Tuesday, December 4, 2018

উপনিবেশ বিরোধী চর্চা - প্রায় ২৫০০ বছরের কৃষিঋণের ধারাবাহিকতা - নষ্ট হল ঔপনিবেশিক লুঠেরা সময়ে

নানান সংগঠনের সম্মিলিত চেষ্টায়, কৃষি ঋণ মকুবের দাবিতে কৃষক পদযাত্রা সূত্রে আমাদের এবং বন্ধুদের ব্যবহার করা কয়েকটা ঐতিহাসিক দেওয়া দরকার।প্রথম স্তবকটিই একমান আমাদের বক্তব্য। মহাস্থানগড় লিপিটি রামকৃষ্ণবাবুর লেখা।
অসাধারণ বর্ননা করেছেন মহাস্থানগড় লিপিটির রামকৃষ্ণ বড়াল মশাই। লেখাটা সোমেনদা সূত্রে পাওয়া। বড়াল মশাইএর লেখা সূত্র ধরে আমরা বলতে পারি রাজা অশোকের পরে ধারাবাহিকভাবে শশাঙ্ক, পাল, সুলতানি, মুঘল এবং নবাবি আমল পর্যন্ত অভাবি এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগে কৃষকদের দান এবং ঋণের সুব্যবস্থা ছিল এই উপমহাদেশজুড়ে। সুলতানি আমল থেকে সিরাজ পর্যন্ত এর নাম ছিল তাকাভি - এটা রাজকোষ থেকে দেওয়া হত এবং প্রজারা এই ঋণ শুধত কয়েক বছর ধরে। এই ধারাবাহিকতা চ্ছিন্ন হল পলাশীর পর এবং ছিয়াত্তরের গণহত্যায় এই শৃঙ্খলটি রাজকীয়ভাবে অমান্য করবে লুঠেরা ঔপনিবেশিক শাসক, যারা রায়তদের দুরবস্থায় ঋণ দেওয়া তো দূরস্থান, বরং ছিয়াত্তরের গণহত্যার বছরগুলোয় সব থেকে বেশি রাজস্ব আদায় করবে অম্লানবদনে চোখের পলক না ফেলে।
হিন্দি-হিন্দুপাদশাহী মোদির রাজত্বকালে সেই ২৫০ বছরের ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ঔপনিবেশিক লুঠেরা ধারাবাহিকতা ছিন্ন হয় নি।
এটি রামকৃষ্ণবাবুর বক্তব্য
মহাস্থান লিপি :-
***************
বাঙলার মাটিতে প্রাপ্ত প্রাচীনতম লিপিটি হল 'মহাস্থানগড় লিপি' বা ‘মহাস্থানলিপি’। এটি ব্রাহ্মী হরফে লিখিত হবার কারনে ‘মহাস্থানব্রাহ্মী লিপি’ নামেও পরিচিত। ১৯৩১ সালের ৩০ নভেম্বর মাসে বগুড়া জেলার মহাস্থানগড়ের বারুফকির নামে এক কৃষক জমি চাষ করার সময় এই লিপিটি পান। এটি একটি লিপির ভগ্নাংশ মাত্র, সম্পূর্ণ লিপিটি উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। লিপিটির পাঠোদ্ধার করেন দেবদত্ত রামকৃষ্ণ ভান্ডারকার। ইপিগ্রাফিয়া ইন্ডিকা গ্রন্থের একুশতম খণ্ডে লিপিটি তাঁরই সম্পাদনায় প্রথম প্রকাশিত হয়। পণ্ডিতেরা মনে করেন শিলালিপিটি খ্রীস্টপূর্ব তৃতীয় শতকে উৎকীর্ণ। মিশ্র-প্রাকৃত ভাষার নিদর্শন সুস্পষ্ঠ। সে সময় সম্রাট মহাস্থানগড় এবং পুণ্ডুনগর মৌর্য সম্রাট আশোকের সাম্রাজ্যভুক্ত ছিল। লিপির পাঠ নিম্নরূপ........
নেন সবগীয় (আ) নং [গলদনস] দুমদিন
[মহা] সাতে সুলখিতে পুডনগলতে এ [ত] ঙ [নি] বহি-পয়িসতি। সংবগীয়ানাং [চ দি] নে [তথা]
[ধা] নিয়ং নিবহিসতি। দ [ঙ] গ (আ) তিয়া [ই] য় [এ] ক [এ] দ [বা] [তিয়ায়ি] কসি।
সুঅতিয়ায়িক [সি] পি গংডি [কেহি] [ধানিয়িকেহি]
এস কোঠাগালে কোসং [ভর] নীয়ে।
লিপির বঙ্গানুবাদে বলা হয়েছে......
এতদ্বারা সকল নাগরিকের কর গ্রহণকারী দুমদিন মহামাত্য সুরক্ষিত পুণ্ড্রনগর থেকে এটি করবেন। সকল দরিদ্র, ষড়বর্গীয় প্রজাকে ধান দেওয়া হল। তা দিয়ে অভাব দূর হবে। সুদিন এলে এই কোষাগারের কোষ যেন কাকনিক, গণ্ডক মুদ্রা ও ধান দিয়ে পূরণ করা হয়।
উপরের পাঠ থেকে এটা নিশ্চিৎ তৎকালীন শাসকের আমলে পুণ্ড্রনগরে একটি জনহিতকর শাসন ব্যবস্থা কায়েম ছিল যেখানে জরুরি অবস্থা বা দুঃসময়ে প্রজাদের হিতার্থে রাজকোষ থেকে অর্থ ও খাদ্যশস্য বিশেষত ধান বন্টিত হত। লিপিতে গণ্ডক ও কাকনিক নামে দুটি মুদ্রার উল্লেখ রয়েছে কাকনিক মুদ্রার কথা কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রে রয়েছে। এই দুটি মুদ্রার ব্যপারে তেমন বিস্তৃত বিবরণ কোথাও পাওয়া যায়না। খুব সম্ভবত গণ্ডক থেকে গণ্ডা শব্দটি এসেছে। সংখ্যাগত দিক থেকে ১ গন্ডা বলতে ৪ সংখ্যাকে বোঝায়। আনুমানিক ভাবে ককনিক ও গন্ডক মুদ্রার মূল্যমান যথাক্রমে ৪ কড়ি ও ২০ কড়ির সমান। ঐতিহাসিক নীহাররঞ্জন রায়ের মতে ‘গণ্ডক’ ছিল শীল মোহরিত নিম্নতম মুদ্রা এবং কাকনিক ছিল ঢালাই করা তঙ্কশালার মুদ্রা। এই মুদ্রার বৈশিষ্ট্য প্রাচীনতম ঢালাই মুদ্রার পরিচয়ও বহন করে। মৌর্যদের রাজকীয় মুদ্রা ছিল কার্যাপণ। পাশাপাশি কাকনিক এবং গণ্ডক মুদ্রার চল ছিল। লিপিতে ছবর্গ্গীয় বা ষড়বর্গীয় থেরবাদী ভিক্ষুক প্রজাদের উল্লেখ রয়েছে। মেগাস্থিনিসের ইন্ডিকায় ভারতে সাত রকম জনগোষ্ঠীর উল্লেখ রয়েছে। মৌর্য সম্রাট চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য্যের আমলে সেলুকাস নিকটরের দূত মেগাস্থিনিস ভারত ভ্রমনে আসেন। চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য্য, বিন্দুসার এবং অশোক যথাক্রমে জৈন, অজীবিক ও বৌদ্ধ ধর্মের পৃষ্ঠপোষকতা করেন। আশোকের আমলে হয়ত নিম্নবর্গের চাষী বা কৃষক সম্প্রদায়ের সাথে সাথে ষড়বর্গীয়দেরও দুর্দিনে ঋন দেওয়া হত। হয়ত এই কারনেই তাদের সুদিনে টাকা অথবা উৎপাদিত শষ্যের বিনিময়ে সরকারি কোষাগার থেকে দুর্দিনে গৃহীত ঋন শোধ করার বিধান দেওয়া আছে।
কৌটিল্য তাঁর অর্থশাস্ত্রে রাজকোষ থেকে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে যে ঋণ দেওয়ার কথা বলেছেন তার বাস্তব নিদর্শন হল মহাস্থানগড়ে প্রাপ্ত লিপি।
শিলালিপিটিতে উল্লিখিত ‘দুমদিন মহা-অমাত্য সুরক্ষিতে’র উপস্থিতি প্রমাণ করে সে সময়ে এই জায়গা কতটা উন্নত ছিল এবং এখানে কাদের বসবাস ছিল। এই পরিবেশে অভাবী দরিদ্র মানুয়েরা ভিক্ষা নয়, রাজকোষ থেকে ঋণ গ্রহণ করেছেন। হয়ত সুদিন এলে সুদসহ ফেরত দেবার জন্য অঙ্গীকারবদ্ধ হয়েছিলেন। তাঁদের মানষিকতা ও মর্যাদাবোধের প্রশংসা করতেই হয়। এরা নিশ্চয়ই ঋণখেলাপী ছিলেন না, যেটা গ্লানিদায়ক ও অমর্যাদাকর। কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রে ঋনখেলাপীদের দণ্ডদানের বিধান দেওয়া রয়েছে। মৌর্য্যদের রাষ্ট্র ব্যবস্থায় ভিক্ষাবৃত্তিকে নিরুৎসাহিত করা হয়েছে বলেই মনে হয়।
তথ্যসূত্র :-
*********
১. উইকিপিডিয়া ও গুগল।
২. বাঙালীর ইতিহাস আদিপর্ব।
৩. বাংলাদেশের প্রত্নসম্পদ।
৪. ইনস্ক্রিপশন অফ বেঙ্গল।
৫. এ কনসাইজ ইকোনমিক হিস্ট্রি অফ দ্যা ওয়ার্ল্ড।
৬. কৌটিল্য অর্থশাস্ত্র।
Ramkrishna Baralদাদার লেখা Soumen Nathদাদা সূত্রে পাওয়া

No comments: