ, খগা, তিতকৌড়ি, গড়বাকী, জাহানী, সুর্কীচোনা, সরতী, আলাবিলা প্রভৃতি৷ এসব শঙ্খের প্রাপ্তিস্থল শ্রীলঙ্কা, মাদ্রাজের উপকূল৷
Lokfolk লোকফোক forum of folk লোক tribal আদিবাসী culture সংস্কৃতি of West Bengal পশ্চিমবঙ্গ, বাংলা. LOKFOLK is Bengal বাংলা India's ভারতের traditional পারম্পরিক knowledge system জ্ঞানভাণ্ডার, history ইতিহাস, Indigenous technology প্রযুক্তি. We have two mass bodies গনসংগঠন Bongiyo Paromporik Kaaru O ও Bastro Shilpi Sangho; Bongiyo Paromporik Aavikaar Shilpi Sangho. Journal পত্রিকা, PARAM, পরম. Picture - KaaliKaach কালিকাচ, Dinajpur দিনাজপুর, Madhumangal মধুমঙ্গল Malakar মালাকার
Saturday, September 11, 2010
শাঁখ শাখার বারোমাস্যা - মধ্যমণ্ডল
লেবেলসমূহ:
Bengal,
Conch Shell Carving,
ConchBangles,
ConchShell,
FolkCommunity,
FolkCraft,
শাঁখ,
শাখা,
শাঁখারি
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
No comments:
Post a Comment